//
//

রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশের কৃতিত্ব আলোচনা কর।

জীবনানন্দ দাশ

অনিশ্চিত মধ্যবিত্ত জীবনের নানামাত্রিক অভিঘাতে জর্জরিত হয়ে একাকিত্ব এবং আধুনিক যুগযন্ত্রণা অবলম্বন করে কবিতাযাপনে ব্রতী ছিলেন তিরিশের প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)। নিসর্গের মোড়কে স্বদেশ, সমাজ, সমকাল এবং অস্তিত্বের হাহাকার উপজীব্য করে কবিতার যে সুদৃঢ় সৌধ তিনি নির্মাণ করেছেন, সেখানে নির্জনতা প্রিয় শুদ্ধ মনীষাকেই কেবল আমন্ত্রণ জানানো হয় না; তার কবিতা সৌধে অবগাহনের মাধ্যমে জীবন স্পর্শও সহজতর হয়। তিনি বলেছেন— ‘শ্মশানের দেশে তুমি আসিয়াছ-বহুকাল গেয়ে গেছ গান/সোনালি চিলের মতো উড়ে আকাশের রৌদ্র আর মেঘে-/লক্ষ্মীর বাহন যেই স্নিগ্ধ পাখি আশ্বিনের জোসনা আবেগে/গান গায়—শুনিয়াছি রাখি পূর্ণিমার রাতে তোমার আহ্বান।’ (শ্মশানের দেশে তুমি আসিয়াছ/রূপসী বাংলা)।সকরুণ ও স্নিগ্ধ এই আহ্বানের ভেতর জীবনানন্দের প্রকৃত কবিসত্তা দুল্যমান। এক জীবন রহস্যময় কবিতার পথে একাকী হেঁটে হেঁটে নিরালম্ব জীবনের আকাঙ্ক্ষাকেই মূর্ত ও বেগবান করেছেন তিনি, এঁকেছেন শাশ্বত মৃত্যুর রূপ, সকরুণ ও নম্র সে স্বর—

কি এক ইশারা যেন মনে রেখে এক-একা শহরের পথ থেকে পথে
অনেক হেঁটেছি আমি; অনেক দেখেছি আমি ট্রাম-বাস সব ঠিক চলে;
তারপর পথ ছেড়ে শান্ত হ’য়ে চ’লে যায় তাহাদের ঘুমের জগতে:
……..
এক-একা পথ হেঁটে এদের গভীর শান্তি হৃদয়ে করেছি অনুভব;
তখন অনেক রাত- তখন অনেক তারা মনুমেন্ট মিনারের মাথা
নির্জনে ঘিরেছে এসে; মনে হয় কোনোদিন এর চেয়ে সহজ সম্ভব
……..
উড়ে গেছে; বেবিলনে এক-একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর
কেন যেন; আজো আমি জানিনাকো হাজার-হাজার ব্যস্ত বছরের পর।
(পথ হাঁটা)

কবিতার রহস্যময় পথে হাঁটতে হাঁটতে জীবনানন্দ দাশ কালক্রমে হয়ে উঠেছেন সুদূরপ্রসারী এক নির্জন পথের অভিযাত্রী। কেননা, ‘পথ’ মানবজাতির জীবনযাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ‘পথ’ কেবল চলার মাধ্যম নয়, পথ লক্ষ্যে পৌঁছারও উপায়। ‘অনেক হেঁটেছি আমি’, ‘একা-একা পথ হেঁটে এদের গভীর শান্তি হৃদয়ে করেছি অনুভব;’ কিংবা, ‘বেবিলনে এক-একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর’—কবির এমন উচ্চারণের মধ্য দিয়ে উপলব্ধ হয়, পথ বহুমাত্রিক, তারও শাখাপ্রশাখা রয়েছে। অনুসন্ধানী সব সময় শতপথের ঠিকানা প্রত্যাশী। জীবনানন্দ দাশ শুধু শহর পরিক্রমণই নয়, গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গশোভায় হেঁটে সঞ্চয় করেছেন মানবপ্রেম, বিষণ্নতা, বিপন্ন মানবতার বেদনা এবং হতাশাবোধ। যাপনের এসব অনুষজ্ঞ যুথবদ্ধ হয়েছে জীবনানন্দের বোধে আর প্রকাশিত হয়েছে কবিতায়। তবে পরিবর্তমান কাল, অতীত, বর্তমান এবং ইতিহাসের রূপকাশ্রয়ী বিষাদময় প্রকাশও তার কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। জীবনানন্দের কবিতা চেতনাকে এমনভাবে হরণ করে নেয় যে, জীবনের যাবতীয় কোলাহল-মুখরতা যেন নিমেষেই নিস্তব্ধ হয়ে যায়।

জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থগুলি হল— ঝরাপালক (১৯২৭), ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬), বনলতা সেন (১৯৪২), মহাপৃথিবী (১৯৪৪), সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮), রূপসী বাংলা (রচনাকাল ১৯৩৪, প্রকাশকাল ১৯৫৭), বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬২)

