আরাকান রাজসভার শ্রেষ্ঠ কবি সৈয়দ আলাওলের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
কবি আলাওল
বাংলা সাহিত্যের মধ্য যুগে ধর্মীয় বিষয়বস্তুর গতানুগতিক পরিসীমায় রোমান্টিক প্রণয়কাব্যধারার প্রবর্তনকারী হিসেবে মুসলমান কবিগণের অবদান সর্বজনস্বীকৃত। এ সময়ে তাঁরা আরবি ফারসি ও হিন্দি সাহিত্যের বিষয়বস্তু ও ভাববৈচিত্র্য অবলম্বনে কাব্যরচনায় এক নবযুগের সৃষ্টি করেন। এ পর্যায়ের কবিগণের মধ্যে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের বিচারে কবি আলাওলকে সর্বোচ্চে স্থান দেওয়া হয়। ‘কবিগুরু মহাকবি আলাওল’ আরাকান রাজসভার অন্যতম কবি হিসেবে আবির্ভূত হলেও মধ্য যুগের সমগ্র বাঙালি কবির মধ্যে ‘শিরোমণি আলাওল’ রূপে শীর্ষস্থানের অধিকারী। কবি আলাওলের মৃত্যুর প্রায় এক’শ বছর পরে কবি মুহম্মদ মুকিম তাঁর ‘গুলে বকাওলী’ কাব্যে কবিকে এভাবে স্মরণ করেছিলেন—
গৌড়বাসী রৈল আসি রোসাঙ্গের ঠাম।
কবিগুরু মহাকবি আলাওল নাম।
শিরোমণি আলাওল মরণে জিওন।
শেষ গুণী গুরু মানি প্রণামি চরণ।
বিদ্যাবত্তায় ও পাণ্ডিত্যে কবি ছিলেন অতুলনীয়। আরবি ফারসি হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষায় তিনি সুপণ্ডিত ছিলেন। ব্রজবুলি ও মঘী ভাষাও তার আয়ত্তে ছিল। সে সময়ে আলাওলের মত অন্য কোন প্রতিভাশালী কবি জন্মগ্রহণ করেননি। তিনি নানা শাস্ত্রেও সুপণ্ডিত ছিলেন। প্রাকৃতপৈঙ্গল, যোগশাস্ত্র, কামশাস্ত্র, অধ্যাত্মবিদ্যা, ইসলাম ও হিন্দু ধর্মশাস্ত্ৰ-ক্রিয়াপদ্ধতি, যুদ্ধবিদ্যা, নৌকা ও অশ্বচালনা প্রভৃতিতে বিশেষ পারদর্শী হয়ে আলাওল মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন।
কবি আলাওলের জন্মস্থান ও জন্মকাল নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতের সৃষ্টি হয়েছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ লিখেছেন— ‘‘কবির আদি বাসস্থান যে ফতেহাবাদের জালালপুর ছিল তাহা কবির আত্মপরিচয় হইতে পাওয়া যায়।…এই ফতেহাবাদ বর্তমান ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত একটি পরগনা ছিল।…এই ফতেহাবাদ পরগনার জালালপুর সম্ভবত কবির জন্মস্থান।’’ ড. মুহম্মদ এনামুল হক চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার জোবরা গ্রামে আলাওলের জন্ম বলে মনে করেন। কিন্তু কবির নিজের উক্তি অনুসারে ফরিদপুরের জালালপুরেই তাঁর জন্ম এবং এ সিদ্ধান্তই পণ্ডিতগণ গ্রহণ করেছেন। কবি আলাওলের পিতা ফতেহাবাদের রাজ্যেশ্বর মজলিস কুতুবের মন্ত্রী ছিলেন বলে উল্লিখিত হয়েছে। ‘পদ্মাবতী’ কাব্যে আত্মকথায় কবি লিখেছেন—
কহিতে বহুল কথা দুঃখ আপনার।
রোসাঙ্গে আসিয়া হৈলু রাজ-আসোয়ার॥
বহু বহু মুসলমান রোসাঙ্গে বৈসন্ত।
সদাচারী, কুলীন, পণ্ডিত, গুণবন্ত॥
