//
//

বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চের অবদান আলোচনা কর।

কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ

(১৯৫৪-১৯৮০)

কলকাতার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে মাণিকতলার খালপুলের পাশে এই থিয়েটারটি অবস্থিত। প্রতিষ্ঠা করেন সমাজসেবিকা শ্যামমোহিনী দেবী। কাশী বিশ্বনাথ সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় এটি নির্মিত হয়। পাশেই ছিল তাদের একটি স্কুল এবং দেবমন্দির। তারই সংলগ্ন এই থিয়েটার বাড়িটি নির্মিত হয়। প্রথমে নাম দেওয়া হয় ‘কাশী বিশ্বনাথ ইনস্টিটিউট’। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে এই থিয়েটার বাড়ির নির্মাণ শেষ হয় এবং ১৯৫৪-এর ৩১ জানুয়ারি মঞ্চটির উদ্বোধন হয়। উদ্বোধন করেন তৎকালীন কংগ্রেসী ভূমি ও রাজস্ব মন্ত্রী সত্যেন্দ্রনাথ বসু।

উদ্যোক্তাদের নিজস্ব নাট্যপ্রযোজনা না থাকাতে তারা এই মঞ্চটি অন্য দলগুলিকে অভিনয়ের জন্য ভাড়া দিতে থাকেন। বিভিন্ন পেশাদার ও অপেশাদার নাট্যদল এ মঞ্চ ভাড়া নিয়ে অভিনয় করতে থাকে।

১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে খ্যাতনামা অভিনেতা-নাট্যকার-পরিচালক মহেন্দ্র গুপ্ত নিজস্ব নাট্যদল গঠন করে এখানে নিয়মিত অভিনয় আরম্ভ করেন। সেই সময়ে তিনি তার এই নতুন মঞ্চে নাট্যাভিনয়ের যেসব বিজ্ঞাপন সংবাদপত্রে এবং অন্যত্র দিলেন, তাতে মঞ্চটিকে ‘কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ’ বলে উল্লেখ করা হতো। তাই থেকেই পূর্বের ইনস্টিটিউটের বদলে এই থিয়েটারের নাম প্রচারিত হয়ে যায় ‘কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ’ রূপে।

মহেন্দ্র গুপ্ত এখানে তাঁর কয়েকটি পুরনো নাটক অভিনয়ের ফাঁকে নতুন নাটক ‘শাপমুক্তি’ (১১.৪.১৯৬৩) এবং ‘রাজা রামপাল’ (২৫.৬.১৯৬৫) অভিনয় করেন। দুটি নাটকই মহেন্দ্র গুপ্তের রচনা এবং তাঁরই পরিচালনায় অভিনীত হয়।

পরে বিভিন্ন নাট্যদল মঞ্চটি ভাড়া নিয়ে তাদের নাটকাভিনয় করতে থাকে। ১৯৬৬এর ২৬ অক্টোবর অভিনীত হয় ‘এন্টনী কবিয়াল’। নাটকটি রচনা ও পরিচালনা করেন বিধায়ক ভট্টাচার্য। প্রযোজনা করে ‘নান্দিক’ গোষ্ঠী। এন্টনী কবিয়ালের ভূমিকায় সবিতাব্রত দত্ত ও সৌদামিনীর চরিত্রে কেতকী দত্ত অসামান্য অভিনয় করেন। সবিতাব্রতের গাওয়া গানের গরিমায় নাটকটি আরো বেশি জমে যায়। ভোলা ময়রার ভূমিকায় প্রবীণ অভিনেতা জহর গাঙ্গুলী গানে এবং অভিনয়ে নতুন করে নিজেকে চিনিয়ে দেন। সুরারোপে ছিলেন অনিল বাগচী। টানা আড়াইবছর নাটকটি এখানে অভিনীত হয়। অভূতপূব দর্শক সমাগমে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে রঙ্গালয়টি। কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ জনমনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের নাট্যরূপ (বিধায়ক ভট্টাচার্য) এখানে অভিনীত হয়, বিধায়ক ভট্টাচার্যের পরিচালনায়। প্রথম অভিনয় ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৮।

এই নাটকটি কিছুদিন চলার পর নান্দিক গোষ্ঠীর দ্বিতীয় প্রযোজনা ‘নটী বিনোদিনী’ অভিনীত হলো ১৯৬৯-এর মার্চ মাসে। নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্য। পরিচালনা করেন প্রবীণ অভিনেতা কানু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে সহায়তা করেন বিধায়ক ভট্টাচার্য।

ধনঞ্জয় বৈরাগীর নাটক ‘মুখোশের আড়ালে’ এখানে অভিনীত হয় ১৯৭০-এর ১ জানুয়ারি। তিনিই (তরুণ রায় নামে) পরিচালনা করেন। তরুণ রায় নিজে এবং তাঁর স্ত্রী দীপান্বিতা রায় দুটি বিশিষ্ট চরিত্রে অভিনয় করেন। দিলীপকুমার রায়ের কাহিনী ‘অঘটন আজো ঘটে’ অবলম্বনে ধনঞ্জয় বৈরাগী নাটকটি লেখেন।

