কথাসাহিত্যিক ফণীশ্বরনাথ রেণুর কৃতিত্ব আলোচনা কর।
কথাসাহিত্যিক ফণীশ্বরনাথ রেণু
ফণীশ্বর নাথ ‘রেণু’ হিন্দি তথা ভারতীয় উপন্যাসে একটি বিশিষ্ট নাম। প্রেমচন্দোত্তর যগে আঞ্চলিক উপন্যাস লিখে তিনি বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ঐতিহাসিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে বৃন্দাবন লাল বর্মা বা মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে যেমন জৈনেন্দ্র খ্যাতি অর্জন করেন, আঞ্চলিক উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে রেণু অগ্রণী সাহিত্যিক।
তাঁর অন্যান্য রচনার কথা বাদ দিলে শুধুমাত্র ‘ময়লা আঁচল’ (১৯৫৪) অথবা ‘পরতী: পরিকথা’ (১৯৫৭) উপন্যাস দুটি তাকে অমর করে রাখবে।
ঔপন্যাসিক ফণীশ্বরনাথ রেণু
ময়লা আঁচল
‘ময়লা আঁচল’ ফণীশ্বরনাথ রেণু-র প্রথম উপন্যাস। ১৯৫৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হওয়া মাত্র পাঠক সমাজ চমকে উঠেছিল। হিন্দি উপন্যাসে যে যুগান্তর ঘটে গেছে তা উপন্যাসটি পাঠ করেই বোঝা যায়। ‘ময়লা আঁচল’ দুইখণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে আছে ৪৪টি পরিচ্ছেদ। দ্বিতীয় খণ্ডে আছে ২৩টি পরিচ্ছেদ। প্রথম খণ্ডের তুলনায় দ্বিতীয় খণ্ডটি ঈষৎ স্বল্পায়তন। প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় ফণীশ্বর নাথ ‘রেণু’ লেখেন—“য়হ হৈ মৈলা আঁচল, এক আঞ্চলক উপন্যাস। কথানিক হৈ পূর্নিয়া। পূর্ণিয়া বিহার রাজ্য কা এক জিলা হৈহ; ইসকে এক ঔর হৈ নেপাল, দুসরি ঔর পাকিস্তান ঔর পশ্চিম বংগাল।”
বলা বাহুল্য পাকিস্তান বলে যার উল্লেখ করা হয়েছে তা বর্তমানে বাংলাদেশ। রেণু আরও লেখেন—“মৈনে ইসকে এক হিসসে কে এক হী গাঁও কো পিছড়ে গাও কা প্রতীক মানকর—ইস উপন্যাস কথাকা ক্ষেত্র বনায়া হৈ।”
অর্থাৎ আমি একে একটাই গ্রাম—পিছিয়ে পড়া গ্রামের প্রতীক মনে করে এই উপন্যাসের কাহিনীর ঘটনাস্থল করে তুলেছি। বেশ বোঝা যায় পূর্ণিয়ার গ্রামাঞ্চলে রেণুর হাতে পিছিয়ে পড়া ভারতীয় গ্রামের ছবিতে রূপান্তরিত। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার চমৎকার ছবি আছে এই উপন্যাসে। গ্রামীন অর্থনীতির কিছু কিছু পরিচয় দিয়েছিলেন লেখক। গ্রামে আছে মালিক। তাদের কাছে ধার করার জন্য চাষিদের আর মজুরদের ভিড় লেগে যায়। বইখাতা নিয়ে বসে থাকে মালিক। পাশে কাজললতা খোলা পড়ে থাকে। টিপসই দিয়ে কর্জি নিয়ে যায় চাষি মজুররা। নির্মমভাবে টাকা আদায় করা হয় যথাসময়ে।
‘ময়লা আঁচল’ একটি সার্থক আঞ্চলিক উপন্যাস। অথচ এই অঞ্চলের রূপে যে সমগ্র ভারতেই ছবি। ভারতের গ্রামের অতিসাধারণ এবং একইসঙ্গে অতি-অসাধারণ এক ছবি। গ্রামের মানুষের সুখ দুঃখ, সংস্কার বিশ্বাস, শশাষণ ও অসহায়তা, দলাদলি, আর্থ সামাজিক দুরবস্থা, রাজনৈতিক কোন্দলের মল্লভূমি হয়ে ওঠার পরিণতি এই উপন্যাসে নানাভাবে ফুটে উঠেছে। আবার এই গ্রামজীবনের ছবি আঁকতে বসে লেখক ফণীশ্বরনাথ রেণু লোকজীবন বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি উজাড় করে দিয়েছেন; এর বর্ণনার ভাষায় লেগেছে মাটির স্পর্শ। প্রবাদ প্রবচন ও লোকভাষা ব্যবহারে লেখকের অসাধারণ মুন্সিয়ানাই তার প্রমাণ।