সবে কৃপা করন্ত সম্ভাষি বহুতর।
তালিম আলিম বলি করন্ত আদর॥
আলাওল ‘রচিলু পুস্তক বহু নানা আলাঝালা’ বলে অনেক গ্রন্থরচনার ইঙ্গিত দিয়েছেন, কিন্তু তার বেশি সংখ্যক গ্রন্থ এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। আজ পর্যন্ত কবির যে সব রচনার পরিচয় পাওয়া গিয়েছে সেগুলি হচ্ছে— ১. পদ্মাবতী, ২. সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল, ৩. সতীময়না, ৪. সপ্ত পয়কর, ৫. তোহফা, ৬. সেকান্দরনামা, ৭. সঙ্গীতশাস্ত্র (রাগতালনামা) ও ৮. রাধাকৃষ্ণ রূপকে রচিত পদাবলী।
পদ্মাবতী
পদ্মাবতী কবি আলাওলের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ কাব্য। কাব্যটি প্রখ্যাত হিন্দি কবি মালিক মুহম্মদ জায়সীর ‘পদ্মাবত’ কাব্যের অনুবাদ। অযোধ্যার কবি জায়সী ১৫৪০ সালে ‘পদুমাবত’ কাব্য রচনা করেছিলেন। আলাওল ১৬৫১ সালে আরাকানরাজ সাদ উমাদার বা থলোমিন্থারের আমলে (১৬৪৫-৫২) মাগন ঠাকুরের আদেশে ‘পদ্মাবতী’ কাব্য রচনা করেন। পদ্মাবতী হিন্দি পদুমাবতের স্বাধীন অনুবাদ। কাহিনি রূপায়ণ, চরিত্রচিত্রণ, প্রকাশভঙ্গি প্রয়োগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে মধ্য যুগের প্রতিভাশালী কবিগণ যে কৃতিত্ব দেখিয়ে মৌলিকতার মর্যাদা লাভ করেছেন সেদিক থেকে আলাওলের স্থান সর্বোচ্চে। এ প্রসঙ্গে কবি বলেছেন—“স্থানে স্থানে প্রকাশিলুঁ নিজ মন উক্তি।’’ একটি অধ্যাত্মরসের কাব্যকে মানবরসের কাব্যে রূপান্তরিত করতে গিয়ে কবি আলাওল আনন্দ ও সৌন্দর্য উপভোগের দিকে বেশি দৃষ্টি দিয়েছিলেন।
পদ্মাবতী প্রেমমূলক ঐতিহাসিক কাব্য। তবে প্রেমের স্বরূপই এখানে বেশি, ইতিহাস এখানে গৌণ। পদ্মাবতী চিতোরের রানী পদ্মিনীর কাহিনি নিয়ে রচিত। পদ্মাবতীর স্বামীর নাম রত্নসেন। পদ্মাবতী অপূর্ব সুন্দরী। চিতোরের রাজসভায় রাঘবচেতন নামে এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত লাঞ্ছনার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য দিল্লির সম্রাট আলাউদ্দীনের নিকট পদ্মাবতীর অনুপম রূপের প্রশংসা করে তাঁকে হরণ করতে প্ররোচিত করেন। আলাউদ্দীন রত্নসেনের নিকট পদ্মাবতী সম্বন্ধে অনুরূপ প্রস্তাব করে প্রত্যাখ্যাত হন এবং প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে চিতোর আক্রমণ করেন। যুদ্ধে রত্নসেন বন্দি হলেও বিশ্বস্ত অনুচরদের সহায়তায় মুক্তি পেতে সক্ষম হন। পরে রাজা দেওপালের সঙ্গে রত্নসেনের যুদ্ধ বাধে। সে যুদ্ধে দেওপাল নিহত এবং রত্নসেন আহত হন। ঐ সুযোগে আলাউদ্দীন পুনরায় চিতোরের আক্রমণ করেন। ইতোমধ্যে রত্নসেনের মৃত্যু ঘটলে পদ্মাবতী সহমৃতা হন। আলাউদ্দীন বিজয়ীবেশে চিতোর পৌঁছে তাদের জ্বলন্ত চিতা দেখতে পেলেন। তখন চিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সুলতান দিল্লি ফিরে এলেন।
