//
//

রামায়ণের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝার কৃতিত্ব আলোচনা কর।

শ্রীরাম পাঁচালী: কৃত্তিবাস ওঝা

‘রামায়ণ’ মহাকাব্যের মূল কাহিনী হল—রঘুবংশজাত রাম এবং লঙ্কার রাজা রাবণের দ্বন্দ্বের কাহিনী। অর্থাৎ আর্ধ-অনার্ধের সংঘাতই এই মহাকাব্যের মূল উপজীব্য। সপ্তকাণ্ডে বিভক্ত, আদিকবি বাল্মীকি রচিত বিশাল মহাকাব্য রামায়ণের বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন কৃত্তিবাস ওঝা। পয়ার ত্রিপদীতে রচিত সেই কাব্যের নাম কবি রাখেন ‘শ্রীরাম পাঁচালী’। কৃত্তিবাসী ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ বাংলার ঘরে ঘরে এতটাই সমাদৃত ও জনপ্রিয় হয়েছিল যে, কৃত্তিবাসের জন্মকাল, কাব্যরচনাকাল ইত্যাদি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত পাঠক ও সমালোচক মহলে বর্তমান। যথাযথ সন তারিখের পরিবর্তে তা অনেকটাই অনুমান নির্ভর। কৃত্তিবাস তার কাব্যের ‘আত্মপরিচয়’ অংশে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন—

মুখটী বংশের পদ্ম শাস্ত্রে অবতার।

ব্রাহ্মণ সজ্জনে শিখে যাঁহার আচার।।

কুলে শীলে ঠাকুরালে ব্রহ্মচর্য্য গুণে।

মুখটী বংশের যশ জগতে বাখানে।।

আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পুণ্য মাঘমাস।

তথি মধ্যে জন্ম লইলাম কৃত্তিবাস।।

কৃত্তিবাস বিখ্যাত মুখটী বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন৷ পিতামহ ছিলেন মুরারী ওঝা, কৃত্তিবাসের পিতার নাম বনমালী এবং মাতার নাম মালিনী। কৃত্তিবাসের আত্মবিবরণী থেকে জানা যায় যে, কোন এক, “আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পুণ্য মাঘ মাসে” তার জন্ম হয়। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মহাশয় জ্যোতিষ গণনার দ্বারা স্থির করেছিলেন যে, ১৩২০ শকাব্দে বা ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে ১৬ই মাঘ রবিবার শ্রীপঞ্চমী তিথিতে সরম্বতী পূজার দিন কবি কৃত্তিবাস জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন মহাশয় তাঁর ‘বঙ্গাভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে— “নৃসিংহ ওঝা সম্ভবতঃ ১৩১০ খ্রীষ্ট অব্দে পূর্ববঙ্গ পরিত্যাগ পূর্বক ফুলিয়ায় আসিয়া বাস করেন। কৃত্তিবাস উৎসাহ হইতে অধস্তন নবমপুরুষ শ্রের কারিকা হইতে জানা যায় যে, উৎসাহ বল্লালের সভায় পূজিত হইয়াছিলেন। বল্লাল সেন সম্ভবতঃ ১১৬৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্য্যন্ত রাজত্ব করিয়াছিলেন। সুতরাং দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে উৎসাহের জন্মকাল ধরিলে তিন পুরুষের ১০০ বৎসর পরিকল্পনা পূর্বক আমরা চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ ভাগে কৃত্তিবাসের জন্মকাল পাইতেছি…মনে হয়, তিনি পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগেই ইহলোক ত্যাগ করিয়াছিলেন।’’ কবি কৃত্তিবাসের জন্মকাল এবং কাব্য রচনাকাল সম্পর্কে ড. সুকুমার সেন ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন— “কৃত্তিবাস ওঝার ‘শ্রীরাম-পীচালী’, বা ‘রামায়ণ’ কাব্য লইয়া বাঙ্গালা সাহিত্যের পাঞ্চালী কাব্যের ইতিহাস শুরু হইয়াছে এই ধারণা এবং তদনুযারী কৃত্তিবাসের সময় নির্ধারণ অনেকগুলি অনুমানের উপর নির্ভর করিতেছে। কৃত্তিবাস যে পুরোনো কবি তাহা প্রথম জয়ানন্দের উক্তি হইতে জানিতে পারি৷ …কৃত্তিবাস পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমে জীবিত ছিলেন৷ এই বিশ্বাস আসিয়াছে কৃত্তিবাসের আত্মবিবরণীর প্রকাশ এবং তদুপলক্ষ্যে পণ্ডিতদের আলোচনা হইতে। কিন্তু আত্মবিবরণীকে প্রামাণিক বলা যায় না, জোর করিয়া বলিলেও কালের অনুমান সিদ্ধ হয় না।’’ সুতরাং দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের সঙ্গে ড. সুকুমার সেন মহাশয় একটি বিষয়ে একমত ছিলেন যে কবি কৃত্তিবাস

পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগেও জীবিত ছিলেন। কিন্তু ড. সুকুমার সেন কৃত্তিবাসের কাব্যের রচনাকাল সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। তিনি কৃত্তিবাসের আত্মবিবরণী অংশের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে স্পষ্টতই মত প্রকাশ করেছেন— “অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে লেখা কৃত্তিবাসের কাব্যের কোন পুথি পাওয়া যায় নাই।’’ আবার অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে মন্তব্য করেছেন যে তিনি প্রাক্‌-চৈতন্যযুগের কবি ছিলেন এ সম্বন্ধে কোন দ্বিধা নেই, কিন্তু ঠিক কোন সময়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং কোন সময়ে শ্রীরাম পাচালী রচনা করেন সে বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে।

গৌড়েশ্বর অর্থাৎ কোনো এক গৌড়ের রাজার অনুরোধে কৃত্তিবাস “রামায়ণ” মহাকাব্যের অনুবাদ করেছিলেন—

বাপ মায়ের আশীর্বাদে গুরু আজ্ঞা দান।

রাজাজ্ঞায় রচে গীত সপ্তকাণ্ড গান।।

সাতকাণ্ড কথা হয় দেবের সৃজিত।

লোক বুঝিবার তরে কৃত্তিবাস পণ্ডিত।।

এই গৌড়েশ্বর হলেন রাজা গণেশ, সম্ভবত কবি ৪৫ বছর বয়সে গৌড়ের রাজা গণেশের রাজসভায় গিয়েছিলেন। রাজা গণেশের অনুরোধে কৃত্তিবাস রামায়ণের অনুবাদ করেন সম্ভবত ১৪১৮ খ্রিস্টাব্দে। এ বিষয়ে শ্রীহরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় মহাশয় তাঁর সম্পাদিত কৃত্তিবাসী রামায়ণের আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেছেন— ‘‘কৃত্তিবাসের রামায়ণ রচনার কাল ১৩৪০ শকাব্দ বলিয়া অনুমিত হয়।” কৃত্তিবাসী রামায়ণই প্রথম মুদ্রণ সৌভাগ্য লাভ করে। শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশন থেকে রেভারেন্ড উইলিয়াম কেরির উদ্যোগে সর্বপ্রথম কৃত্তিবাসী রামায়ণ ছাপা হয় ১৮০২-০৩ খ্রিস্টাব্দে এরপর ১৮৩০-৩৪ খ্রিস্টাব্দে জয়গোপাল তর্কালঙ্কার মহাশয়ের দ্বারা সংশোধিত, দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়, ‘শ্রীরাম পাঁচালী’র জনপ্রিয়তার এ এক বড় প্রমাণ।’’

