শাক্ত পদাবলি রচনায় কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের কৃতিত্ব আলোচনা কর।

কমলাকান্ত ভট্টাচার্য

রামপ্রসাদ শাক্ত পদাবলির যে ধারার সূচনা করলেন, কমলাকান্ত তারই উত্তরসাধক। সাধন-ভজনের অভিন্নত্ব, গীতি-উপচারে মাতৃবন্দনার এবং আত্মবিদনের একাগ্রতায় রামপ্রসাদের উত্তরসূরি হিসেবে কমলাকান্তের নাম স্মরণীয়। এই স্মরণীয় কবিপ্রতিভার জন্ম বর্ধমান জেলার অন্তর্গত অম্বিকা কালনা গ্রামে। ১২১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি বর্ধমানরাজ তেজশচন্দ্র বাহাদুরের সভাপণ্ডিতের পদ প্রাপ্ত হন এবং বর্ধমানে বসবাস করতে শুরু করেন। সাধক ও পণ্ডিত কমলাকাস্ত আপন কবিপ্রতিভার সামর্থ্যে বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

কবিরূপে কমলাকান্তের কাব্যপ্রতিভা চমকপ্রদ না হলেও মাতৃসাধনার যে ব্যাকুলতা তার কণ্ঠে সুর হয়ে উঠেছে, সঙ্গীতে পল্লবিত হয়ে সাধারণের হৃদয়ার্তিতে পরিণত হয়েছে তার কাব্যমূল্য

নিতান্ত অকিঞ্চিতকর নয়। কমলাকান্তের কবিপ্রতিভা উৎকর্ষের শিখরদেশ স্পর্শ করেছে তার রচিত আগমনী ও বিজয়ার পদে। অধ্যাপক জাহবীকুমার চক্রবর্তী কমলাকাস্ত রচিত ‘আগমনী-বিজয়া” পদের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বলেছেন— “রামপ্রসাদে যে আগমনী গানের সূচনা, কমলাকান্তে তাহার পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ বিস্তার। মাতা, পিতা, কন্যা ও স্বামীর মনস্তত্ত্ব উদঘাটনে কমলাকান্ত নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়াছেন। কমলাকান্তের আগমনী গান ভরা-ভাদরের নদীর মতো বেগবতী-উচ্ছল, উদ্বেল; তাহার বিজয়া সঙ্গীত বিজয়ার সানাই-এর মত করুণ ও মর্মস্পর্শী।” সম্ভবত অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্বে আগমনী বিজরাকে বিষয়বস্তু রূপে গ্রহণ করে কোন গীতিকাব্যের ধারা বাংলা দেশে প্রচলিত ছিল না। রামপ্রসাদই প্রথম এবং প্রায় সমসময়ে কমলাকান্ত অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বাঙালির পারিবারিক উৎসবের এই করুণ মধুর পরিবেশটিকে পৌরাণিক স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে লৌকিক জীবনের আনন্দ-বেদনায় স্থাপিত করলেন।

দৃশ্যকাব্যের যে আঙ্গিক আগমনী-বিজয়া পদের বৈশিষ্ট্য কমলাকান্তের রচনায় তা লক্ষগোচর। পরগৃহ-নির্বাসিতা কন্যাকে স্বপ্নে দেখে কন্যার দর্শনাকাঙ্ক্ষায় মায়ের উদ্বেগ-ব্যাকুল চিত্তের উপস্থাপনায় যে লীলানাট্যের সূচনা, তার সমাপ্তি ঘটেছে কন্যার আগমনের পর তার বিষণ্ন বিদায়কালে মাতার অব্যক্ত অশ্ররুদ্ধ আশীর্বাদে। মাতার স্বপ্রদর্শন থেকে শুরু করে বিদায়ের লগ্ন পর্যস্ত কমলাকাত্ত রচিত প্রতিটি পদ নাটকীয়তায় সমৃদ্ধ, গীতরসে নিষিক্ত, বাৎসল্যের মানবিক আবেদন সমৃদ্ধ। আগমনী পর্যায়ের প্রথম দুটি পদে মেনকা স্বপ্নদর্শনের বৃত্তাস্ত হিমালয়কে জানিয়েছেন।

