বাংলা নাটকের ইতিহাসে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান আলোচনা কর।
গিরিশচন্দ্র ঘোষ
সাধারণ মানুষের উপযোগী নাটক লিখে ও সাধারণের প্রবেশাধিকারের জন্য বাংলা রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়ে নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪-১৯১১) বাংলা নাট্যসাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। সাধারণ মানুষের জন্য নাটক রচনা করা, সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠা, রঙ্গমঞ্চ পরিচালনা, অভিনয় শিল্পের শিক্ষাদানে এবং একটি নাট্যগোষ্ঠী তৈরির প্রচেষ্টার দিক থেকে গিরিশচন্দ্র ঘোষের কৃতিত্ব অন্য কোন নাট্যব্যক্তিত্বের মধ্যে লক্ষ করা যায়। গিরিশচন্দ্র জানতেন নাট্যরস প্রকাশের ভিত্তি রঙ্গমঞ্চ এবং সাধারণ মানুষের মর্মের মতো করে কিভাবে নাটক রচনা করতে হয়। তাই তিনি বিভিন্ন শ্রেণির নাটক রচনা করে বাংলা নাট্যসাহিত্যের যেমন সমৃদ্ধিসাধন করেছেন তেমনি সাধারণ মানুষের নাট্যরস পিপাসা চরিতার্থ করতে পেরেছেন।
গিরিশচন্দ্রের নাট্যপঞ্জীকে বিষয়ানুসারে ছয়টি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন—
(১) গল্প, উপন্যাস ও কাব্যের নাট্যরূপ:- ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৮৭৩), ‘বিষবৃক্ষ’ (১৮৭৪), ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৭৮), ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ (১৮৭৭), ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ (১৮৭৭), ‘পলাশীর যুদ্ধ’ (১৮৭৮), ‘চোখের বালি’ (১৯০৭) ইত্যাদি।
(২) গীতিনাট্য:- ‘অকালবোধন’ (১৮৭৭), ‘আগমনী’ (১৮৭৭), ‘মোহিনীপ্রতিমা’ (১৮৮২), ‘স্বপ্নের ফুল’ (১৮৯৩), ‘অশ্রুধারা’ (১৯০১) ইত্যাদি।
(৩) ঐতিহাসিক নাটক:- ‘আনন্দ রহো’ (১৮৮১), ‘চণ্ড’ (১৮৯০), ‘কালাপাহাড়’ (১৮৯১), ‘ভ্রান্তি’ (১৯০২), ‘সৎনাম’ (১৯০৪), ‘সিরাজদ্দৌল্লা’ (১৯০৬), ‘মীরকাশিম’ (১৯০৬), ‘ছত্রপতি শিবাজী’ (১৯০৭), ‘অশোক’ (১৯১১) ইত্যাদি।
(৪) পৌরাণিক ও ভক্তিমূলক নাটক:- ‘রাবণবধ’ (১৮৮১), ‘অভিমন্যু বধ’ (১৮৮১), ‘লক্ষ্মণ বর্জন’ (১৮৮১), ‘রামের বনবাস’ (১৮৮২), ‘সীতাহরণ’ (১৮৮২), ‘পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস’ (১৮৮৩), ‘দক্ষযজ্ঞ’ (১৮৮৩), ‘ধ্রুবচরিত্র’ (১৮৮৩), ‘নল দময়ন্তী’ (১৮৮৩), ‘শ্রীবৎসচিন্তা’ (১৮৮৪), ‘চৈতন্যলীলা’ (১৮৮৪), ‘প্রহ্লাদ চরিত্র’ (১৮৮৪), ‘বিল্বমঙ্গল’ (১৮৮৮), ‘পাণ্ডব গৌরব’ (১৯০০), ‘নিত্যানন্দ’ (১৯১১) ইত্যাদি।
