গৈরিশ ছন্দ কাকে বলে? এর বৈশিষ্ট্যগুলি উদাহরণসহ আলোচনা কর।
গৈরিশ ছন্দ
মধুসূদন পয়ার-বন্ধন ছিন্ন করে বাংলা ছন্দকে মুক্ত করেছিলেন অমিত্রাক্ষর ছন্দের নব শৃঙ্খলায়। শুধু কবিতায় নয় নাটকেও Blank verse প্রবর্তনের চেষ্টায় ছিলেন তিনি— “I would like very much to see Blank Verse gradually introduced our dramatic literature”. (যতীন্দ্রমোহন মধুসূদনের লেখা চিঠি)। গিরিশচন্দ্র অনুভব করেছিলেন—“ছন্দে কথা নাটকের উপযোগী।” (গিরিশচন্দ্র-নবীন সেনকে লেখা চিঠি)। তাঁর মতে কাব্যিক ও ছন্দময় সংলাপ অনেক না-বলা বাণীকে মূর্ত করে তুলতে সাহায্য করে।
গিরিশচন্দ্র অমিত্রাক্ষরের স্বাধীনতা ও প্রবহমানতা অনুসরণ করেই তাঁর নাট্য-ভাষা সৃষ্টি করেছেন। এই ছন্দে কথা বলার ভঙ্গীর পাশাপাশি আবেগ প্রকাশের উপযোগী উপকরণ প্রচুর।
“এই ছন্দ ভঙ্গী পৌরাণিক ভক্তিভাব ও আবেগময়তার উপযুক্ত বাহন। সাধুভাষার সহযোগে এই ছন্দ অপূর্ব নাটকীয় রস সৃষ্টি করতে সক্ষম।” (সুধীভূষণ ভট্টাচার্য)
গিরিশচন্দ্র পৌরাণিক নাটকের ভাষা-রূপেই এই ছন্দের প্রবর্তন করেন। মূলতঃ অমিত্রাক্ষরকে ভেঙ্গে (একাধিক পর্বে বা পর্বাঙ্গে) গৈরিশ ছন্দ সৃষ্টি। গিরিশচন্দ্র পৌরাণিক নাটকের ভাবাবেগ সৃষ্টি করার জন্য ভাবাবেগের ব্যাপ্তি অনুসারে পর্বগুলির মাত্রা বিন্যাস করেছেন, অথবা মূল পংক্তিগুলি ভেঙ্গে ছোট বড় করে প্রয়োগ করেছেন। সেজন্য এই ছন্দকে অনেকে ভগ্ন অমিত্রাক্ষর ছন্দও বলতে চেয়েছেন।
গৈরিশ ছন্দ যেমন অমিত্রাক্ষরের ভাঙ্গা রূপ, তেমনি মুক্তকের সঙ্গেও এর মিল যথেষ্ট। মুক্তক ও গৈরিশ ছন্দ মূলত অমিত্রাক্ষর, তফাৎ শুধু পংক্তিগুলি অসম পর্বের। মুক্তক সাধারণত মিলযুক্ত, কিন্তু গৈরিশ ছন্দ মিলহীন। গৈরিশ ছন্দ অপেক্ষাকৃত গদ্যধর্মী।
প্রকৃতপক্ষে মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর প্রবহমান অক্ষরবৃত্ত ছন্দকে ভেঙ্গেই অসম পংক্তি বিন্যাসে গঠিত হয়েছে গৈরিশ ছন্দ। ১৪ অক্ষরের পংক্তিকে ভেঙ্গে ছোট বড় একাধিক পংক্তিতে সাজানো হয়েছে। সাধারণত এতে মুক্তকের মত অন্ত্যমিল থাকে না। তবে পর্বগুলি অক্ষরবৃত্তের মতই সাধারণত যুগ্ম মাত্রা হয়ে থাকে— অর্থাৎ ৪, ৬, ৮, ১০, ১৪ মাত্রার পর্ব হয়।
গৈরিশ ছন্দের বৈশিষ্ট্য
- এই ছন্দ এক ধরনের অমিল অমিত্রাক্ষর ছন্দ যা অক্ষরবৃত্তের বা মিশ্ৰকলাবৃত্তের শ্রেণিভুক্ত পয়ার জাতীয় ছন্দ।
- এর মাত্রা অক্ষরবৃত্তের রীতি অনুসারে নির্ণীত হয়ে থাকে।
- এর মূল পর্ব-যুগ্ম মাত্রা, ৪, ৬, ৮, ১০, ১৪ হতে পারে। ১৪ মাত্রার প্রবহমান পয়ার বা অমিত্রাক্ষরকে ভেঙে ভেঙে এর পংক্তি সজ্জিত হয়।
- ছন্দটির পংক্তিগুলি সবই অসমমাত্রিক ও মিলহীন।
- মুক্তক ও এই ছন্দের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই।
- ছেদচিহ্ন অনুসারে পংক্তিগুলি বিন্যস্ত হয়।
- প্রতিটি পর্ব ও পংক্তিতে যুক্তবর্ণের ব্যবহার লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।
- প্রত্যেক পংক্তিতেই পূর্ণ অর্থ-বিভাগ দৃষ্ট হয়।
- ভাবানুযায়ী পর্বগুলি দীর্ঘ হয়। ভাব গম্ভীর হলে পর্বগুলি ৮ বা ১০ বা ১৪ মাত্রার হয়।
কয়েকটি উদাহরণ
(ক) যাক্ মম প্রতিজ্ঞা অতলে ১০
রহুক দ্রৌপদী। এলোকেশে চিরদিন ৬+৮
কুশলে কৌরবকুল ৮
রহুক হস্তিনাপুরে। ৮
(গিরিশ চন্দ্র)
(খ) ধিক্কার দিও না তারে | দেবি ৮+২
দেবেন্দ্র করেছে দয়া ৮
করিয়া কবচ শূন্য | উরস্ আমার ৮+৬
কবচ কুণ্ডল গেছে যাক্ ৮+২
সঙ্গে সঙ্গে চলে গেছে। মর্মের পীড়ক। ৮+৬
(ক্ষীরোদপ্রসাদ)
গিরিশচন্দ্রের পূর্বে কালীপ্রসন্ন সিংহ এ জাতীয় অসমপর্ব-বিন্যস্ত ছন্দ রচনা করেছেন তাঁর হুতোম পেঁচার নকশার উৎসর্গ পত্রে—
হে সজ্জন
স্বভাবের সুনির্মল পটে, রহস্য রঙ্গের বঙ্গে
চিত্রিনু চরিত্র দেবী সরস্বতী বরে।
Leave a Reply