গীতিকবিতার স্বরূপ উল্লেখ করে একটি গীতিকবিতা আলোচনা কর।
গীতিকাব্য
গীতিকাব্য ইংরেজিতে যাকে Lyric Poetry বলা হয় বাংলায় তাকে গীতিকবিতা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ‘Lyric’ শব্দটির উৎপত্তি ‘Lyre’ শব্দ থেকে। ‘Lyre’ হল এক ধরনের বাদ্যযন্ত্র। একারণে প্রথম দিকে বাদ্যযন্ত্রসহকারে গাওয়া গানকে বলা হত Lyric—A Song to be sung to the accompaniment of a lyre. কিন্তু আধুনিক কালে লিরিক বা গীতিববিতার সংজ্ঞা বদলে গেছে। কবির ব্যক্তিচিত্তের আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ ঘটে যে ক্ষুদ্র কবিতায় তাকেই বর্তমান দিনে গীতিকবিতা বলা হয়। Ruskin-এর মতে— “Lyric Poctry is the expression by the poct at his own feelings.’’ সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র গীতিকবিতা সম্পর্কে বলেছেন—“বক্তার ভাবোচ্ছাসের পরিস্ফূটতামাত্র যাহার উদ্দেশ্য, সেই কাব্যই গীতিকাব্য।” রবীন্দ্রনাথের গীতিকবিতার ভাব সম্বন্ধে বলেছেন—“যাহাকে আমরা গীতিকাব্য বলিয়া থাকি অর্থাৎ যাহা একটুখানির মধ্যে একটি মাত্র ভাবের বিকাশ..।’’ সবমিলিয়ে বলা যায় যে কবিতায় কবি তাঁর একান্ত আবেগ-অনুভূতিকে এক সাবলীল ও আন্তরিক গীতিপ্রবণ ভাষায় ব্যক্ত করেন তাকেই মন্ময় কবিতা বা গীতিকবিতা বলা যায়।
গীতিকাব্যের শ্রেণিবিভাগ
গীতকবিতা মূলত তিন প্রকার— ১) প্রেমমূলক গীতিকবিতা, ২) দেশপ্রেমমূলক গীতিকবিতা, ৩) প্রকৃতি-প্রেমমূলক গীতিকবিতা।
প্রেমমূলক গীতিকবিতা
মূলত প্রেম এই শ্রেণির গীতিকবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। কারণ মানবিক অনুভূতিসমূহের মধ্যে প্রেমই সর্বাপেক্ষা প্রবল এবং বিচিত্র গতি। বৈষ্ণব পদাবলী, রবীন্দ্রনাথের ‘গুপ্তপ্রেম’, জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ এই শ্রেণির গীতিকবিতার নিদর্শন।
দেশপ্রেমমূলক গীতিকবিতা
স্বদেশ প্রেম তথা দেশাত্মবোধ কবিমানসে উদ্দীপনা সঞ্চার করে এবং তা থেকে জন্ম হয় স্বদেশপ্রীতিবিষয়ক কবিতা ও গান। যেমন মধুসূদন দত্তের ‘বঙ্গভূমির প্রতি’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘আমার দেশ’ প্রভৃতি।
প্রকৃতি-প্রেমবিষয়ক গীতিকবিতা
নিসর্গ প্রকৃতির রূপ-রস-বর্ণ, ঘ্রাণের নিবিড়তা, ভাবনিষ্ঠ চিত্রণ, মানব ও প্রকৃতির দূরত্বকে অতিক্রম করার ব্যাকুলতা, প্রকৃতির রহস্য ও সৌন্দর্যভোগের বাসনা, প্রকৃতিতে নীতি ও তত্ত্বের আরোপ ইত্যাদি বিষয়গুলি এই শ্রেণির গীতিকবিতায় নিত্যনতুন ব্যঞ্জনায় প্রকাশিত। যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘বর্ষামঙ্গল’ ওয়ার্ডসওয়াথের লুসিবিষয়ক কবিতা, কীটসের ‘ode to a nightingale’ প্রভৃতি।
গীতিকাব্যের বৈশিষ্ট্য
গীতিকবিতার উদ্ভব, সংজ্ঞা ও স্বরূপের দিকে দৃষ্টি রেখে এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্যগুলিকে লিপিবদ্ধ করা যেতে পারে—
- কবিহৃদয়ের একান্ত ব্যক্তিগত ভাবাবেগের প্রকাশ হল গীতিকবিতা।
- গীতিকবিতার একক আত্মমগ্ন অনুভবের তীব্রতা, সংবেদনশীল ভাষা ও সুরের অন্তর্লীন স্পর্শ পাঠক চিত্তকে আবিষ্ট করে। অর্থাৎ কবি ও পাঠকের নিবিড় রস সংযোগই গীতিকবিতার প্রধান আকর্ষণ।
- কবি চিত্তের ব্যক্তিগত অনুভূতি-সংবেদন মন্ময়তা সত্ত্বেও গীতিকবিতার একক সর্বজনীন আবেদন ও মূল্য থাকে।
- ভাবের একমুখীনতা গীতিকবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
- গীতিকবিতা যতখানি আবেগ-অনুভূতিমূলক ততখানি চিন্তামূলক নয়।
- সংহত ও সংক্ষিপ্ত অবয়ব বিন্যাসে সার্থক গীতিকবিতা শব্দ-ছন্দ-সুর-তাল-ব্যঞ্জনায় এক সুসমন্বিত শিল্পরূপ।
