//
//

বাংলাদেশের কবি আহসান হাবীবের কৃতিত্ব আলোচনা কর।

কবি আহসান হাবীব

চল্লিশের দশকে অবিভক্ত বঙ্গের অন্যতম কবি আহসান হাবীব (১৯১৭-১৯৮৫)। রবীন্দ্র পরবর্তী তিরিশের কবিদের কাব্যধারার উত্তরসূরী হিসাবেই তিনি কাব্যক্ষেত্রে পদার্পণ করেছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল—রাত্রিশেষ (১৯৪৭), ছায়াহরিণ (১৯৬২), সারা দুপুর (১৯৬৪), আশায় বসতি (১৯৭৪), মেঘ বলে চৈত্রে যাবো (১৯৭৬), দু‘হাতে দুই আদিম পাথর (১৯৮০) প্রভৃতি। সমাজ সচেতন কবি হওয়ার কারণে কাব্যজীবনের শুরু থেকেই সামাজিক অপ্রাপ্তিকে আশ্রয় করেই এগিয়ে যেতে চেয়েছেন তিনি। তাঁর প্রথম কাব্য রাত্রিশেষ-এ হতাশা ও আশাবাদ ক্রমান্বয়ে ধ্বনিত হয়েছে। কাব্যগ্রন্থটি ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হলেও কবিতাগুলি চল্লিশের দশকের উত্তাল সময়ে রচিত। কবিতাগুলি প্রহর, প্রান্তিক, প্রতিভাস ও পদক্ষেপ এই চারটি পর্বে বিভক্ত। এই চারটি পর্ব কবির জীবনের চারটি অধ্যায়ও বটে। প্রহর পর্বের কবিতাগুলিতে কবি দিন বদলের প্রত্যাশা করেছেন। মরুভূমির অন্ধকারে করেছেন আলোর সন্ধান। সময়কালের দিক থেকে দেশ তখনও পরাধীন, কিন্তু পূর্ব-বাংলার মুসলিমরা দেখতে শুরু করেছে নতুন দিনের স্বপ্ন। এক নতুন দেশ পাওয়ার আকুলতা সেদিনের তরুণদের যেন নবমন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। কিন্তু পরাধীন ভারতভূমির জীর্ণতা কবিকে প্রতিনিয়ত পীড়িত করে চলেছে। পূর্ণ জীবনের প্রত্যাশী কবিসত্তা যেন বিকলাঙ্গ পাখির মতোই ‘বন্ধ্যা মাটির ক্ষীণ বিন্দুতে ঘূর্ণ্যমান।’ প্রকৃতির পূর্ণতা আরো বেশী করেই কবির হৃদয়ের তৃষ্ণাকে বৃদ্ধি করে চলেছে। আকাশের বুকে দীপ্ত দীপশিখা জ্বললেও বিষাদের রাত্রি যেন পঙ্গু হয়েই কবির কাছে উপস্থিত হয়েছে। ‘পঙ্গু’ শব্দটিকে কবি দুঃখের দীর্ঘতা বোঝাতেই ব্যবহার করেছেন। বন্ধ্যা সমাজ ব্যবস্থায় ব্যথিত কবিসত্তা শর খাওয়া হরিণের মতোই আর্তনাদ করে ফিরে চলেছেন। কিন্তু কবি নতুন আলোর প্রত্যাশী। তাই ক্ষয়িত যুগের চিতাভস্মের মধ্যেও তিনি স্বপ্নের কণাগুলিকে উড়ে বেড়াতে দেখেন। এই স্বপ্নের কণাগুলি তাঁর কাছে আশার আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায়। তিনি স্বপ্ন দেখেন এক উজ্জ্বল দিনের—

ঝরা পালকের ভস্মস্তূপে তবু বাঁধলাম নীড়,

তবু বারবার সবুজ পাতার স্বপ্নেরা করে ভীড়।

তবু প্রত্যহ পীত অরণ্যে শেষ সূর্যের কণা,

মনের গহনে আনে বারবার রঙের প্রবঞ্চনা।

হতাশার মাঝেই কবি সবুজ পাতার স্বপ্নের উপর ভরসা করেই নতুন বাসা নির্মাণের স্বপ্ন দেখেন। ‘তবু’ শব্দেই কবি তাঁর প্রত্যাশাকে প্রবাহিত করতে চেয়েছেন। দুখের দিনের অবসান সহজে ঘটার নয় জেনেও কবি স্বপ্নে বুক বাঁধেন। তবুও দিনের শেষে সূর্যের রঙবদলের মধ্যেই তিনি রঙের প্রবঞ্চনা লক্ষ করেন। এ সম্পর্কে সমালোচক রফিকউল্লাহ খান বলেছেন—‘‘এই ‘তবু’ একটা অভিজ্ঞানের ফলশ্রুতি। কেননা, শিল্পের অনুকারী অস্তিত্বের কাতরোক্তি তিনি শুনেছেন, প্রাচ্য-প্রতীচ্যের পৌরাণিক মিলন-মোহনাসন্ধানী দুবোর্ধ শিল্পের পথযাত্রাও অগোচরে ছুলো না তাঁর-এজন্যেই ‘তবু’ দিয়ে তাঁকে যাত্রা শুরু করতে হয়।’’

