বাংলাদেশের কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার কৃতিত্ব আলোচনা কর।
মুহম্মদ নূরুল হুদা
ষাটের বাংলা কবিতার অন্যতম শীর্ষ কণ্ঠস্বর মুহম্মদ নূরুল হুদা (১৯৪৯-)। তাঁর কাব্যচেতনার মূলেই রয়েছে মানুষ। তবে এই মানুষ ব্যক্তি মানুষ থেকে জাতি মানুষে রূপান্তরিত হয়ে অবশেষে বিশ্ব মানুষে মিলিত হয়েছে। তাঁর অবস্থান ষাট ও সত্তরের দশকের সন্ধিক্ষণে। তিনি নিজেকে চিহ্নিত করেছেন ‘জাতি সত্তা’র কবি রূপে। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সম্পর্কের মধ্য দিয়েই তাঁর কাব্যযাত্রা অগ্রসর হয়েছে। প্রতিটি বাঁকে নদী যেমন গতি পরিবর্তন করে তেমনি নূরুল হুদাও সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কাব্যভানায় পরিবর্তন এনেছেন তার ফলে এসেছে বৈচিত্র্য। তবে শেষে তিনি আবার দেশ-মাতৃকার কাছেই ফিরে এসেছেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি হল— শোণিতে সমুদ্রপাত (১৯৭২), আমার সশস্ত্র সব্দবাহিনী (১৯৭৫), শোভাযাত্রা দ্রাবিড়ার প্রতি (১৯৭৫), আমরা তামাটে জাতি (১৯৮১), শুক্লা শকুন্তলা (১৯৮৩), যিসাস মুজিব (১৯৮৪), কুসুমের ফণা (১৯৮৮), এক জনমে লক্ষ জন্ম (১৯৮৮), ইত্যাদি। প্রথম কাব্য থেকেই দেখা যায় কবি মানুষের উপরেই আস্থা রেখেছেন। যুগে যুগে মানুষই যেমন সভ্যতার পতন ঘটিয়েছে তেমনই এই মানুষই আবার শুভবুদ্ধি বলে নতুন সভ্যতার পত্তন করেছে। সৃষ্টির আদিতে যে মানুষ ছিল বনচারী, চাঁদের আলো যাদের কাছে বয়ে আনতো অপার বিস্ময় আজ বুদ্ধিবলে মানুষ সেই চাঁদের বুকে পা রাখতে সক্ষম হয়েছে। মানুষের এই কীর্তিকে কুনিশ জানিয়েছেন কবি—
ধূসর অরণ্যের রণে চাঁদের চারণ,
অথবা চাঁদের বুকে মানুষের পা’র
বাতাসের কানে কানে সবুজ নিশান
কিংবা
নিশানের কানে কানে বাতাসের স্বর।
নিশান শব্দটি বিপ্লবের বার্তাবহ। বিপ্লবকে প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত করে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে আনলেন কবি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানুষ শত্রুর সঙ্গে লড়াই করেছে, জঙ্গলে রাত কাটিয়েছেন কবি কেবল মানব সভ্যতার উত্তরণকেই দেখাতে চাইলেন না, তার সঙ্গে তার প্রতিবাদী সত্তাটিকেও আলোকিত করতে চাইলেন। বিজ্ঞানের সঙ্গেই যুদ্ধকে এক সারিতেই রাখলেন। কিন্তু যুদ্ধের সময়ে মানুষের দ্বিখণ্ডিত সত্তাটিতে দেখে তিনি বিস্মৃত। একদল যখন নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে সংগ্রামে লিপ্ত অন্যদল তখন নিজেদের শক্ত বলয়ে সুরক্ষিত রাখতে ব্যস্ত। এই স্বার্থপর শ্রেণির চরিত্রকে শামুকের রূপকে বর্ণনা করলেন কবি—
গুটিয়ে যাও গুটিয়ে গেলেই সুখ
রোদ-দুপুরে পুড়বে না আর বুক
বুকের তলে হৃদয় নামক আঁখি
টের পাবে না তীর-শিকারী পাখি
গুটিয়ে যাও গুটিয়ে গেলেই ভালো
গহন সুখে জ্বলবে জ্বলুক আলো