(৫) সামাজিক নাটক:- ‘প্রফুল্ল’ (১৮৮৯), ‘হারানিধি’ (১৮৯০), ‘মায়াবসান’ (১৮৯৭), ‘বলিদান’ (১৯০৫) ইত্যাদি।
(৬) প্রহসন:- ‘ভোটমঙ্গল’ (১৮৮২), ‘হীরার ফুল’ (১৮৮৪), ‘বেল্লিক বাজার’ (১৮৮৬), ‘বড়দিনের বকশিস’ (১৮৯৩), ‘সভ্যতার পাণ্ডা’ (১৮৮৩), ‘য্যায়সা কা ত্যায়সা’ (১৯০৬), ‘শাস্তি কি শান্তি’ (১৯০৮) ইত্যাদি।
ঐতিহাসিক নাটক
নাট্যকার রূপে গিরিশচন্দ্রের জনপ্রিয়তা তাঁর পৌরাণিক নাটকে। পুরাণ চর্চার দিকে ছিল তাঁর মানসিক প্রবণতা। পৌরাণিক রচনার পুনরুজ্জীবনই ছিল তাঁর স্বপ্ন। শুধু তিনি ঐতিহাসিক নাটক রচনা করেছেন জনপ্রিয়তার জন্যেই। গিরিশচন্দ্রের প্রথম সার্থক ঐতিহাসিক নাটক ‘চণ্ড’। টডের রাজস্থান থেকে তিনি কাহিনি সংগ্রহ করেছেন। মেবার ও রাঠোরের বিরোধের বিষয়টি এই নাটকে চিত্রিত হয়েছে। বিজয়ীর প্রেম ও প্রতিহিংসা নাট্যকারের মৌলিক সৃষ্টি।
স্বদেশী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গিরিশচন্দ্রের মঞ্চসফল ঐতিহাসিক নাটক ‘সিরাজদ্দৌলা’ রচিত হয়। গিরিশচন্দ্র এই নাটকের ভূমিকায় লিখেছেন—“আলিবর্দীর সময় হইতে সিরাজদ্দৌলার শোচনীয় পরিণাম পর্যন্ত যে সকল স্বার্থচালিত ঝঞ্ঝাপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহে বঙ্গ সিংহাসন আলোড়িত হইয়াছিল, তাহার সম্পূর্ণ চিত্র প্রদর্শন ব্যতীত সিরাজদ্দৌলা নাটক প্রস্ফুটিত হয় না।” সিরাজদ্দৌলার চরিত্রকে জাতীয় বীরের মহিমায় মহিমান্বিত করতে গিয়ে গিরিশচন্দ্র চরিত্রটিকে অখণ্ড রূপদানে প্রয়াসী হয়েছেন। নাট্যকার সরাসরি সিরাজ চরিত্রে পরাধীনতার অন্তর্জালা প্রকাশ করেছেন এবং ঐ চরিত্রের তথাকথিত কলঙ্ক খণ্ডন করেছেন বিভিন্ন তথ্য সমাবেশ করে। নাট্যকারের উদ্দেশ্য ছিল এই নাটকে সমসাময়িক জাতীয়তার ভাব সঞ্চার করা, সেজন্য তিনি সিরাজ চরিত্রকে যেমন বীররূপে দেখিয়েছেন তেমনি কাল্পনিক চরিত্রেরও উপস্থাপনা করেছেন। বৃটিশ ঐতিহাসিকদের কুৎসা কলঙ্কিত সিরাজ আমাদের দেশায় ঐতিহাসিকদের দ্বারা দেশভক্তরূপে প্রতিভাত হয়েছিলেন এবং স্বাদেশিকতায় মূর্ত বিগ্রহরূপে তাঁকে চিত্রিত করেছেন গিরিশচন্দ্র। বিষয়বস্তুর মধ্যে পরাধীনতার জ্বালা প্রকাশের সুযোগ ছিল বলেই গিরিশচন্দ্রের কর্মচিন্তা যুগপোচিত সামঞ্জস্যে বিধৃত হয়েছে। নাটকটিতে আপাতদৃষ্টিতে সিরাজ বাংলার বিগত ইতিহাসের একটি দেশহিব্রতী সন্নত বীর চরিত্র। রাজনৈতিক প্রজাবৎসল সিরাজের রূপ উদঘাটনে প্রয়াসী ছিলেন গিরিশচন্দ্র।
