মনসামঙ্গল কাব্য রচনায় কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের কৃতিত্ব ব্যাখ্যা কর।

কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ

চৈতন্যোত্তর যুগের (সপ্তদশ শতাব্দীতে) পশ্চিমবঙ্গের মনসামঙ্গল কাব্যধারার একজন শ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর মনসামঙ্গল সর্বপ্রথম মুদ্রণ সৌভাগ্য লাভ করেছিল। তিনি পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী হলেও সমগ্র বাংলাদেশেই তাঁর পুঁথি প্রচারলাভ করেছিল। তার কারণ মনসামঙ্গলের প্রায় প্রত্যেক পদসংকলনে তাঁর পদ স্থান লাভ করেছে। তাছাড়া পণ্ডিত রামগতি ন্যায়রত্ন তাঁর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাবে’ (১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দ) উল্লেখ করেছেন তিনি কেতকাদাসের পদ্মপুরাণ ছাড়া অন্য কোন কবির নাম জানতেন না। পূর্ববঙ্গে তাঁর কাব্য ‘ক্ষেমানন্দী’ নামে প্রচলিত ছিল। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল প্রকাশ করেন।

ক্ষেমানন্দের ব্যক্তি পরিচয় তাঁর দেওয়া আত্মপরিচয় থেকে জানা যায়। তাঁর নিবাস ছিল বর্ধমান জেলার অন্তর্গত বলভদ্রের তালুকে দামোদর তীরবর্তী কাপড়া গ্রামে, কায়স্থ বংশে। আত্মপরিচয়ে কায়স্থ বংশের কল্যাণ কামনা করেছেন—

কেতকার বাণী রক্ষ ঠাকুরাণী

কায়স্থ যতেক আছে।

তাঁর পিতা শঙ্কর মণ্ডল স্থানীয় ফৌজদার বারাখার অধীনে চাকরি করতেন। বারাখার মৃত্যুর পর সেই অঞ্চলে অরাজকতার সৃষ্টি হয়। তখন কবির পিতা উপদ্রুত অঞ্চল ছেড়ে জমিদার ভারমল্লের আশ্রয়ে এসে বসবাস করেন। ভারমল্পের কাছ থেকে তিনি তিনটি গ্রাম দানস্বরূপ গ্রহণ করেন। সে যাই হোক, বিচিত্র পরিবেশে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তার বাল্যকাল কেটে যায়। একদিন সন্ধ্যাবেলা জমিতে ধান কাটতে গিয়ে দেবী মনসার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। দেবী মনসা মুচিনীবেশে দেখা দিয়ে কবিকে মঙ্গলকাব্য রচনার নির্দেশ দেন— “ওরে পুত্র ক্ষেমানন্দ, কবিত্বে কর প্রবন্ধ আমার মঙ্গল গাইআ বুল’ (বোল)।

কবির নাম নিয়ে মতভেদ আছে। কারণ কারো কারো মতে, ক্ষেমানন্দ ও কেতকাদাস ভিন্ন ব্যক্তি। কিন্তু আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন— “ক্ষেমানন্দ নিজেকে কেতকাদাস অর্থাৎ মনসার দাস বলিয়া পরিচয় দিয়াছে। তাঁহার কাব্যের কোনও কোনও স্থলে কেবল কেতকাদাস ভণিতা দেখিয়া তাঁহাকে স্বতন্ত্র লোক বলিয়া ভ্ৰম করিবার কোনও কারণ নাই” (বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস—২০০২, পৃষ্ঠা-৩৬২)। সুকুমার সেনের মতে— “ক্ষেমানন্দ নামে (বা উপাধিতে) আর এক কবি শুধু বেহুলা-লখিন্দর পালা সইয়া এক ছোট মনসামঙ্গল পাঁচালী লিখিয়াছিলেন।” (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস—১৯৭৫, পৃষ্ঠা-২২৮)

কবির দেওয়া আত্মবিবরণী থেকে তাঁর কাব্যের রচনাকাল সম্বন্ধে অনুমান করা যায়। তাঁর উল্লিখিত বারাখাঁ দক্ষিণ রাঢ়ে অবস্থিত সেলিমাবাদ সরকারের শাসনকর্তা ছিলেন। ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে বারাখাঁ প্রদত্ত একটি দানপত্র পাওয়া গেছে। এই সময়ের পর তিনি যুদ্ধে নিহত হন এবং তারপর কেতকাদাসের মনসামঙ্গল রচিত হয়। দীনেশচন্দ্র সেন এই মত সমর্থন করেন। বর্ধমানের পানাগড় রেল স্টেশনের নিকটেই দামোদরের তীরে বারাখাঁর কবর রয়েছে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতেন। বারাখাঁর অঞ্চল ছেড়ে যে ভারমল্প নামক জমিদারের আশ্রয়ে আশ্রয়লাভ করেন তখন ভারমল্ল যুবক। সেই সময়টা ১৬৭৫-৮০ খ্রিস্টাব্দ। সুতরাং অনুমান করা যায়, কেতকাদাস সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে তাঁর কাব্য রচনা করেছিলেন।