দেশনেতাদের প্রতারণা অনেক ক্ষেত্রে কবিকে প্রতিবাদী করে তুলেছে। রক্তযুদ্ধে যর দেশ পূর্ব-পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে পরিণত হল সে এশের মানুষ সোনার বাংলার আস্বাদ থেকে বঞ্চিত হল। একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তানি শক্তি মৌলবাদী রূপে দেখা দিল স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে। দেশব্যাপী সৃষ্টি হল আতঙ্ক-সন্ত্রাস আর ধর্মের ভীতি। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পুনরায় অন্ধকারে ভরে যায় বাংলাদেশ, বেদনায় নীল হয়ে যায় বাংলার আকাশ। আক্ষরিক স্বাধীনতা শব্দটিকে নিশ্চিহ্ন করতে না পারলেও বাস্তবিক স্বাধীনতাটিকে হরণ করে তারা। সমগ্র বাংলাদেশ পরিণত হয় বধ্যভূমিতে। সেই অরাজকতার বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি বলেন—
পাবেই তো পাবে
সবে তো উঠেছে তেতে এ বঙ্গ কড়াই
ভাজা হচ্ছে চুয়ান্নহাজারবর্গ জিলিপির চাঁই;
খাবে বাবা, জিলিপিটা খাবে?
কবির এই জিজ্ঞাসার মধ্যেই লুকিয়ে আছে শাসকের প্রতি কবির ঘৃণা, ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ। কবি জানেন আবার দেশের মানুষ জেগে উঠলে তবেই এই অপশাসনের অবসান হবে। যেমন করে বাহান্নোর ভাষা আন্দোলন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছিল তেমনি ভাবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধও ভবিষ্যতে বিপ্লবের বার্তাবহ। মিনার ধ্বংস করে সেদিনের শাসক বাঢালির মন থেকে বাংলাকে মুছে ফেলতে পারেনি। মানুষ আবার জেগে উঠেছে। সেই কথা আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিলেন কবি—
ভাঙলেই যদি ভেঙেই দাও
ইটের মিনার ভেঙেই দাও
প্রস্তরস্মৃতি গুঁড়িয়ে দাও
দুহাতে ঢেকো না মুখ;
আবার আমাকে জাগতে দাও
জাগতে জাগতে জাগাতে দাও
অবাক নিশীথে দোলাতে দাও
সাড়ে সাত কোটি বুক।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কবির ভাবনায় বিবর্তন এসেছে। মানুষের জাতীয় কীর্তিকে স্মরণ করার পর কবি এবার পৃথিবীর দিকে মুখ ফিরিয়েছেন। সমগ্র মানব সভ্যতা উঠে এসেছে কবির কলমে তামাটে জাতির পরিচয়ে। জাতির ইতিহাস অনুসন্ধানে নেমেছেন কবি। লক্ষ লক্ষ বছর জীবের রূপান্তরের পরই মানুষের জন্ম হয়েছে পৃথিবীর বুকে। জন্মেই মানুষ অবাক চোখে তাকিয়েছে পৃথিবীর প্রতি। সে যেন কোনো যাদু বলে হঠাৎই কোনো রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করেছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে ধাতস্থ করেছে সে। সভ্যতার বিবর্তনে নানা জাতিতে রূপান্তরিত হয়ে পৃথিবীর বুকে অবির্ভূত হয়েছে। গড়ে তুলেছে এই সভ্যতার বুনিয়াদ। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বুকেও তারা তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তাদের বিজয়গাথার গল্প রচনা করেছেন কবি—
রোদ্দুরে নেয়েছি আর বৃষ্টিতে বেড়েছি
সহস্র শতাব্দী দিয়ে নিজেকে গড়েছি
আমরা তামাটে জাতি, আমরা এসেছি।