জাতীয়তাবাদের প্রচারের জন্যই সরকার ১৯১১ সালের ৮ জানুয়ারি ‘সিরাজদ্দৌলা’ নাটকের অভিনয় ও প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিল। এ থেকে বোঝা যায় এই নাটকটি জনমানসে কী বিপুল আলোড়ন তুলেছিল। তবুও সিরাজকে জাতীয় বীররূপে তুলে ধরতে গিয়ে এবং সমসাময়িক স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাব থাকার ফলে তিনি এই নাটকে সার্থকতা অর্জন করতে পারেননি।
গিরিশচন্দ্রের ‘মীরকাশিম’’ নাটক রচনার পশ্চাৎপটেও সিরাজদ্দৌলার মতো বঙ্গভঙ্গ যুগের ব্রিটিশ বিদ্বেষ, স্বদেশী গ্রহণ, সর্বতোভাবে বিদেশী বর্জন, হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরেইক বিভেদ দূর করে ঐক্য স্থাপনের আহ্বান ঘোষিত হয়েছে। ইতিহাসাশ্রিত এই নাটকে মীরকাশিমকে জাতীয় বীর চরিত্ররূপে নাট্যকার তুলে ধরতে চেয়েছেন এবং প্রমাণে সার্থক হয়েছেন। নাট্যকার এই নাটকে ঐতিহাসিক সত্যকে তুলে ধরেছেন। মীরকাশিম চরিত্রের বলিষ্ঠতা সিরাজের চেয়ে অনেক বেশি। তাই স্বদেশীযুগের জাতীয়তাবোধকে ফুটিয়ে তোলার জন্য নাট্যকার এই চরিত্রের বলিষ্ঠতার দিকটি অঙ্কন করতে প্রয়াসী হয়েছেন।
‘ছত্রপতি শিবাজী’ (১৯০৭) নাটকে গিরিশচন্দ্রের পরিণত ইতিহাস চিন্তার ছাপ রয়েছে। সত্যচরণ শাস্ত্রীর ‘ছত্রপতি শিবাজী’ গ্রন্থটি থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে তিনি এই নাটকটি রচনা করেন। শিবাজীর চরিত্রের ঐতিহাসিক দিকটি নাট্যকারের আদর্শ জাতীয় ভাবধারার ব্যাখ্যার সঙ্গে সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। এই আদর্শ হল ধর্মভাবাশ্রিত জাতীয়তার সাধনা। তাই এই নাটকে জাতীয়তা, হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ইত্যাদি সদ্যোজাত জাতীয় অনুভূতির পাশাপাশি ভবানীর কৃপায় পৌরাণিক অনুষঙ্গটিও সমান্তরাল ধারায় প্রবহমান। তাই নাটকটিতে অবতার শিবাজীর পাশে পাশে ইতিহাসের শিবাজীরও সন্ধান মেলে। নাট্যকার ভারতের অতীত ইতিহাসের জাতীয় বীর চরিত্র চয়ন করে ধর্মাশ্রিত জাতীয়তার সাধনা করেছেন এই নাটকে। গিরিশচন্দ্র দেশানুরাগের অন্ধ উচ্ছ্বাসকে নিজস্ব ভক্তি উন্মাদনার সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেছেন। তাই শিবাজী চরিত্রে জাতীয় বীরের সন্ধান করতে গিয়ে চরিত্রটিকে সাম্প্রদায়িক চরিত্ররূপে গড়ে তুলেছেন।
‘অশোক’ নাটকটিতে গিরিশচন্দ্র ইতিহাস নিষ্ঠার পরিচয় যেমন দিয়েছেন, তেমনি রয়েছে নাট্যকারের মৌলিক কল্পনা। এটি ঐতিহাসিক নাটক হলেও ধর্মর্ভাবের প্রাধান্য রয়েছে। এই নাটকে অশোক চরিত্রের দুটি রূপ—চণ্ডাশোক ও ধর্মাশোক। এই দুটি রূপই সমানভাবে চিত্রিত। এর প্রধান চরিত্র ঐতিহাসিক হলেও ঐতিহাসিক পরিবেশ নাট্যকার ফুটিয়ে তুলতে পারেননি।
পৌরাণিক নাটক
