বাংলা থিয়েটারে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান আলোচনা কর।
গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও বাংলা থিয়েটার
সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে গিরিশের মৃত্যু পর্যন্ত (১৮৭২-১৯১২) বাংলা থিয়েটার গিরিশচন্দ্রকে (১৮৪৪-১৯১২) বাদ দিয়ে চলতে পারেনি। আবার গিরিশচন্দ্রেরও সমগ্র নাট্যজীবন এই সময়কার থিয়েটারগুলিকে অবলম্বন করেই গড়ে ও বেড়ে উঠেছে। থিয়েটার ও গিরিশচন্দ্রের পারস্পরিক সম্পূরণের মধ্যে দিয়েই বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রথম চল্লিশ বছর কেটেছে। ‘গিরিশ যুগ’ নামাঙ্কিত থিয়েটারের এই সময়কালকে পেশাদারি থিয়েটারের সম্ভাবনা ও সাফল্যের সুবর্ণযুগ’ও বলা হয়ে থাকে। সেই গিরিশচন্দ্রকে বাদ দিয়ে যেমন এই যুগের থিয়েটারের আলোচনা সম্ভব নয়, তেমনি সমসাময়িক থিয়েটারের মঞ্চব্যবস্থা ও প্রেক্ষালয় পরিমণ্ডল বিচ্ছিন্ন করে গিরিশচন্দ্রের নাট্যজীবন আলোচনা অসম্ভব।
নাট্যশালার প্রায় সর্বক্ষেত্রেই গিরিশ নিজেকে নিযুক্ত রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন সে যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। ছিলেন একনিষ্ঠ অভিনয় শিক্ষক। মঞ্চাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনে সুনিপুণ। থিয়েটার প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ‘ম্যানেজারি’তে সুদক্ষ এবং অসাধারণ সংগঠক। থিয়েটারে অভিনয়ের প্রয়োজনেই তিনি নাট্য রচনা শুরু করেন এবং ক্রমে সে যুগের তথা বাংলা নাট্য জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের মর্যাদা লাভ করেন। একজন মানুষের মধ্যে একসঙ্গে এতগুলি থিয়েটার জগতের গুণাবলী থাকলে, স্বভাবতই সব রঙ্গালয়ই তাকে পেতে চাইবে। গিরিশচন্দ্রও নিরলসভাবে নানা রঙ্গালয়ের সঙ্গে পেশাদারি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে তার নাট্যক্রিয়াকর্ম করে গেছেন। নাটক রচনা, নাট্যরূপ দেওয়া, সঙ্গীত রচনা, অভিনয় শিক্ষাদান, নাট্য পরিচালনা, মঞ্চ পরিকল্পনা এবং অভিনয়ে অংশ গ্রহণ করা—সব করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক থিয়েটারের ব্যবসায়িক ও পেশাগত দিক নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে। অনেক সময়েই নিজে উদ্যোগী হয়ে নতুন নতুন থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রথম দিকে নিজে থিয়েটারের মালিক হয়েছেন। পরে অবশ্য পারিবারিক কারণে তিনি আর কখনোই কোনো মঞ্চের মালিক হননি। কিন্তু অন্যে মালিক হলেও, তিনিই সেই প্রতিষ্ঠিত থিয়েটারের প্রধান উদ্যোগী এবং প্রাণপুরুষ হয়ে থেকেছেন। তাই গিরিশচন্দ্রকে বাদ দিয়ে যেমন এই সময়কালের থিয়েটারের ইতিহাস আলোচনা করা যায় না, তেমনি এই সময়কালের পরিমণ্ডল বাদ দিলে গিরিশচন্দ্রকে পুরোপুরি বুঝে ওঠাও সম্ভব হবে না। একটা বাদ দিয়ে আরেকটা দেখাও গেলে নিঃসন্দেহে সে আলোচনা অসম্পূর্ণ হয়ে পড়তে বাধ্য।
