//
//

বাংলাদেশের কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কৃতিত্ব আলোচনা কর।

হাবীবুল্লাহ সিরাজী

ষাটের উত্তাল সময়ের কাব্যাঙ্গনে হাবীবুল্লাহ সিরাজী (১৯৪৮-) স্বতন্ত্র কবি-ব্যক্তিত্ব। কবিতা রচনায় তিনি মেধা ও মননকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ায় তাঁর কবিতা সেভাবে পাঠক সমাজে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। একটা নির্দিষ্ট শিল্পগত উচ্চতায় থেকে গেছে তার কবিতা। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি হল— দাও বৃক্ষ দাও দিন (১৯৭৫), মোম শিল্পের ক্ষয়ক্ষতি (১৯৭৭), মধ্যরাতে দুলে ওঠে গ্লাস (১৯৮১), হাওয়া কলে জোড়া গাড়ি (১৯৮২), নোনা জলে বুনো সংসার (১৯৮৩), পোষাক বদলের পালা (১৯৮৮), সিংহ দরজা (১৯৯০), ছিন্নভিন্ন অপরাহ্ন (১৯৯৯) প্রভৃতি। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য তাঁর পরিমিতি বোধ, শব্দচয়ন রীতি, নির্মাণ কুশলতা, ছন্দোবদ্ধতা। প্রথম কাব্য থেকেই কবি কার্যত পাঠকের বোধের সীমার বাইরেই অবস্থান করেছেন—

আলোর প্রবেশ বাতাসের গতি

এবং যাতায়াতের সকল পথ রুদ্ধ হ’লে

মুণ্ডুহীন কালোমাছি আগলে থাকে

দুধভর্তি শাদা বাটি—

একমাত্র কলঙ্ক কবির, কলহের সিংহভাগে

মেয়েমানুষের উদ্যানে এক ঘন কালো ফুল!

দমবন্ধ পরিস্থিতিতে বিপর্যস্ত জীবনযাত্রায় একটি চিত্র রূপায়ণ করেছেন কবি। যারা ক্ষেতে লাঙল চালায়, মাঠে বোনে বীজ, জ্বালিয়ে রাখে সভ্যতার বীজ, জীবনযাত্রার মৌলিক অধিকার থেকে তারা নিজেরাই বঞ্চিত হয়। ফসল ফলিয়ে তারা ফসল পাহারা দেয়, কিন্তু ভাগ পায় না ফসলের যেমন ভাবে মাছি দুধের বাটি অধিকার করলেও দু্ধ পায় না তার আগেই তার মুণ্ড ছিন্ন হয়ে যায়। রাষ্ট্র একইভাবে মানুষের ফলানো ফসল হস্তগত করে মানুষকেই হত্যা করে। মানবাত্মার এই অপমানে কলঙ্কিত হয় কবির কাব্যক্ষেত্র। নষ্ট হয় সমস্ত পবিত্রতা। তাই উদ্যানের ফুল তার সমস্ত সৌন্দর্য হারিয়ে কালো রঙ ধারণ করে।

সমকালের বিপন্ন আদর্শহীনতাকে কবি বিদ্রূপে বিদ্ধ করেছেন। সুস্থ সমাজ গঠনের জন্য, স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের জন্য, নতুন পৃথিবী গড়ার জন্য প্রয়োজন বিপ্লবের। কিন্তু আদর্শের অভাবে বিপ্লব আজ গৃহবন্দি। ঘরোয়া আলাপ, আলোচনার উচ্চকিত তর্কের মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিপ্লব সৃষ্টি করতে চান। কিন্তু কবি জানেন এই ঘরোয়া বিপ্লব ক্ষুরধারহীন, ডানাহীন পক্ষীর মত উড়তে অক্ষম। দুনিয়ার চক্রজালে কেবলই সাকার্সের খেলা চলছে অবিরল। কিন্তু বাস্তবের মাটিতে সেই খেলা দেখানোর মতো মহান মানুষের অভাববোধ করেছেন কবি। তাই ফাঁপা বুলিতে অভ্যস্ত মধ্যবিত্তের প্রতি কবি তাঁর ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন—

বিপ্লব বসত করে ঘরে

পাতার আগুনে ফোটে মোটা চাল

খরা খায় দাঁত-মুখ, চোখে বেঁধে বেগুনি রুমাল

কাচ ভাঙে, গুলি ছোঁড়ে বাগানে বেলুনে;

সেলুনের ক্ষুর-কাচি সাফ করে অযত্নের চুল।

অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় অতি সাধারণ তুচ্ছ বিষয়কে কাব্যে রূপ দিতে সিরাজী সিদ্ধহস্ত। আপাত দৃষ্টিতে বিষয় হিসাবে নগণ্য হলেও অন্তর্নিহিত ভাবনার দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায় গুরুতর বিষয়কেই কবি উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। রূপকের মাধ্যমেই আড়াল করতে চেয়েছেন বিষয়ের সহজলভ্যতাকে। পোকার রূপকে উঠে এসেছে সেরকমই একটি বার্তা—

পোকারও টিকে থাকার দ্বন্দ্ব আছে

খিদে পেলে গিলে খাবে, খুঁড়ে খাবে, কেটে খাবে

শাড়ি-লুঙ্গি, শস্যদানা, ঘরের খুঁটি, জমির দলিল—

খেতে-খেতে বাহাত্তরের বাঁধানো বই

বাদ যাবে না;

দোষ তাতে কার?

