মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কাশীরাম দাসের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
কাশীরাম দাসের ভারত পাঁচালী
মধুসূদন দত্ত কাশীরাম দাস সম্পর্কে বলেছিলেন— “হে কাশী কবীশ দলে তুমি পুণ্যবান।” কবি কাশীরাম দাসের জন্যবৃত্তান্ত সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। তবে যতখানি জানা গেছে তা থেকে বোঝা যায় ইনি বর্ধমান জেলার উত্তরে ইন্দ্রানী পরগনার অন্তর্গত সিঙ্গি গ্রামে জনগ্রহণ করেন। এই গ্রামটি ব্রাহ্মণ নদীর তীরস্থ৷ কাশীরামের প্রপিতামহের নাম প্রিয়ঙ্কর, পিতামহের নাম সুধাকর এবং পিতার নাম কমলাকান্ত। কমলাকান্তের তিন পুত্র ছিল— কৃষ্ণদাস, কাশীরাম ও গদাধর। কবিদের কৌলিক উপাধি ছিল দেব। সম্ভবত পরবর্তীকালে বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করায় তাঁরা দাস উপাধি পান। কথিত আছে কাশীরাম মেদিনীপুরের আওসগড়ের জমিদারের আশ্রয়ে থেকে পাঠশালায় শিক্ষকতা করতেন। সেসময় রাজবাড়িতে যে সমস্ত কথক এবং পুরাণ পাঠকারি পণ্ডিত আসতেন, তাদের মুখ থেকে মহাভারত প্রসঙ্গ শুনে তাঁর মহাভারতের প্রতি অনুরাগ জন্মায়। এই অনুরাগের ফলেই তিনি মহাভারতের অনুবাদ শুরু করেন। কাশীরামের লেখা মহাভারতের অনুবাদ গ্রন্থটির নাম ‘ভারত পাঁচালী’। এটি সম্ভবত তিনি সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রচনা করেন।
কাশীরাম দাসের কাব্য রচনাকাল
কাশীরাম দাস মহাভারতের অনুবাদ করলেও তিনি মহাভারতের প্রথম অনুবাদক নন। তুর্কি আক্রমণোত্তর কালে উচ্চবর্ণের হিন্দু এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুর মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য পঞ্চদশ শতাব্দীতে যখন সংস্কৃতে লেখা পৌরাণিক ধর্মগ্রন্থগুলির অনুবাদ শুরু হয়, মহাভারতের অনুবাদও তখনই শুরু হয়৷ মহাভারতের প্রথম অনুবাদক হিসাবে কবীন্দ্র পরমেশ্বরকে ধরা হয়। ইনি পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষার্ধে অথবা ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে চট্টগ্রামের সুবাদার লস্কর পরাগল খাঁর অনুরোধে মহাভারতের অনুবাদ করেন। তাঁর অনুবাদের নাম—“পরাগলি মহাভারত”। এরপর শ্রীকর নন্দী লস্কর পরাগল খার পুত্র ছুটিখাঁর নির্দেশে মহাভারতের শুধুমাত্র অশ্বমেধ পর্বটি অনুবাদ করেন। এছাড়াও সঞ্জয়, বিজয়পণ্ডিত, নিত্যানন্দ প্রমুখের নাম মহাভারতের অনুবাদক হিসাবে পাওয়া যায়। তবে মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক হিসাবে কাশীরাম দাসই সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। আগেই বলা হয়েছে কাশীরাম দাস তাঁর অনুবাদটি সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে করেছিলেন। এ অনুবাদটির রচনাকাল জ্ঞাপক একটি ছোট্ট শ্লোক পাওয়া গেছে। তাতে লেখা আছে—
চন্দ্র বান পঞ্চ ঋতু শক সুনিশ্চয়।
বিরাট হইল শেষ কাশীদাস কয়।।
