ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
উইলিয়ম ওয়ার্ডসওয়ার্থ (১৭৭০-১৮৫০)
প্রকৃতির তুচ্ছ ও সাদামাটা বিষয়াশয়কে অসাধারণ মহিমায় সাজিয়ে তোলার ক্ষেত্রে ইংরেজি সাহিত্যে যাঁর অবদান অনস্বীকার্য, তিনি হচ্ছেন ব্রিটিশ রাজসভার কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ (১৭৭০-১৮৫০)। উইলিয়াম শেকসপিয়ার এবং জন মিলটনের সঙ্গে ইংলিশ কবিতার জগতে বহুকাল ধরে কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের নামটাও প্রবলভাবে উচ্চারিত হয়। তিনিই সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান কবি, যিনি প্রেম ও নিঃসর্গ-সৌন্দর্যের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জীবনাচরণ, মানবিক বৈশিষ্ট্য ও আবেগ অনুভূতির কথা অত্যন্ত নান্দনিকভাবে তুলে ধরেছেন কাব্যে। তাঁর বেশির ভাগ কবিতার মধ্যে পাওয়া যায় সৃষ্টিজগতের সূক্ষ্ম জীবনবোধ, মানবতার জয়গান এবং প্রেম ও প্রকৃতি-নিঃসর্গের নিগূঢ়তম রহস্যময় উপাদান। একজন দক্ষ সমালোচক হিসেবেও ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর অবস্থান ছিল বেশ শক্ত। পরিণত বয়সে এসে কাব্যসাধনায় মত্ত হয়েছেন বলেই হয়তো লেখালেখির সূচনালগ্ন থেকে সাফল্যের সুঘ্রাণ পেতে শুরু করেন ইংরেজি কবিতার বাঁক বদলের এই শক্তিমান পুরুষ।
ওয়ার্ডসওয়ার্থের জন্ম হয় ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে। ইংল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলীয় নিচু হ্রদ এলাকার নিকটতম শহর ককারমাউথতে। জীবন ও প্রকৃতির যুগল মিশ্রণে তিনি এক অভিনব ও আধ্যাত্মিক জগতের দিকে মানুষকে টেনে নেন কবিতার রথে চাপিয়ে। তাঁর কাব্যে ফসলকাটা কিশোরী, গ্রাম্য রাখাল, শ্রমজীবী মানুষ, কিষান-কিষানি, কুলি-মজুরের মতো কৃত্রিমতা-বিবর্জিত, সরলসোজা মানুষের স্থান অনেক উঁচুতে। কারণ, তাদের সমগ্র জীবনটাই যেন স্বচ্ছ কাচের মতো পরিষ্কার ও নির্ভেজাল। এরা প্রত্যেকেই প্রকৃতির অকৃত্রিম সন্তান। সমাজের উঁচু স্তরের মানুষগুলোর চেয়ে এসব মানুষের জীবনটাই অনেক বেশি বিশুদ্ধ ও অর্থবহ। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি নিজেও ছিলেন অর্থবিত্তহীন একজন সাধারণ মানুষ। ফ্রান্সের পরমা সুন্দরী ম্যারি অ্যানের প্রেমে দীর্ঘকাল হাবুডুবু খেলেও শেষতক মেরি হাচিন্সেন নামক এক নারীর সঙ্গে চূড়ান্তভাবে ঘর বাঁধেন তিনি।
১৭৯১ সালের দিকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর ফরাসি বিপ্লবের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন ওয়ার্ডসওয়ার্থ। মূলত ফরাসি বিপ্লবের ‘সাম্য ও মৈত্রী’ আদর্শের আপ্তবাক্য শুনে এবং তারুণ্যের প্রবাহে গা ভাসিয়ে, বিপ্লবের প্রতি অতি উৎসাহী হয়ে পড়েন তিনি। ছুটে যান ফ্রান্সে। তবে সে ঘোর বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বয়স আটাশের কোটায় পা দেওয়ার আগেই বিপ্লবের নীতি ও আদর্শের বিপথগামিতা দেখে দারুণভাবে মর্মাহত হন তিনি। বিশেষত ১৭৯২ সালের ‘সেপ্টেম্বর ম্যাসাকার’ ঘটনায় পিচাশপ্রতীম উল্লাসে মানুষ হত্যা এবং অমানবিক ধ্বংসলীলার প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে তাঁর চিন্তাচেতনায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ফিরে আসেন ইংল্যান্ডে। ভারাক্রান্ত মনে। এখানে এসে দারুণ আর্থিক সংকটে পড়েন। এ সময় রাইজল কলভার্ট নামে তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু অর্থের জোগান দিতে শুরু করেন এবং কাব্যসাধনায় মত্ত হওয়ার জোর পরামর্শ দেন। পাশে দাঁড়ান বোন ডরোথি। ডরোথির অনুপ্রেরণা আর সেবাযত্নের পাশাপাশি বন্ধু রাইজলের আর্থিক সহযোগিতায় ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাব্যতরী ধীরলয়ে ভাসতে ভাসতে একদিন তা প্রবলভাবে ছুটতে শুরু করে। অল্পদিনের মধ্যেই পরিচয় হয়ে যায় ‘বায়োগ্রাফিয়া লিটারারিয়া’ শিরোনামে বিশ্ববিখ্যাত সমালোচনাগ্রন্থের প্রণেতা ইংরেজি সাহিত্যের আরেক দিকপাল, তারুণ্যের কবি স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের সঙ্গে। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ফরাসি বিপ্লবের ‘নীতি ও আদর্শ’ পদস্খলনের ইতিহাস স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজকেও বিপুলভাবে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল তখন।
