//
//

ঐতিহাসিক উপন্যাস কাকে বলে? একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস ব্যাখ্যা কর

ঐতিহাসিক উপন্যাস

সাধারণভাবে বলতে গেলে, ইতিহাসের কাহিনি ও চরিত্রকে আশ্রয় করে তার অতীতচারী কল্পনায় ঔপন্যাসিক রচনা করেন ঐতিহাসিক উপন্যাস। ইতিহাসের অন্তর্লোকে উকি দিয়ে একটি বিশেষ যুগ ও তার কিছু নির্বাচিত ঘটনা তথা বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, আশা-নিরাশার ছায়াছন্ন দর্পণে ঔপন্যাসিক দেখে নেন নিজের ভাবভাবনা ও সমসময়ের মুখটিকে।

ইতিহাস তথ্যনিষ্ঠ। তথ্য-বিশেষ বা তথ্য-সতাকে প্রকাশ করাই ইতিহাসের লক্ষ্য। অপতে কাব্য তথা সাহিত্য তথ্যকে নিষিক্ত করে কল্পনায়। ইতিহাস ‘বিশেষ’ (Particular)-কে গ্রহণ ও ব্যক্ত করে; সাহিত্য বিশেষ’কে দেয় ‘নিবিশেষ’ বা ‘সামান্য’ (Universal) সত্যের মর্যাদা। অ্যারিস্টটল এই কারণে ‘কাব্য’ বা ‘সাহিত্য’কে ইতিহাসের চেয়ে উচ্চতর অবস্থানের স্বীকৃতি দিয়েছেন। এই পার্থক্য থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে উপন্যাসে ইতিহাসের নিছক যান্ত্রিক ও তথ্যনির্ভর কাহিনি ও চরিত্রের বিবরণ বাঞ্ছনীয় নয়। ঐতিহাসিক উপন্যাসে তাই ইতিহাসের তথ্যসত্যকে জারিত হতে হবে সৃজনী কল্পনার প্রাণরসে। ইতিহাস ও সৃজনশীল সাহিত্যের এই চমকপ্রদ পরিণয় প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যটি বিশেষ অর্থবহ—‘‘ইতিহাস পড়িব, না আইভানহো পড়িব? ইহার উত্তর অতি সহজ। দুই-ই পড়ো। সত্যের জন্য ইতিহাস পড়ো, আনন্দের জন্য আইভানহো পড়ো।…কাব্যে যদি ভুল শিখি, ইতিহাসে তাহা সংশোধন করিয়া লইব।” ঐতিহাসিক উপন্যাসের ইতিহাস হওয়াটা প্রাথমিক নয়, তার উপন্যাস হয়ে ওঠাটাই বেশি জরুরি। তবে ইতিহাসের তথ্য-সত্যকে অগ্রাহ্য বা বিকৃত করলেও তার চলে না।

ঐতিহাসিক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য

ঐতিহাসিক উপন্যাসের লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনার সুবিধার্থে তালিকাবদ্ধ করা যাক—

