//
//

লোকের যেমন বুদ্ধির তারতম্য আছে, তেমনি ভাবুকতায় তারতম্য আছে।

  • সকলে তত্ত্ব বুঝিতে পারে না, সকলে সকল ভাবও বুঝিতে পারে না। ইহাতে প্রমাণ হয়, লোকের যেমন বুদ্ধির তারতম্য আছে তেমনি ভাবুকতারও আছে। ‘কাব্য: স্পষ্ট ও অস্পষ্ট’ প্রবন্ধ অবলম্বনে মন্তব্যটি পর্যালোচনা কর।

১২৯৩ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ সংখ্যায় ‘নবজীবন’ পত্রিকায় অক্ষয়চন্দ্র সরকার কবির ‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যগ্রন্থের সমালোচনায় লিখলেন—‘‘কল্পনা কি ছায়াময়ী? আমি তো বলি, কল্পনা সুস্পষ্ট অবয়ব, সুদৃষ্ট ভঙ্গিমতী এবং উজ্জ্বল বর্ণা। কল্পনার প্রিয় সহচরী কবিতাও তো ছায়াময়ী নহে, তবে আমরা এরূপ কুয়াশার কুহেলিকায়, নিরাশার প্রহেলিকায় বঙ্গসাহিত্য গো-ধুলি গোধুলি করিবার চেষ্টা করিতেছি কেন?’’ নবজীবনের এই সমালোচনা পড়েই রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ‘কাব্য: স্পষ্ট ও অস্পষ্ট’ নামক আলোচ্য প্রবন্ধটি। কবি লিখলেন— ‘‘লোকের যেমন বুদ্ধির তারতম্য আছে, তেমনি ভাবুকতায় তারতম্য আছে।’’ কিন্তু একথা স্বীকার না করেই অধিকাংশ মানুষ অনুভূতিবেদ্য সাহিত্য বুঝতে অক্ষম হলে কৈফিয়ত তলব করে বসে লেখকের কাছে। সকলে সকল তত্ত্ব বুঝতে পারে না, সকলে সকল ভাবও বুঝতে পারে না। আবার তত্ত্ব অনেক করে বোঝালে কোনো ক্ষতি হয় না, কিন্তু সাহিত্যে যতটুকু নিতান্ত আবশ্যক তার বেশি বলার জো নেই। তত্ত্ব নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করে, না হলে সে বিফল; সাহিত্যকে বুঝে নিতে হবে, নিজের টীকা নিজে করতে গেলে সে ব্যর্থ। তুমি বুঝতে না পার তো তুমি চলে যাও, তোমার পরের ব্যক্তি এসে হয়তো বুঝতে পারবে, হঠাৎ যদি কোন সমঝদারের চোখে না পড়ল, তবে অজ্ঞাতসারে ফুলের মতো ফুটে হয়তো ঝরে পড়বে; কিন্তু তাই বলে বড়ো অক্ষরের বিজ্ঞাপনের দ্বারা লোককে আহ্বান করবে না এবং গায়ে পড়ে ভাষ্যদ্বারা নিজের ব্যাখ্যা কখনই করবে না। অথাৎ কবির ভাষায়— ‘‘দূর অস্পষ্ট, নিকট স্পষ্ট, বেগ অস্পষ্ট, অচলতা স্পষ্ট, মিশ্রণ অস্পষ্ট, স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট, সুতরাং প্রয়োজনে কাব্য স্পষ্ট ও অস্পষ্ট।’’