ইতিহাসে আলাউদ্দীনের চিতোর বিজয়ের কাহিনি বর্ণিত হলেও তাতে পদ্মিনীসংক্রান্ত কোন কথার আভাস নেই। হয়তো দেশের চারণ কবিরা যৎসামান্য ইতিহাস অবলম্বনে রাজপুত-বীরত্বের যে গল্পকাহিনি গেয়ে বেড়াতেন কবি জায়সী তাকেই ইচ্ছানুযায়ী রূপ দিয়ে ‘পদুমাবত’ রচনা করেছিলেন তাই জায়সীর কাব্যে সব সময় ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি ছিলেন ধর্মমতে সুফিসাধক এবং কাব্যবিচারে রোমান্টিক আখ্যান লেখক; তিনি রূপক প্রকরণ অবলম্বন করেছিলেন আধ্যাত্মিক তত্ত্ব ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে।
কবি মালিক মুহম্মদ জায়সী রূপক কাব্য হিসেবে ‘পদুমাবত’ কাব্য রচনা করেছিলেন। প্রতিভাবান এই কবির হাতে সহজ আওধী বুলি ঠেট ভাষায় রচিত গল্পরসপূর্ণ, উচ্চ ও সূক্ষ্ম তত্ত্বসম্মতি এ কাম-প্রেমকথা লোকপ্রিয় হয়েছিল। ‘পদুমাবতে’র গল্প ভাবুকের কাছে জীবাত্মা-পরমাত্মাবিষয়ক তত্ত্বের আকর, প্রেমিকের কাছে প্রেম ও কামতত্ত্ব, সাধারণ পাঠকের কাছে বাস্তব ঘটনামিশ্রিত রসকাব্য হিসেবে বিবেচিত। এ প্রসঙ্গে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ মন্তব্য করেছেন—‘‘পদ্মাবতী উপাখ্যান মালিক মুহম্মদ জায়সীর নানা সময়ের নানা ঐতিহাসিক ও অনৈতিহাসিক বৃত্তান্তে জোড়া দেওয়া একটি কাব্য মাত্র। তিনি ইতিহাস লিখিতে বসেন নাই। তিনি তাহার কাব্যে সুফীমতের ব্যাখ্যার জন্য আদিরসের আবরণে এক আধ্যাত্মিক রূপক কাব্য রচনা করিয়াছেন।’’ কবি আলাওল জায়সীকেই অনুসরণ করেছেন। তাই পদ্মাবতীতে ইতিহাসের ছায়া থাকলেও ইতিহাস নির্ভর কাহিনি রূপায়ণ কবির লক্ষ্য ছিল না। তিনি প্রণয়োপাখ্যান রচনায়ই মনোনিবেশ করেছিলেন।
জায়সীর কাব্যের রূপকাৰ্থ কবি আলাওল অনুবাদে অনুসরণ করেননি, তিনি রোমান্টিক প্রণয়কাব্য রচনার প্রয়াসী ছিলেন। ‘পদ্মাবতী’ রচনায় আলাওল জায়সীর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হলেও বর্ণনা পদ্ধতির বিশিষ্টতা এবং বিশেষ বিশেষ সংযোজনের মাধ্যমে মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন। উভয়ের কাহিনিতে পার্থক্যও লক্ষ করা যায়। আলাওল কোথাও মূল ছেড়ে ভিন্ন পথে চলেছেন, কোথাও নতুন অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে, বর্ণনার ধারাও পরিবর্তিত হয়েছে। মূলের ছন্দ ও আঙ্গিকের পরিবর্তন করে আলাওল স্বকীয়তা ফুটিয়ে তুলেছেন। রূপবর্ণনায় কবি অনুবাদের পথরেখা অনুসরণ করলেও নিজস্ব ভাবকল্পনার যথেষ্ট পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর অনুবাদ প্রায় সবটুকু ভাবানুবাদ, তাই পাণ্ডিত্য ও জ্ঞানের পরিচয় কাব্যের সর্বত্র পাওয়া যায়। আলাওল কবি, কিন্তু পণ্ডিত কবি। তাঁর কাব্যে পাণ্ডিত্য ও কবিত্বের সংমিশ্রণ ঘটেছে। রত্নসেন সম্পর্কে কবি যে কথা লিখেছিলেন তা তাঁর নিজের পাণ্ডিত্য সম্পর্কেও সত্য বিবেচিত হতে পারে—
