//
//

ভারতীয় জনজীবনে মহাভারতের প্রভাব আলোচনা কর।

ভারতীয় জনজীবনে মহাভারতের প্রভাব

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন— “ভারতবর্ষ রামায়ণ ও মহাভারতে আপনাকে আর কিছুই বাকি রাখে নাই।” অর্থাৎ রামায়ণ-মহাভারত সমগ্র ভারতের প্রতিনিধি। এই দুই গ্রন্থে ভারতবর্ষের ধর্মাধর্ম, রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহার এক কথায় রাষ্ট্র, সমাজ ও গৃহজীবনের সমস্ত আদর্শের পরিচয় নিহিত রয়েছে। ভারতবর্ষের কথা যেমন এই দুই গ্রন্থে রয়েছে, তেমনি এই দুই মহাগ্রন্থ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে ভারতীয় জনজীবন ও সাহিত্য। একটি বিশাল বৃক্ষ যেমন মাটি থেকেই তার রসদ যোগাড় করে বড় হয়ে ওঠে এবং পরে সেই বৃক্ষ আবার সেই মাটিকেই ছায়াদান করে তেমনি এই দুই মহাকাব্য ভারতের ‘হৃদপদ্মসম্ভব’ও ‘হৃদপদ্মবাসী’।

ভারতীয় জনজীবনে এই দুই মহাকাব্যের প্রভাব অপরিমেয়। বেদ এ দেশের প্রধান গ্রন্থ, কিন্তু বেদজ্ঞান ব্যক্তিবিশেষে সীমাবদ্ধ। পুরাণ এদেশের আর এক সম্পদ, কিন্তু পুরাণের প্রচারও সর্বব্যাপকনয়; রামায়ণ-মহাভারত জনসাধারণের বেদ-পুরাণ। রামায়ণ ‘বেদসম্মিত’, মহাভারত ‘পঞ্চমবেদ’। দুটি মহাগ্রন্থই আবার পুরাণ সমূহের বিশ্বকোষ। তাই জনজীবনে রামায়ণ মহাভারতেরই সমাদর। এদেশের গৃহজীবনে পুত্রের আদর্শ রাম, ভ্রাতার আদর্শ ভরত ও লক্ষ্মণ, পত্নীর আদর্শ সীতা, আর পরিপূর্ণ মনুষ্যত্বের আদর্শ শ্রীকৃষ্ণ। এই দুটি গ্রন্থ যেমন ভারতবর্ষের অন্তঃকরণের ইতিহাস, তার ধর্মবোধ, কর্মনীতিও চারিত্রিক আদর্শকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে তেমনই আবার এ দুটি গ্রন্থ এদেশের চরিত্ৰনীতি, কর্মাদর্শ ও ধর্মবোধকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। তাই রামায়ণ-মহাভারত ভারতীয় জীবনের জীবন্ত প্রেরণা।

মহাভারতের আবেদন প্রধানত ‘জয়াখ্য ইতিহাস’ ও ধর্মশাস্ত্র রূপে। মহাভারত বেদ-উপনিষদ্, বিবিধ শাস্ত্র ও লোকযাত্রাবিধানের তথ্য পূর্ণ। মহাভারত ভারতীয় প্রজ্ঞার বিশিষ্ট কীর্তি— ‘ইদন্তু ত্ৰিষু লোকেষু মহদ্ জ্ঞানং প্রতিষ্ঠিতম্।’

রামায়ণমূলত পারিবারিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে, অন্যদিকে মহাভারত ভারতীয় বৃহত্তর সমাজকেই প্রভাবিত করেছে। কারণ মহাভারতের সমাজ বিস্তৃততর, সংঘাত আরও প্রচণ্ড। মহাভারতের গৃহযুদ্ধে সমগ্র ভারত যুক্ত, সমগ্র ভারত আন্দোলিত। শুধু তাই নয়, ভারতীয় জীবনের সমস্ত নীতি-রাজনীতি, অর্থনীতি, গৃহধর্ম, রাজধর্ম, আপদ্ধর্ম, ধর্মশাস্ত্র ও কামশাস্ত্র। সবই মহাভারতের বিপুল অঙ্গে স্থান লাভ করেছে। তাই মহাভারতে বলা হয়েছে—

ধর্মে চার্থে কামে চ মোক্ষে চ ভরতষভ।

যদিহাস্তি তদন্যত্র যন্নেহাস্তি নকুচিৎ।।

(আদি ৫৭/২৪)

মহাভারত মূলত কুরুপাণ্ডবের বিরোধের ইতিহাস। সেই বিরোধ ভারতবর্ষের জনজীবনে প্রায় লক্ষ করা যায়। তবে মহাভারতের পরিণামও জনজীবনের ধর্মবোধকে প্রভাবিত করেছে। তা হল—দম্ভ, দর্প ও অতিমানিতার শোচনীয় পরিণাম। তাই ভারতে বিরোধ আছে, হানাহানি হয়, কিন্তু তা সাময়িক কারণ। মহাভারতের নীতি ভারতেরও-যতো ধর্ম স্ততো জয়ঃ।