গিরিশের নাট্যজীবন মোট পঁয়তাল্লিশ বছরের। বাগবাজারের এমেচার থিয়েটারের হয়ে ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে দীনবন্ধুর ‘সধবার একাদশী’ নাটকে নিমচাঁদ চরিত্রে অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে গিরিশের নাট্যজীবনের শুরু। শ্যামবাজার নাট্য সমাজের নামে ‘লীলাবতী’তে ললিতমোহন করেন। এই দল ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করে অভিনয় শুরু করলে গিরিশ প্রথমে তাতে ছিলেন না, পরে ‘কৃষ্ণকুমারী’র অভিনয়ের সময়ে (১৮৭৩) ‘এমেচার’ হিসেবে যোগ দেন এবং ভীমসিংহের ভূমিকায় প্রভূত খ্যাতিলাভ করেন। থিয়েটার জীবনের শুরু ও প্রতিষ্ঠার পর থেকে তাকে আর থেমে থাকতে হয়নি। তারপরে নিজের মালিকানায় ন্যাশনাল থিয়েটার কিছুদিন চালান। প্রতাপচাঁদ জহুরি ন্যাশনাল থিয়েটারের মালিক হয়ে গিরিশকে পেশাদারিভাবে থিয়েটারে নিয়ে আসেন। গিরিশ ১৫০ টাকা মাইনের চাকুরি জীবনের নিরাপত্তা ছেড়ে প্রতাপ জহুরির থিয়েটারে একশো টাকার মাইনেতে যোগ দেন। এরপর থেকে গিরিশ সারাজীবন থিয়েটারের সঙ্গে পেশাগতভাবে নিজের জীবনকে জড়িয়ে ফেলেন। থিয়েটার ছাড়া অন্য কোথাও অন্য কোনো জীবিকা গ্রহণ করেননি।
ব্যবসায়িক থিয়েটার পেশাগত ভাবে পরিচালনার নিয়মনীতি এখান থেকেই চাল হল। এখানেই অভিনয় করতে করতে নাটকের অভাবে একেবারে ‘দায়ে পড়ে’ গিরিশচন্দ্রকে নাট্য রচনা শুরু করতে হয়। রঙ্গমঞ্চের শূন্য উদর পূর্ণ করতে নাটক রচনায় হাত দিতে গিয়ে বেতনভোগী গিরিশ পেশাদারি মঞ্চের ‘প্লে রাইট’ হয়ে পড়লেন। থিয়েটারের অন্য কাজকর্মের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নাট্যকার জীবনের অধ্যায়ও অব্যাহতভাবে চলতে লাগলো।
তাঁর সমকালীন প্রায় প্রত্যেকটি নাট্যালয়ের সঙ্গেই তিনি যুক্ত ছিলেন। গুর্মুখ রায়ের স্টার থিয়েটার, হাতিবাগানের স্টার থিয়েটার, এমারেল্ড, মিনার্ভা, ক্লাসিক, কোহিনূর প্রভৃতি তৎকালীন শ্রেষ্ঠ রঙ্গালয়ের অনেকগুলির প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোগী তিনি। আবার এগুলির সঙ্গে তিনি বারে বারে যুক্ত হয়ে থিয়েটারের গতিধারাকে নিজের মতো নিয়ন্ত্রণ করে নিয়ে গেছেন।
কর্মজীবনের ৪৫ বছরের মধ্যে পঁয়ত্রিশ বছর তিনি নাট্যরচনা করেছেন। গিরিশ নাটক লেখা শুরু করেন তাঁর বত্রিশ বছর বয়সে। বেঁচে ছিলেন সাতষট্টি বৎসর ১১ মাস। এই সময়ের মধ্যে অনলস নাটক লিখে গিয়েছেন তিনি।
নিজের মালিকানায় ন্যাশনাল থিয়েটারে থাকাকালীন গিরিশ তিনটি ছোট ছোট গীতিনাট্য অপেরা রচনা করেন মুকুটাচরণ মিত্র ছদ্মনামে। অকালবোধন, আগমনী, দোললীলা। এই সময়ে তিনি বঙ্কিমের উপন্যাস (কপালকুণ্ডলা, বিষবৃক্ষ, দুর্গেশনন্দিনী), নবীনচন্দ্র সেনের পলাশীর যুদ্ধ, মাইকেলের মেঘনাদবধ, দীনবন্ধুর যমালয়ে জীবন্ত মানুষ ইত্যাদির নাট্যরূপ দিয়েছিলেন। ধারাবাহিক নাটক লিখতে শুরু করলেন প্রতাপ জহুরির থিয়েটারে এসে। মায়ারু, আলাদীন, মোহিনীপ্রতিমা, আনন্দরহো, রাবণবধ, সীতার বনবাস, অভিমন্যবধ, লক্ষ্মণবর্জন, সীতার বিবাহ, রামের বনবাস. সীতাহরণ, মলিনমালা, ভোটমঙ্গল, পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস। চুক্তিবদ্ধভাবে