শাস্ত্র ছন্দ পঞ্জিকা ব্যাকরণ অভিধান।
একে একে রত্নসেন করিল বাখান॥
সঙ্গীত পুরাণ বেদ তর্ক অলঙ্কার।
নানা বিধ কাব্যরস আগম বিচার॥
নিজে কাব্য যতেক করিল নানা ছন্দ।
শুনিয়া পণ্ডিতগণ পড়ি গেল ধন্দ॥
সবে বলে তান কণ্ঠে ভারতী নিবাস।
কিবা বররুচি ভবভূতি কালিদাস॥
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে—“বাস্তবিক তাহার সমান নানা বিদ্যাবিশারদ পণ্ডিত সে যুগে আর কেহই ছিলেন না। পদ্মাবতী কাব্যের সর্বত্র এই পাণ্ডিত্যের বিচিত্র প্রকাশ লক্ষণীয়। কিন্তু তা সর্বক্ষেত্রে জায়সীর উত্তরাধিকার নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আলাওলের নিজস্ব জ্ঞানভাণ্ডারের পরিচায়ক। বিশেষত ছন্দশাস্ত্র, অষ্টনায়িকাভেদশাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র, সঙ্গীতশাস্ত্র, অশ্বচালনাবিদ্যা, চৌগানখেলা, বিবাহাচার প্রভৃতি ক্ষেত্রে আলাওল মৌলিক জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন। বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তার যে মন্তব্য তাতেই তাঁর পাণ্ডিত্যের প্রকাশ ঘটেছে। কাব্য সম্পর্কে তাঁর কয়টি পংক্তি—
কাব্যকথা সকল সুগন্ধি ভরপুর।
দূরেতে নিকট হয় নিকটেতে দূর॥
নিকটেতে দূর যেন পুষ্পতে কন্টিকা।
দূরেতে নিকট মধু মাঝে পিপীলিকা॥
বন খণ্ডে থাকে আলি কলেতে বস।
নিয়ড়ে থাকিয়া ভেকে না জানিয় রস॥
এসব ক্ষেত্রে নানা বিষয়ে আলাওলের পাণ্ডিত্যের গভীরতা অনুভব করা যায়।
সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জামাল
আলাওলের দ্বিতীয় কাব্য ‘সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জামাল’। আরাকানরাজের প্রধান অমাত্য মাগন ঠাকুরের উৎসাহে কবি ১৬৫৮ সালে এ কাব্য রচনা আরম্ভ করেন। এ প্রসঙ্গে আলাওল লিখেছেন—
শ্ৰীযুত মাগন মনে হৈল অতি সুখ॥
আহ্মারে পুলিলা শুরু কর অবধান।
ফারসী ভাষেতে এই প্রসঙ্গ পুরাণ॥
সকলে না বুঝে এই ফারসী কিতাব।
পয়ার প্রবন্ধে রচ এই পরস্তাব॥
প্রেমের পুস্তক এই সয়ফুল মুলুক।
নানা অপরূপ কথা শুনিতে কৌতুক॥
কিন্তু মাগন ঠাকুরের মৃত্যুতে কবি ভগ্নোৎসাহ হয়ে কাব্যরচনা বন্ধ রাখেন। পরে আনুমানিক ১৬৬৯ সালে সৈয়দ মুসার অনুরোধে তা সমাপ্ত করেন। কাব্যটি প্রেমমূলক কাহিনিকাব্য। পরীরাজকন্যা বদিউজ্জামালের ছবি দেখে রাজপুত্র সয়ফুলমুলুক মুগ্ধ হয়। কিন্তু রাজকন্যার সন্ধান তার জানা নেই। একরাত্রে সে স্বপ্নে বদিউজ্জামালের পরিচয় লাভ করে। তখনি সয়ফুলমুলুক বন্ধু সাইদকে সঙ্গে নিয়ে পরীরাজ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। পথের