এখানে চন্দ্র অর্থে ১, বান অর্থে ৫, পক্ষ অর্থে ২, এবং ঋতু অর্থে ৬ ধরলে ১৫২৬ শকাব্দটি পাওয়া যায়। আর ১৫২৬ শকাব্দ অর্থাৎ (১৫২৬+৭৮) ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দ। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে কাশীরাম দাস চৈতন্যোত্তর যুগে তাঁর মহাভারতের অনুবাদ কার্যটি সম্পূর্ণ করেছিলেন। তিনি নিজে বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এর জন্য স্বাভাবিকভাবেই তার অনুবাদে এই ধর্মের প্রেম ও মানবতাবাদেরও প্রভাব পড়েছে।
কাশীরাম দাসের কবিকৃতিত্ব
কাশীরাম দাসের কাব্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে অনেকেই বলেন যে, তিনি মহাভারতের সম্পূর্ণ অনুবাদ করতে পারেননি। আদি, সভা, বন ও বিরাট—এই চারটি পর্ব অনুবাদ করেন। বাকি অংশটুকু তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র নন্দরাম সমাপ্ত করেন। সমালোচকদের এই অনুমানের পিছনে একটি কারণ হল কাশীরাম দাস তার অনুবাদে নিজেই লিখেছেন—
আদি, সভা, বন, বিরাটের কতদুর।
ইহা রচি কাশীদাস গেলা স্বর্গপুর।।
তবে অনেকে মনে করেন এই স্বর্গপুর আসলে বৈষ্ণবধর্মের পীঠস্থান কাশী অথবা নীলাচল। যাইহোক কাশীরাম দাস মহাভারতের সম্পুর্ণ অণুবাদ করুন আর না করুন শুধুমাত্র এই চারটি পর্বের অনুবাদ বিচার করলেও তার কবি কৃতিত্ব ছোট করা যায় না৷ কাশীরাম দাস সংস্কৃত মহাভারতের হুবহু অনুবাদ করেননি, তিনি মহাভারতের ভাবানুবাদ করেছেন। তাই অনেকেই মনে করেন কাশীরাম সংস্কৃত জানতেন না, তিনি পাচালিকার ও কথকদের মুখ থেকে মহাভারতের যে কাহিনি শুনেছিলেন, তা-ই নিজের রচনায় লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু একথা সঠিক না। এ ব্যাপারে দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁর “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য গ্রন্থে বলেছেন— ‘‘সে সময়ের অনুবাদ মূল কাব্যের ছায়া লইয়া লিখিত হইত, কাশীরাম দাসের মহাভারত ঠিক সংস্কৃত অনুযায়ী নহে, এই জন্য কবি সংস্কৃত জানিতেন না, এইরূপ মত প্রচার করা বোধ হয় উচিত নহে’’
কাশীরামের অনুবাদটি পড়লে কখনোই মনে হয় না যে, তিনি সংস্কৃত জানতেন না। হয়তো শ্রোতার কাছে আকর্ষণীয় করার জন্য তাঁর অনুবাদে যেমন অনেক কিছু বাদ দিয়েছেন, তেমনি আরও কিছু সংযোজন করেছেন। ফলে কাহিনিটির রসহানি হয়নি, বরং আরও আকর্ষণীয় হয়েছে। তিনি কিছু কিছু জায়গায় মহাভারতের সংস্কৃত শ্লোক যেভাবে বাংলায় রূপান্তরিত করেছেন তা লক্ষ করলে তাঁকে সংস্কৃত ভাষায় পণ্ডিত বললেও কম বলা হয়। আগেই বলা হয়েছে কাশীরাম দাস চৈতন্যোত্তর যুগের কবি ছিলেন এবং নিজেও বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবে তাঁর রচনার ভাব ও ভাষায় চৈতন্যদেবের একটা প্রভাব পড়েছিল। তিনি তাঁর রচনায় মূল মহাভারতের রুক্ষ্মতা, শুষ্কতা, বৈরিতা অনেকটাই কমিয়ে এনেছিলেন। বাংলার প্রকৃতির সাহচর্যে এসে তাঁর রচনায় বাঙালির মানবপ্রেম, সৌভাতৃত্ববোধ এগুলো যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে অনুবাদটি বাঙালির হৃদয়ের অনেক কাছাকাছি আসতে পেরেছে এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