তাঁকে নাটক গীতিনাট্য ও নক্সা-প্রহসন লিখে যেতে হয়। ‘রাবণবধ’ অভিনয়ে সার্থক হয় এবং ‘সীতার বনবাস’ দর্শক আনুকূল্য লাভ করে। চুক্তিবদ্ধ প্লে-রাইটের বিড়ম্বনা একটা ঘটনা থেকে বোঝা যাবে। সীতার বনবাস দর্শক আনুকূল্য পেলে প্রতাপ জহুরি বুঝেছিলেন সীতার দুঃখকথা এবং লবকুশের গান এই নাটকের সাফল্যের মূলে। সীতার বনবাসের পর গিরিশ অভিমন্যুবধ লিখলেন এবং এখানে অভিনীত হয়ে দর্শক আকর্ষণে ব্যর্থ হলে প্রতাপ জহুরি গিরিশকে বলেছিলেন—‘‘বাবু, যব দোসরা কিতাব লিখগে ত ফির ওহি দুনো লেড়কা ছোড় দেও।’’ এবার গিরিশ লিখলেন ‘লক্ষ্মণ বর্জন’ এবং নিয়ে এলেন ঐ ‘দুনো লেড়কা’ লবকুশকে। তাদের ছেড়ে দিলেন তার নাটকের মাধ্যমে মঞ্চে। অকিঞ্চিৎকর এই নাটক চলল ভালো, উচ্চমানের নাটক অভিমন্যুবধ ব্যর্থ হলো। ব্যবসায়ি জহুরি লক্ষ্মীর কৃপা কোথায় বুঝেছিলেন। প্লে-রাইট গিরিশ উপায়ান্তরবিহীনভাবে সেই ধরনের নাটক লিখতে বাধ্য হলেন। গুর্মুখ রায়ের স্টার উদ্বোধন হল গিরিশের নাটক ‘দক্ষযজ্ঞ’ দিয়ে। তারপরে এখানে অভিনয়ের জন্য লিখলেন ধ্রুবচরিত্র, নলদময়ন্তী। গুর্মুখ স্টার ছেড়ে চলে গেলে, তারপর লিখলেন কমলে কামিনী, বৃষকেতু, শ্রীবৎস চিন্তা, চৈতন্যলীলা, প্রহ্লাদচরিত্র, চৈতন্যলীলা (২য় ভাগ), প্রভাসযজ্ঞ, বুদ্ধদেবচরিত, বিশ্বমঙ্গল ঠাকুর, বেল্লিকবাজার, রূপসনাতন, নিমাই সন্ন্যাস। বোঝা যায় এই সময়ে গিরিশের নাট্যরচনার ক্ষমতা পূর্ণমাত্রায় প্রকাশিত। স্টারে সেই সময়ে মঞ্চ মালিকের কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। গিরিশই ছিলেন সর্বেসর্বা। নিজের খুশি মতো নাটক রচনার সুযোগ পেয়ে গিরিশ তার শ্রেষ্ঠ কয়েকটি নাটক এই সময়ে রচনা ও অভিনয় করেন। ‘চৈতন্যলীলা’ তো বাংলা থিয়েটারে অভিনয়ের কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে। নলদময়ন্তী, বুদ্ধদেবচরিত, বিমঙ্গল ঠাকুর, রূপসনাতন, প্রহ্লাদচরিত্র তাঁর পৌরাণিক নাটকের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা।
এমারেল্ড থিয়েটারে কুড়ি হাজার টাকা বোনাস ও তিনশো পঞ্চাশ টাকা মাইনেতে যোগ দিয়ে গিরিশ লিখেছিলেন খুব কম নাটক। পূর্ণচন্দ্র, বিষাদ। হাতিবাগানে নতুন স্টার থিয়েটার তৈরির উদ্যম নিয়ে সঙ্গী-সাথীদের নিজের বোনাসের ষোল হাজার টাকা দিয়ে দেন। এমারেল্ড চুক্তিবদ্ধ থাকার জন্য ‘সেবক’ ছদ্মনামে লুকিয়ে লুকিয়ে লিখেছেন ‘নসীরাম’; যা কিনা হাতিবাগানের স্টারের উদ্বোধন রজনীতে অভিনীত হলো। স্টারের ড্রামাটিক ডিরেক্টার থাকাকালীন লিখলেন প্রফুল্ল, চণ্ড, মলিনাবিকাশ, মহাপূজা, হারানিধি, কালাপাহাড়, হীরক জুবিলী, পারস্য প্রসূন, হাল্কা নৃত্যগীতের ছোট নাটক। শুধুই অভিনয়ের জন্য লেখা, প্রফুল্ল তাঁর প্রথম সামাজিক নাটক। এর আগে গিরিশ কখনো সামাজিক নাটক লেখেননি। সামাজিক নাটক লেখা আর ‘নর্দমা ঘাঁটা’ তার কাছে একই রকম মনে হতো। কিন্তু তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘স্বর্ণলতা’ উপন্যাসের নাট্যরূপ ‘সরলা’ (অমৃতলাল বসুকৃত) খুবই জনপ্রিয় হলে গিরিশকে মঞ্চের চাহিদায় লিখতে হল ‘প্রফুল্ল’। সেই সামাজিক নাটক লিখতেই হল তাঁকে। তারপরে হারানিধি, মায়াবসান। পরে আরো আরো।
