কাব্যনির্মাণ কৌশলের তিনটি ভাগ: বিভাব, অনুভাব ও সঞ্চারী— লেখ।
বিভাবানুভাবব্যভিচারিসংযোগাদ রসনিম্পত্তি
কবিরা যে কাব্যের জগৎ সৃষ্টি করেন তা মায়ার জগৎ বলেই মনে হয়। এই মায়ার জগৎ কীভাবে সৃষ্টি হল তা জানতে পাঠকের মনে কৌতূহল জাগে। কাব্যে যে মায়ার জগৎ সৃষ্টি হয় তা মূলত অলৌকিক জগৎ। দৈনন্দিন বস্তু জগতে যা দেখা যায় না তাই অলৌকিক। লৌকিক বা ব্যবহারিক জগতে মানুষ কষ্ট পায়, আনন্দ উপলব্ধি করে। এই আনন্দ ও কষ্ট লৌকিক কারণে হয় বলে মানুষের মনে তা লৌকিক ভাবের জন্ম দেয়। সে ভাবগুলি সুখ ও দুঃখ রূপেই অভিহিত। কিন্তু এই লৌকিক ভাব কাব্যের জগতে এক অলৌকিক রূপ লাভ করে। পাঠকের মনে যে লৌকিক ভাব আছে তা অলৌকিক রূপে ‘রসে’ পরিণত হয়। এ প্রসঙ্গে আচার্য ভরত ‘নাট্যশাস্ত্র’ গ্রন্থে বলেছেন— ‘‘বিভানুভাবব্যাভিচারী সংযোগাদ্রসরসনিষ্পত্তিঃ’’। অর্থাৎ বিভাব, অনুভাব ও সঞ্চারী বা ব্যাভিচারী ভাবের সংযোগে রস নিষ্পত্তি হয়। এই তত্ত্বকে সামনে রেখে আলংকারিকরা বললেন কাব্য নির্মাণ কৌশলের তিনটি ভাগ-বিভাব, অনুভাব ও সঞ্চারী বা ব্যাভিচারী ভাব।
বিভাব
বিশ্বনাথ কবিরাজ তাঁর ‘সাহিত্যদর্পণ’ গ্রন্থে বিভাব-এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন—
রত্যাদ্যুদ্বোধকা লোকে
বিভাবাঃ কাব্যনাট্যয়োঃ।
অর্থাৎ লৌকিক জগতে যা রতি প্রভৃতি ভাবের উদ্বোধক, কাব্যে বা নাটকে তাকেই বিভাব বলে। যেমন শাজাহানের প্রেমের প্রতীক হল তাজমহল। সাধারণ প্রেমিকের মনে তাজমহল রতিভাব সঞ্চার করে। কিন্তু কবিরা যখন তাজমহলকে কাব্যে রূপান্তরিত করেন তখন ভাব পরিণত হয় বিভাবে।
বিভাব দুই প্রকার—
আলম্বন বিভাব
যে বস্তু বা বিষয়কে অবলম্বন করে রসের সৃষ্টি হয় তাকে আলম্বন বিভাব বলে। যেমন—
কঙ্কা তোমার স্বপ্ন দেখি,
কঙ্কা তোমার স্বপ্ন দেখি;
রাত্রির মতো তোমার চুল
হৃদয়ে তাহার স্বপ্ন দেখি।
(কঙ্কাবতী/বুদ্ধদেব বসু)
এখানে কঙ্কা নামক নারীকে কেন্দ্র করে কবির হৃদয়ে স্থায়ী রতি ভাবের সৃষ্টি হয়েছে। আর সেই রতি ভাব কাব্যের জগতে শৃঙ্গার রসের প্রকাশ ঘটিয়েছে।
উদ্দীপন বিভাব
যে সমস্ত বিষয় রসকে উদ্দীপক করে বা রস সৃষ্টিতে সহায়তা করে সেই সমস্ত বিষয়কে উদ্দীপন বিভাব বলে। যেমন—
এলাইয়া বেণী ফুলের গাঁথনি
দেখয়ে খসায়ে চুলি।
হসিত বয়ানে চাহে মেঘপানে
কি কহে দু হাত তুলি।।
একদিক করি ময়ূর ময়ূরী
কণ্ঠ করে নিরীক্ষণে।।
(পূর্বরাগ/চণ্ডীদাস)
