বাংলা কবিতায় অক্ষয়কুমার বড়ালের অবদান আলোচনা কর।
অক্ষয়কুমার বড়াল
রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক গীতিকবিদের মধ্যে অক্ষয়কুমার বড়াল (১৮৬০-১৯১৯) আত্মময় ভাববিহ্বলতা, মিতভাষিতা, প্রকৃতি বর্ণনা প্রকৃতি দিক দিয়ে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য অর্জনে সক্ষম হয়েছিল। প্রেমের কবিতা রচনায় তাঁর কৃতিত্ব সমধিক। কিন্তু সেই প্রেম দেহসর্বস্ব নয়। এদিক থেকে দেবেন্দ্রনাথ সেনের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য রয়েছে। তাঁর কাব্যের ওপর রবীন্দ্রনাথেরও কিছু কিছু প্রভাব বিদ্যমান। কবির হৃদয়াবেগের প্রাবল্যের বহিঃপ্রকাশের চেয়ে অন্তরের গভীর ভাবের ভাবাবিষ্ট রূপটি কবিতায় বেশি ফুটেছে। নারীপ্রেম অক্ষয়কুমার বড়ালের কবিতাবলীর একমাত্র বিষয়। কবির প্রেয়সী তাঁর পত্নী, কিন্তু তিনি শুধু পত্নী নন, তিনি নারী। তিনি কবির হৃদয় মথিত করে তৃপ্তির নরকে কবিচিত্তকে অতৃপ্তির খেদে জ্বালিয়েছেন। তবু তার মিলনে পরিপূর্ণ চরিতার্থতা অপেক্ষমান।
অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন কবি বিহারীলালের শ্রেষ্ঠ অনুসরণকারী। বিহারীলালকে তিনি সচেতনভাবেই গুরু বলে মানতেন। কবির প্রতিভার স্বরূপ সম্পর্কে ভূদেব চৌধুরী মন্তব্য করেছেন— ‘‘অক্ষয়কুমারের কবিতা রোমান্টিক উৎকণ্ঠায় তীব্র, কোথাও বা আবার বিষণ্নতায় উদাস হয়ে উঠেছে। দেবেন্দ্রনাথের মতই তিনি প্রেমের জগতে গৃহ-সুখ-পিপাসু। কিন্তু প্রশ্নতৃষ্ণায় গৃহাশ্রয়ী হলেও, গৃহ-সীমাতেই কবিমন তৃপ্ত হতে পারেনি। ঘরের প্রেমকে অক্ষয়কুমারের কবিকল্পনা বিশ্বভিসারী করেছে। একদিকে গৃহের নির্জন নিভৃত সৌন্দর্য উপভোগের আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে বিশ্বাভিমুখিতা তাঁর সম্ভোগের মধ্যে তৃষ্ণাকে, আস্বাদনের মধ্যে অতৃপ্তিকে উৎকণ্ঠিত করে রেখেছে।’’
অক্ষয়কুমার কাব্য ও নাটক মিলে অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর মধ্যে প্রধান কয়েকটি— প্রদীপ (১৮৮৪), কনকাঞ্জলি (১৮৮৫), ভুল (১৮৮৭), শঙ্খ (১৯১০), এষা (১৯১২), চন্ডীদাস (১৯১৭) ইত্যাদি। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থগুলির মধ্যে রাজকৃষ্ণ রায়ের কবিতা (১৮৮৭) এবং গিরীন্দ্রমোহিনী দাসীর অশ্রুমালা (১৮৮৭) উল্লেখযোগ্য। ‘এষা’ কাব্যটি কবি-পত্নীর মৃত্যুশোকে রচিত। “মানবীর তরে কাঁদি, যাচি না দেবতা’—এই বাণীই প্রিয়জনের বিয়োগব্যথায় প্রকাশ পেয়েছে। ‘এষা’ কাব্যের ‘নিবেদনে’ কবি লিখেছেন—
কোথা পাব বাল্মীকির সে উদাত্ত স্বর?
কোথা কালিদাস-কণ্ঠ ষড়জ-মধুর ?
কোথা ভবভূতি-ভাষ-গৈরিক-নির্ঝর ?
ছিন্ন-কষ্ঠ পিক আমি, মরণ-আতুর
সে নহে সাবিত্রী, সীতা, দময়ন্তী, সতী,
চিরোজ্জ্বল দেবী-মূর্তি কবিত্ব-মন্দিরে;
লয়ে ক্ষুদ্র সুখ দুঃখ মমতা ভকতি,
ক্ষুদ্র এক বঙ্গনারী দরিদ্র কুটিরে।
নহে কল্পনার লীলা-স্বরগ নরক;
বাস্তব জগৎ এই, মর্মান্তিক ব্যথা।
নহে ছন্দ, ভাব-বন্ধ, বাক্য রসাত্মক;
মানবীর তরে কাঁদি, যাচি না দেবতা।
অক্ষয়কুমারের ভাষারীতির মধ্যে সংযম ও পরিমিতিবোধ বিদ্যমান। বাক্সংযম, শব্দচয়ন ও পদলালিত্যের সঙ্গে ভাবগাম্ভীর্যের মিলন তাঁর রচনাভঙ্গির বিশেষত্ব।
Leave a Reply