মাঝে অভিনীত হয় ‘সওদাগর’ (১ এপ্রিল, ১৯৭১)। সমরেশ বসুর কাহিনী অবলম্বনে নাটকটি তৈরি হয়েছিল। ১৯৭২-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘দয়াল অপেরা’ মঞ্চস্থ হলো। নাটকটি ধনঞ্জয় বৈরাগীর লেখা। তাঁরই (তরুণ রায় নামে) পরিচালনায় নাটকটি এখানে অসামান্য জনসম্বর্ধনা লাভ করে। সুরকার অনিল বাগচীর সুরারোপিত গানগুলি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। দলগত অভিনয়ে, প্রয়োগ-কুশলতায় এবং গানের ব্যবহারে এই নাটকটি খুবই সাফল্য লাভ করেছিল।

এবারে অভিনীত হলো ‘মল্লিকা’। জরাসন্ধের কাহিনীর নাট্যরূপ দিলেন বীরু মুখোপাধ্যায়। এখানে প্রথম অভিনীত হলো ১৯ নভেম্বর, ১৯৭২। এই সময় থেকেই এই মঞ্চের পরিচালনায় একটা ধারাবাহিক পর্যায় শুরু হয়। এই সময়ে হরিদাস সান্যাল এই ‘থিয়েটার হল’টি ভাড়া নেন এবং নিয়মিত অভিনয়ের ব্যবস্থা করেন।

তাঁরই আমলে অভিনীত হলো ‘মল্লিকা’। নাটকটি পরিচালনা করলেন জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়। মল্লিকা চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, শেখর চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমার, সাধনা রায়চৌধুরী, অলকা গাঙ্গুলি উল্লেখযোগ্য অভিনয় করেন। আলোক সম্পাতে ছিলেন তাপস সেন। মঞ্চ নির্মাণে সুরেশ দত্ত। আবেগধর্মী এই নাটক, এক বন্দিনী নারীর বেদনার্ত জীবনের বঞ্চনার হাহাকার দর্শকদের আবেগাপ্লুত করে তুলেছিল। অভিনয়ে পরিচালনায় এবং মঞ্চের কুশলতায় নাটকটি দর্শকমনে সাড়া ফেলে দিয়েছিল।

তারাশঙ্করের উপন্যাস ‘না’ অবলম্বনে নাটক তৈরি করেন জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়। তাঁরই পরিচালনায় ‘না’ নাটকটি মঞ্চস্থ হতে থাকে ৪ অক্টোবর, ১৯৭৫ থেকে। নাটকটি খুব বেশিদিন চলেনি।

বনফুল-এর কাহিনী অবলম্বনে ‘অঘটন’ নাটকটি নির্মিত হয়। নাট্যরূপ বীরু মুখোপাধ্যায়। পরিচালনা জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়। প্রথম অভিনয় হয় ২৫ নভেম্বর, ১৯৭৬। নাটকটি দীর্ঘদিন ধরে এখানে চলেছিল। ঘটনার চমক, অভিনয়ের কুশলতা, মঞ্চ নির্মাণের কৌশল এবং আলোর চমকে নাটকটি দর্শকমন জয় করে নিয়েছিল।

এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা ‘নামজীবন’। নাট্যকার ও পরিচালক—সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এখানে অভিনয় শুরু হয় ২১ ডিসেম্বর, ১৯৭৮ থেকে। খুবই সাফল্য লাভ করে। পেশাদারি মঞ্চে এই ধরনের পরীক্ষামূলক নাটক সে সময়ে দর্শক আনুকুল্য এবং কলারসিকজনের প্রশংসা লাভ করেছিল। একটি ভাঙাচোরা দোতলা বাড়ির সেট, সামনে রাস্তা-ঘরের উঠান—এই একটি মাত্র সেট ব্যবহার করে, আলোর বিভাজনে বিভিন্ন স্থান নির্দিষ্ট করে নাটকটি অভিনীত হতো। সাধারণ রঙ্গালয়ে মঞ্চ ব্যবহারের এই নবতম পরীক্ষা খুবই আদৃত হয়েছিল। কাহিনীর গুণে, অভিনয়ের কৃতিত্বে এবং বাস্তব জীবনভাবনা উপস্থাপনে ‘নামজীবন’ যেমন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের তেমনি বাংলা রঙ্গালয়েরও, একটি মাইলস্টোন। অভিনয়ে সৌমিত্র এবং লিলি চক্রবর্তীর পারঙ্গমতা অবশ্যই স্বীকার্য।

১৯৮০-তে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে ‘বেণী সংহার’ এখানে অভিনীত হয়েছিল। নাট্যরূপ বীরু মুখোপাধ্যায়। পরিচালনা জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়। প্রথম অভিনয় হলো ২ অক্টোবর, ১৯৮০। নাটকটি বেশিদিন চলেনি।

১৯৮০-এর দশকের পর থেকে কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ বন্ধ হয়েই আছে। সেখানে এখন মালপত্র রাখার গুদামঘর তৈরি হয়েছে। এখন অবধি সেখানে আর কোনো অভিনয়ের খবর নেই।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!