সেদিনের সেই অপরাজেয় মানবজাতি আজ নিজেদের মধ্যেই হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে নিজেদেরকে ধ্বংস করার পাশাপাশি সভ্যতাকে বিনাশ করতে উদ্যত হয়েছে। কবি মুখ ফিরিয়েছেন বাংলাদেশের প্রতি। কোথায় সেদিনের তামাটে জাতি আর কোথায় আজকের বাঙালি জাতি। মানুষের এই রূপান্তর কবি মেনে নিতে পারেন না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আধুনিক হয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্বার্থপরতা। যারা একদিন সম্মিলিতভাবে আহার করতো তারাই আজ অন্যকে বঞ্চিত করে গড়ে তোলে নিজেদের প্রাসাদ। স্বাধীন বাংলাদেশেও একই চিত্র দেখেছেন কবি। দেশের মুক্তিযোদ্ধার আজ অনাহারে ধুঁকছে। কিন্তু কবি মনে করেন অভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের জীর্ণ হাড়ের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের আগুন সুপ্ত আছে প্রয়োজনেই তা আবার দাবানল সৃষ্টি করতে পারে। সেদিন বাঙালির নবজন্ম ঘটবে। সেই সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিলেন কবি—
তোমাদের হাড়গুলো বাঙলার হৃৎপিণ্ডে অবিনাশী ঝড়,
বাঙালির জন্মতিথি, রক্তে লেখা ষোলো ডিসেম্বর।
কাব্যজীবনের পরবর্তী বাঁকে কবি পুরাণ আশ্রয়ী। কালিদাসের নায়িকা কবির অবলম্বন হয়ে উঠেছে। শকুন্তলার বেদনায় মধ্যে দিয়ে বাঙালির জীবনযন্ত্রণাকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন কবি। পরিত্যক্তা কালিদাসের শকুন্তলার দুঃখ আর আজকের বাংলাদেশের অবক্ষয় একমাত্রিক হয়ে উঠেছে। আখ্যানের ভঙ্গিতে ব্যঙ্গ করেছেন কবি—
শুক্লা এবার উঠি কালিদাস, আপনি থাকুন
আপনার পাত্রপাত্রী অবশেষে সুখের দম্পতি
আমরা আরেক কালে, আমাদের নেই ভীমরতি
আমরা সুযোগ-মতো হত্যা করি রমণীর ভ্রুণ।
পুরাণকে কেন্দ্র করে নাগরিক অবক্ষয়কে আক্রমণ করলেন কবি। মানবের মহিমা দিয়ে তাঁর কাব্যযাত্রা শুরু হলেও পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে তিনি অগ্রসর হয়েছেন। জাতিসত্তার কবি নূরুল হুদার কাছে কেবল শিকড়-সন্ধান মুখ্য নয়, তিনি সীমাবদ্ধ থাকেন না কিছুতে। বিচিত্র বিষয়ের উপর শিল্পগুণ আরোপ করে গড়ে তুলেছেন নিজের সৃষ্টি কর্ম।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বাংলা কবিতা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে হয়ে ওঠে ঐকান্তিক দ্বিধাহীন। সত্তরের দশকের শুরুতে প্রবল দুটি সামাজিক-রাজনৈতিক স্রোত জাতীয়তাবাদী চেতনায় অভিসিক্ত হয়ে স্বাধীণ বাংলাদেশের কবিতাকে আরো তীক্ষ্ণ করে তোলে। কবিতা কেবল রাজনৈতিক বৈষম্যের বাহন নয় হয়ে ওঠে সামাজিক অসাম্যের হাতিয়ারও। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের কবিতা অর্জিত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে গ্রহণ করে বিশ্বায়নের দিকে এগিয়ে যায়। হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক কবিতায় সমকক্ষ। এভাবেই বাংলাদেশের কবিতা আধুনিক থেকে আধুনিকোত্তর পথে যাত্রা শুরু করে।
Leave a Reply