  • সমসাময়িক জীবনের বিষয়বস্তু ও বাস্তব চরিত্রসমুহের পরিবর্তে ঐতিহাসিক উপন্যাসে উপন্যাসকার বেছে নেন অতীত ইতিহাসের কোনো বিশেষ একটি সময়পর্ব যার প্রতি প্রকাশ পায় লেখকের বিস্ময়, শ্রদ্ধা ও প্রেমমুগ্ধতা।
  • উপন্যাসে বর্ণিতব্য যুগ তথা ঘটনা-কাহিনির প্রতি ঔপন্যাসিককে বিশ্বস্ত থাকতে হয়। সেই সময়কালের রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহার-সংস্কার, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি সকল বিষয়ে উপন্যাস লেখককে সচেতন থাকতে হয়; অন্যথায় তার উপন্যাসটি প্রকৃত ঐতিহাসিক বাস্তবতা অর্জনে ব্যর্থ হবে ‘কালানৌচিত্য’ (Anachronism) দোষের কারণে।
  • ঐতিহাসিক উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা তথা প্রধান কুশীলব সকলেই ইতিহাসের সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। তারা কেউ আপন কীর্তির বলে কীর্তিমান; আবার কেউ অপকীর্তির দরুন অপযশপ্রাপ্ত, নিন্দিত। এইসব চরিত্রের রূপায়ণে ঔপন্যাসিককে ইতিহাসের প্রতি যথাসম্ভব বিশ্বস্ত থাকতে হয়।
  • অবশ্য কালবিরোধগত দোষের আশঙ্কা সত্ত্বেও শিল্পগত প্রয়োজন বা মুল্যের তাগিদে ঔপন্যাসিক কিছু কিছু উদ্ভাবন ও পরিবর্তন করতে পারেন। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় বঙ্কিমচন্দ্রের অভিমত—“উপন্যাসে লেখক সর্বত্র সত্যের শৃঙ্খলে আবদ্ধ নহেন। ইচ্ছামত অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য কল্পনার আশ্রয় লইতে পারেন।” ইতিহাসের কাহিনির পাশাপাশি তাই স্থান পায় কাল্পনিক কাহিনি।
  • ইতিহাসাশ্ৰিত চরিত্রগুলির ঐতিহাসিকতা যথাসম্ভব অক্ষুন্ন রেখেও তাদের যথেষ্ট প্রাণবন্ত করে তোলা ও উপন্যাসে জীবনভাবনা ব্যক্ত করার ক্ষমতাই ঐতিহাসিক উপন্যাসকারের কাছ থেকে প্রত্যাশিত।
  • ঐতিহাসিক উপন্যাসের কারবার ইতিহাসের বিশাল পটভূমিতে আবর্তিত জীবনের উত্থান-পতন নিয়ে। ইতিহাসের সামাজিক-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, আবেগ-আলোড়ন এই জাতীয় উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীদের দেয় বিস্তৃতি, কখনও-বা অতি-মানবিক উচ্চতা।
  • ঐতিহাসিক উপন্যাসে থাকে মহাকাব্যিক বিস্তার; চরিত্রগুলি তাদের নিছক ব্যক্তি পরিচয়ের পোশাক খুলে ফেলে মহাকালের অঙ্গীভূত হয়ে যায়; একটি বিশেষ স্থান ও কালের সীমা অতিক্রম করে উপন্যাস পায় বিশ্বজনীন ব্যঞ্জনা।
  • মহাকাব্যের সঙ্গে ঐতিহাসিক উপন্যাসের এই হৃদ্যতার কারণেই তার ভাষাকে হতে হয় গম্ভীর ও ধ্রুপদি যাতে করে বিশেষ দেশকালের পরিপ্রেক্ষিত ছাড়িয়ে কল্পনার আবিশ্ব স্পন্দিত বিস্তার মন্দ্রিত হয়ে ওঠে।

লুকাচ (Lukacs) তার The Historical Novel-এ ঐতিহাসিক উপন্যাসের আবির্ভাবের। সামাজিক-রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক কারণগুলি ব্যাখ্যা করেছেন এবং উনিশ শতকের প্রারম্ভিক সময়পর্ব অর্থাৎ নেপোলিয়নের পতনের পরবর্তী বছরগুলিকে ঐতিহাসিক উপন্যাসের জন্মলগ্ন বলে উল্লেখ করেছেন। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ইতিহাসাশ্রয়ী কাহিনি রচিত হলেও ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রথম সার্থক রচয়িতা ওয়ালটার স্কট। সমকালীন ও পূর্ববর্তী প্রজন্মের লেখকদের রচনায় যখন পাওয়া যাচ্ছিল বুর্জোয়া মধ্যশ্রেণির সামাজিক জীবনযাপনের খুঁটিনাটি, তখন স্কট ডুব দিয়েছিলেন অতীত ইতিহাসের। বিচিত্র, দুঃসাহসিক গভীরতায়। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড তথা মহাদেশীয় অতীত ইতিহাসের রোমাঞ্চকর অভিযান, মধ্যযুগীয় দুর্গ-প্রাসাদ-গির্জা-সমাধিক্ষেত্র তথা গিরি-প্রান্তর-পরিখার ছবি ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁর উপন্যাসে। তথ্যের প্রামাণিকতা নিয়ে কোথাও কোথাও প্রশ্ন থাকলেও তাঁর অতীতচারী রোমান্টিক কল্পনা ও স্মৃতিমেদুরতায় যেভাবে স্কট ইতিহাস, লোকগাথা ও কিংবদন্তিকে মিশিয়েছেন, মিশেয়েছেন বাস্তবতা ও রোমান্স, যেভাবে অতীত ইতিহাসের বিস্তৃত পরিসরে। বীর্যবত্তার স্পন্দিত উল্লাস অনুভূত হয়েছে তাঁর উপন্যাসে, তা পাঠকের কাছে এক রমণীয় অভিজ্ঞতা। স্কটের ঐতিহাসিক উপন্যাসসমূহের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য—Waverley, Ivanhoe, Rob Roy, The Heart of Midlothian, Kenilworth প্রভৃতি।

