//
//

বাংলাদেশের কবি মোহাম্মদ রফিকের কৃতিত্ব আলোচনা কর।

মোহাম্মদ রফিক

ষাটের দশকের ঐতিহ্যসন্ধানী কবি মোহাম্মদ রফিক (১৯৪৩-)। তাঁর লেখালেখি শুরু ষাটের দশকের রক্তাক্ত। পূর্ব-পাকিস্তানে সামরিক শাসন, স্বাধীনতা আন্দোলনের অস্থির সময়কে তিনি তাঁর কাব্যের রসদ হিসাবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি হল— বৈশাখী পূর্ণিমা (১৯৭০), ধুলোর সংসারে এই মাটি (১৯৭৬), কীর্তিনাশা (১৯৭৯), খোলা কবিতা (১৯৮৩), কপিলা (১৯৮৩), উপকথা (১৯৮৫), গাওদিয়া (১৯৮৬), স্বদেশী নিঃশ্বাস তুমিময় (১৯৮৮), মেঘে এবং কাদায় (১৯৯১), প্রভৃতি। বৈশাখী পূর্ণিমা কাব্যের কবিতাগুলির রচনাকাল ১৯৬২-১৯৬৬। এই কাব্যের কবিতাগুলিতে প্রত্যক্ষ শাসক বিরোধী উচ্চারণ নেই। গ্রামীণ জীবনের পরিবেশকে আশ্রয় করে সমকালীন মানুষের দুঃখ, দুর্দশা, ক্ষুধা, দারিদ্রকে কবি তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু করে তুলেছেন। সামরিক শাসনে বিপর্যস্ত কবি প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নিতে চেয়েছেন। প্রকৃতির পূর্ণতার দিনেও কবি প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করতে পারছেন না। পাখিদের কলধ্বনি, তরুশ্রেণির মর্মর, আকাশের চাঁদ-তারার প্রণয় কবির অব্যক্ত হৃদয় যন্ত্রণাকে কেবলই বৃদ্ধি করে চলেছে—

জ্যোৎস্নায় ভরে আছে পৃথিবীর প্রান্তগুলি,

নির্জনতা মুড়ে দিল সমস্ত মন্দির দেবালয়

আমার হৃদয় শুধু কান্নায় উতলা হয়

কী এক পবিত্র অভিমানে!

‘ধুলোর সংসারে এই মাটি’ কাব্যের কবিতাগুলিতে কবি প্রকৃতির স্মৃতিচারণায় মেতেছেন। রূপকের আশ্রয়ে কবি গ্রাম জীবনের সঙ্গে একাত্ম হতে চেয়েছেন। করি স্বীয় বক্তব্যকে রূপকের আকারে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। ‘জীর্ণ ডাল’, ‘ভীত খরগোশ’, ‘জোনাকির স্তত্র আলো’ ‘আতঙ্কিত কাঠবিড়ালি’ প্রভৃতি শব্দবন্ধ ব্যবহারে জীবনের শূন্যতাকে প্রকাশ করেছেন কবি। সংসারি কবি প্রেমের অনুষঙ্গেই দুঃখকে অনাবৃত করেছেন। গৃহিণীর সংসার কর্মের মধ্যেই নিজের ক্ষয় লক্ষ করেছেন। সন্ত্রাসে আতঙ্কিত কবি আত্মা ভীত খরগোশের মতো আত্মগোপন করতেই ব্যস্ত। সর্বহারা নিসঙ্গ কবি মোমের মতোই একটু একটু করে পুড়ছেন। ব্যক্তিগত জীবনেও আশঙ্কার কালো মেঘ ঘনীভূত। প্রেমিকার সংরাগ কবির মনে উদ্দীপনা জাগাতে ব্যর্থ হয়। ছিন্নমূল কবি-হৃদয়—

খালের কিনারা ঘেঁষে একা নাও পড়ে থাকে একা।

কবি-আত্মা এখানে নাবিকহীন নৌকায় পরিণত। নৌকা সারাদিন দুই পারের মানুষের সংযোগ রক্ষা করে। মানুষের কোলাহলে জীবন্ত হয়ে উঠে নদী। কিন্তু দিনের শেষে পারাপার শেষ হলে নৌকার খোঁজ কেউ রাখে না। নদীর কূলে নিসঙ্গভাবে পড়ে থাকতে হয় তাকে। কবিও তাঁর দৈনন্দিন সংসার যাপনের মধ্যে লক্ষ করেছেন সারাটা জীবন তিনি সবার চোখে স্বপ্নের আলো দেখিয়েছেন। কিন্তু তাঁর খোজ কেউ রাখে নি। নৌকার মতো আজ কবিও জীবন সংসারের তীরে উপেক্ষিত। কেবল ব্যক্তিগত জীবনগাথা নয় সমাজের নকশাও কবির চোখ এড়ায় না। কবি লক্ষ করেন—

একটি বেনামী লাশ ধ্বস্ত দেহ, থেঁতলে যাওয়া মাথা,

কখন আজ-না-কাল গাড়ির চাকায় পিষে গেছে;