এখানে রাধা শ্রীকৃষ্ণের রূপে আত্মহারা। শ্রীকৃষ্ণের অঙ্গশোভা প্রাণ ভরে দেখার জন্য রাধা মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কৃষ্ণ কুন্তলেই শ্রীকৃষ্ণের দেহ লক্ষ করেন, ভাব উন্মাদিনী হয়ে মেঘকে কৃষ্ণ ভেবে দুহাত তুলে অন্তরের গোপন গভীর কথা প্রিয়তমকে বলতে চেষ্টা করেন। শ্রীকৃষ্ণের মস্তকে থাকে ময়ূর পুচ্ছ, তাই রাধা ময়ূর ময়ূরীর কণ্ঠ নিরীক্ষণ করে কৃষ্ণরূপ দেখতে আগ্রহী। এখানে রাধার হৃদয়ে রতি ভাবের উদ্দীপক হিসাবে বেণী, মেঘ, ময়ূর-ময়ূরীর কণ্ঠ বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে এবং শৃঙ্গার রস সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে। তাই বেণী, মেঘ, ময়ূর-ময়ূরীর কণ্ঠ উদ্দীপন বিভাবের উদাহরণ।
অনুভাব
বিশ্বনাথ কবিরাজ তাঁর ‘সাহিত্যদর্পণ’ গ্রন্থে অনুভাবের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন—
উদ্বুদ্ধং কারণৈঃ স্বৈ স্বৈ-
বহির্ভাবং প্রকাশয়ন্
লোকে যঃ কার্যরূপ সোহ-
অনুভাবঃ কাব্যনাট্যয়োঃ।।
অর্থাৎ মনের মধ্যে ভাব উদ্বুদ্ধ হলে, যে-সব স্বাভাবিক বিকার ও উপায়ে তা বাইরে প্রকাশ করা হয়, ভাবরূপ কারণের সেই-সব লৌকিক কার্য্য কাব্য ও নাটকের অনুভাব। বিভাব সমূহের অন্তর্গত ভাবকে যারা অনুভবযোগ্য করে তোলে তারাই অনুভাব। এ-প্রসঙ্গে অতুলগুপ্ত গুপ্ত রবীন্দ্র-কাব্যের একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন—
দ্বিধায় জড়িত পদে কম্প্রবক্ষে নম্র নেত্রপাতে
স্মিতহাস্যে নাহি চল সলজ্জিত বাসরশয্যাতে
স্তব্ধ অর্ধরাতে।
মিলনের ভাব প্রকাশ করতে এখানেও দ্বিধায় জড়িত পদ, কম্প্র বক্ষ, নম্র নেত্রপাত, স্মিত হাস্য প্রভৃতি অনুভাবের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।
কাব্য-নাটক সৃষ্টিতে বিভাবের মতো অনুভাবও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বিভাব ও অনুভাবের সংমিশ্রণেই কাব্যের বিশেষ ভাবনা নির্বিশেষ ভাবনায় পরিণত হয়। ইংরেজি সাহিত্যে একে বলে Universal Ideal Content.
অনুভাবের কয়েকটি শ্রেণিভেদ লক্ষ করা যায়—
বাচিক অনুভাব
শুধু মুখের কথায় যখন মনের ভাব প্রকাশিত হয়, তখন তাকে বাচিক অনুভাব বলে। যেমন—
দেবযানীঃ কৃতজ্ঞতা! ভুলে যেয়ো, কোনো দুঃখ নাই।
উপকার যা করেছি হয়ে যাক ছাই। (রবীন্দ্রনাথ)
আঙ্গিক অনুভাব
অঙ্গ প্রত্যঙ্গের নানা ভঙ্গিতে যখন ভাব প্রকাশ করা যায়, তখন তাকে আঙ্গিক অনুভাব বলে। যেমন—
মোর হস্তে হস্ত রাখি
নীরবে শুধালো শুধু সকরুণ আঁখি,
হে বন্ধু, আছ তো ভালো!
