কারক কাকে বলে? কারকের শ্রেণিবিভাগ উদাহরণসহ আলোচনা কর।
কারক
বাক্যের অন্তর্গত ক্রিয়াপদের সঙ্গে নামপদের সম্বন্ধকে কারক বলা হয়। যেমন— ক্ষুধায় কালকেতু দাওয়ায় গর্ত থেকে আজলায় আমানি খেত। বিশেষ্য এবং বিশেষ্যস্থানীয় পদগুলিকে এক কথায় বলা হয় নামপদ। দৃষ্টান্ত বাক্যটিতে ক্ষুধা, কালকেতু, দাওয়া, গর্ত, আঁজলা, আমানি— এগুলি নামপদ।
আবার, বাক্যের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ক্রিয়াপদ [সমাপিকা]। এটি বাক্যের প্রাণ। উহ্য বা প্রকাশ্য— যা-ই হোক না কেন, বাক্যের ক্রিয়াপদের উপস্থিতি অপরিহার্য। সেই সমাপিকা ক্রিয়াপদের সঙ্গে বাক্যের নামপদগুলি বিভিন্ন প্রকার সম্পর্কযুক্ত। দৃষ্টান্তবাক্যটি পরীক্ষা করে দেখা যাক। স্পষ্টতঃই, ‘খেত’— পদটি সমাপিকা ক্রিয়াপদ। বাক্যস্থিত বিভিন্ন বিশেষ্য বা বিশেষ্য-স্থানীয় পদগুলির সঙ্গে এই ক্রিয়াপদটিকে যুক্ত করে পৃথক পৃথকভাবে পরীক্ষা করা যেতে পারে।
যেমন:
বিশেষ্য বা বিশেষ্যস্থানীয় পদ | সমাপিকা ক্রিয়াপদ | পরীক্ষার প্রশ্ন | সম্বন্ধ |
১. কালকেতু [+0] | খেত | কে | কর্তৃ |
২. আমানি [+0]। | খেত | কী | কর্ম |
৩. আজলা [+য়]। | খেত | কীসের দ্বারা | করণ |
৪. ক্ষুধা [+য়]। | খেত | কীসের নিমিত্ত | নিমিত্ত |
৫. গর্ত [+থেকে]। | খেত | কোথা থেকে | অপাদান |
৬. দাওয়া [+য়]। | খেত | কোথায় | অধিকরণ |
উল্লিখিত ছয়টি বিশেষ্য পদ ‘খেত’ এই সমাপিকা ক্রিয়াপদের সঙ্গে বিভিন্ন সম্বন্ধের দ্বারা অন্বিত।
১. ‘কালকেতু’— এই বিশেষ্য পদটি সমাপিকা ক্রিয়ার সঙ্গে কর্তৃ-সম্বন্ধে অন্বিত; কাজেই, এটি কর্তৃকারক।
২. ‘আমানি’— এই বিশেষ্য পদটি সমাপিকা ক্রিয়ার সঙ্গে কর্ম-সম্বন্ধে অন্বিত; কাজেই, এটি কর্মকারক।
৩. ‘আঁজলায়’— এই বিশেষ্য পদটি সমাপিকা ক্রিয়ার সঙ্গে করণ-সম্বন্ধে অন্বিত, কাজেই, এটি করণকারক।
৪. ‘ক্ষুধায়’— এই বিশেষ্য পদটি সমাপিকা ক্রিয়ার সঙ্গে নিমিত্ত-সম্বন্ধে অম্বিত ; কাজেই, এটি নিমিত্তকারক।
৫. ‘গর্ত’— এই বিশেষ্য পদটি সমাপিকা ক্রিয়ার সঙ্গে অপাদান-সম্বন্ধে অন্বিত; কাজেই, এটি অপাদানকারক।
৬. ‘দাওয়ায়’— এই বিশেষ্য পদটি সমাপিকা ক্রিয়ার সঙ্গে অধিকরণ-সম্বন্ধে অন্বিত; কাজেই, এটি অধিকরণকারক।
কারকের শ্রেণিবিভাগ
অতএব, কারক ছয় প্রকার— কর্তা, কর্ম, করণ, নিমিত্ত, অপাদান ও অধিকরণ।
ক. কর্তৃকারক