নানা বাধাবিপত্তি অগ্রাহ্য করে সয়ফুলমুলুক বহু কষ্টে বদিউজ্জামালকে লাভ করতে সক্ষম হয়। এ কাব্যের কাহিনির উৎস আলেফ লায়লা বা আরব্য উপন্যাস। কবি আলাওল আলেফ লায়লার ফারসি অনুবাদ অবলম্বন করে তাঁর কাব্যের রূপ দেন। পরী ও মানুষের এই প্রেমকাহিনি রোমান্সের দিক থেকে নতুনত্বহীন, তবে কবি এতে সুন্দর বর্ণনাভঙ্গি ফুটিয়ে তুলেছেন। জীবনের শেষ দিকে রচিত এ কাব্যে কবি যথেষ্ট মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন। অনেকে একে মৌলিক রচনা বলে মনে করেন। অনুবাদের অবলম্বন নয় বরং কাহিনির উৎস হিসেবে আলেফ লায়লাকে গ্রহণ করাই এই সিদ্ধান্তের কারণ। কাব্যটিতে পার্থিব নরনারীর রোমান্টিক প্রেমের কথা বর্ণিত হয়েছে। মানুষের সঙ্গে পরীরাজ কন্যার প্রেম, দেহ ও দেহাতীত, মর্ত্য ও অমর্ত্যের ভাববন্ধন বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কবির বৃদ্ধ বয়সের রচনা হলেও তাতে সরসতার অভাব ঘটেনি। অনেকটা নিজস্ব কল্পনাপ্রসূত বলে এতে স্বাধীনভাবে কল্পনা প্রকাশের অবকাশ ছিল। কাব্যটি অত্যধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী’ (অবশিষ্টাংশ)
দৌলত কাজী রচিত ‘সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী’ কাব্যের অবশিষ্টাংশ আলাওলের তৃতীয় রচনা। দৌলত কাজীর এ অসমাপ্ত গ্রন্থটি আলাওল, আরাকানরাজ শ্রীসুধর্মার অমাত্য সোলেমানের উৎসাহে ১৬৫৯ সালে সমাপ্ত করেন। কাব্যের রতনকলিকা-আনন্দবর্মার উপাখ্যান আলাওলের নিজের সংযোজন। কবি দৌলত কাজীর রচনায় নিজের লেখা জুড়ে দিতে গিয়ে কবি আলাওল বিনয়ের সঙ্গে বলেছেন—
শ্ৰীযুত দৌলত কাজী মহাগুণবন্ত।
তানে আদ্যে করিয়া রচিলা আদি অন্ত॥
তান সম আমার না হয় পদ-গাঁথা।
গুণিগণ বিচারিয়া কহ সত্য কথা॥
মোর মত কাব্য সাঙ্গ করিলুঁ পাঞ্চালি।
ভগ্ন বস্ত্র কাজে লাগে যদি দেয় তালি॥
দৌলত কাজীর মত সার্থকতা আলাওলের পক্ষে লাভ করা সম্ভব হয়নি। কবি আলাওলের রচনার তুলনায় দৌলত কাজীর কাব্যাংশ কবিত্বগুণে উন্নত বলে বিশেষজ্ঞগণ অভিমত দিয়েছেন। কিন্তু কবি আলাওল তাঁর ‘পদ্মাবতী’ কাব্যে যে অতুলনীয় প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন তার সমকক্ষতা দৌলত কাজী দাবি করতে পারেন না। দৌলত কাজীর মৃত্যুর অনেক দিন পরে কবি আলাওল আদিষ্ট হয়ে কাব্যটির সমাপ্তি কালে হয়ত স্বকীয় প্রতিভার যথোপযুক্ত প্রয়োগ করতে সক্ষম হননি। মানুষের স্ব স্ব ভাগ্যনির্ভরতা ও অদৃষ্টের অখণ্ডনীয়তা প্রতিদিনই এ কাব্যের বর্ণিত গল্পের উদ্দেশ্য।
সপ্তপয়কর
আলাওলের চতুর্থ রচনা ‘সপ্তপয়কর’। কাব্যটি পারস্য কবি নিজামী গঞ্জভীর ‘হপ্তপয়কর’ নামক কাব্যের অনুবাদ। তবে তা আলাওলের অন্যান্য কাব্যের মতই ভাবানুবাদ। আরাকান রাজের সমরমন্ত্রী সৈয়দ মুহম্মদের আদেশে ১৬৬০ সালে কবি এই কাব্য রচনা করেন। গ্রন্থোৎপত্তি সম্পর্কে কবি লিখেছেন—