নিয়তির খেয়ালে, জীবনসংগ্রামে লিপ্ত থাকা কবি কোলরিজ তখন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই চলে আসেন দেশে। বের করতে শুরু করেন ‘ওয়াচম্যান’ নামের একটি পত্রিকা। এরই মধ্যে কোলরিজ এবং ওয়ার্ডসওয়ার্থের বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে গাঢ় হতে শুরু করে। ধমনিতে প্রবাহিত হতে শুরু করে কবিতার তীব্র স্রোতধারা। শিল্প-সাহিত্যের একই বৃন্তে যেন আটকা পড়ল দুটি মন। ফলে দুই বন্ধু মিলে প্রকৃতির নির্মল আলো-ছায়ায় বসে আলাপচারিতার পাশাপাশি মনেপ্রাণে কাব্যচর্চায় ব্রতী হয়ে ওঠেন। একসঙ্গে কাটিয়ে দেন দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। কবিতার ব্যতিক্রম নির্যাস তুলে আনার প্রত্যয়ে চালিয়ে যান নিবিড় গবেষণা। তারই ধারাবাহিকতায় এবং কোলরিজের আন্তরিক সহযোগিতায় ১৭৯৮ সালে প্রকাশিত হয় দুজনের যৌথকাব্য ‘লিরিক্যাল ব্যালাডস’, যা সমগ্র বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং কবিতার জগতে নতুন এক যুগের দ্বার উন্মোচন করেন। অতীতের সব ধারা ছাপিয়ে, সূচনা ঘটে রোমান্টিক যুগের। ‘Lyrical Ballads’ গ্রন্থের সিংহ ভাগ কবিতা অবশ্য ওয়ার্ডসওয়ার্থেরই ছিল। কিন্তু তার পরও বিশ্বনন্দিত এই গ্রন্থটিতে মাত্র চার-পাঁচটি কবিতার জায়গা হওয়ার পরও এর সমান কৃতিত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে কোলরিজ শতভাগ সফলতার মুখ দেখতে পেয়েছেন।
ওয়ার্ডসওয়ার্থের বিখ্যাত ‘Tintern Abbe’ কবিতার পাশাপাশি Ode জাতীয় কয়েকটি কবিতাসহ সর্বমোট ১৯টি কবিতা ‘Lyrical Ballads’ গ্রন্থে যেমন স্থান পেয়েছে, তেমনি কোলরিজের জগদ্বিখ্যাত ‘The Ancient Mariner’ কবিতাটিও স্থান পেয়েছে এই অভিন্ন গ্রন্থে। সঙ্গে তার আরো কটি গুরুত্ববহ কবিতাও প্রকাশ পেয়েছিল সেখানে। যথাক্রমে ‘Tintern Abbe’ ও ‘The Ancient Mariner’ শিরোনামের কালজয়ী এ দুটি কবিতার বাইরেও বেশ কিছু উচ্চমার্গের কবিতা এ সংকলনটিকে অনেক বেশি ঋদ্ধ করেছে, যার বদৌলতে ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র বিশ্বে। দুজনেই হয়ে ওঠেন রোমান্টিক কাব্যের যুগস্রষ্টা। অবশ্য দুজনের কবিতার আঙ্গিক-প্রকরণ ও নির্মাণ কৌশল ছিল সরাসরি বিপরীতমুখী অর্থাৎ একজন প্রাকৃত, অন্যজন অতিপ্রাকৃত বিষয়কে স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছেন কবিতার জন্য। ফলত কবিতার সম্মোহনী শক্তিমত্তা, ব্যতিক্রমতা, বিষয়বৈচিত্র্যের নান্দনিকতা এবং অভূতপূর্ব উপস্থাপনশৈলীর বদৌলতে ‘লিরিক্যাল বালাডস’ কাব্যের মাধ্যমে ওয়ার্ডসওয়ার্থ এবং কোলরিজ প্রচলিত কাব্যধারা ভেঙেচুরে রোমান্টিক যুগের গোড়াপত্তন ঘটাতে সক্ষম হন।
গবেষকদের ভাষ্যমতে, ওয়ার্ডসওয়ার্থ ‘Tintern Abbey’ এবং স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ ‘The Ancient Mariner’ কবিতা লেখার পরে যদি চিরতরে দুজন কবিতার পথ থেকে সরেও দাঁড়াতেন; তার পরও বিশ্বসাহিত্যে তাঁরা অমর ও অক্ষয় আসনটিতেই অধিষ্ঠিত থাকতেন। কাকতালীয়ভাবে হলেও এটাই ধ্রুবসত্য যে ‘Tintern Abbey’ এবং ‘The Ancient Mariner’ শিরোনামের বিশ্ব কাঁপানো এই দুটি কবিতাই ঠাঁই পেয়েছিল ‘Lyrical Ballads’ নামের অভিন্ন গ্রন্থে, যা প্রথমবারের মতো সংকলিত হয় ১৭৯৮ সালে। শুধু কী তাই! এর বাইরেও ‘লিরিক্যাল বালাডস’ গ্রন্থের মুখবন্ধখানাও যুগ যুগ ধরে দারুণভাবে পাঠক সমাদর কুড়িয়ে আসছে—এটাও এক আশ্চর্য সৃষ্টি!
ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাব্য-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য
- ওয়ার্ডসওয়াথের্র কবিতাগুলি সার্থক গীতিকবিতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ‘টিনটার্ন অ্যাবে’ কিংবা ‘ওড অন দ্য ইনটিমেশন অফ ইমমটালিটি’ ছাড়াও তাঁর লুসিবিষয়ক কবিতাগুলি গীতিকবিতার ভাণ্ডারে অমূল্যরতন। আবেগের আন্তরিকতায়, ভাষাভঙ্গির সারল্যে, সবোর্পরি বিষণ্নতার মানবিক স্পর্শে তাঁর গীতিকবিতাগুলি অনবদ্য।
- গীতিকবিতার পাশাপাশি প্রকৃতিপ্রেমও ওয়ার্ডসওয়ার্থের মধ্যে সুগভীর মানবপ্রেমের জন্ম দিয়েছিল। তাঁর কবিতায় প্রকৃতির নিবিড় শান্তি ও গভীর পরিতৃপ্তি মানবমননকে পরিপূর্ণ স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে তোলে। ওয়ার্ডসওয়ার্থ মানুষকে ভালোবেসেছেন নতুন করে। প্রকৃতির মধ্যে কবি শুনতে পেয়েছেন— The still, sad music of humanity. ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘Poems in Two volumes’-এ ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রতিভার যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য ‘দি সলিটারি রিএপার’ কবিতাটি। পার্বত্যভূমির শস্যক্ষেত্রে একাকী বালিকার গানের মধ্যে যে সূরমূর্ছনা রয়েছে, তাকেই কবি ধারণ করেছেন এই কবিতায়।
- ওয়ার্ডসওয়ার্থের ওড বা স্তুতিমূলক কবিতাগুলিতে দার্শনিক চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর Odd to duty একটি সারগর্ভ উপদেশমূলক কবিতা। এখানে জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে কবি বুঝেছেন কর্তব্য কমই জীবনের একমাত্র উপাস্য। স্কটল্যাণ্ডের এয়ারো নদী এবং তার সন্নিহিত অঞ্চলের নিসর্গ প্রকৃতি ওয়ার্ডসওয়ার্থের তিনটি কবিতার বিষয়— Yarrow unvisited, Yarrow revisited, Yarrow visited.
- ওয়ার্ডসওয়ার্থের কিছু কবিতায় স্বাধীনতা এবং দেশপ্রেমের আদর্শ জয়গান ধ্বনিত হয়েছে। Resolution and Independence কবিতার প্রথম দুটি স্তবকে তাঁর দেশভাবনার পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়। ১৮০২ সালে ফ্রান্স যাত্রাকালে রচিত চতুর্দশপদী কবিতাবলী Upon Westminister Bridge তাঁর কাব্যিক দক্ষতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। একগুচ্ছ রাজনৈতিক কবিতা সনেটের আকারে লিখেছিলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ, যার বিষয় ছিল তৎকালীন ফ্রান্সের ঘটনাবলী বিপ্লবের মহাদর্শের ব্যর্থ পরিণতি।
বায়রণ, কুপার, কলিন্স প্রমুখ কবিরা সাধারণ জীবনের সহজ কাব্য রচনা করেছেন। কিন্তু তার অনেক আগেই ওয়ার্ডসওয়ার্থ কাব্যে সাধারণ অসাধারণের ব্যঞ্জনায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছেন। তিনি কবিতায় প্রকৃতির পাশাপাশি সমাজের যে অতি সাধারণ চিত্রগুলি রচনা করেছেন, তাতে প্রকৃতির অবিমিশ্র সরলতা উদার অনাসক্তি ও সংযত গভীর ভাবাবেগ মূর্ত হয়ে উঠেছে। তাই ওয়ার্ডসওয়ার্থ একাধারে প্রকৃতির কবি, মানুষের কবি, জীবনের কবি।
তথ্যসূত্র:
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস | Download |
ইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাস – শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় | Download |
ইংরেজি সাহিত্য পরিচয় – অরবিন্দ পোদ্দার | Download |
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস – কুন্তল চট্টোপাধ্যায় | Download |
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিবৃত্ত ও মূল্যায়ন – বিমলকৃষ্ণ সরকার | Download |
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস – অরুণ ভট্টাচার্য | Download |
Leave a Reply