যে বিশেষ্য বা বিশেষ্য-স্থানীয় পদ বাক্যের ক্রিয়া সম্পাদন করে, তাতে কর্তৃকারক হয়। বাক্যের ক্রিয়া-সম্পাদনের ব্যাপারে কর্তা সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন। যেমন— কুবের মাঝি আজ মাছ ধরিতেছিল। এখানে ‘ধরিতেছিল’ এই ক্রিয়াপদের কর্তা হল ‘কুবের মাঝি’। ‘কুবের মাঝি’ ‘ধরিতেছিল’ এই ক্রিয়াপদটিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অনেক সময় বাক্যের কর্তা উহ্য থেকেও তা ক্রিয়া সম্পাদন করে থাকে। যেমন: ‘আমাকে মারিতে হয়, আগে তাহাকে মারুন।’ এখানে ‘মারুন’ ক্রিয়ার কর্তা ‘আপনি’ উহ্য। ঊহ্য থেকেও তা বাক্যের ক্রিয়া সম্পাদন করছে।
কর্তার প্রকারভেদ
কর্তা নানা প্রকারের। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কর্তৃবাচ্যের কর্তা, প্রযোজক কর্তা, প্রযোজ্য কর্তা, সমধাতুজ কর্তা, বাক্যাংশ কর্তা, অনুক্ত কর্তা ইত্যাদি।
১. কর্তৃবাচ্যের কর্তা
কর্তৃবাচ্যে কর্তাই ক্রিয়ার নিয়ন্ত্রক। অর্থাৎ, ক্রিয়া কর্তার নিয়ন্ত্রিত। যেমন: মানবশিশু সিংহশিশুর উপর অত্যাচার করিতেছে। বাড়ির বড়োবউ মরিয়াছে।
২. প্রযোজক কর্তা
কর্তা নিজে কাজ না করে অন্য কাকেও দিয়ে করিয়ে নিলে, তাকে প্রযোজক কর্তা বলা হয়। যেমন: “আমি প্রাতে তাহাকে আহার করাইয়া বাহির হইয়াছি। তোমরা পথ জান, [তুমি উহ্য] পথ দেখাও।
৩. প্রযোজ্য কর্তা
অন্যের দ্বারা প্রেরিত হয়ে যদি কেউ কোন কাজ সম্পন্ন করে, তাকে প্রযোজ্য কর্তা বলে। যেমন: মা ছেলেকে দুধ খাওয়ায়। রাখাল গোরু চরায়।
৪. সমধাতুজ কর্তা
একই ধাতু থেকে উৎপন্ন বিশেষ্য বা বিশেষ্যস্থানীয় পদ কর্তারূপে ব্যবহৃত হলে, তাকে সম [একই] ধাতুজ [ধাতু থেকে জাত] বা ধাত্বক [ধাতু+অর্থক = ধাতুর অর্থমুক্ত] কর্তা বলা হয়। যেমন: লেখক লেখে। পড়ুয়া পড়ে। খেলোয়াড় খেলে। “আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি।
৫. ব্যতিহার কর্তা
কোনও কোনও ক্রিয়ার একাধিক কর্তা থাকলে এবং তাদের মধ্যে একটা পারস্পরিক কর্ম-বিনিময়মূলক সম্পর্ক থাকলে, কর্তাগুলিকে একসঙ্গে ব্যতিহার কর্তা বলা হয়। যেমন: রাম-রাবণে করে রণ। পিতা-পুত্রে তর্ক করিতেছিলেন। তিনটে শালিক ঝগড়া করে রান্নাঘরের চালে।
৬. বাক্যাংশ কর্তা
কোন বাক্যাংশ ক্রিয়া সম্পাদন করলে, তাকে বাক্যাংশ কর্তা বলে। যেমন: এ সকল লোকের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ের ইচ্ছে করাও বিপজ্জনক। তোমার এমন কাজ করাটা অন্যায় হয়েছে। ‘তেলা মাথায়’ তেল দেওয়া মনুষ্য জাতির একটা বিশেষ রোগ।
৭. উপবাক্যীয়কর্তা
বাক্যের অন্তর্গত বাক্যকে উপবাক্য [clause] বলা হয়। বাক্যের অন্তর্গত কোন উপবাক্য কর্তারূপে ক্রিয়া নিষ্পন্ন করলে তাকে উপবাক্যীয় কর্তা বলা হয়। যেমন: সে এমন কথা বলতে পারে বিশ্বাস হয় না।
৮. উহ্য কর্তা
মধ্যম পুরুষ ও উত্তম পুরুষের কর্তা অনেক সময় উহ্য থাকে। তাকে বলা হয় উহ্য কর্তা। যেমন: ‘দাড়াও আমার আঁখির আগে।’— তুমি উহ্য