বাংলা সাহিত্যে ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রথম যথার্থ শিল্পী বঙ্কিমচন্দ্র, তাঁর প্রথম উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনীর পটভূমিটি ছিল ঐতিহাসিক। এরপর মৃণালিনী, আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরাণী ও সীতারাম উপন্যাসে ইতিহাসের উপাদান তথা ঐতিহাসিক চেতনার কিছু কিছু মৌল তাগিদের খোঁজ মেলে। তবে এরই মধ্যে বঙ্কিম আমাদের উপহার দিয়েছেন যথার্থ ঐতিহাসিক উপন্যাস রাজসিংহ। যাতে ইতিহাস উপন্যাসের স্বাভাবিক ধর্মকে বিঘ্ন করেনি। বঙ্কিম-প্রদর্শিত পথে পদক্ষেপ করেছিলেন রমেশচন্দ্র দত্ত, যার বঙ্গবিজেতা, মাধবীকঙ্কন, মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত ও রাজপুত জীবনসন্ধ্যা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মানবিকতার উন্মোচন, কল্পনায় রঞ্জিত ইতিহাস আলো-ছায়ার মায়ায় জড়ানো। বাংলা ভাষায় উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলি হলো—প্রতাপচন্দ্র ঘোষের বঙ্গাধিপ পরিচয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কাঞ্চনমালা, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের শশাঙ্ক ও ধর্মপাল, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের তুমি সন্ধ্যার মেঘ,  নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের পদসঞ্চার ও অমাবস্যার গান।

একটি সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস

ঐতিহাসিক উপন্যাসের এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষ করার আগে এই শ্রেণির নিদর্শন হিসেবে রাজসিংহ উপন্যাসটিকে একটু খতিয়ে দেখা যাক। এই উপন্যাসের চতুর্থ সংস্করণের ‘বিজ্ঞাপন’-এ লেখক স্বয়ং জানিয়েছিলেন—এই প্রথম ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখিলাম। দুর্গেশনন্দিনী, চন্দ্রশেখর, সীতারাম প্রভৃতি উপন্যাসে ইতিহাস প্রধান বিষয় নয়, ব্যক্তিগত জীবনের দ্বন্দ্ব ও সমস্যাই সেখানে বড়ো হয়ে উঠেছে। রাজসিংহ উপন্যাসে কিন্তু ঐতিহাসিক অংশই প্রধান, ব্যক্তিগত জীবনসমস্যা ইতিহাসের অনুবর্তী ও প্রভাবাধীন। শক্তিশালী ও তীক্ষ্ণধী মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে সাহসী ও বীর রাজা মহারাণা রাজসিংহের সংগ্রামের ঐতিহাসিক কাহিনিকে তথ্য হিসেবে গ্রহণ করে বঙ্কিমচন্দ্র তাকে ঔপন্যাসিকের কল্পনায় মহিমান্বিত করেছেন। ইতিহাস এই উপন্যাসে যেভাবে পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনকে নিবিড় স্পর্শে স্পন্দিত ও রোমাঞ্চিত করে তুলেছে তেমনটা বঙ্কিমের পূর্ববর্তী ইতিহাসাশ্রয়ী রচনাগুলিতে পাওয়া যায় না।