‘ময়লা আঁচলে’র সার্থকতা তার কাহিনী বিচারে নয়। কী কাহিনী লিখেছেন সেটা বড় কথা নয়। কেমনভাবে লিখেছেন সেটাই বিবেচ্য। টুকরো টুকরো ছবি, অসংখ্য ছবি গ্রামের মানুষের সামগ্রিক মানুষের গভীর পরিচয়বাহী। লেখক মালা গেঁথেছেন। সে মালায় ফুলও আছে কাঁটাও আছে। লতাও আছে ধুলোবালিও আছে। সেসবকে একত্রিত করার মধ্যেই লেখকের শিল্পবাোধ ও সামর্থ্য পরিস্ফুট।
পরতী পরিকথা
রেণু-র দ্বিতীয় উপন্যাস ‘পরতী পরিকথা’ ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয়। এটিও একটি আঞ্চলিক উপন্যাস। এটিও দুখণ্ডে বিভক্ত। প্রথম ও দ্বিতীয় দুটি খণ্ডে (পরিবর্ত) অবশ্য কোন অধ্যায় নেই। তবে ছোট ছোট ঘটনা ও দৃশ্য বর্ণনা করেছেন লেখক।
পরাণপুরের বন্ধ্যা ভূমি অঞ্চলই এই উপন্যাসের পটভূমি। গ্রামজীবনের নানা বৈচিত্র্য ও বৈপরীত্য কাছ থেকে দেখানো হয়েছে। গ্রামের উন্নয়ন, সামাজিক পটভূমি যেমন আছে। তেমনি আছে তার সীমাবদ্ধতা ও সংকীর্ণতার দিকগুলিও। আধুনিকতার স্পর্শ লেগেছে এই গ্রামে, আবার সেই পরিবর্তন গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনকে কতটা প্রভাবিত করতে পেরেছে তা নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন লেখক। পরাণপুরের সংলগ্ন বন্ধ্যা নিলা জমি যেন প্রতীক ওঠে উঠেছে।
শুধু ইতিহাস নয়, পুরাণপুরের লোকজীবন ও লোকতত্ত্বেরও বর্ণনা করেছেন লেখক। এই কাহিনীকে লেখক বলেছেন পরিকথা। লেখকের ভাষায় কথা কা এক খণ্ড পরিকথা। এই পরিকথা রচনায় লেখক লোকমুখে ছড়িয়ে থাকা উপকথার ব্যবহার করেছেন। বুড়ো ভৈসওয়ার এই সব পরিকথা (পৃ-১১) বলেছে। তার মুখে শুধু গল্প নয়। গল্পের টীকাও শোনা যায়।
আঞ্চলিক উপন্যাস লিখে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন ‘রেণু’। ভিন্ন ধরনের উপন্যাস রচনাতেও তার দক্ষতা পরিস্ফুট। ‘মৈলা আঁচল’ (১৯৫৪) ও ‘পরতী: পরিকথা’ (১৯৫৭) -এর পর প্রকাশিত হয় কাহিনী সংগ্রহ ‘ঠুমারী’ (১৯৬০)। এছাড়াও ‘দীর্ঘতপা’ (১৯৬০) ও ‘জুলুস’ (১৯৬৬) উপন্যাস দুটিও তার বিশিষ্ট রচনা। ‘রেণু’-র মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় ‘পল্টুবাবু রোড’ (১৯৭৯)।
জুলুস
দেশভাগের পটভূমিকায় রচিত একটি স্বতন্ত্র উপন্যাস ‘জুলুস’। পূর্ব পাকিস্তান অধুনা বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের জীবন সংগ্রাম, অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, দেশত্যাগজনিত বেদনাই এই উপন্যাসের উপজীব্য। পনেরোটি অধ্যায়ে সম্পূর্ণ। পূর্ণিয়ার নবীনগর কলোনীর গ্রামে। সীমান্তের এই গ্রামে নানা শ্রেণীর মানুষ থাকে, এখানে গোপাল পাইনের মত লোক থাকে যারা বাংলার সব জিনিসকে ভালোবাসে, ভালো বলে আর স্থানীয় মানুষষকে মূর্খ জ্ঞান করে। হরনাথ সাহা, গোপাল পাইনের মত মানুষেরা এই অঞ্চলে নিজেদের বহিরাগত ভাবে আর নিজের দেশে চলে যাবার কথা ভাবে। এইটাই উপন্যাসের মূল বিষয়। অন্যদিকে পবিত্ৰারাণীর মত চরিত্রগুলো ‘আপন পার্টি’ গড়ে তোলে। সেখানে হরিপ্রসাদ যাদব, জয়রাম সিন্ধ তালেবর গৌড়ী সকলেই সামিল হয়। সাম্প্রদায়িকতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, পারস্পরিক অপরিচয় বিচ্ছিন্নতা প্রভৃতি সমস্যাই এই গ্রামের এই অঞ্চলের মানুষকে গ্রাস করছিল। এই সমস্যাকেই রেণু শিল্পরূপ দিয়েছেন।