৯. বহু ক্রিয়ার এক কর্তা
একই কর্তার অধীনে বহু ক্রিয়া [সমাপিকা ও অসমাপিকা] থাকলে তাকে ঐ নামে অভিহিত করা হয়। যেমন: ‘নদীর জল অবিরল চল চলিতেছে— ছুটিতেছে,—বাতাসে নাচিতেছে— রৌদ্রে হাসিতেছে,— আবর্তে ডাকিতেছে।’
১০. এক ক্রিয়ার বহু কর্তা
একটি ক্রিয়ার একাধিক কর্তাও থাকে। যেমন: ‘মাতৃস্তন্যের সহিত স্নেহ, মায়া, মমতা অন্তরে প্রবেশ করিয়াছে।
১১. কর্মকর্তৃবাচ্যের কর্তা
বাক্যের কর্তা ছাড়াই যখন কর্মকর্তার মতো ক্রিয়া সম্পন্ন করে, তখন তাকে কর্মকর্তৃবাচ্যের কর্তা বলা হয়। যেমন: মন্দিরে শঙ্খ বাজিয়া উঠিল। গ্রাম হইতে হাসপাতালটি উঠিয়া গিয়াছে। এখানে আর বাজার বসে না। অনেকদিন হইতেই সেই গড়নের কাজ চলিতেছে। উল্লিখিত বাক্যগুলিতে কর্তার উল্লেখ নেই, কর্মকর্তার মতো আচরণ করে ক্রিয়া সম্পাদন করছে।
১২. নিরপেক্ষ কর্তা [Nominative Absolute]
একই বাক্যে সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়া থাকলে এবং উভয়ের কর্তা ভিন্ন হলে, অসমাপিকা ক্রিয়ার কর্তাকে নিরপেক্ষ কর্তা বলে। যেমন: ‘বসন্ত আসিলে বনপ্রকৃতি নূতন রূপ ধারণ করে।’ ‘ইলিশের মরসুম ফুরাইলে বিপুলা পদ্মা কৃপণ হইয়া যায়।’
১৩. সহযোগী কর্তা
একই বাক্যে দুটি কর্তা থাকলে এবং সেই কর্তা দুটির মধ্যে সহযোগিতার ভাব থাকলে, তাদের সহযোগী কর্তা বলা হয়। যেমন: ‘তোমাতে আমাতে মিলে কাজটা সেরে ফেলি এস।’ ‘ওপাড়া হইতে আয় মায়ে ঝিয়ে।’
১৪. অনুক্ত কর্তা
কর্তৃবাচ্যের কর্তা কর্মবাচ্যে করণ কারকের দ্বারা, কর্তৃক বিভক্তিযুক্ত হয়ে অনুক্ত কর্তায় রূপান্তরিত হয়। যেমন: পিতা পুত্রকে তিরস্কার করিলেন [কর্তৃবাচ্য] > পুত্র পিতা কর্তৃক তিরস্কৃত হইল [কর্মবাচ্য]। তেমনি, রাবণ রাম কর্তৃক নিহত হইল৷
১৫. সাধন কর্তা
যা দ্বারা ক্রিয়া সাধিত হয়, তা কর্তারূপে ব্যবহৃত হলে তাকে সাধন কর্তা বলা হয়। যেমন: যন্ত্র আসিয়া মানুষের হাতের কাজ কাড়িয়া লইয়াছে। সেকালে চরকা ঘুরতো হাজার হাজার, তাঁত চলতো শত শত।
খ. কর্মকারক
কর্তা যা করে বা সম্পাদন করে, তাকে কর্মকারক বলে। বাক্যের মধ্যে কর্তা কোন কাজ সম্পন্ন করে। যখন সেই কাজ কোন পদে গিয়ে বর্তায়, তখন সেই পদটি হয় কর্মকারক। কর্মকেই অবলম্বন করে ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। যেমন: অবশেষে মস্ত এক রায়বাহাদুরের ঘরের একমাত্র ছেলেকে সন্ধান করিয়া বাহির করিয়াছেন। এখানে ‘ছেলেকে’ কর্মকারক। কর্মকারকে ‘কে’, ‘রে’, ‘এরে’ বিভক্তি হয়।
কর্মের প্রকারভেদ
১. মুখ্য কর্ম [Direct Object]