জীবনানন্দ দাশের কবিতার প্রকাশ স্নিগ্ধ, যার অন্তঃস্থলে কোমল ও গভীর চেতনা অনুরণিত হয় সম সময়। এতে পাঠক মোহাবিষ্ট হন। তার কবিতার নান্দনিক সৌন্দর্যে আকণ্ঠ অবগাহনের মাধ্যমে পাঠকের ঘোরগ্রস্ত না হয়ে কোনও উপায় থাকে না। কবির আত্মানুসন্ধান, বিষয়ভাবনা ও নির্মাণকৌশলের ভিন্নতাও স্বতন্ত্র। আপাত পর্যবেক্ষণে অত্যন্ত সহজ ও সরল শব্দের গাঁথুনিতে তার কবিতা মূর্ত হলেও জীবন চেতনার অন্তর্গত অসুখ ও হাহাকারের ক্রমবর্ধিষ্ণু ধারাটি এখানে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। ফলে তার কবিতা হয়ে ওঠে মানবজীবনের গভীর বোধ পরিগ্রহ করে সমাজ সচেতন এবং নগর জীবনের দ্বান্দ্বিকতার সাক্ষ্যবাহী। ‘বোধ’ কবিতায় তিনি বলেন—

আলো-অন্ধকারে যাই-মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়- শান্তি নয়- ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে,
সব কাজ তুচ্ছ হয়-পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা- প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়।

অস্বীকারের উপায় নেই যে, শিল্পের অর্থ বহুরৈখিক। ভাবনা বা দর্শনের ডালপালা মেলে দেয়া তার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মানুষের যাপিত জীবনে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা নানান অর্থ তৈরি করে। যাপনের বাইরেও জীবনের আরও অনেক অর্থ থাকে যা বিশ্লেষিত হতে হতে বহু বিস্তৃত ক্ষেত্রকে স্পর্শ করার সুযোগ ঘটে। এভাবেই কেন্দ্রমুখী সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে জীবনানন্দ দাশ এমন এক ঋদ্ধ অনুভূতিতে পৌঁছান, যেখানে ব্যক্তিক নৈঃসঙ্গ মহৎ শিল্পে স্ফূর্তি লাভ করে। জীবনানন্দের ‘বোধ’ কবিতাটিই এর অনন্য উদাহরণ। বৈশ্বিক চেতনা স্পর্শ করে এ কবিতায় যে বাঁক পরিলক্ষিত হয় তা জীবনের সম্পূর্ণ অভিজ্ঞানকে পরিপূরক করে। তিনি যখন আবারও বলেন—

সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে!
কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
সহজ লোকের মতো; তাদের মতন ভাষা কথা
কে বলিতে পারে আর; কোনো নিশ্চয়তা
কে জানিতে পারে আর?

‘সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে!’—এই বিস্ময়বোধক অভিব্যক্তি, ‘আলোয় আঁধারে’র বিপরীতমুখী অবস্থান থেকেই সৃষ্ট। মানুষের কাজ ও বাস্তবতাজ্ঞানই তাকে চিন্তা বা উপলব্ধির দিক থেকে সজাগ করে। চিন্তা মানসিক উপাদান, তাই তাকে এড়ানো সহজ নয়। জীবনানন্দ এটা বোঝেন এবং সঙ্গত কারণে মানেন বলেই তার পরিভ্রমণ চলতে থাকে প্রাত্যহিক বাস্তবতার ভেতর। জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই এটা উপলব্ধিতে এনে এক সময় তিনি শূন্যতার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এই ‘শূন্য’ একদিকে জীবনের উদ্ভাসন এবং অপরদিকে নির্বাণের উৎস হিসেবে কবির বোধে প্রকট হয়। ‘বোধ’ কবিতায় তিনি উল্লেখ করেছেন—

নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন
এক দিন;
এই সব সাধ
জানিয়াছি একদিন- অবাধ- অগাধ;

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় অস্তিত্ববাদী চেতনাও স্পষ্ট। বলাই বাহুল্য, ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্ব বিষয়গত সত্য নয় বরং বিষয়ীগত বা ‘Subjective Truth’. ব্যক্তি-অস্তিত্ব চরমে পৌঁছালে জন্ম হয় ‘Paradoxical Situation’-এর। ফলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পিছিয়ে পড়লে চলে না। দার্শনিক কিয়ের্কেগার্দ ঈশ্বরপ্রেম ও দার্শনিক তত্ত্বে এভাবেই ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্বকে বড় করে দেখেছেন। ঈশ্বরকে অস্বীকার করেননি। জীবনানন্দ দাশও তার ঈশ্বরকে অস্বীকার না করে অস্তিত্ববাদী দার্শনিক তত্ত্বের কাব্যিক প্রয়োগ করেছেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পুরাণ থেকে আদিম দেবতাদের স্বরূপ তুলে ধরেছেন। ফলে ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে প্রকৃতির মিশ্রণ ঘটেছে কবিতায়। তিনি লিখেছেন—

