বাংলাদেশের কবি জুল্লুর রহমান সিদ্দিকীর কৃতিত্ব আলোচনা কর।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী
পঞ্চাশের অনালোচিত কবি জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী (১৯২৮-২০১৪)। সমগ্র সাহিত্যজীবনে তাঁর তিনটি কাব্য প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর কাব্যচর্চার এই স্বল্পতা প্রসঙ্গে কবি নিজেই বলেছেন—‘‘আমার কলমে কবিতার ধারা কোনোদিন প্রবল ছিল না। মাঝে মাঝে রুদ্ধ হয়েছে, এমনও মনে হয়েছে হয়তো এখানেই শেষ, তবে থেমে যায় নি শেষপর্যন্ত।’’ তাই যখনই কাব্যভাবনায় বিরতি এসেছে কবি অন্যের কবিতা অনুবাদে মন দিয়েছেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি হল— হৃদয়ে জনপদে (১৯৭৫), চাঁদ ডুবে গেলে (১৯৮৪), আসন্ন বাস্তিল (১৯৮৮)। হৃদয়ে জনপদে কাব্যের কবিতাগুলিতে কবির ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে। হৃদয়ের দুঃখকে কবি গোপন করেন নি। দুঃখই কবির প্রেমিকা হয়ে দেখা দিয়েছে। দুঃখ কবির সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গী। সুখ কবির ভাগ্যে জোটে নি, দুঃখ কবির দুঃস্বপ্নের দ্বার উন্মোচন করে সরে যায়। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই দুঃখ কবির সঙ্গী হয়ে থেকেছে। যৌবনের দিনগুলোতে দুঃখ তার সৌন্দর্য নিয়ে উপস্থিত হলেও কবির একাকীত্ব দূর হয়নি। প্রতিমুহূতে ধরা পড়েছে কবির আক্ষেপ—
আমার সংসারে আমি বড়ো একা, এখানে জৌলুস
নেই, দিনের পর কতো দিন হাঁড়িও চড়েনা,
কেবল চড়াই ব্যস্ত সারাদিন ভাঙ্গা কড়িকাঠে
দেওয়ালের ঝুলকালি নিয়ে আমি একা একা থাকি।
দুঃখ কেবল কবির হৃদয়কে অশ্রু ভারাক্রান্ত করে তোলেনি। সমগ্র বাংলাদেশ আজ জলমগ্ন। খরা-বন্যার মতো নিসর্গের অন্যায়গুলিকে বাংলাদেশ বুক পেতে নেয়। মৃত্যু আর উর্বরতা পাশাপাশি চলে। শ্মশান আর সূতিকাগৃহ সহাবস্থান করে। হিংসার ফেলিন জলে বাংলাদেশের দুকূল ছাটিয়ে ওঠে। কিন্তু কবি জানেন যা সত্য তাই চিরস্থায়ী। তিনি জানেন জীবনের সমস্ত কলুষতা একমাত্র প্রকৃতিই পারে আমাদের জীবন থেকে নির্মূল করতে। তাই শান্তির আগমন প্রার্থনা করে তিনি বললেন—
অন্যায় অসমতল ডুবে যাক, শ্রাবনের জল,
হোক করুণার জল, প্রীতি আর প্রণয়ের জল,
যা চলে হিংসার জল, ফিরে আয় শান্তির ফসল।
একাত্তরের দিনগুলোকে কবি প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি দেখেছেন বুলেটের ধারালো শাসনে কত জীবন অকালে থেমে গেছে। তাদের সেই মৃত্যুকে মানুষ প্রথম প্রথম মনে রাখলেও সময়ের স্রোতে সেই স্মৃতি মানুষের মন থেকে মুছে গেছে। জনগণ ভুলে গেলেও কবি ভুলতে পারেন না বাংলার এই সব শহিদদের। তাই স্বাধীন বাংলাদেশে কবি আবার সেই ছেলেদেরকেই ফিরে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন—
এসো বাংলার মাটির ভাষার ছেলেরা, আজকে
রাজপথে নেই রক্তচিহ্ন, বরষাধন্য
রাজধানী আর আজিমপুরাও শ্যামাস্তীর্ণ,
আজকে মিছিল হৃদয়ে হৃদয়ে তোমার জন্য,
সেখানে রক্ত-শপথে অশোকে পলাশে কীর্ণ।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও সেই স্বাধীনতা কাম্য প্রত্যাশা নিয়ে আসেনি। স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়ে সেদিনের বাঙালিরা হাতে চাঁদ পেয়েছিল। কিন্তু কবির কাছে সেই চাঁদ চেনা মনে হয় নি। কারণ তিনি দেখেছেন দেশ স্বাধীন হলেও দেশের মানুষ আজও পরাধীন থেকে গেছে। পরাজিত শক্তিই মৌলবাদের আকারে দেশজুড়ে বিরাজ করছেন। স্বাধীনতার পরেও কবি দেখছেন মানুষের দ্রারিদ্র কমেনি। আজও মানুষ বঞ্চিত। তাই স্বাধীনতা আজ কবির কাছে অচেনা। যাকে বিদেশী চাঁদের উপমায় ভূষিত করে কবি বললেন—
গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত শীত বসন্তের এই
বিচিত্র বিন্যাসে গড়া আমাদের আপন আকাশে
আমাদের অরক্ষিত অপ্রাচীর সরল চত্বরে
কেন আসে, কেন চাঁদ, কেম এ বিদেশী চাঁদ, যার
ঠিকানা জানি না যার উদ্দেশ্য অজানা। কেন আসে
আমার আকাশে ওই আবার বিদেশী চাঁদ, কেন?
কবির এ প্রশ্ন নিজের বিবেকের কাছে। স্বাধীন বাংলাদেশে কবি দেখছেন আনুগত্যের বহর। নিজের মেরুদণ্ডকে ভুলে গিয়ে আজ নিজের স্বার্থের জন্য সবাই অন্যকে তুষ্ট করতে ব্যস্ত। চারিদিকে কেবল শুভেচ্ছার আদান-প্রদান। কিন্তু এর মাঝেই বাংলাদেশে সুচিকিৎসা দুর্লভ বলে কেউ কেউ স্বাধীন বাংলাদেশের পরিকাঠামোহীন মূর্তিটি আমাদের সামনে অনাবৃত করে দেন। এভাবেই জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর কবিতা হয়ে ওঠে সামাজিক সত্য উন্মোচনের চাবিকাঠি।
Leave a Reply