ব্যাকরণে নির্দিষ্ট কতকগুলি ক্রিয়া আছে, তাদের দ্বিকর্মক ক্রিয়া বলা হয়। দ্বিকর্মক ক্রিয়ার দুটি করে কর্ম থাকে। একটি বস্তুবাচক, অপরটি ব্যক্তিবাচক।
দ্বিকর্মক ক্রিয়ার বস্তুবাচক কর্মকে মুখ্য কর্ম বলে। যেমন: আমি তোমায় শকুন্তের লাবণ্য দেখিতে কহিয়াছি।
২. গৌণ কর্ম [Indirect Object]
দ্বিকর্মক ক্রিয়ার ব্যক্তিবাচক কর্মকে গৌণ কর্ম বলে। যেমন: ‘তা তোমাকে বলে রাখি অপূর্ব।’
৩. উদ্দেশ্যকর্ম
কোনও কোনও ক্রিয়ার কাজ একটি কর্মের দ্বারা সম্পন্ন হয় না, পরিপূরক [Complement]-রূপে অপর একটি কর্ম গ্রহণ করে। বিভক্তি-যুক্ত স্বাভাবিক কর্মকে বলা হয় উদ্দেশ্য কর্ম। যেমন: তুমি আমাকে মিথ্যাবাদী বলিয়াছ।
৪. বিধেয়কর্ম
একটি কর্মের দ্বারা কোন ক্রিয়ার কাজ সম্পন্ন না হলে পরিপূরক [Complement]-রূপে দ্বিতীয় একটি অতিরিক্ত কর্মের প্রয়োজন হয়। বিভক্তিহীন সেই দ্বিতীয় অতিরিক্ত কর্মকে বিধেয়কর্ম বলে। যেমন: আমাকে পরম বন্ধু মনে করো। তিনি দেশকে জননী ভাবিতেন।
৫. সমধাতুজ বা ধাত্বর্থক কর্ম (Cognate Object)
কোন কোন অকর্মক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে সেই ক্রিয়াজাত কোন শব্দকে কর্মরূপে ব্যবহার করে ক্রিয়া নিষ্পন্ন করতে হয়। এরূপ কর্মকে সম [একই]-ধাতুজ [ধাতু থেকে জাত] কর্ম বা ধাত্বর্থক [ধাতু+অৰ্থক] কর্ম বলা হয়। যেমন: সে কী মায়া কান্নাই না কাঁদতে পারে। আমি বেশ এক ঘুম ঘুমিয়েছি। বাঁদর নাচ নাই-বা নাচলে। কহিলেন শেষে ক্রুর হাসি হেসে। প্রলয় নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে, হে নটরাজ, জটার বাধন পড়লো খুলে।
৬. কর্মকর্তৃবাচ্যের কর্ম
কর্মই যেখানে কর্তারূপে ক্রিয়া নিষ্পন্ন করে, সেখানে কর্মকর্তৃবাচ্য হয়। কর্ম-কর্তৃবাচ্যের কর্মকে বিচারে চিনে নিতে হয়। যেমন: সন্দীপনকে লক্ষ্মণের ভূমিকায় চমৎকার মানিয়েছিল। সুতপাকে নতুন শাড়িতে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছিল।
৭. বাক্যাংশ কর্ম
সমাপিকা ক্রিয়াবিহীন পদ-সমষ্টি বাক্যে কর্মরূপে ব্যবহৃত হলে তাকে বাক্যাংশ কর্ম বলা হয়। যেমন: তার এই কিছু বলে চলে যাওয়া আমি বরদাস্ত করবো না। তোমার এই খুট খুট করে কাজ আমার একেবারেই পছন্দ হয় না।
৮. উপবাক্যীয় কর্ম
বাক্যের অন্তর্গত কোন উপবাক্য কর্মরূপে ব্যবহৃত হলে, তাকে উপবাক্যীয় কর্ম বলে। যেমন: তাঁহার শেষ কি হইল কেহ জানে না। ‘রঙ্গরাজ দেখিল, বাস্তবিক ভবানী ঠাকুরের সেনা জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করিল।
৯. কর্মের বীপ্সা
পুনরাবৃত্তির ফলে কর্মের বীপ্সা হয়। যেমন: ‘শুধাইব জনে জনে।’ তোমরা যা যা বলতে চাও, বলে যাও। কী কী আনবে, মনে আছে তো?