কৃত্তিবাসের মৌলিকতা

কবি কৃত্তিবাসের জন্মকাল বা কাব্যরচনাকাল সম্পর্কে মতবিরোধ থাকলেও কবি যে আপন কবিত্ব শক্তির প্রভাবে প্রায় এক নতুন কাব্যের রচনা করেছিলেন সে বিষয়ে সকল পণ্ডিতরাই একমত। মহাকবি বাল্মীকি রচিত ‘রামায়ণ’ মহাকাব্যের আক্ষরিক অনুবাদ কৃত্তিবাস করেননি, করেছেন ভাবানুবাদ; রামায়ণের মূল কাহিনীকে সরল বাংলা পয়ার-ত্রিপদী ছন্দে বাঙালি পাঠক মনের উপযোগী করে রচনা করেছেন কবি কৃত্তিবাস এবং মূল চরিত্রগুলিও হয়েছে বাঙালি সমাজের উপযোগী।

‘রামায়ণ’ মহাকাব্য সংস্কৃত ভাষায় রচনা করেন মহামুনি বাল্মীকি; বাঙালি কবি কৃত্তিবাস সংস্কৃত-রামায়ণের হুবহু অনুবাদ না করে এক মৌলিক কাব্য রচনা করলেও মহামুনি বাল্মীকির সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত ছিলেন; সংস্কৃত রামায়ণও তিনি অধ্যয়ন করেছিলেন। কৃত্তিবাস তাঁর আত্মবিবরণী অংশে বাল্মীকির উল্লেখ করেছেন—

মুনি মধ্যে বাখানি বাল্মীকি মহামুনি।

পণ্ডিতের মধ্যে কৃত্তিবাস গুণী।

বাল্মীকি রামায়ণের কিছু কিছু কাহিনীকে তিনি গ্রহণ করেছেন, নিজ কল্পনাবলে সৃষ্টি করেছেন নতুন কাহিনী, কোথাও তিনি অনুসরণ করেছেন পুরাণকে, কখনও প্রচলিত গল্প কথাকে স্থান দিয়েছেন তার রামকথাতে। বাল্মীকি-রচিত কোনো কোনো কাহিনীকে কৃত্তিবাস বর্জন করেছেন— যেমন শিবপুত্র কার্তিকের জন্ম, বশিষ্ঠ মুনির সঙ্গে বিশ্বামিত্র মুনির বিরোধ, অম্বরিশ যজ্ঞ ইত্যাদি। কৃত্তিবাস নিজ প্রভাব বলে সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য নতুন কাহিনী। গুহকের সঙ্গে রামের মিত্রতা, গণেশের জন্ম, রামের বিমাতা কৈকেয়ীর স্বামী দশরথের কাছ থেকে বর লাভ, বালক হনুমানের দ্বারা সূর্যকে বাহুতলে ধারণ, রাবণের পুত্র বীরবাহুর যুদ্ধ এবং মৃত্যুবরণ, মেঘনাদের সঙ্গে যুদ্ধে লক্ষণের মুচ্ছিত হওয়া এবং হনুমান কর্তৃক বিশল্যকরণী আনয়ণ, রাবণকে পরাজিত করতে রামের দ্বারা দেবী দুর্গার অকালবোধন, রাবণকে পরাজিত করা, রাবণের কাছ থেকে রামের রাজনীতির শিক্ষা, রামের মনে সীতার প্রতি সন্দেহের উদ্রেক, লব-কুশের দ্বারা অশ্বমেধের ঘোড়া আটকানো, এবং পিতৃব্যদের সঙ্গে যুদ্ধ এবং তাদের অচেতন হওয়া ইত্যাদি। এছাড়া দস্য রত্নাকরের দ্বারা ‘মরা মরা’ বলতে বলতে ‘রাম’ শব্দ উচ্চারণ এবং তাঁর বাল্মীকি হয়ে ওঠার কাহিনী, ভগীরথের জন্ম বৃত্তান্ত, রামেশ্বরম্‌ দ্বীপ থেকে লঙ্কার সমুদ্রতট পর্যন্ত সেতুবন্ধনের সময় শিবলিঙ্গের প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কাহিনী কৃত্তিবাসের কল্পনা প্রসূত। বালীকি রচিত রামায়ণ কাব্যের মূল কাহিনীকে অক্ষুণ্ন রেখে কৃত্তিবাস যে অনুবাদ কাব্য ‘শ্রীরাম পাচালী’ রচনা করেছেন তা প্রায় মৌলিক কাব্যের মর্যাদা দাবী করতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!