বাংলাদেশের কবি শহীদ কাদরীর কৃতিত্ব আলোচনা কর।
শহীদ কাদরী
শহীদ কাদরী (১৯৪২-২০১৬) তাঁর সময়ের উল্লেখযোগ্য কবিদের মধ্যে একজন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তরাধিকার’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৭ সালে, দ্বিতীয়টি ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ ১৯৭৪ সালে এবং তৃতীয়টি ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’ ১৯৭৮ সালে। তাঁর প্রথম কাব্যের কবিতাগুলিতে প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ নেই রয়েছে নাগরিক বৈদগ্ধ্য, নিসঙ্গতাবোধ। আশৈশব তিনি শহরে বেড়ে উঠেছেন। নগর জীবনের গ্লানি, যন্ত্রণা, হতাশাকে তিনি কাছ থেকে দেখেছেন যা তাঁর কবিতায় অবক্ষয়ী চেতনার জন্ম দিয়েছে। জন্মসূত্রেই তিনি পেয়েছেন শহরের শুষ্ক, কঠিন, নির্মম পরিবেশ। মাতৃগর্ভ থেকে কালের গর্ভে নিক্ষিপ্ত হয়ে কবি অবাক চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন জীবনের সর্বগ্রাসী শূন্যতাকে। শাসকের লোভাগ্নিতে কবির স্বপ্নের আবাসভূমি আজ বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। সমাজের সর্বত্র চোরাবালির স্রোত কবিকে অবিশ্বাসী করে তুলেছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে কবি খুঁজে নিতে চেয়েছেন তাঁর বাসভূমিকে, এই সন্ধানের মধ্যে রয়েছে প্রতিবাদের আভাস। আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্বিপাক যেমন মুহূর্তে পরিবেশকে তছনছ করে দেয় তেমনি পূর্ব পাকিস্তানও শাসকের অত্যাচারে বিধ্বস্ত। এরকমই একটি পরিবেশকে বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে তুলে ধরলেন কবি যেখানে প্রতিফলিত হয়েছে মানবজীবনের বিরূপ প্রতিচ্ছবি—
সহসা সন্ত্রাস ছুঁলো। ঘরফেরা রঙিন সন্ধ্যার ভীড়
যারা ছিলো তন্দ্রালস দিগ্বিদিক ছুটলো চৌদিকে
ঝাঁকে ঝাঁকে লাল আর্শোলার মতো যেনবা মড়কে
শহর উজাড় হবে; বলে গেল কেউ, শহরের
পরিচিত ঘণ্টা নেড়ে নেড়ে খুব ঠাণ্ডা এক ভয়াল গলায়
এবং হঠাৎ
সুগোল তিমির মতো আকাশের পেটে
বিদ্ধ হলো বিদ্যুতের উড়ন্ত বল্লম!
কবিতাটিতে সুস্থ নগরজীবনে শাসকের অতর্কিত আক্রমণে শহরবাসীর অসহায় আত্মরক্ষার চিত্রকল্পটিকে তুলে ধরেছেন কবি। কলোনিয়ান সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ আজ আরশোলার মতোই অসহায়। আকাশের বুকে বিদ্যুতের আক্রমণে অবাধ বারিধারা যেমন প্রকৃতিকে বিপর্যস্ত করে দেয় সুস্থ সমাজ ব্যবস্থার বুকে শাসকের বুলেট তেমনই ক্ষত তৈরি করেছে যেখানে কেবলই শোষিত মানুষের রক্তধারায় গোটা সমাজটাই রক্তস্নাত। কবির এই রূপকাত্মক বৃষ্টির বর্ণনা অন্যদিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণও বটে। বাংলা কবিতায় বৃষ্টি বর্ণনায় কবিরা ভাবের সাগরে পাড়ি দেন কিন্তু শহীদ কাদরী স্বভাবধর্মে স্বতন্ত্র। তাঁর জীবনকে দেখার এবং অনুভব করার প্রকৃতি যে ভিন্ন তা এই কবিতা থেকে বোঝা যায়। বাংলা কবিতার চিরাচরিত প্রথানুসরণের ভঙ্গিকে কবি পরিহার করতে চেয়েছেন। বাঙালির বৃ্ষ্টিস্নাত চিরপরিচিত রূপ তাঁর দৃষ্টিতে কিছুটা ভিন্নভাবে ধরা পড়েছে।
