কমেডি রচনায় শেক্সপীয়ারের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
শেক্সপীয়ার (১৫৬৪-১৬১৬)
১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর বাংলায় শেক্সপীয়ার চর্চার যে সূচনা হয়েছিল তারই ধারাবাহিকতায় বাঙালীর প্রতিষ্ঠিত প্রথম রঙ্গশালা প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের হিন্দু থিয়েটারে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে শেক্সপীয়ারের ‘জুলিয়াস সীজার’ নাটকের অভিনয় হয়েছিল।
উনিশ শতকের নাট্যচর্চায় শেক্সপীয়ার ছিলেন প্রধান নাটাপ্রেরণাস্বরূপ। গিরিশচন্দ্র ঘোষ ‘ম্যাকবেথ’ এবং দেবেন্দ্রনাথ বসু ‘ওথেলো’ অনুবাদ করেছিলেন। এইসব অনুবাদ নাটক ও বাংলা নট্যশালার উন্মেষপর্বে শেক্সপীয়ারের মূল নাটকগুলির উপাদান তারই অকাট্য প্রমাণ। যোগেশচন্দ্র গুপ্তের ‘কীর্তিবিলাস’ নাটকে শেক্সপীয়ারের হ্যামলেট নাটকের প্রভাব লক্ষ করা যায়।
বাংলা ভাষায় প্রথম সার্থক নাট্যকার মধুসূদনের উপর শেক্সপীয়ারের প্রভাব অনেকখানি। পদ্মাবতী নাটকের আঙ্গিকে শেক্সপীয়রীয় প্রভাব যথেষ্ট। তবে কৃষ্ণকুমারী নাটকের অন্তর্দ্বন্দ্বে তীব্র ও ট্রাজিক বেদনায় শেক্সপীয়ারের নাটকের সত্তাটি প্রকাশিত। শেক্সপীয়ারের মতোই মধুসূদন রোমান্টিক ট্র্যাজেডি লিখতে চেয়েছিলেন। কৃষ্ণকুমারী নাটকের নায়ক ভীমসিংহের মধ্যে রাজা লিয়ারের উন্মাদনা ও আর্তি লক্ষ করা যায়।
শেক্সপীয়ারের নাটক ও নাট্যরীতি সর্বাধিক প্রভাবিত করেছিল দ্বিজেন্দ্রলালের নাটকগুলিকে। দ্বিজেন্দ্রলালের তারাবাঈ নাটকের সূর্যমল ও তার স্ত্রী তমসা শেক্সপীয়ারের ম্যাকবেথ ও লেডি ম্যাকবেথের মতো রাজ্যলাভের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় তাড়িত। দ্বিজেন্দ্রলালের অপর ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি নাটকের এক অসামান্য সংঘাতজর্জর চরিত্র নূরজাহানের মধ্যে লেডি ম্যাকবেথের প্রতিচ্ছবি লক্ষ করা যায়। ঘটনার তীব্র গতিবেগ, নাট্যোত্কণ্ঠা, চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব, সংলাপ ও পরিস্থিতি নির্মাণে দ্বিজেন্দ্রলাল বাংলা নাট্য সাহিত্যে শেক্সপীয়ারের সার্থকতম উত্তরাধিকারী।
শেক্সপীয়ারের কমেডি
শেক্সপীয়ারের কমেডিতে সুন্দরের আলপনা, যৌবন স্বপ্নের মদির বিকাশ, প্রাণের অপরূপ উজ্জ্বল প্রবাহ, এখানে শেক্সপীয়ারের বাস্তবের মৃত্তিকার উপর কল্পনার রঙীন পু্ষ্পসৃজন করেছেন যা বৈচিত্র্যের রামধনুর সপ্তবর্ণের মতো। তাঁর কমেডির প্রধান উপজীব্য প্রেম। যৌবনের বিচিত্র বেদনা অশ্রু গান হাসিতে এরা পূর্ণ, তার কমেডিতে কল্পনার অজস্র সমারোহ। পরীদেবতারা মানবস্বভাবযুক্ত, নারী পুরুষের কোন ভেদাভেদ নেই, জীবনের সমস্যা হালকা মেঘের মতো স্বচ্ছন্দ প্রবাহমান, চরিত্রগুলির হিউমার স্নিগ্ধ মাধুর্যে দীপ্ত, কমেডিতে নায়িকারই প্রাধান্য—তারা রূপবতী, বুদ্ধিমতী, রসিকা, প্রেমময়ী, দুঃখ সাধনায় তাদের প্রেম দীপ্ত, নিঃসংশয় ও অক্ষয়।’