ধানের খোসার ভিড়ে নিশ্চিত আশ্রয়ে ছিল চাল

ঢেঁকির পাড়ের ঘায়ে সব ধুলো শুধুমাত্র ধুলো;

একটি বেনামী লাশ থেঁতলে যাওয়া মাথা পড়ে আছে।

পাকিস্তান সরকারের হত্যাযজ্ঞের নিদর্শন রূপেই কবি উপরোক্ত চিত্রকল্পটিকে অঙ্কন করেছেন। ঊন-সত্তরেও গণঅভ্যুত্থান বা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে নতুন সংগ্রামী চেতনায় পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নতুন দেশ গঠনের আশায় সরকারের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রেরণাশক্তি ছিল বাহান্নর ভাষা আন্দোলন। ‘কীর্তিনাশা’ কাব্যের কবিতাগুলিতে কবি বাহান্নোর স্মৃতিকেই জাগিয়ে রাখতে চেয়েছেন। তাই এই কাব্যের কবিতাগুলির নামকরণ করতে গিয়ে কবি বর্ণমালার এক একটি অক্ষরকে বেছে নিয়েছেন কবি। কয়েকটি অক্ষর যেমন একটি জ্বলন্ত শব্দের জন্ম দেয় তেমনি কবিও বিশ্বাস করেন সম্মিলিত জনগণই পারে বিদ্রোহের আগুন জ্বালাতে, আশার আলো দেখাতে। কিন্তু বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানি জল্লাদবাহিনি শুরু করে খুন, ধর্ষণ। রক্তে ভেসে যায় পূর্ব-পাকিস্তানের রাজপথ। কিন্তু তাতেও পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষ পিছিয়ে যায় নি। এই ঘটনা তাদের মনের জেদকে আরো দ্বিগুণ করে তুলেছিল। বাঙালির সেই হার না মানা মানসিকতাকে এক সন্তান হারা মায়ের জবানীতে ব্যক্ত করেছেন কবি—

ছেলে নিলি স্বামী নিলি একটিমাত্র মেয়ে তাকে নিলি

কী আর করবি তুই বড়জোর আমাকেও নিবি,

কার্তিকের ভোরবেলা বকুলের কান্নামাখা কুঁড়ি

পড়ে আছে, তার সঙ্গে মৃত্যুর সম্পর্ক ভারী গাঢ়;

এক স্বামী-সন্তান হারা মাতার বেদনাকে ঝরা বকুলের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন কবি। এই মাতার বেদনা বিফলে যায় নি। রক্তের বিনিময়ে পূর্ব-পাকিস্তানের অধিবাসীরা ‘বাংলাদেশ’ পায়। কিন্তু তাদের আশা পূর্ণ হয় না। আমরা জানি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটা দেশের কাছে সামাজিক-অর্থনৈতিক শোষণমুক্ত পরিবেশ প্রত্যাশা করে। কবিও সেইরকম সুস্থ সমাজ প্রত্যাশা করেছেন। কিন্তু অর্জিত সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা সমকালীন মানুষের আশাপূরণে ব্যর্থ। কিন্তু সাধারণ মানুষ যে শোষিত, শাসকশ্রেণি প্রতিনিয়ত তাদের শোষণ করে চলেছে। সেই শোষণের চিত্র রূপকী ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়েছে কবির লেখনীতে—

ছোটোখাটো মাছ ধরে এই জন্যে তৈরি তার জাল

কোমল ঢেউয়ের ঘায়ে ক্ষুদ্র ডিঙি দোলে হালকা লয়ে,

বাড়িয়ে প্রচুর মুখ দুই বউ ছেলেপিলে ঢের

ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে দু-একটা রুপোর ইলিশ…

বাড়িতে প্রচুর মুখ দুই বউ ছেলেপিলে ঢের;

স্বপ্নে দেখে জালের ভেতর ঢোঁড়া খেয়ে নেয় মাছ

আসলে মোহাম্মদ রফিক স্বপ্ন দেখতে যেমন ভালোবাসেন, তেমনি বাস্তবকেও প্রত্যক্ষ করেন। এজন্য অতীত ঐতিহ্য-ইতিহাস-পুরাণ-উপকথা তার কবিতায় ভীড় করে। পরাজিত,প্রান্তিক মানুষের জীবনবেদনা থরে থরে সজ্জিত করে মোহাম্মদ রফিকের কবিতার শরীর। এ প্রসঙ্গে জুলফিকার হায়দার বলেছেন—‘‘বাংলার মাটি ঘেঁষা মানুষের জীবনের মূল্যবোধ, তার সংস্কৃতি ও তার দুঃখ কষ্টে, আশা-আকাঙ্ক্ষা, শোষণ যন্ত্রণা ও হাহাকারের মধ্য থেকে তিনি কবিতার রসায়ন সৃষ্টি করেন। গ্রামীণ আবহকে তিনি কবিতায় প্রাধান্য দেন। অন্ত্যজ মানুষের প্রতি তার অসীম মমত্ববোধ, ভাঙনের জনপদের ও ঐসব ক্ষুৎপিপাসাকাতর, কঙ্কালসার মানুষের জীবনের তিনি চিত্রলিপিকার।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!