আধুনিক কবিতার ইতিহাসে বুদ্ধদেব বসুর অবদান আলোচনা কর।
বুদ্ধদেব বসু
নিতান্তই কিশোর বয়সে লেখা যাঁর কবিতা পড়ে রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন, ‘কেবল কবিত্ব শক্তিমাত্র নয়, এর মধ্যে কবিতার প্রতিভা রয়েছে, একদিন প্রকাশ পাবে’ সেই বুদ্ধদেবের কবিতা রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কাব্য সাধনার সুদীর্ঘ ধারার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে ও বিচিত্রযোগে যুক্ত। তাঁর কবিতাও একাধারে বিদ্রোহের, ক্লান্তির, সন্ধানের, বিস্ময়ের, জাগরণের এবং বিশ্ববিধানে আস্থাবান চিত্তবৃত্তির। মহাযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর বাস্তব অভিক্ষেপ তাঁর কাব্যে সরাসরি এসে না পড়লেও আধুনিক য়ুরোপীয় ও বাংলা কাব্যকলার প্রভাবপথে অনুপ্রবেশ করেছে প্রতিশ্রুত হয়ে। এবং বুদ্ধদেবের কবিমানসে প্রতিসরণের সেই ত্রিকোণ স্ফটিক খণ্ডটির কাজ করেছে তাঁর প্রেমবোধ। প্রেমের অনুভব সীমানাতেই জীবনের রূপ বর্ণালি রেখায় দেখা দিয়েছে বুদ্ধদেবের কল্পনায়। তাই বুদ্ধদেব আজীবন ব্যতিক্রমহীনভাবে প্রেমের কবি নিজেই জানিয়েছেন— “যা-কিছু লিখেছি, সব, সবই ভালোবাসার কবিতা, কথা বুনে, ছন্দ গেঁথে, শব্দ ছেনে আমি শুধু ভালোইবেসেছি সব চেয়ে তীব্র, মত্ত, সত্য করে।”
কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল— ‘বন্দীর বন্দনা’ (১৯৩০), ‘কঙ্কাবতী’ (১৯৩৭), ‘দময়ন্তী’ (১৯৪২), ‘দ্রৌপদীর শাড়ি’ (১৯৪৮), ‘শীতের প্রার্থনা: বসন্তের উত্তর’ (১৯৫৫), ‘যে আঁধার আলোর অধিক’ (১৯৫৮), ‘মরচে পড়া পেরেকের গান’ (১৯৬৬) ইত্যাদি।
আধুনিক প্রতিভার নির্ভুল সাক্ষ্যে তাঁর প্রথম প্রখ্যাত ‘বন্দীর বন্দনা’ এই প্রেমেরই বিদ্রোকাব্য। বিদ্রোহী যৌবন-বসন্তের কবি বুদ্ধদেব প্রেমের যে রূপ আঁকলেন এই কাব্যে তা বাংলা কাব্যে যথার্থই আধুনিক। তাঁর সমগ্র কাব্যকলা নানা আবর্তসংকুল প্রেমবিকাশ ও পরিণামের এক তীব্র আনন্দ বেদনাময় অন্তনাট্যের ছন্দোরূপ। সামগ্রিক কবিজীবনে সৃষ্টির যে যৌবনস্বপ্নে তিনি আকুল হয়েছেন অবিরাম, তার লক্ষ্যে ছিল নারী ও কবিতা তুল্যরূপেই। শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘স্বাগত বিদায়’-এর ‘সন্ধিলগ্ন’ কবিতায় বুদ্ধদেব লিখেছেন—
যৌবনে ভেবেছিলাম কবিতাই প্রেম…
কিন্তু অন্য ধারণা সম্প্রতি
মাঝে মাঝে হানা দেয় আমাকে বিশেষ ভাবে।
বুদ্ধদেবের কবিতা রবীন্দ্রোত্তরণের সেই সন্ধিলগ্নে নবযৌবনের প্রেমের তীব্র আর্তি, বাস্তবতা ও মদিরতাকে বুকে গ্রহণ করেছে একান্ত সত্য রূপে। তাই রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে বুদ্ধদেবের যদিও মনে হয়েছিল, তাঁর কাব্যে বাস্তবের ঘনিষ্ঠতা নেই, সংরাগের তীব্রতা নেই, নেই জীবনের জ্বালাযন্ত্রণার চিহ্ন, মনে হল তাঁর জীবনদর্শনে মানুষের অনতিক্রম্য শরীরটাকে তিনি অন্যায়ভাবে উপেক্ষা করে গেছেন। ‘শীতের প্রার্থনা: বসন্তের উত্তর’ কাব্যে এই সত্যটিকে সুন্দর প্রকাশ করেছেন ‘কবি’।