উনিশ শতকের শেষভাগে নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের জনপ্রিয়তা পৌরাণিক নাটকের জন্য। গিরিশচন্দ্র হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবনের জন্য হৃদয়প্রধান জীবনাদর্শ ও ভক্তিভাবকে গ্রহণ করেছিলেন তাঁর পৌরাণিক নাটকে। যুক্তিবাদী নাস্তিক গিরিশচন্দ্র শেষ পর্যন্ত রামকৃষ্ণের অহৈতুকী ভক্তি ভাবকে অবলম্বন করে পৌরাণিক নাটকে জোয়ার আনলেন। গিরিশচন্দ্র তৎকালীন বাঙালির একান্ত বাস্তব জীবন, যে জীবনে প্রগতিশীলতা ও সংস্কারানুগত্য পাশাপাশি রয়েছে, যেখানে মুক্তবুদ্ধির সঙ্গে ধর্মানুরাগ যুক্ত, সে জীবনের পরিচয় দিলেন তাঁর পৌরাণিক নাটকে। এই শ্রেণির নাটকগুলির মধ্যে জাতীয়তার মন্ত্রই প্রচার করেছেন—যা সেদিন নব্য হিন্দুদের পুনরুজ্জীবনে সহায়তা করেছিল। তিনি বাঙালির প্রাণ-ধর্মকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই পৌরাণিক নাটকে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।
‘পাণ্ডব গৌরব’ (১৯০০) গিরিশচন্দ্রের মঞ্চসফল নাটক। নাটকটির কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হল উর্বশীর শাপমোচন। এই শাপমোচনের জন্যই পাণ্ডবদের সঙ্গে কৃষ্ণের বিরোধ। পাণ্ডবদের শরণাগতকে রক্ষা করবার অপরাধে কিন্তু এই বিরোধ বা দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত যুগরুচি অনুযায়ী দৈবানুগত্যে সমাপ্ত হয়েছে। পাণ্ডবদের শরণাগতকে রক্ষা করবার অপরাধের সূত্র ধরেই কৃষ্ণের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ঘনিয়ে এসেছিল। এই আশ্রিত রক্ষণ ও পালন—হিন্দু ধর্মাদর্শের একটি মহৎ নীতি যা হিন্দুদের প্রাচীন সংস্কার। সেই সংস্কারকে গিরিশচন্দ্র হিন্দু পুনরুজ্জীবন মানসে তুলে ধরেছেন কিন্তু পাণ্ডবরা তাদের চিরাচরিত কৃষ্ণভক্তি থেকে দূরে সরে যাননি, তা প্রচ্ছন্ন ভাবেই থেকেছে। তা শেষ পর্যন্ত তাদের ধর্মনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই নাটকে নাট্যকার রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের ধর্মসমন্বয়ের আদর্শের দ্বারা অনুপ্রারাণিত হয়েছিলেন। তাই নাটকে দেখতে পাই— “কৃষ্ণ ভক্তি অম্বিকা ভক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে।’’
দেব ও নরের প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লীলাময় কৃষ্ণের প্রভাবকে বড় করে দর্শক শ্রোতাদের ভক্তিপ্রাণের সংবেদনশীলতাকে এই নাটকে নাট্যকার প্রকাশ করেছেন। কর্মকে গৌণ করে ভক্তি, বিশ্বাস ও লীলার প্রাধান্যকে বড় করে দেখানো হয়েছে। তবে শ্রীকৃষ্ণ এ নাটকে সামগ্রিক আচরণে মানবিক ধর্ম ও দৈব ধর্মকে যুগপৎ রক্ষা করেছেন। শ্রীকৃষ্ণকে একদিকে যেমন জাগতিক সমস্ত নিয়মের নিয়ন্ত্ৰীশক্তি রূপে নাট্যকার দেখিয়েছেন, তেমনি দেখিয়েছেন মানবিক দ্বিধা দ্বন্দ্বে ও কর্মপ্রয়াসে ব্যক্ত শ্রীকৃষ্ণকে শেষ পর্যন্ত প্রথম দিকটি (দেবত্ব)-ই নাটকে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