১০. অসমাপিকা ক্রিয়া-রূপী কর্ম
অসমাপিকা ক্রিয়া ভাববাচক বিশেষ্যরূপে ব্যবহৃত হয়ে কর্মসংজ্ঞা প্রাপ্ত হয়। যেমন: খোকা এখন কথা বলতে পারে। ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।’ ‘মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’
গ. করণ কারক
কর্তা যে পদের দ্বারা ক্রিয়া সম্পাদন করে, তাকে করণ কারক বলে। যার সাহায্যে কর্তা ক্রিয়া সম্পন্ন করে, তাতে করণ কারক হয়। যেমন: আমরা চোখ দিয়ে দেখি, কান দিয়ে শুনি, হাত দিয়ে ভাত খাই। করণ কারক বোঝাতে এ, তে, য়, এতে বিভক্তিরূপে এবং দ্বারা, দিয়ে, করে, সাহায্যে, কর্তৃক ইত্যাদি শব্দ অনুসৰ্গরূপে প্রযুক্ত হয়।
করণের প্রকারভেদ
১. সাধন বা যন্ত্রাত্মক করণ
কোন বস্তু বা যন্ত্র দ্বারা ক্রিয়া সম্পন্ন হলে, তাকে সাধন বা যন্ত্রাত্মক করণ বলে। যেমন: ‘দড়ির দ্বারাই জলের নীচে জালের মুখ বন্ধ করা হয়।’ ‘ফুলদল দিয়া কাটিলা কি বিধাতা শাল্মলী-তরুবরে?’
২. উপায়াত্মক করণ
যে উপায় দ্বারা ক্রিয়া সাধিত হয়, তাকে উপায়াত্মক করণ বলে। যেমন: ‘নেবুর তেলের গন্ধে ব্যাটা থানাশুদ্ধ ললাকের মাথা ধরিয়ে দিল।’ গুণের দ্বারা মন জয় করা যায়। ‘আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি।’
৩. হেত্বর্থক করণ
হেতু বা কারণ বোঝাতে হেত্বর্থক করণ হয়। যেমন: ‘অরিন্দম কহিলা বিষাদে।’ শোকে তাহার বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল।
৪. কালাত্মক করণ
কাল বা সময় বোঝতে কালাত্মক করণ হয়। যেমন: দুদিনেই সব ফুরিয়ে গেল। একদিনেই কাজটা হয়ে যাবে।
৫. উপলক্ষণে করণ
কোন লক্ষণ বা চিহ্ন বোঝাতে উপলক্ষণাত্মক করণ হয়। যেমন: ‘গোঁফ দিয়ে যায় চেনা।’ ‘দুধের বেশে এসেছ বলে তোমারে নাহি ডরিব হে।’ ‘বালক বীরের বেশে তুমি করলে বিশ্বজয়।’
৬. অসমাপিকা ক্রিয়াবেশী করণ
কাঁদিয়া মন জয় করিতে চাও [কান্নার দ্বারা]? ‘মরিয়া হবে জয়ী আমার ’পরে [মরণের দ্বারা]?