কাশীরাম দাস তাঁর আনুবাদের ঘটনাবিন্যাস, নাটকীয়তা, সরস উক্তি-প্রত্যুক্তি এবং হাস্যরসকে সুন্দরভাবে পরিবেশন করেছেন। ফলে তাঁর রচনা অনেক বেশি চিত্তাকর্ষী হয়ে উঠেছিল। কাশীরাম দাস ছাড়াও আর যাঁরা মহাভারতের অনুবাদ করেছিলেন তাঁদের তুলনায় কাশীরামের ভাষা ছিল অনেক সহজ-সরল এবং মার্জিত। তিনি রসসাহিত্যের প্রায় সব রসকেই এই অনুবাদের উপযুক্তভাবে প্রয়োগ করেছেন। তিনি যেন এই কাব্যের মধ্যে দিয়ে বাঙালি সমাজের স্বার্থত্যাগের মহিমা, ভ্রাতৃত্বত্রীতি, মাতৃভক্তি ও স্বজনপ্রীতির সত্যনিষ্ঠা, আধ্যাত্মিক আদর্শ প্রভৃতিকে প্রকট করে তুলতে চেয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই অনুবাদ রচনায় তাঁর সঙ্গে কৃত্তইবাসের তুলনা এসে পড়ে। এ প্রসঙ্গে দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন— “কীর্তিবাস যেরপ পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক যশের অধিকারী হইয়া ছিলেন, কাশীদাস তাহা হইতে পারেন নাই।” আবার অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় দুইজনের তুলনা করে বলেছেন যে— “কীর্তিবাসী রামায়ণে বাঙ্গালী জীবন ও সমাজের এত বেশী ছাপ পড়েছে যে, রামকাহিনী বাঙ্গালীর ঘরের সামগ্রী হয়ে উঠেছে, কাশীরাম দাসের মহাভারতে ঠিক ততটা বাঙ্গালীয়ানা দেখা যায়না। তবে কাশীরামের বিনয়াবনত বৈষ্ণবমনটি রচনার মধ্যে অকৃত্রিম ভাবেই ধরা পড়েছে। ভক্তবংশে যে তাঁর জন্ম হয়েছিল, তা তার রচনা থেকেই বুঝতে পারা যায়। এদিক থেকে উত্তর চৈতন্যযুগের ভক্তির ধারা তাঁর হৃদয়কে গভীরভাবে প্লাবিত করেছিল।”
যাইহোক আমাদের এটা মানতেই হবে কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণের অনুবাদে বাঙালিয়ানা দেখানোর অনেক সুযোগ ছিল, কাশীরাম করেছিলেন বীররসাত্মক কাব্য মহাভারতের অনুবাদ। এখানে বাঙালিয়ানার চাইতে অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে যুদ্ধ-বিগ্রহ, লড়াই-সংঘাত। তবুও কাশীরাম যে তাঁর রচনাটি বাঙালির উপযোগী করে লিখেছিলেন এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আর হয়ত এই কারণেই আজও মহাভারতের কথা মনে পড়লে সবার আগে স্মরণে আসে কাশীরাম দাসের সেই বিখ্যাত শ্লোক—
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।
আমরা দীনেশচন্দ্র সেনের একটি মন্তব্য দিয়ে কাশীরাম দাসের আলোচনা শেষ করব। তিনি মহাভারতের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন— ‘‘এক একখানি পত্র এক একটি চমৎকার চিত্রপটের ন্যায়, পড়িতে পড়িতে জগৎপুঞ্জ, যুদ্ধবীর ও প্রেমিকগণের মূর্তি মানসচক্ষের সমক্ষে উদ্ঘাটিত হয়; তাহাদের সরল বিবেক, দৃঢ় কামনা ও চরিত্রের সাহস কবির সচেতন লেখনির গুণে ক্ষণকালের জন্য আমাদের নিজস্ব হইয়া পড়ে। এই নিঃসম্বল, অর্ধভুক্ত, পরদোষে কটাক্ষ পাণ্ডুরতাপূর্ণ বাঙ্গালীজাতিও ক্ষণকালের জন্য পৃথিবীজয়ী উচ্চ আকাঙ্ক্ষাশালী অভিমানাঙ্ক্ষিত পূর্বপুরুষের কাহিনি পড়িয়া স্বীয় ক্ষুদ্রত্ব ভুলিয়া গর্ব অনুভব করে।’’
Leave a Reply