মিনার্ভার উদ্বোধন হয় গিরিশের অনুবাদ করা ‘ম্যাকবেথ’ নাটক দিয়ে। গিরিশ এখানে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন ম্যানেজার, নাট্যকার ও শিক্ষক হিসেবে। প্রচুর পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে ‘ম্যাকবেথ’ অভিনয় করা হলো। কিন্তু এই বিশ্ববিশ্রুত নাটক দর্শক আকর্ষণে ব্যর্থ হল। ভালো নাটকের জন্য তার এতো পরিশ্রমের এই ব্যর্থতা লক্ষ করে গিরিশ বলেছিলেন—‘‘নাটক দেখিবার যোগ্যতা লাভে ইহাদের এখনও বহু বৎসর লাগিবে, নাটক বুঝিবার সাধারণ দর্শক এখনও রঙ্গালয়ে তৈয়ারী হয় নাই। পেশাদার থিয়েটার প্রতিষ্ঠানে আমার যে আপত্তি ছিল—ইহাও তাহার একটি কারণ।
ম্যাকবেথ ব্যর্থ হলে গিরিশ লিখলেন মুকুলমুঞ্জরা ও আবু হোসেন। অচিরাৎ দর্শকপরিপূর্ণ হয়ে গেল প্রেক্ষাগৃহ। ম্যাকবেথ ছেড়ে আবুহোসেনের প্রতি দর্শকের পক্ষপাতিত্ব গিরিশের নাট্যভাবনাকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত করলো। শেক্সপীয়র এবং অন্যান্য ভালো বিদেশী নাটকের অনুবাদ করে অভিনয়ের যে পরিকল্পনা গিরিশের ছিল ম্যাকবেথের তিক্ত অভিজ্ঞতায় তিনি তা থেকে নিরস্ত হলেন। এবারে লিখলেন অনেকগুলি হাল্কা প্রহসন ও নাচ-গানের নাটক। সপ্তমীতে বিসর্জন, বড়দিনের বখশিস, স্বপ্নের ফুল, সভ্যতার পাণ্ডা, ফণীর মণি, পাঁচ কনে। বড়ো নাটক বলতে একমাত্র ‘জনা’। ‘জনা’ তার উল্লেখযোগ্য ভালো নাটক। অভিনয়েও সাফল্যলাভ করেছিল।
ক্লাসিক থিয়েটারে যোগ দেন তিন বছরের এগ্রিমেন্টে নাট্যকার, নাট্যশিক্ষক ও নাট্যাচার্যরূপে। বছরে চারটি নাটক (দুটি বড়ো) লিখে দেবার চুক্তিতে আবদ্ধ হন। ক্লাসিকের উদ্বোধন হয় গিরিশেরই পুরনো নাটক নল-দময়ন্তী ও বেল্লিক বাজার দিয়ে। তারপরে ক্লাসিকে অভিনয়ের জন্য লেখেন—হাল্কা গীতিনাট্য ও প্রহসন—দিলদার, অভিশাপ, অশ্রুধারা, আয়না, মনের মন। বড়ো নাটকের মধ্যে পাণ্ডব-গৌরব ও সনাম উল্লেখযোগ্য। সত্যম তো মুসলমান দর্শকদের আপত্তিতে বন্ধ করে দিতে হয় লোকসান সত্ত্বেও। একমাত্র ‘পাণ্ডব-গৌরব’ তাঁর ভালো পূর্ণাঙ্গ নাটক।
দ্বিতীয় দফায় মিনার্ভায় আবার এসে তিনি শেষদিকটা এখানেই কাটান। মাঝে মাঝে অন্য থিয়েটারেও গেছেন। ১৮৯৮ থেকে ১৯০৭-এর দীর্ঘ সময়ে তিনি গীতিনাট্য প্রহসন লেখেন—মণিহরণ, নন্দদুলাল, হরগৌরী, বাসর, য্যায়সা ক্যা ত্যায়সা, ছটাকী। স্টেজে অভিনয় করছেন সীতারাম, আবার গ্রীনরুমে বসে মুখে মুখে বলে যাচ্ছেন মণিহরণ। তারই ফাকে ২৮টি গানও লিখেছিলেন। সেই নাটক রিহার্সাল দিয়ে পরের রবিবার অভিনয় করা হলো।