বস্তুতঃ সাহিত্যে অস্পষ্টতার অভিযোগ বহু কবির বিরুদ্ধেই সমকালীন বা উত্তরকালের সমালোচকরা করেছেন। মালার্মে অভিযুক্তদের অন্যতম। তিনি এই অভিযোগের উত্তরে বলেছিলেন, প্রাত্যহিক সাধারণ ভাষা অপূর্ণ ও ভাব প্রকাশে অক্ষম, আর কাব্য আমাদের ফিরিয়ে দেয় মানুষের ভাষার সাহায্যে রহস্যময় অস্তিত্ববোধের মূলে। সুতরাং কাব্যের ভাষায় দুর্বোধ্যতা ও অস্পষ্টতা থাকা অসম্ভব নয়। কবিও বলেছেন—‘‘কোন কবির কাব্যে যদি ছায়া দেখিতে পাওয়া যায় তবে বুদ্ধিমান সমালোচক যেন ইহাই সিদ্ধান্ত করেন যে, তাহা এই অসীম প্রকৃতির সৌন্দর্যময়ী রসচ্ছায়া।’’ কাব্যের ভাষা যখন ভাবানুসারী হওয়া আবশ্যক, তখন অন্তরের রহস্যাবৃত অনুভূতির সত্যমূর্তি জগতসমক্ষে উপস্থাপনার জন্য ভাষাতেও ব্যঞ্জনাঘন রহস্যের স্পর্শ থাকা স্বাভাবিক। এই অস্পষ্টতার অভিযোগেও কি অভিযুক্ত হন টি.এস এলিয়ট কিংবা এজরা পাউণ্ড? অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এলিয়টের অভিমতও তেমন মধুর ছিল না। বিশ শতকে পশ্চিমের বহু কবির বিরুদ্ধেই অস্পষ্টতার অভিযোগ ধ্বনিত হয়েছিল একদল সাহিত পাঠকের কণ্ঠে। কবি ও সমালোচক হাবার্ট রীড উক্ত অভিযোগের জবাবে তাঁর ‘Obscuri in Poetry’ প্রবন্ধে বলেছেন— ‘‘In order to remain faithful to the inner languaguage form, the poet must invent words and create images, he must mishandle and strech the meaning of words.’’ শব্দ আবিষ্কার করা, ইমেজ তৈরি করা এবং শব্দের প্রচলিত অর্থের বিস্তার ঘটিয়ে নতুন অর্থতাৎপর্যে তাকে সমৃদ্ধ করা আবশ্যক। আবশ্যক এই কারণে যে, অন্তর্গত ভাবকে ফুটিয়ে তোলার দিকে কবিদের বিশ্বস্ত থাকতে হয়। আধুনিকদের যুক্তি হল, জীবনে এসেছে জটিলতা এবং কাব্যে জীবনের ছাপ বাঞ্ছনীয়। তা ছাড়া কাব্যের বিষয় অন্তর্গত ভাব বলে কাব্যের ভাব ও বিষয়গত জটিলতার জন্য প্রকাশে জটিলতা হয়ে উঠেছে অনিবার্য। সুতরাং কাব্যে অস্পষ্টতা সম্পর্কে; রবীন্দ্রনাথের সিদ্ধান্ত পরিণত মনীষার ফসল।

কাব্যের বিরুদ্ধে অস্পষ্টতার অভিযোগ খণ্ডন করে কবি বলেছেন— ‘‘স্পষ্টতাই কাব্যের শ্রেষ্ঠত্ব বিচারের মানদণ্ড নয়; প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে কবিতা কোথাও স্পষ্ট কোথাও অস্পষ্ট।’’ সহজবোধ্যতা বা স্পষ্টতা যে কাব্যবিচারের নিরিখ হতে পারে না— এ ছিল কবির পূর্বের সিদ্ধান্ত। তাঁর বক্তব্য ছিল, বচনের মধ্যে অনির্বচনীয় বা ভাষার ব্যঞ্জনাধর্মিতাই কাব্যের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ। প্রয়োজনবোধে স্পষ্টতা ও অস্পষ্টতা। অস্পষ্টতা ও ব্যঞ্জনা বা অনির্বচনীয়তা যে সমার্থক নয়, তা স্মরণ রাখা উচিত। কাব্যে নানা কারণে অস্পষ্টতা সৃষ্টি হতে পারে। ভবভূতি লিখেছেন—‘‘স তস্য কিমপি দ্রব্যং যো হি যস্য প্রিয়োজনঃ!’’ সে তার কী-জানি কী যে যাহার প্রিয়জন। যদি কেবলমাত্র ভাষার দিক দিয়ে দেখ, তবে এ ধুয়া নয় তো কী, ছায়া নয় তো কী। এ কেবল অস্পষ্টতা, কুয়াশা। এতে কিছুই বলা হয়নি। ভাবের দিক দিয়ে দেখার ক্ষমতা যদি থাকে তো দেখবে ভাবের অস্পষ্টতা নেই। তুমি যদি বলতে প্রিয়জন অত্যন্ত আনন্দের সামগ্রী, তবে ভাষা স্পষ্ট হত সন্দেহ নেই, তবে একে ছায়া অথবা ধুয়া অথবা কাব্যি বলার সম্ভাবনা থাকত না, কিন্তু ভাব এত স্পষ্ট হত না। ভাবের আবেগে ভাষায় একপ্রকার বিহ্বলতা জন্মে। এ সহজ সত্য, কাব্যে তার ব্যতিক্রম হলে কাব্যের ব্যাঘাত হয়।