শহীদ কাদরীর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে। এই কাব্যের কবিতাগুলির রচনাকাল ১৯৬৭-১৯৭৪ এর মধ্যবর্তী সময়। সময়ের দিক থেকে এই সময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। এই সময় পর্বে শহীদ কাদরী অনেকটা স্পষ্টবাদী। পূর্বের কাব্যের মতো এখানে তিনি ব্যক্তি চেতনায় আবদ্ধ নন। বরং নিজস্ব গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে কবি সমষ্টিকে অঙ্গীকার করেন। যদিও সমষ্টির তরল চিৎকার থেকে তিনি অনেক দূরে। রাজনীতিকে সচেতনভাবেই তিনি কবিতায় ব্যবহার করেছেন। রাজনৈতিক নৈতিকতা তিনি বোঝেন। জানেন নোংরামির নির্মমতা। রাজবন্দী, মন্ত্রীর কালো গাড়ী, জনগণের মিছিল, আহত শ্রমিকের মুখ, ছত্রভঙ্গ জনতা, ক্যামেরা হাতে সাংবাদিক, দেওয়ালে নীতিবাদী পোস্টার, মাইক্রোফোন, কারফিউ, জরুরি অবস্থা-সবই রাজনীতির মোড়ক-পোশাক। এসবের মধ্যে কোনো কল্যাণকর, শান্তিময় কিছু নেই, যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, ফাঁপা বুলির বহর। এসব রাজনৈতিক ভণ্ডামো কবি বোঝেন। তাই তাঁর কলম এই মেকি শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে ফেটে পড়তে চায়। কবি দেখেছেন ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ মুক্তির প্রত্যাশায় পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সাধারণ মানুষ দীর্ঘকালের সামরিক শাসনের বেড়াজালকে ছিন্ন করতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। সাধারণ মানুষের এই সাহসকে কবি চুলের প্রতীকে ফুটিয়ে তুলেছেন। মাথার তুচ্ছ চুল কবির লেখনীতে হয়ে উঠেছে প্রতিবাদী মানবাত্মা—
আমার ক্ষুধার্ত চুল বাতাসে লাফাচ্ছে অবিরাম
শায়েস্তা হয় না সে সহজে, বহুবার
বহুবার আমি তাকে খাইয়ে-দাইয়ে ঘুম
পাড়াতে চেয়েছি। ‘বর্গীরা আসছে তেড়ে’,
ঘুমাও ঘুমাও বাছা!’ কিছুতেই কিছু হয়না যে তার
অনিদ্র সে দাঁড়িয়ে রয়েছে যেন সাঁওতাল সর্দার এক
চিকন সুঠাম দেহ আবরণহীন
সে যেন নিশ্চল নিষ্পলক কোনো বিপ্লবীর মতো বহুকাল,
বহুকাল ধ’রে তবু ঝড়েও কাতর নয়
অথবা বৃষ্টিতে নতজানু!
উপরোক্ত পঙক্তিগুলির প্রেক্ষাপটে রয়েছে দীর্ঘ সময়ের রাজনৈতিক টানাপোড়েন, রক্তক্ষয়ের ইতিহাস। ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও আওয়ামী লিগকে বিচ্ছিন্নতাবাদী দল তক্মা দিয়ে উভয় দলের বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করে। ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানে সুপরিকল্পিত গণ-অভ্যুত্থান ঘটানোর অপরাধে পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ ২৮ জনকে গ্রেফতার করে জেলবন্দী করে। কিন্তু এই গ্রেফতারিকে ভয় না পেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ দ্বিগুণ উৎসাহে প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন। ধারাবাহিক এই আন্দোলন বছরের শেষে ধর্মঘটে রূপান্তরিত হয়। ঐদিন পূর্ব পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলি আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী শাসনের প্রতিবাদ করে ধর্মঘট আহ্বান করলে সরকার প্রায় পাঁচ শতাধিক রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার করে। কিন্তু এই গণ-গ্রেফতারিতেও পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকে যে দমানো সম্ভব হয়নি তার প্রমাণ ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। এই সময় পর্বের অসংখ্য বিদ্রোহীকে কবি মাথার ক্রমবর্ধমান চুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কবি যেমন নিজের মাথাকে সুন্দর রাখার অভিপ্রায়ে অবাধ্য চুলগুলোকে কেটে ফেলতে চান তেমনি নাপিতরূপি পাকিস্তান সরকারও তৎকালীন সময় পাকিস্তানকে শান্ত রাখার অভিপ্রায়ে অসংখ্য চুলের মতো অগণিত রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার তথা হত্যা করেছিল। কিন্তু চুল কেটে তাকে পাকাপাকি দমন করা সম্ভব হয়না কারণ দুদিন পরেই তা আবার বেড়ে উঠে সাঁওতাল সর্দারের মতো আস্ফলন করে। এখানে সাঁওতাল সর্দার বলতে কবি শেখ মুজিবুর রহমানকেই ইঙ্গিত করেছেন কারণ পাকিস্তান সরকার আন্দোলনকে দমন করার জন্য একাধিক বার শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করলেও তিনি প্রতিবাদ করা থেকে সরে দাঁড়াননি। বারংবার মুক্তি পেয়েই নতুন উদ্যমে আন্দোলন শুরু করেছেন। তেমনি কবিও লক্ষ করেন তাঁর মাথার চুল অবাধ্য চুল মাস শেষ না হতেই আহত অশ্বের মতো লাফিয়ে উঠেছে। এই লাফিয়ে ওঠার পিছনেই রয়েছে সর্বহারার প্রতিবাদ।
ভাষা-আন্দোলনের মধ্যে যে স্বাধীনতার যে বীজ ভ্রুণাকারে নিহিত ছিল তাই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অঙ্কুরিত হয়ে মহীরূহে পরিণত হয়েছে। বাঙালির শক্তি ও সাহসের মহীরূহকে পাকিস্তান সরকার বারবার অস্ত্রশক্তির কুঠারাঘাতে উপড়ে ফেলতে চেয়েছে কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। একুশের চেতনা থেকেই কবির মধ্যে একধরনের আত্মপ্রত্যয়ের জন্ম হয়েছে যা তাঁকে ভয়ডরহীন করে তুলেছে। কবিতায় সেই অভিমন্ত্রের কথা স্বীকার করে তিনি বলেছেন তিনি মায়ের মতো ভালোবাসেন এদেশকে—
অর্থাৎ যখনই চিৎকার করি
দেখি, আমারই কণ্ঠ থেকে
অনবরত
ঝ’রে পড়ছে অ, আ, ক, খ
আসলে ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের কবিতার বাঁকবদলে সাহায্য করেছে। কবিতায় এসেছে নতুন ভাবনা। বিভাগ পূর্ব বাংলা কবিতার যে সাম্প্রদায়িক ভাবনা তা অনেকটাই ভাষা আন্দোলনের ফলে মুছে যেতে শুরু করে। প্রাধান্য পেতে শুরু করে মানবতাবাদী ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি। বস্তুত ভাষা আন্দোলনের ফলেই সূচিত হয়েছে বাঙালির স্বাধিকার চেতনা। ভাষা-আন্দোলন বাঙালির মধ্যে সাংস্কৃতিক গণজাগরণও সৃষ্টি করেছে। এই জাগরণ থেকেই জন্ম নিয়েছে প্রতিবাদ। ফলে কবিতাটি প্রতিবাদী কবিতা হয়ে উঠেছে। শহীদ কাদরীর কবিতার ধারাক্রম লক্ষ করলে বোঝা যায় প্রথমপর্বে কবি মূলত নাগরিক জীবনের নিসঙ্গতার ধারাভাষ্যকার। এই পর্বের অর্থাৎ ‘উত্তরাধিকার’ কাব্যগ্রন্থের কবিতায় প্রতিবাদের ভাষা অনেকটাই হাল্কাভাবে উচ্চারিত, রূপকের মাধ্যমে প্রতীকায়িত। কিন্তু দ্বিতীয় পর্বের কবিতা তথা ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ কাব্যের কবিতাগুলিতে কবি ব্যক্তিকেন্দ্রিক বেড়াজাল থেকে ছিন্ন হয়ে সমষ্টিতে এসে মিশেছেন। এই পর্বের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলিই তাঁকে প্রতিবাদী হতে বাধ্য করেছে। তবে প্রতিবাদের মাত্রা কখনই শিল্পগুণের ক্ষতি করে কবিতাকে স্লোগানে পরিণত করেনি কারণ তিনি মনে করেন কবির একমাত্র অবলম্বন কবিতা, ‘কবিতাই আরাধ্য আমার, মানি; এবং বিব্রত তার জন্য কিছু কম নই।’ আসলে নিসঙ্গতা কবিকে নিজ বাসভূমে পরবাসী করেছে সেইসূত্রে কিছুটা প্রতিবাদীও।
Leave a Reply