কলাবৃত্ত ছন্দ কাকে বলে? এর বৈশিষ্ট্যগুলি উদাহরণসহ আলোচনা কর।
মাত্রাবৃত্ত বা কলাবৃত্ত ছন্দ
যে ছন্দে মূল পর্ব চার, পাঁচ, ছয় বা সাত মাত্রার হয়, লয় হয় মধ্যম, নির্দিষ্ট ধ্বনি ঝংকার থাকে, এবং রুদ্ধদল মাত্রই দুমাত্রার হয় তাকে মাত্রাবৃত্ত বা কলাবৃত্ত বা কলামাত্রা বা ধ্বনি প্রধান বা বিস্তার প্রধান ছন্দ বলা হয়।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দের নামবৈচিত্র্য
এই ছন্দের প্রকৃতি অনুযায়ী নামকরণে ভিন্ন মত দেখা যায়। প্রচলিত মত হল মাত্রা সংখ্যাগত বলেই এই ছন্দ মাত্রাবৃত্ত। প্রবোধচন্দ্র সেন এই নামটি প্রথমত, সমর্থন করেও মন্তব্য করেছেন সব ছন্দেই মাত্রা সংখ্যার গুরুত্ব আছে, অতএব ‘মাত্রাবৃত্ত’ নামের আলাদা তাৎপর্য কিছু নেই। তিনি দেখিয়েছেন সংস্কৃত ও প্রাকৃতে ধ্বনি পরিমাণকে ‘কলা’ বলা হয়েছে; এই ‘কলা’-ই এ জাতীয় ছন্দের Unit বা মাত্রা; তাই এই ছন্দকে কলামাত্রা বা কলাবৃত্ত বলাই উচিত। তিনি একে সরল কলামাত্রিক ছন্দও বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ একে ‘সংস্কৃত ভাঙা’ ছন্দ বলেছেন। অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় এই ছন্দে অক্ষরের উচ্চারণগত ধ্বনি-পরিমাণের প্রাধান্য দেখিয়ে নাম দিয়েছেন ধ্বনি প্রধান ছন্দ। আবার প্রচলিত মত হল—যেমন অক্ষরবৃত্ত, বা মিশ্রকলাবৃত্তে অক্ষর সমতা, এবং স্বরবৃত্ত/দলবৃত্তে স্বর-সমতা বিচার করে ছন্দ প্রকৃতি স্থির হয়, ঠিক তেমনি এই ছন্দে প্রধানত মাত্রা সংখ্যা গণনা করেই প্রকৃতি নির্ধারণ হয়, তাই মাত্রাবৃত্ত নামকরণ যথার্থ। তারাপদ ভট্টাচার্য মাত্রাবৃত্ত নামটিকে যুক্তিযুক্ত বলেছেন, কলাবৃত্ত নামটিও তিনি গ্রহণ করেছেন। এ ছাড়া সত্যেন্দ্রনাথ একে গঙ্গা-যমুনা ও হৃদ্যা ছন্দ নামেও অভিহিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ছন্দটিকে ‘নূতন’ ছন্দ ও ‘সাধু’ ছন্দ নামে অভিহিত করেছেন।
কলাবৃত্ত বা মাত্রাবৃত্তের বৈশিষ্ট্য
কলাবৃত্ত/মাত্রাবৃত্তের বৈশিষ্ট্যগুলিকে সূত্রাকারে লিপিবদ্ধ করা যেতে পারে। যেমন—
- মূল পর্ব চার, পাঁচ, ছয় বা সাত মাত্রার হয়।
চার মাত্রার পর্ব
ছিপ খান । তিন দাঁড় । তিন জন । মাল্লা ৪+৪+৪+৩
চৌপর । দিনভর । দ্যায় দুর । পাল্লা। ৪+৪+৪+৩
পাঁচ মাত্রার পর্ব
সাগর জলে । সিনান করি । সজল এলো । চুলে ৫+৫+৫+৩