পূর্ণাঙ্গ নাটক বলিদান, সিরাজদৌল্লা, মীরকাশিম, ছত্রপতি শিবাজী। ১৯০৫-এর ‘বঙ্গভঙ্গ’ প্রতিরোধে যে প্রবল আন্দোলন বাংলায় গড়ে ওঠে, তার মধ্যে জাতীয়তাবোধ ও স্বদেশানুরাগ মূর্ত হয়ে উঠেছিল। রঙ্গমঞ্চও সেই জনজোয়ারের আবেগকে অস্বীকার করতে পারেনি। জনমানসের স্পন্দন উপলব্ধি করে সাধারণ রঙ্গালয় ইতিহাসের কাহিনী নিয়ে স্বদেশপ্রেমের নাটক অভিনয় করতে থাকে। মিনার্ভায় গিরিশ পর পর এই রকমের নাটকগুলি লিখে গেলেন। অভিনয়ে অভূতপূর্ব জনসমর্থনও লাভ করা গেল। গিরিশ এর আগে অকিঞ্চিৎকর দু-একটি ছাড়া আর কোনো ঐতিহাসিক বা দেশাত্মবোধের নাটক রচনা করেননি। কিন্তু জাতীয় আন্দোলনের সময়ে জনসমর্থনের প্রত্যাশায় ও স্বদেশানুরাগের দাবীতে গিরিশ লিখে ফেললেন সিরাজদৌল্লা, মীরকাশিম, ছত্রপতি শিবাজী।
তৃতীয় দফায় মিনার্ভায় থাকাকালীন (১৯০৮-১১) লিখেছিলেন শাস্তি কি শান্তি, শঙ্করাচার্য, অশোক, তপোবন।
গিরিশকে নাটক লিখতে হয়েছে তাঁর সময়কালীন থিয়েটারের ব্যবস্থা ও পরিবেশের মধ্যে থেকে। তাঁর মধ্যে মঞ্চমালিক যেমন আছে, তেমনি রয়েছে দর্শক সম্প্রদায়। আবার মঞ্চের অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক-গায়িকা ও নৃত্যশিল্পী। সব কিছুকে মাথায় রেখেই নাটক লিখতে হয়েছে এবং বিশুদ্ধ নাট্যরসের চেয়ে মঞ্চ সাফল্যের তাগিদই সেখানে কাজ করেছে বেশি। যাত্রার রসপুষ্ট সাধারণ দর্শকের মর্মাশ্রয়ী নাটক লিখতে গিয়ে তিনি ধর্মাশ্রয়ী পৌরাণিক নাটক লিখলেন, নর্দমার কাদা ঘাঁটতে হবে জেনেও লোকচাহিদার জন্যে সামাজিক নাটক-প্রহসন-নক্সা লিখলেন। গীতিনাট্য-পঞ্চরং লিখতে হলো অজস্র, রঙ্গমঞ্চের উদরপূর্তি ও সাধারণ দর্শকের মানসপূর্তির জন্য। তাছাড়া তখনকার চলতি প্রথামতো দুর্গাপূজা, জন্মাষ্টমী, দোল, বড়দিন, ভাো, মজাদার কেলেঙ্কারীর কোনো ঘটনা—এই সমস্ত তাৎক্ষণিক বিষড়ে নাট্যরচনা করতে হয়েছে। তার বাইরে পৌরাণিক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে অনেকগুলি নাটক লিখেছেন। পরবর্তীকালে সেইসব নাটকের আলোচনা প্রসঙ্গে সুকুমার সেন মন্তব্য করেছেন—‘‘গীতিনাট্যের কথা বাদ দিলে তাহার প্রায় পঁয়তাল্লিশখানি নাটকের বদলে চার-পাঁচখানি মাত্র লেখায় তাহার যশোহানি ঘটিত না।’’
চার-পাঁচখানি মাত্র নাটক লিখলে তার যশশালাভ কতোখানি ঘটতো বলা মুশকিল, তবে একথা ঠিক, রঙ্গালয়ের ক্ষুধা এবং দর্শকের চাহিদা মেটাতে আবার শতখানেক নাটক না লিখলে, নাট্যকারের যে মানহানি ঘটতো, তাতে সন্দেহ নেই। নাট্যালয়ে অভিনয়ের ধারাকে সচল ও প্রাণবন্ত রাখতে গিরিশকে অনবরত ও অপর্যাপ্ত নাট্য রচনা করে যেতে হয়েছে। তদানীন্তন মঞ্চব্যবস্থা ও প্রেক্ষালয় পরিস্থিতি বিচ্ছিন্ন হয়ে গিরিশচন্দ্রকে শুধুমাত্র সাহিত্য শিল্পগত দিক দিয়ে বিচার করতে গিয়ে পরবর্তী অনেক সমালোচকই এমন মন্তব্য করেছেন।
সর্বসাধারণের জন্য নাটক লিখতে হতো বলে, নাটক মহড়ার সময়ে গিরিশ মালিক থেকে রঙ্গমঞ্চের দারোয়ান, সিফটার সবাইকে ডেকে দেখাতেন। মন্মথমোহন বসুর ‘বাংলা নাটকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ’ গ্রন্থের বিবরণ থেকে দেখছি যে, গিরিশ স্ত্রী-পুরুষ, পণ্ডিত-মূর্খ সকলের আনন্দ দানের জন্য নাটক লিখতেন বলে পণ্ডিতের সঙ্গে মুখেরও নাটকখানি কেমন লাগছে তা দেখার জনাই এমন ব্যবস্থা করতেন। প্রয়োজনে কারো অপছন্দের অংশ পরিবর্তন করতেন। এইভাবে ‘সিরাজদৌল্লা’ নাটকের প্রথম দৃশ্যটি তিনবার পরিবর্তন করে বর্তমান দৃশ্যটি তৈরি করেছিলেন।