ভক্তিমূলক নাটকগুলির মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় নাটক হল ‘বিল্বমঙ্গল’, স্বামী বিবেকানন্দ বিল্বমঙ্গলের উচ্চভাবের প্রশংসা করেছেন। ধর্মপ্রাণ বাঙালি বিল্বমঙ্গলের আকর্ষণ ছিল যথেষ্ট। এই নাটকের কাহিনি ‘ভক্তমাল’ গ্রন্থ থেকে গৃহীত। এই নাটকে ধর্মতত্ত্বই মুখ্য। নাটকটি প্রেম ও বৈরাগ্যমূলক নাটকরূপে চিহ্নিত। ভগবান শ্রীকৃষ্ণই বিল্বমঙ্গল নাটকের আরাধ্য দেবতা। নাটকের মূল তত্ত্ববস্তু বিল্বমঙ্গল চরিত্রকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হয়েছে। ভক্তিসাধক হলেও তার মানসিক ভাবাবেগের দ্বন্দ্বময় রূপটি নাটকে প্রকাশিত হয়ে নাট্যরস সৃষ্টি হয়েছে। নাটকের সংলাপেও রয়েছে গৈরিশ ছন্দের গতিময়তা।
তাঁর ‘জনা’ নাটকটিও উল্লেখযোগ্য পৌরাণিক নাটক। জনার মাতৃহৃদয় তথা বীরহৃদয়ের স্বরূপ এই নাটকে প্রকাশিত হয়েছে। জৈমিনি ভারত, কাশীদাসী মহাভারত, মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্য থেকে গিরিশচন্দ্র এই নাটকের উপাদান সংগ্রহ করেছেন। জনা ও প্রবীর চরিত্রকে অবলম্বন করে নাটকের বাস্তব আবেগ ও প্রবৃত্তির ঘাতপ্রতিঘাতজনিত লৌকিক নাট্যরস সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্যদিকে নীলধ্বজ, বিদূষক, অগ্নি, বৃষকেতু প্রভৃতির মাধ্যমে অলৌকিক ভক্তিরস নাটকের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে। ক্রোড় অঙ্কে মিলনান্ত পরিণতির কথা বাদ দিলে এই নাটকে জনার ট্রাজিক পরিণতি দর্শককে আপ্লুত করে। আসলে জনা চরিত্রের তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ক্ষাত্র রমণীসুলভ দৃঢ়তা ও বীরত্ব নাটকের অন্যতম সম্পদ।
সামাজিক নাটক
গিরিশচন্দ্র সামাজিক নাটকে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের চিত্র অঙ্কন করেছেন। গিরিশচন্দ্রের সামাজিক নাটকে ও প্রহসনে জীবনের চিত্রই উপস্থাপিত হয়েছে। গিরিশচন্দ্র তাঁর সামাজিক নাটকগুলিতে নারীকে সমাজ নির্দেশিত আদর্শে অঙ্কিত করেছেন। নারীর আত্মবিশ্বাস ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের চেয়ে সতী সাধ্বী রমণীর রূপই তিনি চিত্রিত করেছেন। একান্নবর্তী পরিবারের চিত্রকে, সমাজ সত্তার কাছে ব্যক্তি সত্তার পরাজয়কে