কোরেশী মাগন ঠাকুরের ‘চন্দ্রাবতী’ কাব্য সম্পর্কে আলোচনা কর।
কোরেশী মাগন ঠাকুরের ‘চন্দ্রাবতী’
আরাকান রাজসভার অন্যতম খ্যাতিমান ব্যক্তি হিসেবে কোরেশী মাগন ঠাকুরের নাম উল্লেখযোগ্য। কবি কোরেশ বংশজাত সিদ্দিকী গোত্রভুক্ত মুসলমান। তার প্রকৃত নাম জানা যায়নি। মাগন ঠাকুর তাঁর ডাক নাম। ‘ঠাকুর’ আরাকানি রাজাদের সম্মানিত উপাধি। কবির প্রপিতামহ ছিলেন আরব থেকে আগত কোরেশ। মাগন ঠাকুরের জন্ম চট্টগ্রামের চক্রশালা বা চাশখালায়। পরে রোসাঙ্গবাসী হন। তিনি ‘চন্দ্রাবতী’ নামক কাব্যের রচয়িতা এবং কবি আলাওলের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। ড. মুহম্মদ এনামুল হক কবির কাল আনুমানিক ১৬০০ থেকে ১৬৬০ সাল বলে নির্দেশ করেছেন। ‘চন্দ্রাবতী’ কাব্যটির প্রথম ও শেষাংশ খণ্ডিত বলে কবির নিজের পরিচয় তেমন নেই। কবি আলাওল মাগন ঠাকুরের উৎসাহে ‘সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল’ কাব্য রচনা করেন। সেখানে মাগন ঠাকুরের কিছুটা পরিচয় দেওয়া হয়েছে। মাগন ঠাকুর রোসাজের প্রধান মন্ত্রী ছিলেন। সেখানেই তিনি বসবাস করতেন এবং সেখানেই তিনি মারা যান। মাগন ঠাকুর গুণশালী ও বহু শাস্ত্রবিদ কবি ছিলেন। প্রধান মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেও তার পক্ষে কাব্যরচনা করা সম্ভব হয়েছিল। তিনি আরবি ফারসি বর্মি ও সংস্কৃত ভাষা জানতেন। কাব্য, নাটক ও সঙ্গীতে তার ব্যুৎপত্তি ছিল। কবি আলাওল মাগন ঠাকুরের বিদ্যাবত্তার পরিচয় দিয়েছেন এভাবে—
আরবী ফারসী আর মঘী হিন্দুয়ানী।
নানা শাস্ত্র পারগ সঙ্গীতাজ্ঞা গুণী॥
কাব্য অলঙ্কার জ্ঞাতা ষষ্ঠম নাটিকা।
শিল্পগুণ মহৌষধি নানাবিধ শিক্ষা॥
কবি আলাওল মাগন ঠাকুরের নামের একটি তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন—
মান্যের ‘ম’-কার আর ভাগ্যের ‘গ’-কার।
শুভযোগে নক্ষত্রের আনিল ‘ন’-কার॥
এ তিন অক্ষরে নাম ‘মাগন’ সম্ভবে।
কবি এ দেশে প্রচলিত রূপকথার কাহিনিকে তাঁর কাব্যের উপজীব্য করেছিলেন এবং যেভাবে তিনি তা রূপায়িত করেছেন তাতে তার মৌলিক প্রতিভার পরিচয় ফুটে উঠেছে। ভদ্রাবতী নগরের রাজপুত্র বীরভান মন্ত্রীপুত্র সুতের সহায়তায় কীভাবে সরন্দ্বীপ রাজকন্যা অপূর্বসুন্দরী চন্দ্রাবতীকে লাভ করেছিলেন তাই এ কাব্যে বর্ণিত হয়েছে। বীরভানের রূপগুণের কথা শুনে এবং তার চিত্রার্পিত রূপ দেখে রাজকন্যা চন্দ্রাবতী রাজপুত্রের রূপ ধ্যান করে। সে বীরভানকে পতিরূপে পেতে চায়। চন্দ্রাবতীর সাথী চিত্ৰাবতী রূপসী চন্দ্রাবতীর এক