বসিয়াছিলে । সজল উপ । কূলে। ৫+৫+২
ছয় মাত্রার পর্ব
রাত নির্জন । পথে কত ভয় । তবুও রানার । ছোটে ৬+৬+৬+২
দস্যুর ভয় । তারো চেয়ে ভয় । কখন সূর্য। ওঠে। ৬+৬+৬+২
সাত মাত্রার পর্ব
ধ্বনিল আহ্বান । মধুর গম্ভীর । প্রভাত অম্বর । মাঝে ৭+৭+৭+২
দিকে দিগন্তরে । ভুবন মন্দিরে । শান্তি সংগীত । বাজে। ৭+৭+৭+২
- রুদ্ধদল মাত্রই দুমাত্রা হয়, তবে অপ্রসারিত উচ্চারণে একমাত্রিক হয়।
- মুক্তদল সর্বত্র একমাত্রা। তবে প্রসারিত হলে দ্বিমাত্রিক হয়।
- হলন্ত বা যৌগিক স্বরান্ত বা যৌগিক স্বরসর্বস্ব অক্ষর যেখানেই থাকুক না কেন, তা দ্বিমাত্রিক হবে।
ঐ আসে ঐ । অতি ভৈরব । হরষে।।
জল সিঞ্চিত । ক্ষিতিসৌরভ । রভসে।।
ঘন গৌরবে । নব যৌবনা । বরষা
শ্যাম গম্ভীর । সরসা।
- যুক্ত ব্যঞ্জন বিশ্লিষ্ট হয়ে পূর্ববর্তী অক্ষর/দলকে দীর্ঘ ও দ্বিমাত্রিক করে।
কলিকাতা । শোনে নাকো । চলার খে । য়ালে।।
নৃত্যের । নেশা তার । স্তম্ভে দে । য়ালে।।
- লয় হয় মধ্যম।
- শব্দ ধ্বনির অতিরিক্ত ধ্বনি থাকে না।
- কখনো কখনো একাক্ষর মুক্তদল শব্দ পূর্ববর্তী বা পরবর্তী শব্দের সহযোগে উচ্চারিত না হয়ে বিশ্লিষ্টভাবে উচ্চারিত হলে তা সম্প্রসারিত হয় ও দ্বিমাত্রা হয়।
গোলাপ ফুল/ফুটিয়ে আছে/মধুপ হোথা/যাস নে।
ফুলের মধু/লুটিতে গিয়ে/কাঁটার ঘা/খাস নে।
এই ‘ঘা’-দ্বিমাত্রা হয়েছে। একাক্ষর মুক্তদলটি অন্য নিরপেক্ষ ভাবে উচ্চারিত হয়েছে।
- পর্বগুলি জোড় ও বিজোড় মাত্রা সংখ্যার হয়ে থাকে—৪, ৫, ৬, ৭, ৮ মাত্রার পর্ব।
একদা তুমি । অঙ্গ ধরি । ফিরিতে নব । ভুবনে ৫+৫+৫+৩
মরি মরি । অনঙ্গ দে । বতা। ৪+৫+২
কুসুম রথে । মকরকেতু । উড়িত নব । পবনে, ৫+৫+৫+৩
পথিক বধূ । চরণে প্র । ণতা। ৫+৫+২
- কখনো কখনো শ্বাসাঘাত পড়ে, পর্বের প্রথম অক্ষরে/দলে।
দুর্গম গিরি । কান্তার মরু । দুস্তর পারা । বার।
লঙ্ঘিতে হবে । রাত্রি নিশীথে। যাত্রীরা সাব । ধান।
- অতিপর্ব ও অপূর্ণপদী পর্ব থাকতে পারে।
- অন্তঃস্থ ‘ব’— ধ্বনি প্রচ্ছন্ন ‘ওয়’, রূপে ব্যবহৃত হয় এবং প্রয়োজনানুসারে সংকুচিত হয়। পাওয়া, যাওয়া,-এর উচ্চারণ পা-ওরা, যা-ওয়া।
- ঐ, ঔ ছাড়া যৌগিক স্বরধ্বনির (আই, ওয়া, ইয়ে, ইয়া ইত্যাদি) মাত্র বৈচিত্র্য দেখা যায়।
- মাত্রাবৃত্ত দুপ্রকার— প্রত্ন বা প্রাচীন এবং নব্য বা আধুনিক।
Leave a Reply