পণ্ডিত কবি ক্ষেমানন্দের কাব্যের বহু জায়গায় শ্রীচৈতন্যের উল্লেখ আছে। কাহিনিবয়ন ও চরিত্রচিত্রণে কবির কৃতিত্ব সমধিক। কাহিনির দিক থেকে ক্ষেমানন্দের কাব্যে কোন কোন ক্ষেত্রে অন্যান্য মনসামঙ্গলের থেকে সামান্য পার্থক্য আছে। মনসার কেয়াবনে জন্ম কাহিনিটি ক্ষেমানন্দের নুন সংযোজন। কতকগুলি নামের মধ্যে নতুনত্ব আছে। যেমন, বেহুলার মার নাম চুহিলা। শুধু বেহুলা লখিন্দরের কাহিনি ছাড়া অন্য মঙ্গলকাব্যের মতো পৌরাণিক আখ্যানের বর্ণনা কবির কাব্যে নেই।

চরিত্রচিত্রণে বিশেষ করে চাঁদ চরিত্রের রূপায়ণে কবি দ্বিজ বংশীদাসের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে (আশুতোষ ভট্টাচার্যের মত)। চাঁদের চরিত্রের দৃঢ়তা সর্বত্র রক্ষিত হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি একজন মনসাভক্তে পরিণত হয়েছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে চাদের চরিত্র বেশ জীবন্ত। যেমন, লখিন্দরের মৃত্যুসংবাদে চাঁদের প্রতিক্রিয়া—

লোহার বাসরে মৈল বালা লখীন্দর

শুনিয়া যে চাদ বণ্যা হরষিত হৈল।

কান্ধে হেতালের বাড়ি নাচিতে লাগিল।।

ভাল হৈল পুত্র মৈল কি আর বিষাদ।

কানি চেঙ্গমুড়ি সনে ঘুচিল বিবাদ।।

মনসার ঈর্ষাকুটিল চরিত্রও কবির লেখনীতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বিষপানে শিবের মৃত্যুতে তার বিমাতা বিধবা হল এই আনন্দে মনসা বলেছে—

বিষপানে মরিল মহেশ মোর বাপ।

চণ্ডিকা রাণ্ডিকা হৈল ঘুচিল সস্তাপ।।

ক্ষেমানন্দের কাব্যে সপ্তদশ শতকের বাঙালিজীবন বিভিন্ন প্রসঙ্গে চিত্রিত হয়েছে। বেহুলার যাত্রাপথের বাইশটি ঘাটের বিবরণ, লখিন্দরের বিবাহ, জন্ম প্রসঙ্গ, জাতকর্মের বিবরণ প্রভৃতি সমকালীন বাঙালি জীবনের পরিচয়বহ। এমনকি সমকালীন সহমরণ প্রথার পরিচয় রয়েছে শিবের সাময়িক মৃত্যুতে গঙ্গার সহমরণ ইচ্ছার মধ্যে।

মনসামঙ্গলের মূল রস শান্ত হলেও ক্ষেমানন্দের কাব্যে হাস্য ও করুণ রসের পরিচয় মেলে। বেহুলার মর্মস্পর্শী করুণ আর্তনাদে করুণরসের পরিচয় মেলে—

প্রাননাথ কোলে কালে বেহুলা নাচনী।

ঘরে হৈতে শোনে তাহা সেনা বাণী।।

ক্রন্দন শুনিয়া তার শুকাইল হিয়া।

পুত্রবধু দেখিবারে চলিল ধাইয়া।।

সুকুমার সেনের মতে— “ক্ষেমানন্দের কনার প্রধান বিশেষত্ব সরলতা ও সহৃদয়তা।” যেমন, শ্বশুরবাড়িতে ফেরার পথে বেহুলা স্বামীকে নিয়ে ছদ্মবেশে বাপের ঘরে দেখা দিতে চলেছে, তখনকার বর্ণনা—

গলায় রুদ্রাক্ষামালা   স্কন্ধে ঝুলি হাতে থালা

লখিন্দর চলে তার আগে।

বেহুলা যায় পিছু পিছু     লজ্জায় না বলে কিছু

মায়ারূপে দেহে ভিক্ষা মাগে।।

যদিও সুকুমার সেন কেতকাদাস ক্ষেমানন্দকে কৃত্তিবাস, মুকুন্দ ও কাশীরামের মতো প্রতিনিধিস্থানীয় কবি বলেছেন তবুও বেশিরভাগ সমালোচকেরা মনে করেন কেতকাদাস দ্বিতীয় শ্রেণির শ্রেষ্ঠ কবি। কৃত্তিবাস প্রভৃতির প্রতিভার সঙ্গে ক্ষেমানন্দের প্রতিভার তুলনা অবান্তর। তবুও তাঁর কাব্যের জনপ্রিয়তার মূলে ছিল তাঁর যুগের সামাজিক রীতিনীতি ও ভৌগোলিক সংস্থানের বর্ণনা এবং সহৃদয়তা ও সরলতা। তাঁর ভাষা স্বচ্ছ সরল প্রসাদগুণযুক্ত এবং গ্রাম্যতা দোষমুক্ত। তাছাড়া তিনি তার কাব্যে শিথিলতা বর্জন করে সর্বত্র উচ্চতর আদর্শ বজায় রাখতে পেরেছেন। তাঁর কাব্যে কবিত্বের চেয়ে পাণ্ডিত্য বড় হয়ে ওঠায় কাব্যসুষমা কোথাও কোথাও পাণ্ডিত্যের ভারে জ্ঞান হয়ে পড়েছে। তবুও ছাপাখানার কল্যাণে তাঁর কাব্য প্রথম মুদ্রিত হওয়ায় তা ঊনবিংশ শতাব্দীর শিক্ষিত সমাজে পরিচিতি লাভ করে।

১. বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস: আশুতোষ ভট্টাচার্য

২. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত: অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

৩. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস: সুকুমার সেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!