(রবীন্দ্রনাথ)
সাত্ত্বিক অনুভাব
স্তম্ভ, স্বেদ, রোমাঞ্চ, স্বরভেদ, বেপথু, বৈবর্ণ, অশ্রু এবং প্রলয়— এই আট রকম সাত্ত্বিকের কোনো কোনোটির প্রকাশে যখন ভাব প্রকাশ করা হয়, তখন সাত্ত্বিক অনুভাব হয়। যেমন—
ছল ছল নয়ন কমল সুবিলাস।
নব নব ভাব করত পরকাশ।।
(রাধামোহন)
বেশভূষা অনুভাব
বেশভূষায় নানা ভঙ্গিতে যখন ভাব প্রকাশ করা হয় তখন তাকে বেশভূষা অনুভাব বলে। যেমন—
এলাইয়া বেণী ফুলের গাঁথনি
দেখয়ে খসায়ে চুলি।
হসিত বয়ানে চাহে মেঘ পানে
কি কহে দু হাত তুলি।।
(চণ্ডীদাস)
স্থায়ীভাব
বাসনাশূন্য হয়ে মানুষ কখনো পৃথিবীতে জন্মলাভ করে না। মানুষের কিছু কিছু বাসনা বা প্রবৃত্তি হল সহজাত। যতদিন রক্তমাংসের মানুষ পৃথিবীতে থাকবে, ততদিন তার বাসনা থাকবে। তাই দীর্ঘকালের অভিব্যক্তি বশে যে সমস্ত বাসনা মানুষের মনের মধ্যে দৃঢ়মূল হয়ে গেছে তা বৃদ্ধ থেকে শিশুতে, এক যুগ থেকে আর এক যুগে সঞ্চারিত হবেই। এই বাসনার কোনো শেষ নেই।
মানুষের মনোজগৎ এরকম শত শত বাসনার দ্বারা প্রতি নিয়ত আন্দোলিত হচ্ছে। এই বাসনা বা প্রবৃত্তিগুলিকে সাহিত্যমীমাংসকগণ দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন স্থায়ী ও সঞ্চারী। আমাদের চিত্তে অনন্ত ভাবরাজির মধ্যে যেগুলি সর্বদাই গৃঢ়ভাবে বর্তমান রয়েছে সেগুলি হল স্থায়ীভাব। ভাবরূপ বহু চিত্তবৃত্তি বা বাসনার মধ্যে এইভাবগুলি বহুলরূপে প্রতীয়মান হয় বলেই এগুলি স্থায়ী।
আলংকারিকগণ তাঁদের কাজের সুবিধার জন্যে এরকম নয়টি ভাবকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এগুলি হল—রতি, হাস্, শোক, ক্রোধ, উৎসাহ, ভয়, জুগুপ্সা, বিস্ময় ও শম। অভিনবগুপ্ত এই নয়টি ভাবকেই মাত্র স্থায়ী বলেছেন, কেননা প্রাণী জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গেই এই কয়টি বাসনার দ্বারা ব্যাপ্ত হয়ে থাকে। এইসকল চিত্তবৃত্তি বিরহিত হয়ে কোনো প্রাণী জন্ম নিতে পারে না।
তাই সকলেই জন্ম লাভের সঙ্গে সঙ্গে দুঃখের প্রতি বিদ্বেষ-ভাবাপন্ন হয় ও সুখের জন্য লালায়িত হয়। ঈপ্সিত বস্তুর বিয়োগে মানবচিত্তের শোকাকুল স্বভাব কিংবা ভীষণ বস্তু দর্শনে ভয়াকুল হওয়া শিশু থেকে বৃদ্ধ সকল মানুষের জীবনে স্বাভাবিক ঘটনা। আলংকারিকেরা যে নয়টি স্থায়ীভাবের কথা বলেছেন তাদের কখনো সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা যায় না। তারা চিরন্তন, অক্ষয় ও অব্যয়।