অত্যন্ত স্পষ্ট কবিতা না হলে যাঁরা বুঝতে পারেন না, তাঁদের স্পষ্ট কবিতার একটি নমুনার উদ্ধৃতি হল— কবিকঙ্কন মুকুন্দের দারিদ্র দুঃখ বর্ণনা যে কখনো দুঃখের মুখ দেখেনি তাকেও দীনহীনের কষ্টের কথা বুঝিয়ে দেয়—

দুঃখ করো অবধান, দুঃখ করো অবধান

আমনি খাবার গর্ত দেখো বিদ্যমান।

এই দুটি পদের ভাষ্য করে সমালোচক বলেছেন—ইহাই সার্থক কবিত্ব, সার্থক কল্পনা, সার্থক প্রতিভা। পড়ে সহসা মনে হয় এ কথাগুলি হয় গোঁড়ামি, না হয় তর্কের মুখে অত্যুক্তি। আমানি খাবার গর্ত দেখিয়ে দারিদ্র্য সপ্রমাণ করার মধ্যে কতকটা নাট্যনৈপুণ্য থাকতেও পারে, কিন্তু এর মধ্যে কাব্যরস কোথায়? দুটো ছত্র, কবিত্বে সিক্ত হয়ে ওঠেনি, এর মধ্যে অনেকখানি। আমানি আছে, কিন্তু কবির অশ্রুজল নেই।

প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে কবিতা কোথাও স্পষ্ট, কোথাও অস্পষ্ট, সম্পাদক ও সমালোচকরা তার বিরুদ্ধে দরখাস্ত ও আন্দোলন করলেও তার ব্যতিক্রম হবার জো নেই। চিত্রেও যেমন কাব্যেও তেমন দূর অস্পষ্ট, নিকট স্পষ্ট, বেগ অস্পষ্ট, অচলতা স্পষ্ট, মিশ্রণ অস্পষ্ট, স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট। আগাগোড়া সমস্তই স্পষ্ট, সমস্ত পরিষ্কার, সে কেবল ব্যাকরণের নিয়মের মধ্যে থাকতে পারে, কিন্তু প্রকৃতিতেও নেই, কাব্যে নেই। অতএব ভাবুকেরা স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট নিয়ে বিবাদ করেন না, তাঁরা কাব্যরসের প্রতি মনোযোগ করেন। ‘আমানি খাবার গর্ত দেও বিদ্যমান’ এ স্পষ্ট বটে, কিন্তু কাব্য নয়। কিন্তু বিদ্যাপতির—

সখি, এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর।

শূন্য মন্দির মোর।

স্পষ্ট ও বটে কাব্যও বটে। এ নিছক বর্ণনা বা কথার কথা মাত্র নয়, কেবল এতটুকু পরিষ্কার উক্তি নয়, এর মধ্যে থেকে গোপনে বিরহিণীর নি:শ্বাস নিশ্বসিত হয়ে আমাদের হৃদয় স্পর্শ করছে—

শিশুকাল হৈতে বঁধুর সহিতে

পরাণে পরানে লেহা।

এ শোনামাত্র হৃদয় বিচলিত হয়ে ওঠে স্পষ্ট কথা বলে যে তা নয়, কাব্য বলে। সমালোচক মিলটন মারে তাঁর The Problem of Style গ্রন্থে বলেছেন— “The essential quality of good writing is precision: that must be kept at its maximum, and the writer who sacrifices one percent of precision for a gain of hundred percent in music on the downward path.’’ সুতরাং স্পষ্টতা বা অস্পষ্টতা তখনই কাব্য যখন তা কাব্যে অবশ্যম্ভাবী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!