১৮৮২-তে প্রকাশিত প্রথম সংস্করণে মাত্র তিরাশি পৃষ্ঠার রাজসিংহ ছিল একটি গল্প বা ক্ষুদ্র কথা। ১৮৯৩-এর চতুর্থ সংস্করণে কয়েকগুণ বর্ধিত কলেবরে রাজসিংহ ‘পুনঃপ্রণীত’ হয় এবং এই সংস্করণের ‘বিজ্ঞাপনে’ উপন্যাসটির ঐতিহাসিকতা বিষয়ে লেখক তার মূল্যবান মতামত দেন। হিন্দু ও মোগলদের বিবাদ যা এই উপন্যাসের ঐতিহাসিক অংশ তার পরস্পরবিরোধী ও পক্ষপাতদুষ্ট বিবরণসমূহ থেকে ঐতিহাসিক সত্য-মীমাংসা যে অসম্ভব সেকথা স্বীকার করে নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র ইতিহাসকে উপন্যাসশিল্পের মুক্ত বাতাবরণে নিয়ে এসেছেন। “ইতিহাসের উদ্দেশ্য কখন কখন উপন্যাসে সুসিদ্ধ হইতে পারে। উপন্যাস লেখক সর্বত্র সত্যের শৃঙ্খলে বদ্ধ নহেন। ইচ্ছামত অভীষ্টসিদ্ধির জন্য কল্পনার আশ্রয় লইতে পারেন।”—বঙ্কিমের এই মন্তব্যেই ঐতিহাসিক উপন্যাস তথা তার রচনার মূল সূত্রটি আভাসিত হয়।

একটি যুগের সমগ্র ইতিহাস পরিবেশন ও পর্যালোচনা করা বঙ্কিমের উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি তাই মোগল সম্রাটদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা কঠোর কঠিন, অথচ শক্তিমান, তীক্ষ্ণধী ও কূটনীতিজ্ঞ ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে রাজপুত কুলতিলক রাজসিংহের বিরোধ ও যুদ্ধকে বেছে নিয়েছেন উপন্যাসের প্রধান ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে। উপন্যাসের প্রধান ঘটনা ও পটভূমি যেমন ঐতিহাসিক, তেমনি তার মুখ্য চরিত্রগুলিও ইতিহাসের বাস্তবতা ও মহা প্রতিষ্ঠিত। এ-বিষয়ে বঙ্কিম নিজেই বলেছেন—

“স্থূল ঘটনা, অর্থাৎ যুদ্ধাদির ফল ইতিহাসে যেমন আছে, প্রায় তেমনই রাখিয়াছি। কোন যুদ্ধ বা তাহার ফল কল্পনাপ্রসূত নহে। তবে প্রকরণ, যাহা ইতিহাসে নাই, তাহা গড়িয়া দিতে হইয়াছে। ঔরঙ্গজেব, রাজসিংহ, জেব-উন্নিসা, উদিপুরী, ইহারা ঐতিহাসিক ব্যক্তি। ইহাদের চরিত্রও ইতিহাসে যেরূপ আছে, সেইরূপ রাখা গিয়েছে। তবে তাহাদের সম্বন্ধে যে সকল ঘটনা লিখিত হইয়াছে, সকলই ঐতিহাসিক নহে। উপন্যাসে সকল কথা ঐতিহাসিক হইবার প্রয়োজন নাই।”

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ আচার্য যদুনাথ সরকার রাজসিংহ উপন্যাসের ভূমিকায় ঐতিহাসিক তরণে কোথাও কোথাও ছোটোখাটো কয়েকটি ভুলের কথা উল্লেখ করলেও স্বীকার করেছেন—‘‘বঙ্কিম কল্পনার বেগে সত্যকে অতিক্রম করেন নাই, সত্যকে জীবন্ত আলোকে উদ্ভাসিত করিয়াছেন মাত্র।” ঐতিহাসিক উপাদানের যে ভুলগুলি আচার্য যদুনাথ দেখিয়েছেন সেগুলি তেমন মারাত্মক ভুল নয় যে উপন্যাসের মূল কাহিনি ও প্রধান ঐতিহাসিক সত্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