‘জুলুস’ (১৯৬৬) উপন্যাসটি পড়লে রেণুর সমাজ চেতনার স্বরূপ বোঝা যায়। ভারতীয় সমাজ গঠনে জাতি-ধর্ম ভাষা নির্বিশেষে যে একতার স্পর্শ লেগেছে তার মর্ম উদঘাটন করেছেন লেখক। উপন্যাসটির ভূমিকায় লেখক লিখেছেন—“কিন্তু বেশ কিছু বছর ধরে একটা অদ্ভুত ভ্রমের মধ্যে রয়েছি। দিনরাত শুতে বসতে খেতে কেবলই আমার মনে হয় একটা বিশাল মিছিলের সঙ্গে চলেছি। এই মিছিল কোথায় যাচ্ছে, এরা সব কারা, কোথায় চলেছে, কী চায়—এসব কিছুই জানি না। এই মহা কোলাহল থেকে নিজেকে মুক্ত করার কথাটা আমি নিজেই ভুলে গেছি।…এই ভিড় থেকে আলাদা হয়ে রাজপথের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে এই মিছিল দেখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এই ভিড় থেকে নিজেকে আলাদা করার সামর্থ্য আমার নেই।…আমার এই ‘জুলুস’ উপন্যাসে আমার এই অদ্ভুত মানসিক বিকারের প্রভাব অবশ্যই পড়েছে।” এ বেশ বোঝা যায়, দেশব্যাপী এক কালচেতনার তীব্র প্রভাব থেকে লেখক মুক্ত নন। সমাজ চেতনার উজ্জ্বল প্রাচুর্যে ভরে আছে শুধু ‘জুলুস’ নয়, রেণুজীর সব উপন্যাসই।
কিশোর পাঠ্য উপন্যাস ‘কিতনে চৌরাহে‘। এটি দেশাত্মবোধমূলক উপন্যাস। বিষয় যেমন মর্মস্পর্শী তেমনি চমকপ্রদ। অন্তরঙ্গ গীতিকাব্য সুলভ মেজাজই এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।
‘পল্টুবাবু রোড‘ উপন্যাসটির নায়ক চরিত্র পন্টুবাবুই। তার মাধ্যমেই তৎকালীন সমাজের ক্ষয়িষ্ণু রূপটি অঙ্কিত। পটভূমি বৈরীগাছি গঞ্জ। কুটিল, ধূর্ত, স্বার্থপর, কামুক পন্টুবাবুর অঙ্গুলি হেলনে, ঠিকাদার, ব্যবসায়ীরা কীভাবে আমজনতার ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত করেন তার সত্য চিত্র এখানে উন্মোচিত।
এই ছ’খানি উপন্যাসের বাইরে আর দু’খানি উপন্যাস রেণু লিখেছিলেন। তার মধ্যে ‘রামরতন রায়’ অসম্পূর্ণ রচনা। রামরতন নামক এক চোরের কৌতূহলোদ্দীপক জীবন কথা নিয়ে শুরু হয়েছিল এই উপন্যাস। ভারত-নেপাল সীমান্তের কাহিনি এ উপন্যাসে লিপিবদ্ধ।
‘গোত্রান্তর’ প্রকৃত অর্থে উপন্যাস নয়। চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য। ঔপন্যাসিক রেণুর উপন্যাসাবলির মর্মকথা হল অন্ত্যজ মানুষের প্রতি সহানুভূতি। গ্রাম জীবনের প্রতি মমত্ববোধ।
গল্পকার ফণীশ্বরনাথ রেণু
‘ঠুমরী’ গল্প সংগ্রহ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। পরে প্রকাশিত হয় ‘মেরী প্রিয় কহানিয়া’। এই গল্প সংকলনের ভূমিকায় রেণু কবি রামশের বাহাদুর সিংহের এক প্রসিদ্ধ পংক্তি উদ্ধার করেছেন— “বাত বোলেগী, মৈ নহী! বাত খোলেগী, বাত হী…মৈ নহী।’’ অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চান যে তিনি কাহিনী বলছেন না, গল্প নিজের পথ নিজেই খুলে দিচ্ছে। একথা গভীর অর্থব্যঞ্জক।
