চৈতন্যদেবের জীবনকথা সম্পর্কে আলোচনা কর।
শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনকথা
“প্রেম পৃথিবীতে একবার মাত্র রূপ গ্রহণ করিয়াছিল, তাহা বাঙ্গালাদেশে।”— চৈতন্যদেবের আগমন সম্বন্ধে দীনেশচন্দ্র সেনের এই প্রশংসা অত্যুক্তি নয়, তা রসজ্ঞের উক্তি। চৈতন্যের আবির্ভাবের সমকালীন পটভূমি ছিল চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা। জাতির সেই চরম দুর্দিনে চৈতন্যচন্দ্রোদয় ঘটেছিল—যা বাঙালি চিরকাল স্মরণে রাখবে।
শ্রীচৈতন্য ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি (১৪০৭ শকাব্দ) ফাল্গুন মাসে দোল পূর্ণিমায় নবদ্বীপধামে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন নবদ্বীপ প্রবাসী শ্রীহট্টের পণ্ডিত জগন্নাথ মিশ্র, মাতা শচীদেবী। তাঁর এক অগ্রজ বিশ্বরূপ অল্প বয়সেই গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন। শ্রীচৈতন্যের নাম ছিল বিশ্বম্ভর, ডাক নাম ছিল নিমাই।
আজানুলম্বিত বাহু, কনকাবতার শ্রীচৈতন্য শৈশব থেকেই ছিলেন মেধাবী ও চঞ্চল প্রকৃতির। নবদ্বীপে গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে অধ্যয়ন করে তিনি অল্পবয়সেই শাস্ত্রবিদ্যায় পণ্ডিত হয়ে ওঠেন। এমনকি বাল্যে তিনি নবদ্বীপের পণ্ডিতদের ও টোলের পড়ুয়াদের ক্ষ্যাপাতে, জ্বালা করতে থাকেন। সেদিনের নবদ্বীপ ছিল নব্য ন্যায়ের পীঠস্থান। এই দুষ্টু ছেলেই যৌবনে সেখানকার সর্বাগ্রগণ্য পণ্ডিত হয়ে উঠলেন।
এদিকে লক্ষ্মীপ্রিয়ার সঙ্গে তাঁর শুভ পরিণয় সম্পন্ন হয়। বিবাহের কিছুদিন পর তিনি যখন পূর্ববঙ্গ ভ্রমণে যান তখন তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়। এতে নিমাই খুবই মর্মাহত হন। মায়ের পীড়াপীড়িতে আপত্তি সত্ত্বেও তিনি দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করেন বিষ্ণুপ্রিয়াকে।
বিবাহের কিছুদিন পরে পিতৃকৃত্য সমাপনের উদ্দেশ্যে তিনি গয়া গমন করেন। সেখানেই তিনি নবজীবনের সন্ধান পান, শুরু হয় আর এক জীবন। অবশ্য এর পেছনে রয়েছে মাধবেন্দ্রপুরী ও ঈশ্বরপুরীর সান্নিধ্য। গয়া থেকে প্রত্যাবর্তন করে সেই চঞ্চল দুরন্ত নিমাই হয়ে গেলেন ভক্তিমার্গের মানুষ। তিনি সব সময় কৃষ্ণনামে মাতোয়ারা হয়ে পড়লেন।
ভগবৎ প্রেমে পাগল হয়ে বিশ্বম্ভর তখন নবদ্বীপে ভাগবৎ পাঠ, হরিসংকীর্তন প্রভৃতি নিয়ে মেতে ওঠেন। কৃষ্ণনামে নবদ্বীপ তখন টলমল করতে লাগল। তার সঙ্গী হলেন নিত্যানন্দ ও হরিদাস। এরপর ২৪ বৎসর বয়সে কাটোয়ার কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস গ্রহণ করে নিমাই হলেন ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’, সাধারণ কথায় ‘শ্রীচৈতন্য’। তার নবদ্বীপ লীলার সহচরেরা তাকেই আরাধ্য এবং অবতাররূপে সাধনার লক্ষ্য বলে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন।
সন্ন্যাস গ্রহণ করে মহাপ্রভু চৈতন্যদেব যান পুরীধামে। সেখান থেকে তিনি তীর্থ পর্যটনে বেরিয়ে পড়েন। প্রথমবার তিনি মহারাষ্ট্র, দাক্ষিণাত্য ও গুজরাট ভ্রমণ করেন। এরপর বৃন্দাবনে যান। বৃন্দাবন থেকে শান্তিপুর, গৌড়, রামকেলি হয়ে তিনি ফিরে আসেন। সেই সময়ে রামকেলিতে তার সংস্পর্শে আসেন সুলতান হুসেন শাহের মন্ত্রী ‘দবীর খাস’ (সনাতন গোস্বামী) ও ‘সাকর মল্লিক’ (রূপ গোস্বামী)। এঁরাও শ্রীচৈতন্যের সান্নিধ্যে এসে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। এই তীর্থ পর্যটনের ফলে ভারতবর্ষের বৃহত্তর জীবনের সঙ্গে চৈতন্যদেবের যেমন পরিচয় ঘটল, তেমনি তাঁর জীবন ও প্রেমধর্মের দ্বারা সমসাময়িক বাঙালি জীবন অনুপ্রাণিত হয়ে উঠল। এইসময় চৈতন্যদেবকে ঘিরে একটি পরিমণ্ডল গড়ে উঠল। যারা পরবর্তীকালে গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের ভিত্তি রচনা করল।
শ্রীচৈতন্যের অবশিষ্ট দিনগুলি ছিল ভাবময়। জীবনের শেষ আঠার বছর তিনি পুরীতেই অবস্থান করেন। এই সময় দিনের পর দিন তার জীবন কৃষ্ণপ্রীতিতে ভরে ওঠে। শেষের কয়েক বৎসর তিনি দিব্যোম্মাদ অবস্থায় দিন কাটান। ৪৮ বৎসর বয়সে পুরীতে ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে জুন চৈতন্য মহাপ্রয়াণ করেন। তবে তাঁর জীবনাবসান রহস্যাবৃত। কারো মতে, জগন্নাথ মন্দিরে নৃত্য করতে করতে মারা যান, আবার কেউ বলেন দিব্যোন্মাদ অবস্থায় নদীতে ভেসে যান, আবার কারো মতে পুরীর পাণ্ডারা তাকে হত্যা করেন। সে যাই হোক, তাঁর জীবন বাঙালির কাছে আদর্শস্বরূপ। বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে এতো বড় ব্যক্তিত্ব আগে আসেনি।
Leave a Reply