আগমনী পর্যায়ের প্রথম দুটি পদেই কন্যা উমার জন্যে মেনকার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পরিচয় এবং বৈষ্ণব পদাবলীর রাধা ও শচীর স্বপ্নদর্শনের প্রভাব আছে। শচীমাতা ও রাধার স্বপ্নদর্শনের পদে ভষ্টস্বপ্নের অপূর্ণ বেদনা পুনর্মিলন বা পুনর্দশনের যে গভীর অপ্রতিরোধনীয় তৃষ্ণা জাগ্রত করে তারই রেশটুকু সংগ্রহ করে কবি মেনকার স্বপ্নদর্শন ও স্বপ্নভঙ্গে কন্যা নিরীক্ষণের গাঢ়তম প্রার্থনায় রূপান্তরিত করেছেন। কমলাকান্তের ‘আমি কি হেরিলাম’ পদটিতে গৌরীর মানবিক এনং ঈশ্বরী রূপের মধুর সমন্বয় ঘটেছে—

আমি কি হেরিলাম নিশি স্বপ্নে।

গিরিরাজ! অচেতনে কত না ঘুমাও হে।

এই এখুনি শিয়রে ছিল গৌরী আমার কোথা গেল হে।

আধ-আধ মা বলিয়ে বিধু-বদনে।।

বিতরে অমৃতরাশি সুললিত বচনে।

অচেতনে পেয়ে নিধি চেতনে হারালাম গিরি হে।

ধৈরজ না ধরে মম জীবনে।।

পরমানন্দদায়িনী জগন্মাতা যে আতুর সন্তানের জাগ্রত অস্তিত্বে অপ্রাপণীয়া, এই সত্য জানেন বলেই সেই অসম্ভব ব্যাপারকে বিপন্ন মাতৃত্বের বিহ্বল স্বপ্নে স্থানান্তরিত করেছেন। স্বপ্ন কেবল স্মৃতিভাণ্ডার উদ্‌ঘাটিত করে সঞ্চিত স্বপ্ন-দর্শন মাত্র নয়, উদ্বিগ্ন জননীর কাছে স্বপ্ন রূপান্তরিত বাস্তব তাই স্নেহকাতরা জননী আধ-আধভাষিণী দর্শনচপলা উমার মুখাবয়বে অভিমান আবিষ্কার করে কন্যার পারিবারিক গোলযোগের সম্ভাব্য সূত্রগুলির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে হিমালয়কে কৈলাসে যেতে অনুরোধ করে বলেছেন—

করে যাবে বল গিরিরাজ গৌরীরে আনিতে

ব্যাকুল হইয়াছে প্রাণ উমারে দেখিতে।

পার্বতী-পরমেশ্বর যে অভিন্ন এই সত্য অবোধ মাতৃ-হৃদয়ে প্রবেশ করবে না, এটা বুঝেই অনিচ্ছাকৃত চরণে হিমালয় কৈলাসের দিকে অগ্রসর হলেন, অবশ্য দেবাদিদেব শঙ্করকে দেখার আনন্দটুকুও হিমালয়ের মনে পুলকের সঞ্চার করেছে। সংশয়াবৃত পিতৃহৃদয়ের দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাবটি দক্ষ শিল্পীর তুলিকায় কমলাকাস্ত ফুটিয়ে তুলেছেন—

গিরিরাজ গমন করিল হরপুরে।

হরিষে বিষাদ প্রমোদ প্রমাণে ক্ষণে দ্রুত ক্ষণে চলে ধীরে।

মনে মনে অনুভব হেরিব শঙ্কর শিব

আজি তন জড়াইব, আনন্দ সমীরে।

পুনরপি ভাবে গিরি, যদি না আনিতে পারি

ঘরে আসি কি কব রাণীরে।

এর পরের পদে উমার মাতাকে দেখার আগ্রহ ব্যক্ত হয়েছে। মানব জননীর স্নেহব্যাকুল বাহুপাশে বন্দিনী হবার আগ্রহে ত্রিভুবনেশ্বরী দেবাদিদেবের কাছে পিতৃগৃহে যাবার অনুমতি ভিক্ষা করেছেন। কমলাকান্ত অত্যন্ত নিপুণতায় উমার এই মনোভাবটি ব্যক্ত করেছেন—