‘রেণু’-র লেখা কাহিনী বা গল্প আঞ্চলিক জীবনেরই গল্প। গল্প লেখার জন্য সে গল্প নয়। তবুও কোনো কোনো সমালোচক যে তাকে ‘জীবনদর্শনহীন রোমান্টিক প্রাণী’ বলে গাল দিয়েছেন তা তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন। তবে এইসব গল্পে তিনি নিজেকেই খুঁজে ফিরেছেন এমন অপবাদ কেউ দেয়নি।
‘রেণু’র গল্প পাঠ করলেই এক আঞ্চলিক জীবনের শিল্পীকে চিনে নেওয়া যায়। ‘রসপ্রিয়া’, ‘তিসরী কসম’, ‘এক আদিম রাত্রি কী মহক, ‘অগিনঘোর’ প্রভৃতি গল্পে তার প্রমাণ মিলবে।
রচিত গল্পের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও ফণীশ্বর নাথ রেণুর গল্প বহুমাত্রাযুক্ত। বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে বহুমাত্রিক জীবনাভিজ্ঞতার সম্পৃক্তিতে, লোকমনস্ক বিষয় সম্বলিত গল্প রচনা করে তিনি হিন্দি সাহিত্যকে স্বতন্ত্র করে তুলেছেন। কিছু গল্পের আলোচনা প্রসঙ্গে এই স্বতন্ত্র গল্পকারের স্বরূপ উন্মোচনের প্রয়াস এবার করা হল।
রেণু রচিত প্রথম ছোটোগল্প বটবাবা একটি বটগাছকে কেন্দ্র করে রচিত। গ্রামবাসী কর্তৃক দেবতাজ্ঞানে পূজিত হওয়া বটগাছকেন্দ্রিক এ গল্প রেণুর অনন্যসাধারণ শিল্প কুশলতার নিদর্শন। গল্পটিতে রেণুর আত্মজীবনের ছাপ স্পষ্ট। স্বতন্ত্র ভাষারীতি, নাটকীয় রীতির সম্পৃক্তি ও আঞ্চলিক বিষয় গৌরবে গল্পটি রস সার্থক।
রেণু রচিত প্রথম পর্যায়ের গল্পগুলিতে দাঙ্গা, দেশভাগ, সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত ভারতের দ্রুত পরিবর্তিত সামাজিক-রাজনৈতিক-আর্থিক সমস্যার গল্প বিষয় হিসাবে গৃহীত। রাজনৈতিক জগতের সুবিধাবাদের চিত্রটিও এ পর্যায়ের বেশ কিছু গল্পে উন্মোচিত হয়েছে। পটিকাভূত, ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে, খণ্ডহর, জলওয়া আত্মসাক্ষী এই ধারার গুরুত্বপূর্ণ রচনা। একজন সৎ বিবেকবান মানুষের, রাজনৈতিক কর্মীর মোহভঙ্গের কাহিনি পটিকাভূত গল্পটি। আদর্শের টানে স্বাধীনতা যুদ্ধে নামা সেনানী’র বঞ্চনা ও দুর্দশাপ্রাপ্তি ধর্মক্ষেত্রে গল্পের বিষয়। স্বাধীন ভারতের নৈতিক অবনতির ধারাভাষ্য রচিত হয়েছে খণ্ডহর ও জলওয়া গল্পে। প্রতীকি গল্প আত্মসাক্ষী। একনিষ্ঠ কমিউনিস্ট কর্মী গণপতের গভীর ট্র্যাজেডিই এ গল্পের বিষয়। লোভী কমরেড বলরামের চক্রান্তের শিকার গণপত এক সময় দেখে তার পার্টির পতাকা বর্ণহীন হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে রেণুর গল্পে যে মাত্রাটি সংযুক্ত হয়েছে তা হল বাস্তববাদী জীবন সত্যের সঙ্গে উচ্চ আদর্শের মেলবন্ধন। সংগ্রামশীল মানুষের কথাতে মুখর রেণুর এ পর্বের গল্প। পহলবান বা ঢোলক বিঘটন কে ক্ষণ, তবে একলা চলে রে গল্পগুলি এ ধারার গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি। বোধে উত্তরণের কথা পহলবান, চুরমুনিয়া বিজয়া প্রমুখ চরিত্রের মাধ্যমে রূপায়িত হয়েছে। তবে একলা চলো রে’ গল্পে ব্যক্তির এই উত্তরণ চেতনা তার আত্মানুসন্ধানের নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসাবে ব্যবহৃত। এ গল্পের প্রধান চরিত্র কিশন মহারাজের শহিদ হবার মাধ্যমে নতুন মূল্যবোধের জন্ম ঘটেছে।
