রবীন্দ্রানুসারী কবি হিসেবে করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৃতিত্ব লেখ।
করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়
রবীন্দ্র শিষ্যদের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৭৭-১৯৫৫) কাব্য পটভূমি বাংলাদেশের পল্লী প্রকৃতি এবং ভারতবর্ষের নানা তীর্থক্ষেত্রের অনবদ্য প্রকৃতিভূমি। আত্মমগ্ন রূপমুগ্ধ রোমান্টিক স্বপ্নবিভোর এই কবির কাব্যে বহির্জগতের ঘটনা বিশেষ ছায়াপাত করেনি, বঙ্গভঙ্গ ছাড়া সমকালের উত্তেজনা তাকে বিশেষ স্পর্শ করেনি, এক গভীর আস্তিক্যবোধ ও গভীর মমতা তাঁর সব কবিতায় পরিব্যাপ্ত। বৈষ্ণবীয় ভক্তিরসে তাঁর মন পরিপূর্ণ, দাম্পত্যপ্রেমও তাঁর বহু কবিতার বিষয়। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি হল— ‘বঙ্গমঙ্গল’ (১৯০১) স্বদেশী আন্দোলনের দেশপ্রীতি পর্বের সৃষ্টি। তারপর প্রকাশিত হয় ‘প্রসাদী’ (১৩১১), ‘ঝরাফুল’ ‘১৩১৮), ‘শান্তিজল’ (১৩২০), ‘ধানদূর্বা’ (১৩২৮), ‘রবীন্দ্র-আরতি’ (১৩৪৪) এবং চয়নিকা গ্রন্থ ‘শতনরী’ ১৩৩৭)। তাঁর কবিতা আবেগময়, চিত্র উজ্জ্বল এবং অনায়াস স্বচ্ছন্দ—
হেথায় তা’রা নাইতে নামে
ভাসিয়ে তরী জ্যোৎনা ঘাটে,
লুটায় তাদের বসন-ঝালর
নীরব রাতে উচ্চে বাজে।
ধূসর পাষাণ-সিঁথির তটে—
অকুট চুলের ফুলের বাসে
গন্ধ হারায় গোলাপ বেলা
কে অপ্সরী সারঙ বাজায়
কি অপরূপ সুরের খেলা!
(স্বপ্রলোক)
রবীন্দ্রনাথকে তিনি গুরু বলে মেনেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রকাব্যে প্রতিরোধহীন আত্মবিলোপের উদাহরণ নিশ্চয় করুণানিধানের কবিতা নয়। নিবিড় হৃদয়াবেগের অকৃত্রিম প্রকাশ এবং রোমান্টিক কবিদৃষ্টির জন্য, বেশ কিছু রোমান্টিক অনুভবের জন্য করুণানিধান স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কবি সাময়িক ঘটনার উপর বা জনতার চাহিদা অনুসারে কবিতা লিখতে কখনো উৎসাহ বোধ করেননি। তিনি আত্মমগ্ন রোমান্টিক স্বপ্রবিভোর রূপমুগ্ধ কবি। এ রোমান্টিকতা তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। তাঁর প্রমাণ “রবীন্দ্র-আরতি” কাব্য।
করুণানিধানের প্রকৃতিপ্রেমই তাঁকে কাব্যজগতে স্বাতন্ত্র্য এনে দিয়েছে। তিনি প্রকৃতিকে দেখেছেন নিজের হৃদয়রসে জারিত করে। তাই তাঁর কাব্যে রয়েছে প্রকৃতির অন্তরঙ্গ রূপ। তিনি কাব্যলক্ষ্মীর রূপমুগ্ধ পুজারী। অধীর রূপসৃষ্টির আগ্রহে সদাচঞ্চল কবি আমাদের প্রকৃতির সেই রূপলোকে নিয়ে গেছেন যেখানে ‘নাচিছে দামিনী, মেঘে পাখোয়াজ বাজে’। সেই মেঘলোক থেকে আজ বাংলা কাব্যসংসার অনেক দূরে চলে গেছে। তাঁর ‘বর্ষায়’ কবিতাটিতে প্রকৃতিপ্রীতির দৃষ্টান্তও মেলে—
গ্রামে ঢোকে জল, গাঙে নামে ঢল
আকাশের কোলে কোমল-কাজল
এসেছে বরষা-বড় চঞ্চল বড় দুরন্ত মেয়ে।
সত্যেন্দ্রনাথের মতো কল্পনাশক্তি তাঁর কবিস্বভাবকে খেয়ালী ও অবাস্তব সৌন্দর্যের প্রতি অনুরাগী করে তুলেছিল ঠিকই এবং তাঁর অনুভূতিও ছিল প্রগাঢ়, কিন্তু তুলনায় তাঁর কাব্যের শিল্পসার্থকতা সত্যেন্দ্রনাথের সমপর্যায়ের নয়।
Leave a Reply