মহাভারতের অষ্টাদশ পর্ব যেন ভারতীয় জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়। সেই সব অধ্যায়ে রয়েছে—শৌর্য-বীর্য, প্রেম-প্রীতি, ধর্মনীতি,হর্ষ-শোক, যুদ্ধ শান্তি প্রভৃতির কথা ভারতীয় জীবনকে প্রভাবিত করেছে।

মহাভারতের প্রেম ও বীর্যকথা ভারতীয় জীবনকে প্রভাবিত করেছে। যেমন দুষ্যন্ত ও শকুন্তলার উপাখ্যান, কচ ও দেবযানীর কাহিনী, যযাতি-শর্মিষ্ঠা সংবাদ, নলোপাখ্যান, বিদুলার কথা ইত্যাদি। শকুন্তলা ও দুষ্যন্তের প্রেমকাহিনী ভারতীয় জীবনের আত্মসংবৃত প্রেম ও বিদেহী প্রেমের স্বরূপকে প্রভাবিত করেছে। তেমনি কচ ও দেব্যানীর কথা, যযাতি-শর্মিষ্ঠার উপাখ্যান, তপতী সংবরণের অপূর্ব রোমাঞ্চকর প্রেমোপাখ্যান ভারতবাসীকে আকৃষ্ট করে এখনো। উদ্যোগ পর্বের অন্তর্গত বিদুলা-সঞ্জয় সংবাদটি ভারতবাসীর কাছে বিশুদ্ধ উৎসাহদ্দীপক কাহিনী। সন্তানের বৈক্লব্য দেখলে ভারতের বীরাঙ্গনা নারী কি অসীম তেজোগৰ্ভবাক্যে তাকে কর্মে প্রেরণা দিতেন—বিদুলা উপাখ্যান তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। বিদুলা ছিলেন ক্ষাত্রধর্মনিরতা বীরাঙ্গনা।

মহাভারতের ধর্মমূলক উপ্যাখ্যানগুলিও ভারতীয় জীবনকে ধর্মপথে অনুপ্রেরণা দান করেছে। যেমন—বক যুধিষ্ঠির সংবাদে (বন পর্ব) রয়েছে জীবনে কে সুখী। তাতে বলা হয়েছে—যিনি অঋণী ও অপ্রবাসী হয়ে নিজ গৃহে দিনের শেষে শাকান্নও ভোজন করেন তিনিই সুখী।

মহাভারতের অনুশাসন পর্বের নানান রীতিনীতি, সামাজিক নিয়মকানুন ভারতীয় জীবনে মুদ্রিত হয়ে রয়েছে। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের সম্পর্কে মহাভারতের অনেক বক্তব্য এখনো গ্রহণীয়। তাছাড়া গীতা হিন্দুর জীবনবেদ, কর্মের প্রেরণা, ধর্মের মূল, অধ্যাত্ম চিন্তার সার। হিন্দুজীবনে জ্ঞানে, কর্মে ও ভক্তিতে যে আপাত বিরোধ আছে, গীতা তার সার্থক সমন্বয়।

মহাভারতের যুদ্ধনীতি, করনীতি, বৃহনির্মাণ, সৈনাপত্য-কৌশল, কূটষড়যন্ত্র প্রভৃতি ভারতীয় রাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করেছে। ব্যাসকূট ও প্রহেলিকাগুলি ভারতীয় জনজীবনে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। যেমন, উদ্যোগ পর্বে ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি বিদুরের উক্তি—এক দ্বারা দুইকে জানিয়া, তিনকে চার দ্বারা বশ কর; পাঁচকে জয় করিয়া, ছয়কে জানিয়া, সাতকে ত্যাগ করিয়া সুখী হও।

সুতরাং রামায়ণ ও মহাভারত এদেশের চিরকালের সম্পদও উৎস। চরিত্র গঠনে, সামাজিক আদর্শ স্থাপনে এই দুই মহাকাব্যের প্রভাবজাতীয় জীবনে অনপনেয়। তাই রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন— “এইজন্যই শতাব্দীর পর শতাব্দী যাইতেছে, কিন্তু রামায়ণ-মহাভারতের স্রোত ভারতবর্ষে আর লেশমাত্র শুষ্ক হইতেছে না। প্রতিদিন গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে তাহা পঠিত হইতেছে; মুদির দোকান হইতে রাজার প্রাসাদ পর্যন্ত সর্বত্রই তাহার সমান সমাদর। ধন্য সেই কবিযুগলকে, কালের মহা-প্রান্তরের মধ্যে যাহাদের নাম হারাইয়া গেছে, কিন্তু যাহাদের বাণী বহন করিতেছে, শত শত প্রাচীন শতাব্দীর পলিমৃত্তিকা শক্তি ও শান্তি বহন করিতেছে, শত শত প্রাচীন শতাব্দীর পলিমৃত্তিকা অহরহ আনয়ন করিয়া ভারতবর্ষের চিত্তভূমিকে আজও উর্বরা করিয়া রাখিতেছে।” (রামায়ণ/প্রাচীন সাহিত্য)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!