আগুন বাতাস জল: আদিম দেবতারা তাদের সর্পিল পরিহাসে
তোমাকে দিল রূপ-
কী ভয়াবহ নির্জন রূপ তোমাকে দিল তারা;
তোমার সংস্পর্শের মানুষের রক্তে দিল মাছির মতো কামনা।’
(আদিম দেবতারা: মহাপৃথিবী)

জীবনানন্দ জানতেন, ‘কবিতা কালজ্ঞানশূন্য প্রপঞ্চ নয়; সময়কে আশ্রয় করে হয়ে ওঠা ব্যক্তির আবেগ ও প্রজ্ঞার সততাপূর্ণ স্মারক’—যে কারণে তিনি ‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘কেউ কেউ কবি’। এ উক্তিটি জীবনানন্দ দাশ একজন প্রকৃত কবির স্বাতন্ত্র্যকে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করেছেন। বলেছেন, কবিকে তার স্বতন্ত্র ‘সারবত্তা’র কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হয়। ‘সারবত্তা’ শব্দটি মৌলিক, সুনির্বাচিত এবং অসাধারণ। শব্দটি গবেষণালব্ধ। জীবনানন্দ বলেছেন ‘উপমাতেই কবিত্ব’। ‘উপমা’ নিজেই অন্যতম সারবত্তা। ‘উপমা’ কবিতা রচনার অন্যতম উপকরণ বা শিল্পগত উপায়। উপমার ব্যবহারে এমন অনেক কবিতা আছে যা আমাদের পরিচিত এবং বহুল পঠিত হয়ে থাকে। সে সূত্রে উপমার ব্যবহার শুধুমাত্র কবির ক্ষেত্রেই সম্ভব যেহেতু তিনি বুঝে কবিতা লেখেন। জীবনানন্দ দাশ নিজের প্রতিভা ও প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রটিকে নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করেছেন। তার প্রায় সব কবিতায় দ্বিধাহীনভাবে যাপিত সত্যের উদ্বোধনও লক্ষ্যণীয়। আবার—

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে- সব নদী- ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
(বনলতা সেন)

জীবনানন্দ দাশ ছিলেন প্রবল ধ্বনি-সচেতন কবি। পাঠকের চেতন-অনুভূতিতে নাড়া দেবার প্রত্যাশায় তিনি ধ্বনি নিয়ে নিরীক্ষা করেছেন। এ কবিতায় অশ্রবণীয় শিশির-পতনের শব্দ আর মৃত্যুর নিঃশব্দ আগমন-বার্তার মধ্য দিয়ে নীরব-অন্ধকার হাজির হয়; যেন, কবি অনুভব করেন প্রকৃতির নিয়মতান্ত্রিক চালচিত্র, জীবজন্তুর নিয়তিতাড়িত জীবনযন্ত্রণা। মানুষের বাধ্যবৃত্তিজনিত এই অসহায়ত্বের আড়ালে এই কবিতায় নির্মিতি পায় আশ্বাস-বারতা আর সবশেষে নিথর পৃথিবীর ভয়াবহ নির্জনতা। অন্ধকারে মুখোমুখি নিরালাপ দাঁড়িয়ে থাকার নিষ্প্রয়োজনীয়তার বোধও প্রকারান্তরে পাখা মেলে।

তবে ‘বোধ’ কবিতায় তিনি আমিত্ব ও বহুত্বের ব্যাপকতায় জীবনের প্রকৃত ‘বোধ’কে নানান ক্ষুদ্র বোধের সমষ্টিরূপে সম্পূর্ণ শিল্পে রূপান্তরিত করে তুলেছেন। যে বোধ থেকে প্রতিমুহূর্তে মানুষের নবজাগরণ ঘটতে পারে। সত্য যে, বোধ থেকে মানুষের মুক্তি নেই। কেননা, ইন্দ্রিয়জ উপলব্ধিগুলোকে কিছুতেই এড়ানো যায় না। তিনি যে চেতনে কিংবা অবচেতনে অত্যন্ত নিরীক্ষাপ্রবণ, তাও এ কবিতাটিতে স্পষ্ট। ‘বোধ’ কবিতায় কবির ‘অবাধ’ ও ‘অগাধ’ জীবনের সূক্ষ্ম, গভীর বা বহুমাত্রিক অধ্যায়ের প্রত্যক্ষ দৃশ্যময়তা অনেক নতুন জিজ্ঞাসার উপাদানকেই তুলে ধরে। জীবনের এই মৌলিক বোধ উপলব্ধিতে আসে বলেই কবি নির্দ্ধিধায় উচ্চারণ করতে পারেন— ‘নক্ষত্রের তলে ঘুমায়েছে মন’। এছাড়া এ কবিতায়, ‘আমি থামি—সেও থেমে যায়’—কবির এই বক্তব্যকে জীবনের পরিসমাপ্তিতে মৃত্যুর সঙ্গে ‘বোধ’ সমাপ্তির নির্দেশক হিসেবেও বিবেচনা করা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!