গিরিশকে নাটক লিখতে হয়েছে স্টেজের প্রয়োজনে। স্টেজে অভিনয়ের সাফল্যই হচ্ছে দর্শকের ভিড়। অন্তত বাণিজ্যিক থিয়েটারের হিসেব তাই বলে। গিরিশকে তাই স্টেজ, জনরুচি, নিজের দলের শিল্পী সবার দিকে নজর রাখতে হয়েছে। সমসাময়িক অন্য নাট্যদলগুলির সঙ্গে মঞ্চে প্রতিযোগিতা, যাত্রার প্রচণ্ড দর্শক-আকর্ষণ, তার প্রকরণ, সংস্কৃত রীতি ও ইংরেজি নাটকের আদর্শ-সবগুলি মাথায় রেখে, সব মিলে তাঁর নাটকে যে নতুন নাট্যরীতি গড়ে উঠেছে তাতে এ্যাকশান ও ইমোশান মিশে গেছে—পরে আবার এ্যাকশানের ওপর সেন্টিমেন্ট বেশি হয়ে গেছে। সীমিত বাছাই সমঝদার দর্শকের সামনে নিজের প্রেরণায় নাটক রচনা নয়, সর্বসাধারণের সামনে নাটক হাজির করতে হয়েছে। তার কোনো নাটকই তিনি রঙ্গমঞ্চের অভিনয়ের চাহিদা ছাড়া রচনা করেননি। কখনো কখনো এই গণ্ডী ভেঙে স্বাধীন নাট্যসত্তার বিকাশে যখন আকাশে ডানা মেলতে চেয়েছেন, তখনই বাস্তবের প্রেক্ষাগৃহের শূন্য আসন অভিসম্পাতের মতো তাঁকে জর্জরিত করেছে। এই নিয়ে তাঁর আক্ষেপোক্তি এখনো কানে বাজে।
গিরিশের সাক্ষ্য থেকেই জানা যায় যে, তিনি মনে মনে নাটক রচনা করতে চেয়েছিলেন, ‘শুধু Internal facts and internal struggle’ নিয়ে, কারণ তার মত ছিল internal actions এঁকে দেখানোই ‘best literay at’. কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, ‘দেশের লোকের apatliv’র জন্যে শেষ পর্যন্ত গিরিশ মনের ইচ্ছা কার্যে পরিণত করতে পারেননি পুরোপুরি। তবুও গণ্ডীবদ্ধতার মধ্যেও তিনি যা করেছেন, তার জন্যে বাংলা নাটক ও নাট্যশালা তাঁকে চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
ইংরেজি নাটক থেকে সৃষ্ট বাংলা নাটক ইংরেজিয়ানার দিকে মোড় ফিরেছিল। আবার জনরুচিতে ছিল তৎকালীন গীতাভিনয় যাত্রার আকর্ষণ। গিরিশ ইংরেজি নাটক এবং বাংলা যাত্রার টানাপোড়েনে পথ হারাননি। জাতীয় জীবনের মূল ভাবনার সঙ্গে বাংলা নাটককে তিনি বেঁধে দিতে পেরেছিলেন। যাত্রা থেকে মুখ ফিরিয়েছিল শিক্ষিত বাঙালি, আর ইংরেজি নাটকের সঙ্গে সাধারণ বাঙালির কোনো নাড়ীর যোগ ছিল না। গিরিশ এই দুটোর হাত থেকেই বাংলা নাটককে বাঁচিয়েছিলেন। বাঙালির জাতীয় ভাবনাকে একটা সুনির্দিষ্ট পথ দিয়েই তিনি নাটকের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সে যুগের রঙ্গমঞ্চ সম্পর্কে শিক্ষিত বাঙালির ঘৃণা ও অনীহা উপেক্ষা করে, নিজের সমগ্র জীবনকে তিনি রঙ্গালয়ের সঙ্গেই জুড়ে দিয়েছিলেন। এবং নিয়ত প্রচেষ্টায় বাংলা মঞ্চকে ধারাবাহিকভাবে সামনে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সে যুগের মঞ্চের ‘গরুড়ের ক্ষুধা মেটাতে তাকে অনেক কিছুই করতে হয়েছে’—সেগুলির জন্যে তাকে সমকাল ও পরবর্তীকালে সমালোচকদের নিন্দা-প্রস্তাব সহ্য করতে হয়েছে কিন্তু নির্দ্বিধায় অবিচল বিশ্বাসে তিনি মঞ্চকে এবং তার সঙ্গে বাংলা নাটককে বাঁচিয়ে গেছেন। বাংলা নাটককে বাঙালির প্রাণের জিনিসে পরিণত করে গেছেন।