৭. সমধাতুজ করণ
বাক্যের ক্রিয়া যে ধাতু থেকে উৎপন্ন, সেই ধাতু থেকে উৎপন্ন বিশেষ্যের দ্বারা ক্রিয়া নিষ্পন্ন হলে, তাকে সমধাতুজ করণ বলা হয়। যেমন: ‘যে কাঁদনে হিয়া কাদিছে সে কাঁদনে সেওঁ কাদিল।’ ‘যে বাঁধনে মোরে বাঁধিছে সে বাধনে তারে বাঁধিল।’
৮. করণের বীপ্সা
পুনরাবৃত্তির ফলে করণেও বীপ্সা হয়। যেমন: হাতে হাতে কাজটা সেরে ফেল। ‘রঙে রঙে রঙিল আকাশ।’ ‘পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখী।’
ঘ. নিমিত্ত কারক
নিমিত্ত, জন্য, উদ্দেশে বা উদ্দেশ্যে বোঝাতে নিমিত্ত কারক হয়। বাক্যের মধ্যে নিষ্পন্ন ক্রিয়ার দ্বারা কখনও কখনও নিমিত্ত, জন্য, উদ্দেশ বা উদ্দেশ্য বোঝায়। সেক্ষেত্রে নিমিত্ত কারক হয়ে থাকে। যেমন: ‘বেলা যে পড়ে এলো জলকে চল।’ এখানে ‘জলকে’ অর্থাৎ জল আনবার উদ্দেশ্যে বা নিমিত্ত চলার কথা বলা হয়েছে। তেমনি, কুম্ভকর্ণ কাঁচা ঘুম থেকে উঠে যুদ্ধে গেল। এখানে ‘যুদ্ধে’ গেল অর্থাৎ যুদ্ধ করবার উদ্দেশ্যে বা নিমিত্ত গেল। তিনি আহারে বসেছেন। এখানে ‘আহারে’ অর্থাৎ আহার করবার জন্যে বসেছেন। মহাদেব ভিক্ষায় [ভিক্ষা করবার উদ্দেশ্যে] বাহির হইলেন।
নিমিত্ত কারকের প্রকারভেদ
১: ‘জন্য’ বোঝাতে নিমিত্ত কারক হয়। যেমন: ‘এতদিনে জানলেম যে কাঁদন কাঁদলেম, সে কাহার জন্য।’ ‘পরের জন্য আত্মবিসর্জন ভিন্ন পৃথিবীতে স্থায়ী সুখের অন্য মূল নাই।’ ‘কিছু বলব বলে [জন্য] এসেছিলেম।’
২. ‘লাগিয়া’ অর্থে নিমিত্ত কারক হয়। যেমন: ‘মৈত্র মহাশয় যাবে সাগর-সঙ্গমে তীর্থস্নান লাগি।’ ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু।’
৩. ‘উদ্দেশ্যে’ অর্থে নিমিত্ত কারক হয়ে থাকে। যেমন: সে যুদ্ধে যাবে [যুদ্ধ করবার উদ্দেশ্যে]। তিনি বাজারে গেছেন [বাজার করবার উদ্দেশ্যে]। বিকাশবাবু প্রাতঃভ্রমণে গেছেন [প্রাতঃভ্রমণ কবার উদ্দেশ্যে]। আমার কেটেছে দিন বপনে [বিপনের উদ্দেশ্যে] রোপণে [রোপণের উদ্দেশ্যে]। তিনি পূজায় [পূজা করবার উদ্দেশ্যে] বসেছেন।
৪. ‘উদ্দেশ’ বোঝাতে নিমিত্ত কারক হয়। যেমন: ‘আজি হৃদয় আমার যায় যে ভেসে যাস পায়নি দেখা তার উদ্দেশে। মূক বধিরদের উদ্দেশে প্রতি অঞ্চলে একটি করে বিদ্যালয় থাকা উচিত। আপনি আমাদের উদ্দেশে কিছু বলুন।
৫ ‘নিমিত্ত’ উপসর্গ যোগে নিমিত্ত কারক হয়। যেমন: দরিদ্রের নিমিত্ত কেহ ভাবে না। তুমি কিসের নিমিত্ত আসিয়াছ?