‘বন্দীর বন্দনা’ কাব্যের মূল কথাটা ছিল তাই। বুদ্ধদেবের ভাষায়, ‘‘সৌন্দর্য্যের উপলব্ধিতে নিজের ভিতরে যত বাধা, যত মানসিক প্রলোভন ও দুর্বলতা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ; একদিকে মহৎ ও রোমাঞ্চকর স্বপ্নসঞ্চার, অন্যদিকে পঙ্কিল ও ক্ষুদ্র কামনা— এই আত্মবিরোধের যন্ত্রণা ও সেই কারণে স্রষ্টার উপর অভিসম্পাত।’’
‘বন্দীর বন্দনা’ ও ‘কঙ্কাবতী’র কবি বুদ্ধদেব যখন মধ্য তিরিশের যৌবনোন্মাদনা ছাড়িয়ে ক্রমশ চল্লিশের দরজায় এসে দাঁড়ালেন তখন তাঁর কবিতায়ও দেখা গেল প্রেমের সেই উদ্দাম বেদনোল্লাসের পরিবর্তে প্রেমের দর্শন-চিন্তা। রোমান্টিক কবি বুদ্ধদেব শিল্পের চিরজীবী সত্তায় অবিচলভাবে বিশ্বাসী। বুদ্ধদেবের শিল্পীসত্তা পূর্ণতই কবিসত্তা, সাহিত্যের সকল প্রাঙ্গনে তার অভিনন্দিত সাফল্য। তাই—
যার সম্বল কেবল শব্দ, তাকে বাধ্য হ’য়ে।
শব্দেই চালাতে হবে সব কাজ— যতই কঠিন মনে হোক।
তাই আমি অবিরল পরিশ্রমী।
রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক বাংলা কাব্যের সাধনক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসু সর্বতোভাবে প্রেমের কবি। যৌবন-বসন্তের কবি হিসেবে আবির্ভূত বুদ্ধদেবের সুদীর্ঘকালের কবিতা রচনার একটিই বিষয়—প্রেম। যা লিখেছি, সবই ভালোবাসার কবিতা। প্রথম যৌবনের উদা উন্মাদনা থেকে শুরু করে বিগত বসন্তের সুতীব্র বেদনা এবং তারপর আবার পঠিত জীবনে ‘বসন্ত-স্মৃতির মমতাময় স্পর্শকাতরতা’— বুদ্ধদেবের সমগ্র কবিতাবলী পর্যায়ক কবিচিত্তের প্রেমতন্ময়তার এই বিভিন্ন স্তরের পরিচয় তুলে ধরেছে। প্রেম ও কল্পনা ভদ কবিমানসে ব্যতিক্রমহীনভাবে অন্যোন্য নির্ভর। প্রেমোচ্ছল কাব্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা হল ‘শেষের রাত্রি’। কাব্যগ্রন্থটি শেষ কবিতা। ইন্দ্রিয়ঘন আবেগের গাঢ়তায়, কল্পনার সুদূরতায় ও রূপকর্মের অনিন্দ্য সৌন্দর্যে আধুনিক বাংলার একটি শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা। কবি এখানে প্রেমের অসীম বাসনার মতো অন্ধকার বুকে নিয়ে তার নায়িকাকে আহান জানাচ্ছেন ইন্দ্রিয়াতুর আবেগে তার শেষের রাত্রিতে—
কোটি কোটি মৃত সূর্যের মতো অন্ধকার
তোমার আমার সময়-ছিন্ন বিরহ-ভার;
তাই, এমন একাগ্র নিষ্ঠায় অনন্যমনা হয়ে কাব্য সৃষ্টির সাধনায় কবিদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু অদ্বিতীয়।
Leave a Reply