মনোরম চিত্র তৈরি করে তাতে চন্দ্রাবতীর ঠিকানা লিখে উড়িয়ে দেয়। সেটি ঘুমন্ত কুমারের বুকে গিয়ে পড়ে। রাজপুত্র জেগে ওঠে সে চিত্রপট দেখে চন্দ্রাবতীর সন্ধানে বিবাগী হয়ে ছোটে এবং নাগের-বাঘের-যক্ষের সঙ্গে দ্বন্দ্বে-সংঘর্ষে জয়ী হয়ে, অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ অতিক্রম করে, ষড়যন্ত্র দুঃখবিপদ উত্তীর্ণ হয়ে অবশেষে চন্দ্রাবতীকে লাভ করে।
কবি চরিত্রগুলোকে জীবন্ত ও মানবিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করে চিত্রিত করেছেন। এ কাব্যের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ‘আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে বলা হয়েছে—‘‘চন্দ্রাবতী কাব্যখানি কবিত্বের অফুরন্ত ভাণ্ডার ও কাব্যকলার চরম নিদর্শন না হইলেও, তাহার স্থানে স্থানে মুক্তার ন্যায় কবিত্ব ছড়াইয়া রহিয়াছে।…বাস্তব ও অবাস্তবের মিলনে প্রকৃত ও অতিপ্রাকৃতের সামঞ্জসাসাধনে এই কবি সিদ্ধহস্ত। এই দুই বস্তুর সমাবেশে সমগ্র কাব্যখানি পাঠককে টানিয়া মর্ত্যের ধূলিকণা হইতে বহু ঊর্ধ্বে রূপকথার রাজ্যে লইয়া যায়।’’ কাব্যের অনেক জায়গায় কাব্যসৌন্দর্যমণ্ডিত আবেগ ব্যক্ত হয়েছে। যেমন—
হাহা কন্যা চন্দ্রাবতী তুহ্মি প্রাণধন।
কর্ণের কুণ্ডল তুহ্মি আঁখির অঞ্জন॥
নয়ানের জুতি তুহ্মি ভিনে হএ ঘোর।
কেমনে দেখিব তোর রূপ মনুহর॥
কেমতে শুনিব তোর মুখের বচন।
কেমনে দেখিব তোর পাএর চলন॥
কেমতে ভুরুর কালা চন্দ্রিমা দেখিব।
কেমতে লোচন চারু পোতলি মিলিব।
কেবা মোরে সরন্দ্বীপ নগর দেখাএ।
কেবা বিরহের জ্বালা আনল নিবাএ।
ড. আহমদ শরীফ লিখেছেন— ‘‘কবিত্বে পাণ্ডিত্যে মাগন প্রথম শ্রেণির একজন নন বটে, তবে তাঁর ভাষা সুন্দর ও সুবিন্যস্ত, ভঙ্গি ঋজু এবং কাব্যটি বিভিন্ন রসের ও বিচিত্র ঘটনার সমাবেশের দরুন সুখপাঠ্য। দেশী ঐতিসম্মত উপকরণে ও আদর্শে তিনি সুপ্রাচীন দৈশিক রীতিতে নির্মাণ করেছেন এ কাব্যসৌধ।’’
কবি পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন, কিন্তু তাঁর কাব্যটিকে ভিন্ন ভাষার কাব্যের প্রভাব থেকে দূরে রাখেন। মৌলিক পথে বিচরণ করার এই অনন্য নিদর্শন মধ্য যুগের সাহিত্যে স্বাতন্ত্র্যের পরিচায়ক ড. ওয়াকিল আহমদ কবি মাগন ঠাকুর সম্পর্কে বলেছেন— ‘‘তিনি যে পরিমাণে জ্ঞানী ছিলেন সে পরিমাণে শিল্পী ছিলেন না। এ জন্য তাঁর সযত্ন প্রয়াস প্রাণহীন বস্তুপিণ্ডে নিঃশেষিত হয়েছে, কল্পনানুরঞ্জন দ্বারা তিনি অনির্বচনীয় শিল্পমায়া রচনা করতে পারেননি।’’
Leave a Reply