গঙ্গাধর হে, শিবশঙ্কর অনুমতি হর,

যাইতে জনক-ভবনে।

ক্ষণে ক্ষণে মম মন, হইতেছে উচাটন, ধারা বহে তিন নয়নে,

বিশেষ জননী আসি আমার শিয়রে বসি

এর পরে কয়েকটি পদে বর্ণিত হয়েছে মাতার অধীর প্রতীক্ষা ও কন্যাবরণের লৌকিক আয়োজন। পথশ্রমে ক্লান্ত কন্যার আগমন সংবাদে মেনকা অসংলগ্ন বেশবাসে বেরিয়ে এসেছেন। আর—

আঙ্গিনার বাহিরে হেরিয়ে গৌরীরে

দ্রুত কোলে নিল রাণী

অমিয়া বরষি উমা মুখশশী চুম্বয়ে যেন চকোরিণী।

বাৎসল্য ও স্নেহবুভুক্ষার এই অপরূপ লীলা কমলাকান্তের লেখনীতে অপরূপ মাধুর্যে অঙ্কিত। ‘জগতজননী তোমার নন্দিনী’— এই লীলা বিমোহনের গীতি আলেখ্যই বাংলার আগমনী সঙ্গীত। এই লীলাবাদী ভক্তিতত্ত্বের মানবায়নে কমলাকান্তের আগমনী পদগুলি বাংলার আগমনী পর্যায়ে সর্বশ্রেষ্ঠ।

আগমনীর পদে কমলাকান্তের কাব্যপ্রতিভার স্ফূরণ হলেও সার্বিকভাবে শাক্ত পদাবলির অন্যান্য পর্যায়ে তিনি যথেষ্ট প্রতিভার পরিচয় দিতে পারেননি। বস্তুত ব্যক্তি-মানসের সঙ্গে সমাজ- মানসের যে ছন্দে মানুষ অসহায় বোধ করে, তার প্রতিরূপ রচনা করার মধ্যেই কবি সার্থক হতে পারেন— রামপ্রসাদে যার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু কমলাকান্তের ব্যক্তি জীবনে এ ধরনের কোন মানস-সঙ্কট না থাকায় অসহায় মানুষের সঙ্কটের চিত্র তার কাব্যে বিশেষ পাওয়া যায় না। শাক্ত পদাবলির তাত্ত্বিক পদগুলিকে তিনি হৃদয়-রসে জারিত করে সর্বজনীন করে তুলতে পারেননি। সেগুলি মূলত প্রথানুসরণে সমাপ্ত হয়েছে। কমলাকান্তের কবিতা লোকায়ত জীবনকে আশ্রয় করে রচিত হয়নি। স্বভাবতই তাঁর তত্ত্বধর্মী কবিতার আবেদনও সীমাবদ্ধ। তাঁর বহু পদে শ্যাম-শ্যামার অদ্বৈত তত্ত্বে বিশ্বাস আছে। কিন্তু এ বিশ্বাস যতটা প্রথাগত ততটা হৃদয়জাত নয়।

তীর্থ পর্যটন বা মন্দির স্পর্শকাতরতাকে কমলাকান্ত রামপ্রসাদের মতই পরিহার করতে চেয়েছেন, কিন্তু রামপ্রসাদ এগুলির পরিবর্তে ভক্তিনম্র চিত্তে মাতৃপদ আকাঙ্ক্ষা করেছেন। কিন্তু কমলাকান্ত শেষপর্যন্ত যোগাচারঘটিত সাধনা এবং তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপকেই তীর্থের বিকল্পে স্থাপন করেছেন। এইসমস্ত পদে কমলাকান্ত তাঁর সাধকসত্তাকে বিসর্জন দিতে পারেননি। অবশ্য কমলাকান্ত শিল্পী হিসেবে যথেষ্ট উচ্চ আসন দাবি করতে পারেন। অধ্যাপক জাহবীকুমার চক্রবর্তীর মতে— “শিল্পীর সৌন্দর্যবোধ, সুনির্বাচিত শব্দের প্রতি অনুরাগ, এবং শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কারের বিচিত্র কারুকার্য কমলাকান্তের এই পদাবলীকে গাঢ়বন্ধ, ভাবগূঢ় গীতিকবিতার সৌন্দর্য ও মাধূর্যে পূর্ণ করিয়া তুলিয়াছে। এইখানেই শান্ত কবি কমলাকান্ত ও বৈষ্ণব মহাজন গোবিন্দদাস কবিরাজ সমধর্মী। উভয়েই ভক্ত অথচ সচেতন রূপদক্ষ শিল্পী।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!