রাজসিংহ উপন্যাসের দুই কেন্দ্রীয় চরিত্র—রাজসিংহ ও নায়ক ঔরঙ্গজেব ইতিহাসের স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। এই দুই চরিত্রের ঐতিহাসিকতা বিসর্জন না দিয়েও বঙ্কিম কল্পনার স্পর্শে তাদেরকে সজীব করে তুলেছেন। অন্যদিকে চঞ্চলকুমারী, মানিকলাল, নির্মলকুমারী, যোধপুরী বেগম প্রমুখ চরিত্রগুলি অনৈতিহাসিক হলেও কাহিনির গতিপথে স্বাভাবিকভাবেই এসেছে ও ইতিহাস তথা জীবনের সমন্বয়ে গড়ে-ওঠা শিল্পকাঠামো নির্মাণে সাহায্য করেছে। রাজসিংহ ও ঔরঙ্গজেব যেমন নিছক ঐতিহাসিক ব্যক্তিবিশেষ নন; বরং তাঁরা বিশেষ স্থান ও কালের গণ্ডি আক্রম করে সর্বকালের অভিজ্ঞতার দৃষ্টান্তস্বরূপ; তেমনি জেবউন্নিসা-মবারকের প্রেম, রাজপূতনারী চঞ্চলকুমারীর রোমান্টিক মাধুর্য ও দৃপ্ততা, নির্মলকুমারীর প্রতি ঔরঙ্গজেবের গুণমুগ্ধতাসঞ্জাত ভালোবাসা ইত্যাদি এই উপন্যাসে ইতিহাসের কুশকাঠামোর ওপর মানবীয় আবেগ-আকাঙ্ক্ষা-বাসনার রং আর মাটি। ঐতিহাসিক বিষয় ও চরিত্রসমূহের খড়ের কাঠামোটিকে বঙ্কিম তাঁর উপন্যাসে রং-রূপ-প্রাণস্পন্দনের সৌন্দর্য ও সার্থকতায় মণ্ডিত করেছেন।

রবীন্দ্রনাথের নজরে পড়েছে কীভাবে ঘটনাবিন্যাসের অসম্ভব ও অবিরাম দ্রুতত উপন্যাসের ঘটনাবলী ভারত ইতিহাসের একটি যুগাবসান হইতে যুগান্তরের দিকে বা গিয়াছে। সমস্ত চরিত্রের আচার-আচরণ সম্ভাব্যতা ও যৌক্তিকতার সীমায় উপনীত। কালানৌচিত্য দোষে উপন্যাস দুষ্ট নয়। ‘ইতিহাস এবং উপন্যাসকে একসঙ্গে চালাইতে গিয়া উভয়কে রাশের দ্বারা বাঁধিয়া সংযত করিতে হইয়াছে।’

আট খণ্ডে বিভক্ত এই উপন্যাসের ইতিবৃত্ত মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব ও রাজপূতবীর রাজসিংহের সংঘাত। উদ্দেশ্য বঙ্কিমের নিজের বয়ানে—‘‘হিন্দুদিগের বাহুবলই আমার প্রতিপাদ্য। উদাহরণস্বরূপ আমি রাজসিংহ লইয়াছি’। রাজস্থানের রূপনগর প্রাসাদ থেকে যে কাহিনির সূত্রপাত, তার সমাপ্তি যুদ্ধে পরাস্ত ঔরঙ্গজেবের সন্ধিচুক্তি দিয়ে। একদিকে ঐতিহাসিক যুদ্ধের বৃত্তান্ত, অন্যদিকে কল্পনাশ্রয়ী প্রণয়কাহিনি। ইতিহাসচেতনা ও জীবনবোধের রসগ্রাহী সমন্বয়ে রাজসিংহ সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস।

তথ্যসূত্র:

কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্তDownload
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাসDownload
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরীDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাসDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যালDownload
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাসDownload
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
সাহিত্যের রূপরীতি ও অন্যান্য – কুন্তল চট্টোপাধ্যায়Download
সাহিত্য ও সমালোচনার রূপরীতি – উজ্জ্বলকুমার মজুমদারDownload
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তDownload
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দীDownload
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যালDownload
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেনDownload
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায়Download
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষDownload

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!