তৃতীয় পর্যায়ে রেণুর গল্পের প্রধান সুর হয়েছে লোকজীবন, লোকসংস্কৃতি। রসপ্রিয়া, ভিত্তি চিত্ত কি ময়ূরী, রসুল মিস্ত্রি নেপথ্যকা অভিনেতা এ জাতীয় গল্প। রসপ্রিয়াতে মৃদঙ্গ বাজিয়ে পাঁচকড়ি ভিত্তি চিত্ত কি ময়ূরীতে ভিত্তি চিত্রকর, রসুল মিস্ত্রিতে কারিগর রসুলের অভাব অভিযোগ সুখ-দুঃখ সর্বস্ব জীবন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। নেপথ্য কা অভিনেতাতে এক পারসি নৌটজী দলের বৃদ্ধ অভিনেতার বেদনাপূর্ণ জীবনকথা মর্মস্পর্শী ভাষায় লেখা হয়েছে। লোক জীবনের অনবদ্য শিল্পরূপ এ গল্পগুলি।
মাটির কাছাকাছির নিতান্ত সাধারণ মানুষের সহজ-সরল জীবন কথাতে পূর্ণ চতুর্থ পর্যায়ের গল্পাবলি। সাধারণ মানুষের সহজ স্বচ্ছ ধর্ম বিশ্বাস, ধ্যানধারণা, উৎসবাদি, রীতি রেওয়াজ সর্বস্ব মিউমধুর ও স্নিগ্ধ জীবন রসের গল্প হল—লালপান কি কোম, সির পঞ্চমী কা সগুন, তীর্থেদক, জড়শু মুখড়া, তিন বিন্দিয়া ইত্যাদি।
পঞ্চম পর্যায়ে রেণু গল্পাবলিতে প্রেমের স্বরূপ রহস্য উন্মোচিত। রোমান্টিক প্রেমের গল্প রচনায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। পঞ্চ লাইট, তিসরি কসম, এক আদিম রাত্রি কি মহক, নয়না জেগিন ইত্যাদি এ ধারার সার্থক গল্প। সরল সাদাসিধে গোরুর গাড়োয়ান হিরামন ও নৌটঙ্কী দলের বাইজি হীরাবাইয়ের মধ্যেকার অনুচ্চারিত প্রেম মাধুর্যের গল্প তিসরি কসম হিন্দি কথা সাহিত্যের একটি ক্লাসিক গল্প হিসাবে বন্দিত।
আসলে হিন্দি সাহিত্যের ‘নট কাহিনী’ যুগের গল্পকার ফণীশ্বর নাথ রেণু’ এই যুগে সাহিত্য সাধন শুরু করলেও কালোচিত ‘গ্রামকথা’ বনাম ‘নগর কথার’ বাদানুবাদের বাইরে গিয়েই স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছিলেন। বহুমাত্রিক গল্পশিল্পী রেণু তাই সার্থক ছোটোগল্পকার হিসাবে নন্দিত।
কথাসাহিত্যিক রেণুর রচনাশৈলীর বৈশিষ্ট্য
- ফণীশ্বর নাথ রেণুর কাহিনির ভূগোলটি বিস্তৃত কেবল বিহার ও বিহারের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল নয়, বিহার পেরিয়ে কখনো বাংলা, কখনো নেপাল সীমান্ত পর্যন্ত তাঁর গল্প বিষয় ও পটভূমি ছড়িয়ে গেছে।
- ফণীশ্বর নাথ রেণুর গল্প-উপন্যাসে বাস্তবতা ও রোমান্টিকতার যুগ্মস্রোত প্রবাহিত একদিকে তিনি যেমন ছিলেন অভিজ্ঞতা নির্ভর লেখক, বাস্তবের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষক অন্যদিকে আবার রোমান্টিক গল্পের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী।
- কথাকার রেণুর একটা তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল— তিনি একাধারে রিয়ালিস্ট আইডিয়ালিস্ট। কালচেতনা প্রধান বাস্তববাদী কাহিনির মধ্যে একটা জীবনাদর্শের সুর সম্পৃক্ত রয়েছে তাঁর গল্পে।
- গল্পের কাহিনিতে লোকসংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে রেণু হিন্দি কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে একটা নতুন মাত্রা সংযোজন করেছেন।
Leave a Reply