এ মিড সামার নাইট্স ড্রিম
এই নাটকের কাহিনী বেশ চিত্তাকর্ষক। ডিমিট্রিয়াস ভালোবাসত হেলেনকে অন্যদিকে লাইসেন্ডা ও হার্মিয়া প্রণয়াবদ্ধ। কিন্তু চঞ্চল প্রকৃতির যুবক ডিমিট্রিয়াস হঠাৎ পাগল হয়ে উঠল হার্মিয়াকে পাবার জন্য। লাইসেন্ডা ও হার্নিয়া তখন নির্জন দ্বীপে। তাদের অনুসরণ করল ডিমিট্রিয়াস। ডিটিট্রিয়াসকে অনুসরণ করল হেলেন। সে বধ্যভূমি হল পরীদের আবাসস্থল। পরীদের চেষ্টায় সকলের মোহভঙ্গ হল এবং উভয়ে লাভ করল উভয়ের প্রণয়ীকে। নাটকটির কাব্যময় ভাষা, রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টির দক্ষতা প্রশংসনীয়।
মার্চেন্ট অব ভেনিস
মার্চেন্ট অব ভেনিসে তিনটি প্রেমের কাহিনী গ্রথিত। ব্যাসানিও, পোর্শিয়া, লরেঞ্জো ও জেসিকা এবং গ্রাসিয়ানো ও নেরিমা। ভেনিসের সদাগর অ্যান্টনিওর কাছে ধনী তরুণী পোর্শিয়াকে লাভের জন্য তার বন্ধু ব্যাসানিও কিছু অর্থ সাহায্য নিল। এ্যান্টোনিওর অর্থপিশাচ ইহুদি শাইলকের কাছ থেকে টাকা সুদে নিয়ে ছিল এক শর্তে। এ্যান্টোনিওর জাহাজ হল জলমগ্ন, ব্যাসানিও পেল পোর্শিয়াকে, অন্য দিকে শর্তভঙ্গের অভিযোগ আনল শাইলক। পোর্শিয়ার প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে তার পৈশাচিক উদ্দেশ্য হল ব্যর্থ। শাইলকের কন্যা জেসিকা তার প্রধান প্রেমিকের সঙ্গে চলে গিরেছিল। তাতে শাইলক আরও শাস্তি পেল। তার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হল। মিলনদুলক পরিণতি হলে নাটকটির ট্যাজিক উপকরণ যথেষ্ট। সে যুগের খ্রিস্টানদের ইহুদি বিদ্বেষ শাইলক চরিত্রে পরিস্ফূট। তেমনি ইহুদিদের উপর খ্রিস্টানদের অত্যাচার এবং শাইলকের প্রতিবাদের মাধ্যমে মানবিক মর্যাদার দিকটি পরিস্ফূট হয়েছে।
এ্যাজ ইউ লাইক ইট
নাটকটির মূল ভাব প্রেম। এই নাটকে রোমান্টিকতার শ্রেষ্ঠ বিকাশ, হিংসা দ্বেষে পরিপূর্ণ সমাজ থেকে দূরে আদর্শ শান্তিরাজ্যে কাহিনীর পরিবেশ। নাটকটিতে চারটি প্রেমের কাহিনী। রোজালিন্ড, টাচষ্টোন চরিত্র দুটি অনবদ্য। কেবল রোমান্সের চরম বিকাশে নয়; শিল্পকর্মে, কাহিনীগ্রন্থনে মানবচরিত্রের সার্থক উপলব্ধিজাত প্রকাশে এটি সার্থক সৃষ্টি। বিদূষক টাচস্টোনের চরিত্রটি জীবন্ত। নাটকের গানগুলিও রোমান্সরসে পূর্ণ।
দি টেম্পেস্ট
এই নাটকে ভ্রাতার ষড়যন্ত্রে মিলানের ডিউক প্রসপেরো ও তার কন্যা মিরান্দা নির্বাসিতা হলেন এক নির্জন দ্বীপে। জাদুবিদ্যার সাহায্যে প্রসপেরো ‘এরিয়েল’ নামক আত্মাকে বশীভূত করলেন এবং ক্যালিবানকে দাসত্বে নিযুক্ত করেন। জাদুবিদ্যার বলে একদিন তিনি সমুদ্রে ঝড় তুললেন। তার ভাই ও তার সাহায্যকারী নেপল্স-এর রাজা এবং তার যুবক পুত্র ‘ফার্দিনান্দ’ সেই নির্জন দ্বীপে এলেন। শেষে ফার্দিনান্দের সঙ্গে মিরান্দার প্রণয় ও সব দ্বন্দের মিলনমূলক পরিণতিতে নাটকের সমাপ্তি। এটি নাট্যকারের একমাত্র নাটক যেখানে ধ্রুপদী নাট্যকলার ত্রি-ঐক্যরীতি মেনে চলা হয়েছে।
শেক্সপীয়রীয় কমেডি ও বাংলা নাটক