অভিনয় শিক্ষক হিসাবে তিনি অতি নিষ্ঠায় সে যুগের অনেককেই অভিনয় শিক্ষা দিয়েছেন। অর্ধেন্দুশেখরের মতো তাঁরও হাতে অনেক শ্রেষ্ঠ অভিনেতা তৈরি হয়েছেন, তারাই পরবর্তী সাধারণ রঙ্গালয়ে অভিনয়ের উচ্চমান বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। সে যুগের শ্রেষ্ঠ বহু অভিনেতাই তাঁর হাতে তৈরি। মতিলাল সুর, ক্ষেত্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, অমৃতলাল মিত্র, অমৃতলাল মুখোপাধ্যায় (বেলবাবু), মহেন্দ্রলাল বসু, সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ (দানীবাবু), নীলমাধব চক্রবর্তী, চুনীলাল দেব তাঁরই হাতে গড়া সব শিল্পী।
১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে সাধারণ রঙ্গালয়ে অভিনেত্রী গৃহীত হলে, বাংলা নাটকের ধারাই কিছুটা পাল্টে যায়। নৃত্যগীত-পটিয়সী অভিনেত্রীদের জন্য গীতিনাট্য-অপেরা প্রচুর লিখিত ও অভিনীত হয়েছে। কিন্তু এদের সকলেই অভিনয়ে পারদর্শী ছিলেন না। সেরকম শিক্ষাদীক্ষাও ওদের ছিল না। প্রত্যেকের উচ্চারণ ক্ষমতা ও ভাবপ্রকাশের পরিশীলন ছিল না। এইসব অভিনেত্রীদের বেশিরভাগই গিরিশের হাতে ক্রমে ক্রমে তৈরি হয়েছেন। গিরিশচন্দ্র তাদের জন্য নাটকে নারী চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। তাদের উচ্চারণ উপওগী সহজ শব্দ ব্যবহার করে সংলাপ রচনা করেছেন। এবং বিখ্যাত ‘গৈরিশ ছন্দ’ সৃষ্টির মূলেও এই অভিনেত্রীদের সংলাপ উচ্চারণের সুযোগ-সুবিধার প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। তখনকার অভিনেত্রীদের ‘আকৃতি’ ও ‘অভিনয়’ ক্ষমতার দিকে লক্ষ রেখেই তাঁর নাটকের নারী চরিত্র ও সংলাপ সৃষ্টি করেছেন। ফলে অভিনেত্রীরা খুব সহজে ও কম পরিশ্রমে সেই চরিত্রে রূপদান করতে পারতেন। অভিনেত্রীরাও তাই গিরিশের নাটকে এবং তার শিক্ষাদানে অভিনয় করতে পেরে সার্থকতা লাভ করতো। এবং ক্রমে ক্রমে নিজেদের অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতো। গিরিশের মৃত্যুর পর স্মরণসভায় প্রায় সব অভিনেত্রীই অবরুদ্ধকণ্ঠে এই কথা স্বীকার করেছেন। (নাট্যমন্দির, আশ্বিন-কার্তিক, ১৩১৯, পৃঃ ৬৮-৭৭)। গিরিশের নাটকে এই নারী চরিত্র ও তাদের সংলাপ বিচারে তৎকালীন থিয়েটারের পরিমণ্ডল তাই অবশ্যই স্মরণযোগ্য।
সমকালীন হাতে গড়ে-পিটে তৈরি করা এইসব অভিনেত্রীদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীকালে বাংলা মঞ্চের খ্যাতিমান শিল্পীতে পরিণত হয়েছিলেন। বিনোদিনী, তিনকড়ি, তারাসুন্দরী, কুসুমকুমারী এদের অন্যতম। সমাজে নিন্দিত ও অপমানিত এইসব অভিনেত্রীদের গিরিশ অসীম সহনশীলতায় ও নিষ্ঠায় শিল্পী হিসেবে তৈরি করেছিলেন। অপবাদ, নিন্দা ও দোষত্রুটির যতো গরল কণ্ঠে ধারণ করে গিরিশ নীলকণ্ঠের মতো বাংলা মঞ্চের অভিনয়ের ধারাকে অব্যাহত ও গতিশীল রেখেছিলেন।