আরবী ফারসী ভাষা বয়েতের ছন্দ।
বিশেষ নিজামী বাক্য সরস প্রবন্ধ॥
এই গ্রন্থ মাঝে যথ আছে ইতিহাস।
পয়ার প্রবন্ধে তার করহ প্রকাশ॥
এ কাব্যে আরব ও আজমের অধিপতি নোমানের পুত্র বারহামের রাজ্যলাভ এবং তার সাতটি কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। বারহাম তার রাজ্যের পার্শ্ববর্তী সাতটি রাজ্য জয় করে সে সব রাজ্যের সাত রাজকন্যাকে বিয়ে করেন। রাজকন্যারা প্রতি রাত্রে এক একটি গল্প বলে বারহামকে শোনাতেন। এ ধরনের সাতটি গল্প নিয়েই ‘সপ্তপয়কর’। ফারসি কবি নিজামীর শ্রেষ্ঠ পঞ্চকাব্যরত্ন বা ‘খামস’ এর অন্যতম কাব্য হিসেবে হপ্তপয়করের স্থান। এই অত্যুৎকৃষ্ট কাব্যটিকে আলাওল স্বাধীন অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা কাব্যে রূপান্তরিত করেন। এ কাব্যে গল্পগুলো খুব সরলভাবে বর্ণিত হয়েছে; তবে কাব্যমূল্য নিতান্তই নগণ্য।
তোহফা
‘তোহফা’ গ্রন্থটি কবি আলাওলের পঞ্চম রচনা। এই কাব্য বিখ্যাত সুফী সাধক শেখ ইউসুফ গদা দেহলভীর ‘তোহফাতুন নেসায়েহ’ নামক ফারসি গ্রন্থের অনুবাদ। আলাওল ১৬৬৪ সালে এই কাব্য সমাপ্ত করেন। এ গ্রন্থটি শ্ৰীমন্ত সোলেমানের নির্দেশে রচিত হয়েছিল। তোহফা গ্রন্থটি কাব্যাকারে রচিত হলেও ধর্মীয় নীতিকথাই এতে রূপ লাভ করেছে। ধর্মীয় তত্ত্বমূলক ও নৈতিক উপদেশাত্মক কাব্য তোহফা পঁয়তাল্লিশ অধ্যায়ে বিভক্ত এবং এর বিভিন্ন অধ্যায়ে মুসলমানদের ধর্ম আচার-আচরণ কর্তব্য ইত্যাদি বিষয় বর্ণিত হয়েছে। তৌহিদ, ইমান, এলম, শাস্ত্রব্যবস্থা, এবাদত, বিবাহ ইত্যাদি ধর্মীয় সামাজিক ও দৈনন্দিন জীবনের পালনীয় কর্তব্য সম্পর্কে পয়ার ছন্দে রূপ দিয়ে আলাওল মুসলমানদের জন্য অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ হিসেবে এর মর্যাদা দিয়েছেন।
সেকান্দরনামা
আলাওলের ষষ্ঠ গ্রন্থ ‘সেকান্দরনামা’। কাব্যটি নিজামী গঞ্জভীর ফারসি ‘সেকান্দর নামা’ গ্রন্থের অনুবাদ। নবরাজ উপাধিধারী মজলিস নামক আরাকানরাজ চন্দ্র সুধর্মার জনৈক অমাত্যের অভিপ্রায়ে গ্রন্থটি রচিত।
সেকান্দরনামা কাব্যে কবি আত্মপরিচয় দিয়েছেন। সে আত্মপরিচয় পদ্মাবতী কাব্যে প্রদত্ত আত্মপরিচয়ের অনুরূপ। তবে এখানেও কবির পরিচয়টি সম্পূর্ণ হয়ে ওঠেনি। আগের মতই হার্মাদদের হাতে পিতার শহীদ হওয়ার কথা আছে, কিন্তু পিতার নামের উল্লেখ নেই। কবি তার জন্মস্থান সম্পর্কেও কিছু বলেন নি। তাই এসব তথ্য রহস্যময়ই রয়ে গেছে। গ্রন্থের রচনাকাল সম্ভবত ১৬৭২ সাল। আলাওল তখন অতি বৃদ্ধ, শোকতাপ ও অর্থাভাবে বিপর্যস্ত। কাব্যের মূল বিষয় সেকান্দর বা আলেকজান্ডারের দিগ্বিজয় কাহিনি। আলেকজান্ডারের পিতা ফিলিপ, শিক্ষাগুরু