ঙ. অপাদান কারক
যা থেকে কোন কিছু উৎপন্ন, নির্গত, পতিত বা বিশ্লিষ্ট হয়, তাই-ই অপাদান কারক। অপাদান কারকে ব্যক্তি বা বস্তুর একটা গতি অনুমিত হয়। যা থেকে, যার নিকট থেকে অথবা যেখান থেকে বস্তু বা ব্যক্তি গতিলাভ করে বা যা সেই গতির উৎস বা বিচ্ছেদের সীমা [limit of separation], তাতেই অপাদান কারক হয়। কিন্তু যা গতি লাভ করে, অর্থাৎ যা উৎপন্ন, নির্গত, চলিত, ভীত, বিচ্ছিন্ন বা বিশ্লিষ্ট হয়, তাতে অপাদান কারক হয় না, কর্তৃকারক হয়। অপাদান কারকে ‘হতে’, ‘থেকে’, ‘চেয়ে’, ‘অপেক্ষা’ ইত্যাদি শব্দ অনুসর্গরূপে যুক্ত হয়ে থাকে। ‘হইতে’ [হতে বা থেকে] শব্দ-যোগে অপাদান কারক। উৎপন্ন: গঙ্গানদী গঙ্গোত্রী হইতে। উৎপন্ন হইয়াছে। নির্গত: তাহার ক্ষতস্থান হইতে রক্তধারা নির্গত হইতে লাগিল। পতিত: বৃক্ষ হইতে ফলটি পতিত হইল। চলিত: মন্দির হইতে পুরোহিত বাহির হইয়া আসিলেন। ভীত: ব্যাঘ্র হইতে কে না ভয় পায়? বঞ্চিত: আমার প্রাপ্য থেকে আমি বঞ্চিত হলাম। গৃহীত: মৌমাছিরা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে। রক্ষিত: এই বিপদ হইতে কে আমাকে রক্ষা করিবে? বিরত: অসৎ কর্ম থেকে বিরত হও। পরাজিত: আলেকজান্ডার হইতে পুরুরাজ পরাজিত হইলেন।
অপাদান কারকের প্রকারভেদ:
১. আধার বা স্থানবাচক অপাদান
কোন আধার বা স্থান থেকে বিশ্লেষ বা চ্যুতি বোঝালে আধার বা স্থানবাচক অপাদান হয়। যেমন: ‘ঘাট হতে ঘট ভেসে চলে যায়।’ শাখা হতে ফুল ঝরে পড়ে হায়।
২. অবস্থাবাচক অপাদান
কোন অবস্থান থেকে ক্রিয়া নিষ্পন্ন হলে অবস্থাবাচক অপাদান হয়। যেমন: ‘জানালা থেকে দেখবে চেয়ে চেয়ে।’ ‘দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে।’
৩. কালবাচক অপাদান
কাল বা সময় বোঝালে কালবাচক অপাদান হয়। যেমন: ‘কখন থেকে এসে বসে আছি।’ ‘সকাল থেকে বাদল হল ফুরিয়ে এল বেলা।’
৪. দূরত্ববাচক অপাদান
কোন স্থান থেকে দূরত্ব বোঝালে দূরত্ববাচক অপাদান হয়। যেমন: ‘বুঁদির কেল্লা চিতোর হতে যোজন তিনেক দূর।’ ‘এখন ম্যান্ডালে থেকে নদীপথে জাহাজে চড়ে রেঙ্গুনে আসবেন।’ ‘দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান।’
৫. তারতম্যবাচক অপাদান
দুই বা ততোধিক ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যে তুলনা বোঝালে তারতম্যবাচক অপাদান হয়। যেমন: রামের অপেক্ষা শ্যামের বয়স বেশী। জননী জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও বড়। বয়সে ওর চেয়ে পাঁচগুণ সে বড়ো।
৬. অসমাপিকা ক্রিয়াবেশী অপাদান
আমরা মরিতে [মরণ হইতে] ভয় করি না। ওখানে যেতে [যাওয়া থেকে] তোমার এত দ্বিধা কেন? ওকথা বলতে [বলা থেকে] আমার কোন লজ্জা নেই।
চ. অধিকরণ কারক