‘ছায়া হরিণ’ কাব্যে কবি কেবল সমাজ সচেতন নন, তাঁর ইতিহাসবোধও যুক্ত হয়েছে এই পর্বে। কবিতাগুলি রচিত হয়েছে পঞ্চাশের দশকে অস্থির পটভূমিতে। ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের জয়, সামরিক শাসনের সূচনা সবমিলিয়ে এই সময়ের উত্তাল পরিবেশে কবি কবিতাগুলি রচনা করেছেন। কাব্যগ্রন্থের নামকরণে রয়েছে কবির স্মৃতিচারণা। হরিণ বলতে কবি তাঁর নবগঠিত মাতৃভূমি পূর্ব-পাকিস্তানকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু ছায়া শব্দের ব্যবহার অপ্রাপ্তিকেই প্রকাশ করেছে। যে মাতৃভূমি কবি প্রত্যাশা করেছিলেন তা তিনি পাননি। তাঁর স্বপ্নের বাসভূমি শাসকের অত্যাচারে বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। কবি আস্তে আস্তে তাঁর ভাবনার পরিসরটিকে প্রসারিত করছেন। দেশ-কালের উর্ধ্বে উঠে তিনি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নিজের যুক্তিবোধকে শান দিতে চাইছেন। আগ্রাসী রাজনীতির কারণে পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলি আজ সমগ্র পৃথিবীর শাসকে পরিণত হয়েছে। দরিদ্র দেশগুলি তাদের ব্যবসাক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। নিজেদের স্বার্থের আখর গোছাতেই তারা ব্যস্ত। কিন্তু চোখের সামনে নিজের স্বদেশকে লুণ্ঠিত হতে দেখে দেশ-জাতির আপন অস্তিত্ব আর পরিচয় অক্ষুণ্ন রাখতে কবি দৃঢ়-সংকল্প—

আমাকে বিশাল কোনো সমুদ্রের ঢেউ হতে বলো।

হতে পারি, যদি এই প্রতিশ্রুতি দিতে পারো-

সমুদ্রের ঢেউ

হারায় না সমুদ্রের গভীরে এবং

ফিরে আসে শৈশবের নদীর আশ্রয়ে।

আহসান হাবীব তাঁর কবিতায় মানুষকে উপলব্ধি করেছেন হৃদয়ের অন্তর্গত উপলব্ধি দিয়ে। নিজের ব্যক্তিগত বোধ দিয়ে তিনি সমগ্রকে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন। তাই নদী না হয়ে তিনি সমুদ্রের ঢেউ হতে চেয়েছেন। সমুদ্রের যে ব্যাপ্তি, বিশালতা তার মধ্যে কবি মিশে যেতে চান নি। বরং নির্দিষ্ট স্থানিক প্রেক্ষাপট থেকে কবি সমগ্র বিশ্বের সংকটকে দেখতে চাইছেন।

‘সারা দুপুর’ কাব্যগ্রন্থটিতে মধ্যবিত্ত মনের জীবনযন্ত্রণার প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায় উৎসর্গ পত্রটিতে। কবি লিখছেন—সারা রাত সারা রাত এত শিশির আর/জানালার বাইরে সারারাত/এত যে কান্নার সুর…/কেন পোড়ে এত ভোরে/কে পোড়ায় সাজানো বাগান? কবির এই জীবনবেদনাই এই কাব্যের কবিতাগুলিতে সঞ্চারিত হয়েছে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার চাপে প্রতিনিয়ত পদদলিত হচ্ছে মধ্যবিত্তের চাওয়া পাওয়া গুলি। ধনতান্ত্রিক সভ্যতার শোষণের ঝড়ে কবিসত্তা দিশেহারা। তাঁর মনের শেষ আশার প্রদীপটিও যেন নিভে যেতে চায়। তাই নিসঙ্গ কবি প্রকৃতির মধ্যেই তাঁর বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পেতে চায়—

আমার

সব গেছে, ঘাটের ময়ূরপঙ্খী গেছে আর

পুকুরের মাছ, গোলাভরা ধান নেই, দুধমাখা ভাতে

এখন বসে না কাক; তবু রাত্রিদিন

প্রহরীর মত দেখো জেগে আছে দিগন্ত আমার;

আমি আছি এই নদী আর এই নদীর কল্লোলে

কান পেতে নির্ভয়;

সমাজ সংসারে ক্রমশ একা হয়েও দায়িত্ববান কবি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার কথা বিস্মৃত হন না। তিনি চান তাঁর না পাওয়া যেন আগামী প্রজন্মের কাছে অপ্রাপ্তি না হয়ে দাঁড়ায়। তাই প্রকৃতির পূর্ণতাকেই তিনি আগামীর সম্পদ হিসেবে রেখে যেতে চান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!