ও মন্ত্রী আরস্ততালিশ (আরিস্টটল), পারস্যরাজ দারা বা দায়ুস প্রভৃতির কাহিনি সেকান্দরনামা কাব্যে বর্ণিত হয়েছে। আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ এবং কান্যকুব্জরাজ, চৈনিক ও রুশরাজের সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ ইত্যাদি কাহিনি কাব্যাকারে রূপ লাভ করেছে। কাব্যটিতে যুদ্ধবিগ্রহের দীর্ঘ বর্ণনা আছে, এতে অনেক রূপকথাধর্মী অনৈতিহাসিক গল্পও বিদ্যমান।
আলাওল ছিলেন সঙ্গীতবিদ। সঙ্গীত শিক্ষাদানকালে প্রয়োজনের তাগিদে রাগতালের ধ্যান ও ব্যাখ্যা রচনা এবং সেই সঙ্গে উদাহরণস্থলে গীত (পদসমূহ) রচনাতেই তাঁর কাব্যের হাতেখড়ি হয়েছিল। এ গানগুলো কবির মৌলিক রচনা। আলাওল বাংলা ও ব্রজবুলিতে বৈষ্ণবপদও রচনা করেছিলেন। এই রচনা গতানুগতিক সাহিত্যসৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত হয়—তাতে ভক্তহৃদয়ের সার্থক পরিচয় পাওয়া যায়।
কবি আলাওলের কাব্যসাধনা মোটামুটি অনুবাদমূলক। তবে তাঁর অনুবাদে মৌলিক রচনার স্পর্ধা রাখে। জ্ঞানের প্রাচুর্যে, শব্দসম্ভারের ব্যাপকতায়, বিভিন্ন ভাষাজ্ঞানের দক্ষতায় ও কুশল শিল্পচর্চায় আলাওলের শ্রেষ্ঠত্ব বিদ্যমান। তাঁর রচনা অনুবাদমূলক হলেও প্রধানত তৎসম শব্দের ব্যবহারে, বাংলা ছন্দের পরিচর্যায়, বুদ্ধি ও জ্ঞানগত নতুন নতুন সংযোজনে তিনি মৌলিক কবি হিসেবে বিবেচ্য। তাছাড়া তাঁর সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল কাব্যটির উপাখ্যানের আভাস ও মৌল কাঠামো আরব্যোপন্যাস থেকে গৃহীত হলেও কাহিনি নির্মাণ ও বর্ণনা সর্বাংশে কবির নিজস্ব। সতীময়না ও লোরচন্দ্রানীর যে অংশ আলাওলের রচনা তা তাঁর নিজস্ব কল্পনার পরিচায়ক— অনুবাদ নয়। ড. মুহম্মদ এনামুল হক ও আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ রচিত ‘আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য গ্রন্থে’ বলা হয়েছে—‘‘মহাকবি আলাওল একজন অসাধারণ কবি ছিলেন। তাঁহার কবিত্ব ও পাণ্ডিত্য প্রাচীন বঙ্গ সাহিত্যে নতুন প্রাণলাভ করিয়াছিল ।…অনুবাদে তাহার কৃতিত্ব অসাধারণ। অনুবাদে মূলের সৌন্দর্য রক্ষা করিয়া নিজের অসামান্য প্রতিভার সাহায্যে তাহাতে মৌলিকতার ছাপ দিতে তাহার ক্ষমতা অতুলনীয়। এইজন্য তাহার গ্রন্থগুলি অনুবাদের গণ্ডী ছাড়াইয়া নূতন সৃষ্টির সৌন্দর্যে মহীয়ান হইয়া উঠিয়াছে। তাহার অনুবাদের ভাষায় কোথাও আড়ষ্টতা নাই, কোথাও শ্রুতিকটুতা নাই, উহা পার্বত্য নির্ঝরিণীর মত স্বচ্ছন্দে সাবলীল গতিতে বহিয়া চলিয়াছে।’ মানবীয় প্রণয়কাহিনি ও অধ্যাত্ম প্রেমসাধনা—এই দুই প্রেরণাকে সম্মিলিত করে আলাওল মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে একটি গৌরবময় আসন অলঙ্কৃত করেছেন।
Leave a Reply