বিবাহকে, কন্যাদায়, পণপ্রথা, সম্পত্তি সংক্রান্ত গোলমাল প্রভৃতি ঘটনা নিয়ে সামাজিক নাটকে রচনা করেছেন। তবে এক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টির ব্যাপকতা ছিল না। চরিত্রের অন্তর্জীবনকে, তার দ্বন্দ্বকে সামাজিক নাটকে তিনি ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। অতিনাটকীয়তা, ভাবাবেগ, ধর্মচেতনা প্রভৃতির বাড়াবাড়ি সামাজিক নাটকের শিল্পরসকে ব্যাহত করেছে।
১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২৭ এপ্রিল ষ্টার থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় গিরিশচন্দ্রের জনপ্রিয় সামাজিক নাটক ‘প্রফুল্ল’। এই নাটকের অভিনয় সম্বন্ধে সমকালীন ‘ভারতী’ পত্রিকা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে তা পত্রিকায় প্রকাশ করে। একান্নবর্তী পরিবারের কর্তা যোগেশের সাজানো সংসার কীভাবে ব্যাংক ফেলের ঘটনায় ও পরবর্তী নানান ক্রিয়ায়ায় নষ্ট হয়ে গেল তারই মর্মন্তুদ পারিবারিক কাহিনি এই নাটকের প্রধান। নাটকটি তাই পারিবারিক-সামাজিক নাটক। কারণ এই নাটকে যে সমস্যা চিত্রিত হয়েছে তা একাধারে পারিবারিক হয়েও সামাজিক। তাছাড়া এই নাটকে নানান স্তরের মানুষের পরিচয় লিপিবদ্ধ হয়েছে। যেমন, শুড়িখানার চারপাশে মাতালদের ক্রিয়াকলাপ, নানা ধরনের দালাল, জুয়াচোর, ঘুষখোর, পুলিশের ক্রিয়াকলপা, ডাক্তারের শয়তানি, কুটিল লোকের কুটিল চক্রান্ত প্রভৃতি।
নাম ‘প্রফুল্ল’ হলেও এই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র যোগেশ। যোগেশের পতন ও বিপর্যয়ের কাহিনি নাট্যকার সহানুভূতির সঙ্গে ব্যক্ত করেছেন। ব্যাংক ফেলের ঘটনার পর মদ্যপান করা এবং সেই সুযোগে রমেশের কুটিল চক্রান্তে বিপর্যয় এই নাটকে বাস্তবরূপে চিত্রিত। প্রফুল্ল এই নাটকের আদর্শ চরিত্র। স্নেহশীলতা, কোমলতা তার চরিত্রের প্রধান মূলধন।
গিরিশচন্দ্রের ‘হারানিধি’ (১৮৯০) একটি মিলনান্ত সামাজিক নাটক। এই প্রেমের জয় ঘোষিত হয়েছে। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের ৭ সেপ্টেম্বর স্টার থিয়েটা প্রথম অভিনীত হয়। এই নাটকের বিষয়বস্তু গড়ে উঠেছিল বন্ধুর বিশ্বাসঘাতক থেকে। নব, কাদম্বিনী, অঘোর চরিত্রগুলি মন্দ নয়। অঘোর একটি উল্লেখযোগ্য হাস্যরসাত্মক চরিত্র।
অন্যদিকে ‘মায়াবসান’ (১৮৯৭) নাটকটি বাঙালির পারিবারিক জীবনের উপর ভিত্তি করে রচিত বিয়োগান্ত নাটক। এই নাটকের প্রথম অভিনয় হয় ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ডিসেম্বর স্টার থিয়েটারে। কালীকিঙ্কর চরিত্রের মাধ্যমে এই নাটকে নিষ্কাম কর্মের আদর্শ প্রচার করেছেন নাট্যকার। নাটকটিতে করুণরস জাগ্রত হলেও তা সার্থক ট্রাজেডি নয়।
