বাংলাদেশের কবি আবুল হাসানের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
আবুল হাসান
আবুল হাসান (১৯৪৭-১৯৭৫) ষাটের দশকের এমন একজন কবি যিনি মাত্র দশ বছরের কাব্যজীবনে হতাশা, নিসঙ্গতা, বিপন্নতাবোধকে আত্মীকরণ করে বাংলা কবিতাকে দিয়েছেন এক নতুন মাত্রা। প্রথম থেকেই তাঁর কবিতায় দার্শনিকতার স্থাপনা লক্ষ করা যায়। তাঁর সংক্ষিপ্ত কাব্যজীবনে তিনি ঐতিহ্য তাড়িত হয়ে প্রেম-প্রকৃতি-রাজনীতিকে একসঙ্গে কবিতায় স্থান দিয়েছেন। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে তাঁর বেদনাবোধ। কারণ তাঁর কবিতার বড়ো অংশ জুড়েই রয়েছে আত্মচৈতন্য উন্মোচনের তাড়না। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি হল— রাজা যায় রাজা আসে (১৯৭৩), যে তুমি হরণ করো (১৯৭৪), পৃথক পালঙ্ক (১৯৭৫)। প্রথম কাব্যেই কবি এক অস্থির সময়ের সন্তান। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের রক্তস্নাত প্রভাত, মানুষের হাহাকার, আশাভঙ্গের বেদনা, নৈরাশ্য, অধঃপতন, নিষ্পৃহতাকে সংবেদনশীল কবিকে বিচলিত করেছে। আবুল হাসান কবিতায় কবি নিজ সত্তার কাছেই নিজের জন্ম রহস্য জানতে উদগ্রীব হয়েছেন। তাঁর এই আত্মানুসন্ধান তাঁকে নিয়ে গেছে ভাবনার জটিল জগতে। কবির মনে ভীড় করেছে একাধিক প্রশ্ন—
সে এক পাথর আছে কেবলই লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র,
মায়াবী করুণ
এটা সেই পাথরের নাম নাকি? এটা তাই?
এটা কি পাথর নাকি কোনো নদী? উপগ্রহ? কোনো রাজা?
পৃথিবীর তিনভাগ জলের সমান কারো কান্না ভেজা চোখ?
মহাকাশে ছড়ানো ছয়টি তারা? তীব্র তীক্ষ্ণ তমোহর
কী অর্থ বহন করে এই সব মিলিত অক্ষর?
নিজের জীবনজিজ্ঞাসা কবিকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, প্রতিমুহূর্তে ক্ষতবিক্ষত হয় কবির হৃদয়। উত্তর প্রাপ্তির জন্য কবি অশান্ত হৃদয়ে ছটপট করেন। অবশেষে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন যে, তিনি তাঁর পিতারই জীবনের রুগ্ন রূপান্তর। তাঁর নাম কোনো পৃথক অর্থ বহন করেনা তিনি কেবল সেই নাম বহনের অনিচ্ছুক দাস মাত্র। কিন্তু কবি সত্তা পরাধীন থাকতে চায় না। কবি চান স্বাধীনতা, আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি। তাই তিনি বলেন—
আমি আমার ভালোবাসার স্বীকৃতি চাই
স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে,
মৃত্যুমাখা মাটির উপর দাঁড়িয়ে আছি একলা মানুষ,
বেঁচে থাকার স্বীকৃতি চাই,
স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে!
কিন্তু স্বীকৃতি চাইলেই পাওয়া যায় না। বাস্তব অভিজ্ঞতায় কবি বুঝেছেন মানুষ সমাজবদ্ধ জীব হলেও এটা তার খণ্ডিত পরিচয়। মানুষ আসলে একা। সে নিজেকেও চেনেনা। তাই কবি নিজেকে খুঁজে পাওয়ার সন্ধানে বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়েছেন। নদীর কলতানের মধ্যে শুনতে চেয়েছেন প্রিয়জনের কান্নার আওয়াজ। নিসঙ্গ কবির চেতনায় ভীড় করে তাঁর আপনজন। কবির সরজূ দিদি, বড়ভাই, ছোটবোন স্মৃতির স্মরণী বেয়ে কবির সামনে এসে দাঁড়ায়। তাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য কবির প্রাণ পাখি হতে চায় কিন্তু না পারার ব্যর্থতা কবিকে গ্রাস করে। তাই স্বাধীনতার পতাকায় কবি হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের সন্ধান করেন—
কেবল পতাকা দেখি,
কেবল উৎসব দেখি,
স্বাধীনতা দেখি,
তবে কি আমার ভাই আজ
ঐ স্বাধীন পতাকা?
তবে কি আমার বোন, তিমিরের বেদীতে উৎসব?
আত্মগ্লানির ক্লেদ ও যন্ত্রণায় ভরে গেছে কবির হৃদয়। তাই মানব জমিনকে আবাদ করে কবি সোনা ফলাতে চান। তাই আজ কবি অন্ধ কবি হোমার হয়ে কাব্যভুবনে ফুল ফোটাতে চান না বরং কৃষকের বেশেই তিনি নিজের চেতনাশক্তিকে উর্বর করে তুলতে চান—
দুঃখের এক ইঞ্চি জমিও আমি অনাবাদী রাখবো না আমার ভেতর।
সেখানে বুনবো আমি তিনসারি শুভ্র হাসি, ধৃতি পঞ্চইন্দ্রিয়ের
সাক্ষাৎ আনন্দময়ী একগুচ্ছ নারী তারা কুয়াশার মতো ফের এক পলক
তাকাবে এবং বোলবে, তুমি না হোমার? অন্ধ কবি ছিলে? তবে কেন হলে
চক্ষুষ্মান এমন কৃষক আজ? বলি কী সংবাদ হে মর্মাহত রাজা?