এদের উদয় এবং বিলয় কোনোটাই নেই। বিশ্বনাথ কবিরাজ এই ভাবগুলিকে আস্বাদরূপ অঙ্কুরের মূল বলে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ এগুলিরই একমাত্র রস-পরিণতি ঘটে। এরা আস্বাদরূপ অঙ্কুরের মূল বলেই স্থায়ী। স্থায়ীভাব থেকে যে সমস্ত রসের সৃষ্টি হয় সেগুলি হল যথাক্রমে শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস, অদ্ভুত ও শান্ত।
ব্যাভিচারী বা সঞ্চারী ভাব
বি (বিশেষ) অভি (স্থায়ীর অভিমুখে) চর (চরণ করে) অর্থাৎ যে-সমস্ত ভাব স্থায়ী ভাবের অভিমুখে বিশেষভাবে বিচরণ করে তাদেরকেই ব্যাভিচারী বা সঞ্চারী ভাব বলে। মানব জীবনের স্থায়ী ভাবকে পরিস্ফূট করার জন্য ব্যাভিচারী বা সঞ্চারী ভাব সহায়ক ভাব হিসাবে কাজ করে। মানব জীবনে নয়টি স্থায়ী ভাব ব্যতীত আরও অসংখ্য ভাবের উদয় ঘটে। কিন্তু এগুলি স্থায়ী নয়। এগুলি উদ্ভূত হয় এবং তিরোহিত হয়। তাই আচার্য ভরত সঞ্চারী ভাবকে সমুদ্রের তরঙ্গ বলে অভিহিত করেছেন। তরঙ্গ যেমন সমুদ্রে উত্থিত হয়ে সমুদ্রেই বিলীন হয়ে যায় তেমনি ব্যাভিচারী ভাব স্থায়ী ভাব থেকে সৃষ্ট হয়ে সেখানেই বিলীন হয়ে যায়।
আলংকারিকগণ নির্বেদ, লজ্জা, হর্ষ, অসূয়া, বিষাদ এরকম তেত্রিশটি ভাবের কথা বললেও সুধীরকুমার দাশগুপ্ত দয়া, উপেক্ষা, করুণা, ক্ষমা, প্রীতি ইত্যাদি আরও তেত্রিশটি সঞ্চারী ভাবের কথা বলেছেন। প্রকৃতপক্ষে সঞ্চারী ভাবের কোনো অন্ত নেই। কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাভিচারী ভাবের নিত্য নতুন রূপ দেখা যায়। কিছু বিলুপ্ত হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও মূল ভাবের রসপুষ্টির সহায়ক হিসাবে ব্যাভিচারী ভাবের গুরুত্ব অপরিসীম।
বিভাব, অনুভাব ও সঞ্চারী ভাবের মধ্যে অভিনব গুপ্ত বিভাব ও অনুভাবকে বলেছেন— ‘সকল হৃদয়ে সম-বাদী।’ কারণ যে লৌকিক ভাবের তারা রসমূর্তি, সে লৌকিক ভাব ব্যক্তির হৃদয়ে আবদ্ধ, তা সামাজিক নয়। কবি যখন কাব্যের ভাবকে রসে রূপান্তরিত করে, তখন তা লৌকিক থেকে অলৌকিক হয়ে ওঠে। কাব্যের এই রসপুষ্টিতে সঞ্চারী ভাব পরিপোষক হিসাবে কাজ করে। তাই বিশ্বনাথ কবিরাজ ‘সাহিত্যদর্পণ’ গ্রন্থে বলেছেন—
বিভাবেনানুভাবেন
ব্যক্তঃসঞ্চারিণা তথা।
রসতামেতি রত্যাদিঃ
স্থায়ী ভাবঃ সচেতসাম্।।
অর্থাৎ চিত্তের রতি প্রভৃতি স্থায়ীভাব, (কাব্যের) বিভাব, অনুভাব ও সঞ্চারীর সংযোগে, রূপান্তর প্রাপ্ত হয়ে, রসে পরিণত হয়। তাই বলা যায় কবিরা মায়ার জগৎ সৃষ্টি করতে বা কাব্যনির্মাণ করতে যে কৌশল অবলম্বন করে তার প্রধান ভিত্তি বা অবলম্বন হল— বিভাব, অনুভাব এবং সঞ্চারী ভাব।
তথ্যসূত্র:
১. কাব্যজিজ্ঞাসা: অতুলচন্দ্র গুপ্ত
২. কাব্যালোক: সুধীরকুমার দাশগুপ্ত
৩. ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব: অবন্তীকুমার সান্যাল
Leave a Reply