‘প্রফুল্ল’, হারানিধি’ ও ‘মায়াবসান’-এর পর গিরিশচন্দ্র ‘বলিদান’ (১৯৫০) নাটক রচনা করেন। বাংলার পণপ্রথার বিষময় ফল নির্দেশ করে একটি নাটক রচনা করার জন্য তিনি স্বর্গত সারদাচরণ মিত্র কর্তৃক অনুরুদ্ধ হন। তারই ফলস্বরূপ—“বাঙ্গালায়। কন্যা সম্প্রদান নয়—বলিদান’ (৫/৯)। এই কথা প্রচার করে, তিনি ‘বলিদান’ রচনা করেন। গিরিশচন্দ্র ‘বলিদান’ নাটকে পণপ্রথার মতো সামাজিক সমস্যার রূপায়ণ ঘটিয়েছেন।
সুতরাং সামাজিক নাটকে গিরিশচন্দ্র বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় রেখেছে। নাটকগুলির মঞ্চসাফল্যও যথেষ্ট। সমকালীন সমস্যার রূপায়ণেও নাট্যকার ছিলেন বিশ্বস্ত। তবে আদর্শনিষ্ঠতা, অতিনাটকীয়তা, টাইপধর্মী চরিত্রের জন্য সামাজিক নাটকগুলির শিল্পমূল্য অনেকাংশে বিঘ্নিত হয়েছে।
প্রহসন
গিরিশচন্দ্রের প্রহসনগুলি মূলত রঙ্গমঞ্চের দিকে লক্ষ্য রেখে রচিত। আধুনিক সভ্যতার দোষত্রুটি, উন্মার্গগামী চরিত্র, সামাজিক ভ্রষ্টতা তাঁর প্রহসনগুলির মূল অবলম্বন। অবিনাশ গঙ্গোপাধ্যায় ‘সপ্তমীতে বিসর্জন’ নামক প্রহসনের আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেছেন— “ইংরেজীতে যাহাকে Extravaganga বলে ইহা সেই প্রকৃতির। ইহা সম্বন্ধে অধিক আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। সামাজিক নাটক বাস্তব সংসারের ঘটনা ও চরিত্র লইয়া রচিত হয়, এইরূপ বিদ্রুপাত্মক প্রহসনের গল্প এবং চরিত্র সম্ভব রাজ্যের প্রান্তসীমা হইতে আহৃত হইয়া থাকে—ইহার সকলই উচ্ছৃঙ্খল।” (গিরিশচন্দ্র, পৃঃ ৩৫০)।
‘য্যায়সা কা ত্যায়সা’:-মলিয়ের কৃত ‘লাভ ইজ দি বেস্ট ডক্টর’ অবলম্বনে গিরিশচন্দ্র ‘য্যায়সা কা ত্যায়সা’ (১৯০৭) রচনা করেন। স্বদেশীয় দর্শকদের সংস্কার অনুযায়ী গিরিশচন্দ্র নাটকটি ঢেলে সাজিয়েছেন। পাত্রপক্ষের অহেতুক পণ চাওয়া ও পণপ্রথার রূঢ়তার দিকটিও এই রচনায় রয়েছে।
‘শাস্তি কি শান্তি’ (১৯০৮):-এই নাটকে গিরিশচন্দ্র মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দু সমাজে বিধবাদের ভালোবাসা বা বিবাহকে সমাজ জীবনের অভিশাপ বলে জেনেছেন এবং সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই এই নাটক রচনা করেছেন। ‘শাস্তি কি শান্তি’ নাটকের অবলম্বন বিধবার ত্রিধা বিভক্ত সমস্যা। নাটকটি ১৯০৮ সালের ৭ নভেম্বর মিনার্ভা থিয়েটারে প্রথম অভিনীত হয়।
গিরিশচন্দ্রের নাট্য-প্রতিভা বৈশিষ্ট্য