এখানে আঁধার পাওয়া যায়? এখানে কি শিশু নারী কোলাহল আছে?
রূপশালী ধানের ধারণা আছে? এখানে কি মানুষেরা সমিতিতে মালা
পেয়ে খুশী?
কবিসত্তা আকাশের তারা হয়ে কবিকে প্রশ্ন করছে। এই প্রশ্নের মধ্যে লুকিয়ে আছে ব্যঙ্গের বীজ। আসলে কবি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বিদ্রূপ করেছেন। দেশের নেতারা সভ্যতার আলো দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও আজ তারাই অন্ধকারের দিকে দেশকে ঠেলে দিচ্ছে। নারী, শিশুর কোলাহল, রূপশালী ধানের সোনার বাংলা আজ আর নেই, চারিদিকে কেবল স্বার্থের হানাহানি। তাই সমাজ-ব্যবস্থার উন্নয়ন নয় মানুষ আজ নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে অধিক ব্যস্ত। ‘সমিতির মালা’ শব্দটি মানুষের সেই স্বার্থপরতাকেই ইঙ্গিত করে। কিন্তু কবি এই রৌদ্র ও রাত্রিভুক অবসাদগ্রস্ত সমিতিপ্রধান সভ্যতা থেকে মুক্তি চান। রাজা, রাজ্য, ক্ষমতা-এসব কবি ঘৃণা করেন। জ্যোৎস্না রাত্রেও কবির হৃদয়ে জেগে উঠে যাযাবর সত্তা কবির ঘুম কেড়ে নেয়। গোলাপভুক সিংহ কবিকে শিল্প সৃষ্টির নামে প্ররোচিত করার চেষ্টা করে। কবি প্ররোচনায় পা না দিলেও সাধারণ মানুষ সেই প্ররোচনায় পা দেয়। তাই কবি বলেন—
আমি দেখেছি তো মানুষ কেবলি তারা ভুল মানুষ ভুল মানুষ,
ভুল মানুষ!
আমি দেখেছি তো শিল্প কেবলি তারা ভুল শিল্প, ভুল শিল্প!
আমি দেখেছি নির্মাণ কেবলি তো অবৈধ নির্মাণ, শুধু অবৈধ নির্মাণ!
হয়েছে আমার দেখা হয়ে গেছে সব, জানা হয়ে গেছে সব, চেনা হয়ে
গেছে সব!
হাজার বছরের পথ পরিক্রমা করে কবি জীবনের শেষপ্রান্তে উপনীত হয়েছেন। আজ খ্যাতির মোহ কবিকে লোভ দেখাতে পারে না। কবি কেবল নারীর নম্রতায় জীবনের আস্বাদ খোঁজেন। ঘরের ছাদ, মসলিন তাঁত, মিহি কুয়াশায় খোঁজেন শিল্পের নতুনত্ব। আজো কবি শুনতে চান ঘুম পাড়ানি গান, নির্মেঘ রাতের আকাশের নির্জন বাতাসের ঘ্রাণ নিতে চান। কিন্তু চারিদিকে সামাজিক অবিশ্বাসের হাওয়া কবির আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরায়। তাই অকপটে কবি সামাজিক কৃত্রিমতার মধ্যে নিজের অবস্থানকে ব্যাখ্যা করেন—
আমার এখন চাঁদ দেখলে খারাপ লাগে
পাখির জুলুম, মেঘের জুলুম, খারাপ লাগে
কথাবার্তায় দয়ালু আর পোশাকে বেশ ভদ্র মানুষ
খারাপ লাগে,
এই যে মানুষের মুখে একটা, মনে একটা….
খারাপ লাগে
খারাপ লাগে
আত্মপ্রেমিক কবি আবুল হাসান জীবনকে নতুন আলোকে উদ্ভাসিত করতে চান, অবলোকন করতে চান আত্মার পরিশুদ্ধ রূপ। আত্মবিশ্বাসে ভর করে কবিসত্তার আলোকে তিনি খুঁজতে চান জীবনের সংজ্ঞা। প্রেম-প্রকৃতি, দুঃখ-আনন্দ, হাসি-কান্না, জীবন-মৃত্যু, ছায়া ভেজা মাটির মধ্যেই গড়ে তোলেন কবিতার শরীর। আসলে বহিরাঙ্গিক সামাজিক জীবন এবং হৃদয়ের অন্তরঙ্গতাকে একই সঙ্গে কবিতায় ধরার জন্য কবি নিজের মেধা ও শ্রমকে কাজে লাগিয়েছেন। তাই জগৎজীবন আর ব্যক্তিজীবন দুই তাঁর কবিতায় স্থান পেয়েছে। দুইয়ের মধ্যেই তাঁর শিল্পোজ্জ্বল উপস্থিতি তাঁর কবিত্ব শক্তির পরিচয়কেই প্রকাশ করে।
Leave a Reply