ক্রিয়ার আধারকে অধিকরণ কারক বলা হয়। ক্রিয়া নিষ্পন্ন হবার জন্যে স্থান, কাল এবং বিষয়ের প্রয়োজন হয়। কোনও স্থানে, কোনও কালে কিংবা কোনও বিষয়ে ক্রিয়া সংঘটিত হয়। তাই অধিকরণ কারকের রূপ হল মূলত এই তিনটি— আধারাধিকরণ, কালাধিকরণ এবং বিষয়াধিকরণ বা ভাবাধিকরণ। অধিকরণ কারকে ‘এ’, ‘তে’, ‘এতে’ ও ‘য়’ বিভক্তি হয়। অধিকরণে অনুসর্গও ব্যবহৃত হয়। যেমন: ‘ভিতরে’, ‘মধ্যে’, ‘উপরে’, ‘পানে’, ‘পাশে’, ‘নীচে’, ‘অন্তরে’, ‘করে’, ‘করিয়া’ ইত্যাদি।
অধিকরণ কারকের প্রকারভেদ
অধিকরণ কারক প্রধানত তিন প্রকার— আধারাধিকরণ, কালাধিকরণ ও ভাবধিকরণ।
১. আধারাধিকরণ
ক. কোন স্থান বা দেশ বোঝাতে— ‘হে মোর চিত্ত, পুণ্যতীর্থে জাগোরে ধীরে এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে। ‘পড়ে আছি নদীকূলে।’ ‘পশিয়াছে কত যাত্রী যশের মন্দিরে।’ ‘গাঁথিব নৃতন মালা তুলি সযতনে তব কাব্যোদ্যানে ফুল।’ ‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।’
খ. ঐকদেশিক অধিকরণ: দেশের এক অংশ বোঝাতে— ‘রেতে মশা দিনে মাছি তাই নিয়ে কলকাতায় আছি।’ সে এখন বিলেতে আছে । সে মন্দিরে দেব নাই।
গ. স্থানের ব্যাপ্তি বোঝতে— মাঠে জল থই থই করছে। হাটে লোকে গিস্ গিস্ করছে। ফুলে আছে গন্ধ। তিলে আছে তৈল।
ঘ. অবস্থা ও বিষয় বোঝতে— শান্তিতে থাকো। বৈকালেতে আনন্দেতে থাকবে যাদুধন।’ ‘গৌড়জন যাহে আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি।’ লেখাপড়ায় মন দাও।
ঙ. সামীপ্য বোঝাতে— ‘ফটকে গাড়ি দাড়িয়ে আছে।’ ‘দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি।’ ‘চরকার দৌলতে আমার দরজায় বাধা হাতী।’
২. কালাধিকরণ
ক. সময়ের বিশেষ ক্ষণ বোঝাতে— ‘আমি সকালে উঠেই চণ্ডীমণ্ডপে যেতাম।’ ‘তিনি সন্ধ্যে সাতটায় কলকাতায় পৌছবেন।’
খ. সময়ের ব্যাপ্তি বোঝাতে— ‘বসন্তে বসন্তে তোমার কবিরে দাও ডাক।’ বর্ষাকালে নদীতে বন্যা নামে। ‘আজ বারি ঝরে ঝরঝর ভরা বাদরে।’
৩. ভাবাধিকরণ
শোকে দুঃখে তিনি একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছেন। তোমার দুঃখে পথের কুকুরও কাদবে না।
বিশেষ দ্রষ্টব্য
বিষয়াধিকরণ
আধারাধিকরণ, কালাধিকরণ ও ভাবাধিকরণ ছাড়া আর একপ্রকার অধিকরণ কারকের অস্তিত্ব ভাষায় লক্ষ করা যায়, তা হল বিষয়াধিকরণ। কোন বিষয়ে ক্রিয়া নিষ্পন্ন হলে বিষয়াধিকরণ কারক হয়। যেমন— সাহিত্যে তিনি ছিলেন সাত সমুদ্রের কাণ্ডারী। বিজ্ঞানে জগদীশচন্দ্রের দান অসামান্য। ছেলেটি অঙ্কে বড় কাচা। তীরন্দাজিতে তার সমকক্ষ কেউ নেই। তিনি ন্যায়শাস্ত্রে পণ্ডিত।
স্মরণীয় যে, করণ ও অধিকরণ উভয় স্থলেই বিভক্তি এক [এ, তে, এতে, য়]; তবে অর্থ দেখে কোনটা করণ, আর কোনটা অধিকরণ, বিবেচনা করে নিতে হয়।
Leave a Reply