- সুকুমার সেন গিরিশচন্দ্রের নাট্যরচনার কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা নির্দেশ করেছে। সেগুলি হল—(ক) ভক্তিভাব ও পৌরাণিক আদর্শের আনুগত্য। (খ) নাটকের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে শিক্ষাদান। (গ) তার নাটক সাধারণ দর্শককে তৃপ্ত করলেও নাট্যরসিকের কাছে সেগুলির আবেদন উল্লেখযোগ্য নয়। (ঘ) তাঁর নাটকে অবতার কল্প পুরুষ বা আদর্শ চরিত্র থাকবে—যারা নাট্যকারের উদ্দেশ্যকে পরিষ্ফূট করবে। (ঙ) ঘটনার অত্যধিক ভীড়। (চ) কোলকাতার সাধারণ গৃহস্থঘরের ছবিই নাটকের প্রধান উপজীব্য। (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস—দ্বিতীয় খণ্ড-১৩৮, ৩৫৫-৫৬)
- গিরিশচন্দ্রের নাটকে দেশীয় এবং জাতীয় ভাব বেশি পরিমাণে লক্ষ করা যায়।
- নাটকের পঞ্চাঙ্ক বিভাগ তিনি সর্বত্র মেনে নিয়েছেন।
- শেক্সপীয়ার ছিলেন গিরিশচন্দ্রের নাট্যাদর্শ। তিনি নিজেই বলেছেন— ‘‘মহাকবি শেক্সপিয়রই আমার আদর্শ।’’
- গিরিশচন্দ্রের সর্বাধিক কৃতিত্ব ভক্তিরসের পৌরাণিক নাটকে। কারণ তিনি উপলব্ধি করেছিলেন— “ভারতবর্ষের জাতীয়তার মূলে ধর্ম। ভারত ধর্মপ্রাণ। যাহারা নাস্থল ধরিয়া চৈত্রের রৌদ্রে ক্ষেতে পরিশ্রম করিতেছে, তাহারাও কৃষ্ণনাম জানে। তাদেরও মন কৃষ্ণনামে আকৃষ্ট। যদি নাটকে সার্বজনীনতার প্রয়োজন থাকে তবে কৃষ্ণনামেই হইবে।” তাই তিনি বাঙালি দর্শকদের ‘মর্মাশ্রয়’ করে নাটক রচনার জন্য ‘ধর্মাশ্রয়’ করেছিলেন।
- সংলাপের ক্ষেত্রে বাংলা নাটকে গিরিশচন্দ্র সবচেয়ে বেশি সংস্কার সাধন করেছেন। মধুসূদন ও দীনবন্ধুর গদ্য সংলাপের আড়ষ্টতা গিরিশচন্দ্র কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। কারণ তিনিই প্রথম সাবলীল ও গতিশীল সংলাপ ব্যবহার করলেন নাটকে।
- নাটকে গৈরিশ ছন্দ ব্যবহারের কৃতিত্বও তাঁর যথেষ্ট। এই ছন্দের ব্যবহারে নাটকীয় ক্রিয়া যেমন নাট্যরূপ পেয়েছে তেমনি চরিত্রগুলিও হয়ে উঠেছে জীবন্ত ও গতিশীল। এই ছন্দ ব্যবহারে নাটকের কথোপকথন কখনো ক্লান্তিকর বলে মনে হয় না।
- গিরিশচন্দ্রের চরিত্রচিত্রণও সরল এবং সহজবোধ্য। তবে তারা খুব ভাল অথবা খুব মন্দ শরৎচন্দ্রের চরিত্রের মতো। অনেক পতিতা চরিত্রও তার নাটকে বিবর্তিত চরিত্ররূপে চিত্রিত হয়েছে।
- তাঁর নাটকগুলি হাল্কা ধরনের নয়, বরং তার মধ্যে রয়েছে গভীর জীবনজিজ্ঞাসা।
- গিরিশচন্দ্রের নাটকে দোষ ত্রুটি থাকলেও কিম্বা তাঁর বেশিরভাগ নাটকগুলির নাট্যমূল্য কিঞ্চিৎকর হলেও এক সময়ের সাধারণ দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য তিনি যেসব নাটক রচনা করেছিলেন তাঁর ঐতিহাসিক মূল্য যথেষ্ট।
Leave a Reply