উনিশ শতকের বাংলা নাট্যচর্চায় শেক্সপীয়ারের কমেডির প্রভাব যথেষ্ট। হরচন্দ্র ঘোষের ‘ভানুমতী চিত্তবিলাস’, (১৮৫৩) এবং ‘চারুমুখ চিত্তহরা’ নাটক দুটি যথাক্রমে ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ এবং ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ নাটকের অনুবাদ। গিরিশচন্দ্রের ‘স্বপ্নের ফুল’, ‘মনের মতন’ নাটক দুটি যথাক্রমে ‘এ মিড সামার নাইটস ড্রিম’ এবং ‘অ্যাস ইউ লাইক ইট’ নাটকের অনুবাদ। রবীন্দ্রনাথের ‘মালিনী’, ‘রাজা ও রাণী’, ‘চিরকুমার সভা’ প্রভৃতি নাটকে চরিত্র চিত্রণ, উপকাহিনি সৃষ্টিতে শেক্সপীয়ারের বিভিন্ন কমেডি নাটকের প্রবাব দুর্লক্ষ্য নয়।
শেক্সপীয়ারের নাট্যশৈলীর বৈশিষ্ট্য
- শেক্সপীয়ারের কাহিনীগ্রন্থন নৈপুণ্য অসাধারণ। তার নাটকের কাহিনী প্রধানত ইতিহাস ও লোককথা থেকে গৃহীত।
- চরিত্রস্রষ্টা হিসাবে শেক্সপীয়ারের প্রধান বিশেষত্ব হল তার ঐকান্তিক নির্লিপ্ততা। মানবচেতনার সুগভীর বিস্তৃতি ও অতলান্ত গভীরতার প্রকাশ তার নাটকগুলিকে শাশ্বত সাহিত্যমূল্যে অভিষিক্ত করেছে।
- শেক্সপীয়ারের নাটকে দুটি কেন্দ্রীয় প্রতীকের কথা বলা হয়েছে। একটি ঝড় অপরটি সংগীত। প্রথমটি ছন্দ এবং দ্বিতীয়টি সামঞ্জস্যের ইঙ্গিতবহ। টি. এস. এলিয়ট তার নাটকে কাব্য, নাটক ও সংগীতের সমন্বয় লক্ষ করেছেন।
- স্থান, কাল ও কার্যসংক্রান্ত ক্লাসিক্যাল নাট্যরীতি প্রায় ক্ষেত্রেই তিনি লঙ্ঘন করেছেন। সমালোচক জনসনের ভাষায় শেক্সপীয়ার নাট্যরচনা করেছেন মানবজীবনের মিশ্রসূত্রে।
- বিভিন্ন শ্রেণির চরিত্র সৃষ্টিতে বিশেষ করে খল চরিত্র সৃষ্টিতে শেক্সপীয়ারের কৃতিত্ব যথেষ্ট। এছাড়া বিদূষক বা ফুল জাতীয় চরিত্রগুলিও অনবদ্য।
- ট্র্যাজেডি নাটকে ছন্দ সৃষ্টিতে শেক্সপীয়ারের কৃতিত্ব স্মরণীয়। এদিক দিয়ে তিনি যথার্থ জীবনশিল্পী। সেজন্য তিনি মানবহাদয়ের বিষ্ময় ও রহস্যকে উন্মোচিত করেছেন।
- শেক্সপীয়ারের নাটকের ভাষাশৈলী, কল্পনার অপরূপ লাবণ্য যে কোনো পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শব্দচয়ন, চিত্রকলা সৃষ্টিতে বিশ্বসাহিত্যে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছেন— “শেক্সপীয়ারে আমরা চিরকালের মানুষ এবং আসল মানুষটিকেই পাই, কেবল মুখের মানুষটি নয়”
তথ্যসূত্র:
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস | Download |
ইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাস – শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় | Download |
ইংরেজি সাহিত্য পরিচয় – অরবিন্দ পোদ্দার | Download |
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস – কুন্তল চট্টোপাধ্যায় | Download |
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিবৃত্ত ও মূল্যায়ন – বিমলকৃষ্ণ সরকার | Download |
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস – অরুণ ভট্টাচার্য | Download |
Leave a Reply