- সাবলীল গতি, সংগীত মুখরতা, নিটোল প্লাকৃতির অবয়ব, গভীর অনুভূতি, আবেগ ব্যাকুলতা প্রভৃতি গীতিকবিতার অন্যতম লক্ষণ।
একটি সার্থক গীতিকবিতা
মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘আত্মবিলাপ’ কবিতাটি সার্থক গীতিকবিতার অন্যতম উদাহরণ। বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলি ‘আত্মবিলাপ’ কবিতায় কীভাবে ফুটে উঠেছে তা আমরা আলোচনা করে দেখব—
- কবি হৃদয়ের একান্ত ব্যক্তিগত ভাবাবেগের প্রকাশ হল গীতিকবিতা। আলোচ্য ‘আত্মবিলাপ’ কবিতায় মধুসূদনের ব্যক্তিগত উপলব্ধি ও অনুভূতির আন্তরিক প্রকাশ ঘটেছে। সমগ্র কবিতার প্রতি ছত্রে কবির ব্যক্তিগত ভাবাবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে আত্মবিশ্লেষণ বা বিলাপের মাধ্যমে।
- পূর্ণ মানব জীবনের নয় একক জীবনের সুখ, দুঃখ, আশা-আনন্দের প্রতিধ্বনি বা ও গীতিকবিতায়। ‘আত্মবিলাপ’ কবিতায় মধুসূদন দত্ত জীবনের প্রতিটি পর্বে উপনীত হয়ে উপলব্ধি করেছেন যে তিনি আশার ছলনায় ভুলে প্রকৃত সাফল্যের সন্ধান পাননি। এর পরিণামে তাঁর জীবনে নেমে এসেছিল দুঃখের রাত্রি। সে দুঃখ একান্তভাবে কবির ব্যক্তিগত, অন্য কারও নয়।
- আলোচ্য কবিতায় মধুসূদনের অন্তরের যে যন্ত্রণা বা কষ্টের কথা প্রতিফলিত হয়েছে তাতে তাঁর প্রতি পাঠকের সহানুভূতি জাগে। ফলে কবি ও পাঠকের মধ্যে এক নিবিড় সংযোগ ঘটেছে তা গীতিকবিতার আকর্ষণ।
- গীতিকবিতা অনুভূতিমূলক, চিন্তামূলক নয়। ‘আত্মবিলাপ’ কবিতায় চিন্তার অবকাশ নেই, আছে একান্ত ব্যক্তিগত ভাবোচ্ছাসের পরিস্ফুটন।
- ‘আত্মবিলাপ’ কবিতায় কবি মধূসূদনের সুখ বা আনন্দের কথা ব্যক্ত হয়নি। কেবলমাত্র তাঁর মনের বা আত্ম-অনুশোচনার কথা অর্থাৎ একটিমাত্র ভাবের প্রকাশ ঘটেছে। অর্থাৎ ভাবের একমুখী তা যে গীতিকবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য তা ‘আত্মবিলাপ’ কবিতায় ফুটে উঠেছে।
- সংযত ও সংক্ষিপ্ত অবয়ব বিন্যাসে, শব্দ চয়নে, ছন্দ পরিপাটে, উপমা প্রয়োগে ‘আত্মবিলাপ’ এক সুষমামণ্ডিত শিল্পরূপে পরিণত হয়েছে।
সর্বোপরি বলা যায় গীতিকবিতার সমূহ বৈশিষ্ট্য আলোচ্য ‘আত্মবিলাপ’ কবিতার মধ্যে সার্থকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাছাড়া মধুসূদন নিজেই বলেছেন—“I have a tendency of lyrical way”. সুতরাং তাঁর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এবং উপরের আলোচনার সূত্রে আমরা নিঃসংশয়ে বলতে পারি ‘আত্মবিলাপ’ একটি সার্থক গীতিকবিতা।
তথ্যসূত্র:
কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্ত | Download |
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাস | Download |
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরী | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাস | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যাল | Download |
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাস | Download |
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
সাহিত্যের রূপরীতি ও অন্যান্য – কুন্তল চট্টোপাধ্যায় | Download |
সাহিত্য ও সমালোচনার রূপরীতি – উজ্জ্বলকুমার মজুমদার | Download |
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত | Download |
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দী | Download |
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যাল | Download |
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেন | Download |
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায় | Download |
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষ | Download |
Leave a Reply