শিবায়ন কাব্যের কবি কবিচন্দ্র রামকৃষ্ণ রায়ের পরিচয় দাও।

কবিচন্দ্র রামকৃষ্ণ রায়

সপ্তদশ শতাব্দীর শিবায়ন কাব্যের এক প্রতিভাবান কবি হলেন রামকৃষ্ণ কবিচন্দ্র। রামকৃষ্ণের শিবায়নের দুটি পুঁথি পাওয়া গিয়েছে। দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য ও আশুতোষ ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় সাহিত্য পরিষৎ থেকে রামকৃষ্ণের শিবায়ন প্রকাশিত হয়েছে। কাব্যের নাম ‘শিবসঙ্গীত’ বা ‘শিবমঙ্গল’ বা ‘শিবায়ন’। মঙ্গলকাব্য রচনার প্রচলিত রীতি অনুযায়ী স্বপ্নাদেশে যে তার কাব্য রচিত হয়েছে তার উল্লেখ আছে—

ভারতী দিলেন উক্তি নহে মোর নিজ শক্তি

স্বপ্নের ইঙ্গিত অনুগ্রহ।

কাব্যের মধ্যে বর্ণিত আত্মপরিচয় থেকে জানা যায় কবির নিবাস ছিল হাওড়া জেলার আমতা থানার অন্তর্গত রসপুর গ্রামে। কবিরা ছিলেন কায়স্থ। মূল পদবী ছিল দেব, পরে রায় উপাধি গ্রহণ করেন। কবির পিতার নাম কৃষ্ণরায়, পিতামহ যশশ্চন্দ্র, পিতামহী নারায়ণী সরস্বতী, মাতামহ সূর্যমিত্র, মাতা রাধাদাসী। কবির পিতা ছিলেন পণ্ডিত ব্যক্তি। রামকৃষ্ণ উত্তরাধিকার সূত্রে সেই পাণ্ডিত্য পেয়েছিলেন। কবিচন্দ্র ছিল তাঁর উপাধি। কাব্য রচনার পূর্বেই তিনি এই খ্যাতি পেয়েছিলেন।

তার কাব্যের কাহিনির তিনটি ধারা লক্ষ করা যায়। পৌরাণিক তথ্য, তত্ত্ব, সৃষ্টিরহস্য, মন্বন্তর প্রভৃতির বর্ণনা, শিব কাহিনি ও তার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন পৌরাণিক উপকাহিনি এবং লৌকিক শিবের রঙ্গরসিকতামূলক লঘু কাহিনি। তার কাব্যে পৌরাণিক উপাদান যথেষ্ট। কারণ কবি মূলকাহিনির সঙ্গে অনেক উপকাহিনি সন্নিবিষ্ট করেছেন। যেমন—দক্ষযজ্ঞ নাশ, শিবের ধ্যানভঙ্গ, হর-পার্বতীর বিবাহ, শিব-দুর্গার কোন্দল, মদনভস্ম প্রভৃতি ঘটনা। আবার মোট পাঁচটি পালায় শিব কাহিনির লৌকিক আদর্শ অনুসরণ করেছেন। যেমন, শিবের রূপদর্শনে এয়োদের নিন্দা—

 আই আই আই আই               কি লাজ কি লাজ গো

গৌরীর বর নাকি এইটা।

বরের ঘর নাঞি দ্বার নাঞি    আঁত নাঞি দাঁত নাঞি

আয় নাঞি তার নাঞি দায়।

পরিছে বাঘ ছাল                      গলায় হাড়ের মাল

বিভূতি মাখ্যায়ে গায়।।

কবির শিবায়ন মোট ছাব্বিশটি পালায় বিভক্ত। তবে তাঁর কাহিনিতে অন্যান্য শিবায়নের মতো কোনও কেন্দ্রীয় কাহিনি নেই। হর-গৌরীর জীবন তৎকালীন নিম্নবিত্ত জীবনের স্বরূপকে প্রকাশিত করে। যেমন হর-গৌরীর কোন্দল অংশের বর্ণনা—

শয়নে তোমার পাশে             নিদ্রা নাহি হয় ত্রাসে

জটায় জলের কুলকুলি।

সাপের ফেঁসফেঁস শুনি         সাত পাঁচ মনে গুণি

পালাইতে পরম আকুলি।।

শব্দ প্রয়োগে ও ছন্দনৈপুণ্যে রামকৃষ্ণের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। শব্দ প্রয়োগের দৃষ্টান্ত (শিবদর্শনে নারীদের অবস্থা)—

লাজ পাইয়া যত নারী        প্রবেশিল অন্তঃপুরী

নাকে হাতে দাঁতে জিভ চাপে।

কেহ হাসে কেহ কান্দে    কেহ বা গিরিরে নিন্দে

মেনকা মরিতে চাহে তাপে।

ত্রিপদী ছন্দের প্রয়োগও লক্ষণীয়। যেমন পতিনিন্দায় দেবীর কোচিনী প্রসঙ্গ আনয়নের বর্ণনা—

কোচিনী ভুলাও তালে     নাগরালি বুড়া কালে

লোকমুখে শুনি বিপরীত।

রামেশ্বরের কবিখ্যাতির প্রচারে রামকৃষ্ণ রায় আড়ালে চলে গেলেও শিবায়ন কাব্যের অন্যতম কবি ছিলেন রামকৃষ্ণ রায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!