কবি জানেন দোষ আমাদের। শাসকরূপী পোকাদের আমরাই বাড়তে দিয়েছি। হতে দিয়েছি সমাজের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ পেয়েই শাসক জন্তুতে পরিণত হয়েছে। তাদের লোভের তালিকা থেকে কিছুই বাদ যায়নি। ‘গিলে খাবে’, ‘খুঁড়ে খাবে’, ‘কেটে খাবে’ শব্দবন্ধে কবি আগ্রাসনের তীব্রমাত্রাকে বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু এরজন্য দায়ি মানুষ নিজে। কর্মহীনতা, ভীরুতা আজ তাদের গৃহবন্দী অলস করে রেখেছে। ফলে পোকারা আজ তাদের বাধাহীন সাম্রাজ্যবিস্তারে ব্যস্ত।

প্রেম বর্ণনায়ও কবি ব্যঙ্গের ছাপ রেখেছেন। তাঁর প্রেমভাবনার একটি বৈশিষ্ট্য হল প্রেমকে তিনি কখনই ব্যক্তিগত সীমায় আবদ্ধ রাখেননি, সবক্ষেত্রেই তিনি নৈর্ব্যক্তিক হয়ে উঠতে চেয়েছেন। কবি বিশ্বাস করেন সীমার মধ্যে প্রেমকে ধরা সম্ভব নয়, এমনকি কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় প্রেমকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। যারা মনে করেন প্রেম বস্তুগত তাদেরকে লক্ষ করে কবির ব্যঙ্গোক্তি—

তোমাকে ভালোবাসবো ব’লে মাছরাঢা ধ’রে

রেখেছিলাম খাঁচায়, আশায় একটি কৃষ্ণচূড়া পুঁতেছিলাম টবে

চুম্বনে ভরাবো ঠোঁট—ডানায় কী ডালে

শক্তপোক্ত ঋতুবাস হবে

মঞ্জুমালা তুমি তার কিছুই নিলে না—

মাছরাঙা উড়ে গেলো, খোলা তার রঙ

কৃষ্ণচূড়া বনবাসী, আকাশ-সমান গলা

এ রকম চল্লিশ বছর!

তবে সব ক্ষেত্রে রূপকের আশ্রয় নেননি। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ভয়াবহ পরিস্থিতিকে কবি সহজ সরলভাবেই ব্যক্ত করেছেন। নতুন দেশ লাভের আশায় পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ একাত্তরের সংগ্রামে শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে উগরে দিয়েছিল তাদের ক্ষোভ। ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল নিজেদের ভূখণ্ডকে। কিন্তু পাকিস্তান সরকারও এত সহজে তাদের ক্ষমতা হাত ছাড়া করতে চায়নি। নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে তারা নির্বিচারে হত্যা শুরু করেছিল। মানুষের বেঁচে থাকাটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল একাত্তরের অগ্নিগর্ভ সময়ে। একটি ক্ষুদ্র পরিবারের চিত্র অঙ্কন করে এই সময়ের এক সুখী গৃহকোণের বিনষ্টের চিত্র তুলে ধরেছেন কবি। সকালে খাওয়ার টেবিলে সন্তান-পিতা-মাতার সুন্দর চিত্রকেই রাত্রের মধ্যে কবি অবস্থানভেদে নির্মমভাবে অঙ্কন করেছেন—

রাতে বারান্দায় ব’সে আকাশের তারা গুনছেন মা

বই-খাতা উল্টিয়ে ঘুমুচ্ছে মেয়ে

বাবা মর্গে।

মুক্তিযুদ্ধের অভিঘাতে সেদিনের প্রাক-বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ পরিবার এভাবে স্বজন হারা, গৃহহারা হয়েছিল। সেদিনের সেই স্মৃতিকে আজও শত রূপকের আড়ালে চাপা দেওয়া সম্ভব হয় না। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সেদিনের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের নাড়ির যোগাযোগ। কবিও ভুলতে পারেননি। তাঁর কবিতাকে তিনি রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে মননের আশ্রয় নিয়েছেন ঠিকই কিন্তু সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে বিস্মৃত হননি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!