//
//

চর্যাপদের সন্ধ্যাভাষা সম্পর্কে আলোচনা কর।

সন্ধ্যাভাষা

চর্যাগীতির মূল বিষয় বৌদ্ধ সাধকদের অধ্যাত্মতত্ত্ব। ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্ব বিষয়ে বিভিন্ন নির্দেশ দানের জন্য এই গানগুলি রচিত। কিন্তু এইসব উপদেশ সর্বজনবোধ্য ভাষায় দেওয়া হয়নি। আসল বক্তব্যকে কতগুলি ভিন্ন অর্থবহ শব্দ, উপমা-উৎপ্রেক্ষার সাহায্যে আচ্ছন্ন করা হয়েছে। ফলে চর্যার ভাষায় প্রায় প্রতিক্ষেত্রে দুটি করে অর্থ বিদ্যমান। একটি অর্থ বাহ্য বা লৌকিক, অপর অর্থ গূঢ় এবং পারিভাষিক। যা একমাত্র দীক্ষিত সাধকদের অবগত।

চর্যাগানের টীকা রচনা করতে গিয়ে মুনিদত্ত চর্যায় ব্যবহৃত শব্দগুলির গূঢ় অর্থ উদ্ধারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাঁর টীকার বিভিন্ন স্থানে এই দ্ব্যর্থ শব্দ ও প্রকাশরীতিকে ‘সন্ধ্যাভাষা’, ‘সন্ধ্যাবচন’, ‘সন্ধ্যাসংকেত’ অথবা ‘সন্ধ্যা’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। মুনিদত্তের টীকা অনুসরণ করে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রচার করেছিলেন যে চর্যাগীতিগুলি ‘সন্ধ্যাভাষায় লেখা’। সন্ধ্যাভাষার অর্থব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন— ‘সন্ধ্যাভাষার মানে আলো আঁধারি ভাষা, কতক আলো, কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায়, খানিক বুঝা যায় না’।(মুখবন্ধ, বৌদ্ধগান ও দোঁহা, পৃ.৮)।

কিন্তু পরবর্তীকালের গবেষকদের কাছে এই ব্যাখ্যা মনঃপূত হয়নি। শাস্ত্রীর এই ব্যাখ্যার প্রতিবাদ করে পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন— ‘ভাগলপুর জেলার দক্ষিণ-পূর্বাংশ, সাঁওতাল পরগণা এবং বীরভূমের পশ্চিমাংশ, এই ভূভাগকে সন্ধ্যাদেশ কহে অর্থাৎ ইহা আর্য্যাবর্ত এবং বঙ্গদেশের সন্ধিস্থলে অবস্থিত; এই প্রদেশের ভাষাকেও সন্ধ্যাভাষা কহে। …সিদ্ধাচার্য্যগণের অবলম্বিত দোহা পদ-সকলের ভাষা এই দেশেরই সন্ধ্যাভাষা বা বিভাষা। (পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৯৮)। অর্থাৎ পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে চর্যার ভাষা ভাষাবিশেষের গূঢ়রূপ নয়, আঞ্চলিক উপভাষা মাত্র।

পণ্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী ‘সন্ধ্যা’ শব্দটির বানান ও ব্যুৎপত্তি সম্পর্কে আপত্তি প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে ‘সন্ধ্যা’ বানানটি লিপিকর-প্রমাদ। প্রকৃত বানান ‘সন্ধা’, সম্-ধা ধাতু থেকে এই শব্দের ব্যুৎপত্তি। এই ব্যুৎপত্তি অনুযায়ী ‘সন্ধাভাষা’ বা বচনের অর্থ, যে ভাষায় বা শব্দে অর্থ সম্যকরূপে নিহিত আছে অর্থাৎ আভিপ্রায়িক ভাষা বা সাংকেতিক ভাষা। চর্যাগীতির অপর বিশেষজ্ঞ ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী বিধুশেখর শাস্ত্রীর এই মতকে সমর্থন করেছেন।

যুক্তির দিক থেকে বিধুশেখর শাস্ত্রী ও প্রবোধচন্দ্র বাগচীর ‘সন্ধা’ বানানটি গ্রহণযোগ্য হলেও পুথিতে প্রাপ্ত ‘সন্ধ্যা’ বানানটি একেবারে উপেক্ষণীয় নয়। কেননা পুথি ছাড়াও সরহের দোহাকোষের অদ্বয়ব্রজরচিত ‘সহজাম্নায়পঞ্জিকা’ নামক টীকায় এবং ‘হেবজ্রতন্ত্রে’ এবং অন্যান্য বৌদ্ধতান্ত্রিক পুথিতে ‘সন্ধ্যা’ নামটি পাওয়া যায়। ‘সন্ধ্যা’ বানানটি লিপিকর প্রমাদ হলে অন্যান্য পুথিতেও ‘সন্ধ্যা’ বানানটি থাকত না। সেক্ষেত্রে ‘সন্ধ্যা’ বানানটি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। এবং প্রাকৃতিক সন্ধ্যার সঙ্গে মিলিয়ে না দেখে বরং অন্যভাবে ‘সন্ধ্যা’ শব্দের তাৎপর্য উপলব্ধি করা উচিৎ।

প্রকৃতপক্ষে, ‘যে ভাষার অভীষ্ট অর্থ সম্যক ধ্যান (সম্-ধ্যৈ) যোগে বুঝতে হয়’, এরকম অর্থ করলে ‘সন্ধ্যা’ বানানটি অক্ষুণ্ন থাকে। সবমিলিয়ে বলা যায় ‘সন্ধ্যা’র বানান ও ব্যুৎপত্তি যাইহোক না কেন, ‘সন্ধ্যাভাষা’ কোনো আঞ্চলিক উপভাষা নয়, আসলে একধরনের গূঢ়ার্থ প্রতিপাদক বচন-সংকেত।

তথ্যসূত্র:

১. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত: অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়—

২. বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত: অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

৩. বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা: ভূদেব চৌধুরী

৪. বাঙলা সাহিত্যের রূপরেখা: গোপাল হালদার

৫. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস: সুকুমার সেন

৬. চর্যাগীতি পরিক্রমা: নির্মল দাশ

৭. চর্যাগীতির ঐতিহাসিক ভূমিকা: জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!