গিরিশ নিজেও অসামান্য অভিনেতা ছিলেন। ট্রাজিক চরিত্র অঙ্কনে তাঁর খুবই পারদর্শিতা ছিল। ভারী ও গম্ভীর কণ্ঠস্বরের অধিকারী গিরিশ কিছুটা রোমান্টিক ধরনের অভিনয়ের পক্ষপাতী ছিলেন। মঞ্চে তাঁর ব্যক্তিত্বময় উপস্থিতি ও চরিত্রচিত্রণের কুশলতা দর্শকদের আবেগবিহ্বল ও মুগ্ধ করে রাখতো। নিমচাঁদ (সধবার একাদশী), ভীমসিংহ (কৃষ্ণকুমারী), ক্লাইভ (পলাশীর যুদ্ধ), রাম (রাবণ বধ) ম্যাকবেথ (ম্যাকবেথ), বিদূষক (জনা), যোগেশ (প্রফুল্ল), কুঞ্চকী (পাণ্ডবগৌরব), করুণাময় (বলিদান), করিমচাচা (সিরাজদৌল্লা), পশুপতি (মৃণালিনী) নগেন্দ্রনাথ (বিষবৃক্ষ), রঙ্গলাল (ভ্রান্তি) প্রভৃতি বিভিন্ন জাতের চরিত্রাভিনয়ে গিরিশ অভিনয়ের নতুন ধারা তৈরি করেছিলেন।
তিনি নিজে অভিনেতা ও নাট্যকার ছিলেন বলে, তার অভিনয়জীবনের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নাটকের প্রধান চরিত্রগুলিও পরিবর্তিত হয়েছে। প্রথম জীবনের নাটকের প্রধান চরিত্র যৌবনদীপ্ত পুরুষ। মধ্যবয়সে প্রধান চরিত্রগুলি মধ্যবয়সী হয়ে গেছে। পরিণতকালে চরিত্রগুলি পরিণত বয়স্ক। ১৮৮১-তে রাম (রাবণবধ), ১৮৯৫-তে যোগেশ (প্রফুল্ল) এবং ১৯০৫-তে করুণাময় (বলিদান) চরিত্র গিরিশের ক্রমবিবর্তনের স্বাক্ষরবাহী। অভিনেতা ও নাট্যকার একই ব্যক্তি হলে নাট্য রচনায় তাঁর প্রভাব কখনোই অস্বীকার করা যায় না।
গিরিশের পূর্ব পর্যন্ত বাংলা থিয়েটার পরমুখাপেক্ষী ছিল। মধুসূদন, দীনবন্ধুর নাটক, বঙ্কিমের উপন্যাসের নাট্যরূপ অভিনীত হচ্ছিল। তারপরে মঞ্চে নাটকের অভাবে, ‘দুর্ভিক্ষে বিচারহীন কদন্ন আহারের মতো’, যা তা নাটক লেখা ও অভিনীত হতে থাকল। রঙ্গমঞ্চ প্রাণশূন্য হয়ে পড়লো। গিরিশ এই সময়েই শুধু অভিনয় নয়, নাট্যবাণীর পূজার প্রধান উপকরণ, তার প্রাণ, তার অন্ননাটক রচনা শুরু করলেন। গিরিশ যেমন অনেক নাট্য গালা প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোগী হলেন, তেমনি, অন্ন দিয়ে তাদের প্রাণরক্ষা করেছিলেন। বরাবর স্বাস্থ্যকর আহার দিয়ে তাকে পুষ্ট করেছিলেন, মজ্জায় মজ্জায় রসসঞ্চার করে তাকে পরিপূর্ণ ও আনন্দপূর্ণ করে তুলেছিলেন। আর সেই কারণেই গিরিশচন্দ্র ‘ফাদার অফ দি নেটিভ ষ্টেজ। নাট্যকার ও নাট্য পরিচালক অপরেশচন্দ্র মুখখাপাধ্যায়ের তাই মত—‘‘ইহার খুড়া-জ্যাঠা কেহ কোনদিন ছিল না। ইহা একপ্রকার অভিভাবক-শূন্য বেওয়ারিশ অবস্থায় টলিতেছিল, পড়িতেছিল, ধূলায় গড়াইতেছিল। যে অমৃত পানে বাঙ্গালায় নাট্যশালা এই পঞ্চাশ বৎসরাধিক (কাল) বাঁচিয়া আছে, প্রকৃতপক্ষে সে অমৃতের ভাণ্ড বহন করিয়া আনিয়াছিলেন গিরিশচন্দ্র।’’ (রঙ্গালয়ে ত্রিশ বৎসর)।
১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুলাই ‘বলিদান’ নাটকে করুণাময়ের ভূমিকায় তাঁর শেষ অভিনয়। এদিন অভিনয় চলাকালীন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার মাঝরাত্রে ১-২০ মিনিটের সময় তাঁর মৃত্যু হয়। তাই ইংরেজিতে ৯ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার তার প্রয়াণ দিবস হওয়া উচিত। যদিও বাংলা মতে ১৩১৮ সালের ২৫ মাঘ তার মৃত্যু দিবস।
অভিনয়ে, অভিনয় শিক্ষাদানে, মঞ্চাধ্যক্ষের কাজে, থিয়েটারের ম্যানেজারিতে এবং নাট্য রচনায় গিরিশ বাংলা থিয়েটারকে বাঁচিয়ে রাখেন। বাংলা সাধারণ রঙ্গালয় ও নাটকের প্রথম পঞ্চাশ বছর তাই গিরিশ নামাঙ্কিত হয়েছে শুধু তার অবস্থানের জন্য নয়, হয়েছে তাঁর কার্যগুণাবলীর জন্যই।
Leave a Reply