নাট্যশালার ইতিহাসে জোড়াসাঁকো নাট্যশালার অবদান আলোচনা কর।
ঠাকুরবাড়ির জোড়াসাঁকো নাট্যশালা
১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুরবাড়িতে জোড়াসাঁকো নাট্যশালা প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বারকানাথ ঠাকুরের বাড়িতে তাঁর মধ্যম পুত্র গিরীন্দ্রনাথের অংশে (৫ নম্বর বাড়ি) এই নাট্যশালাটি তৈরি হয়। প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় ও গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর। গুণেন্দ্রনাথ ছিলেন গিরীন্দ্রনাথের ছোট ছেলে এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথের খুড়তুত ভাই। সারদাপ্রসাদ এঁদের নিকট আত্মীয়। গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বাবুবিলাস’ নামে একটি নাটক এর আগে লিখেছিলেন এবং সেটি ঠাকুরবাড়িতে অভিনীতও হয়েছিল। তার আগে পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ইংরেজদের চৌরঙ্গী ও সাঁ সুসি থিয়েটারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। এই বাড়ির মধ্যেই নাটকের আবহাওয়া গড়ে উঠেছিল। যদিও ধর্মমতে দেবেন্দ্রনাথের বাড়ি (৬ নং) ছিল ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত এবং গিরীন্দ্রনাথের বাড়ি (৫ নং) ছিল হিন্দু সমাজভুক্ত। কিন্তু মানসিকতায় এঁরা কেউ গোঁড়া ছিলেন না। তাই দুই বাড়ির ছেলেরা মিলেই যখন নাট্যশালা স্থাপন করে অভিনয় শুরু করেছিল, তখন নাটোর থেকে দেবেন্দ্রনাথ গণেন্দ্রনাথকে (গিরীন্দ্রনাথের বড় ছেলে, গুণেন্দ্রনাথের দাদা) একটি চিঠিতে লেখেন (১৬ জানুয়ারি, ১৮৬৭)
প্রাণাধিক গণেন্দ্রনাথ,
তোমাদের নাট্যশালার দ্বার উদ্ঘাটিত হইয়াছে—সমবেত বাদ্য দ্বারা অনেকের হৃদয় নৃত্য করিয়াছে—কবিত্বরসের আস্বাদনে অনেকে পরিতৃপ্তি লাভ করিয়াছে। নির্দোষ আমোদ আমাদের দেশের যে একটি অভাব, তাহা এই প্রকারে ক্রমে ক্রমে দূরীভূত হইবে। পূর্বে আমার সহৃদয় মধ্যম ভায়ার (গিরীন্দ্রনাথ) উপরে ইহার জন্য আমার অনুরোধ ছিল, তুমি তাহা সম্পন্ন করিলে। কিন্তু আমি স্নেহপূর্বক তোমাকে সাবধান করিতেছি যে, এ প্রকার আমোদ যেন দোষে পরিণত না হয়। সদ্ভাবের সহিত এ আমোদকে রক্ষা করিলে আমাদের দেশে সভ্যতার বৃদ্ধি হইবে তাহার সন্দেহ নাই।
ইতি—
শ্রীদেবেন্দ্রনাথ শর্মণঃ
এইভাবে ঠাকুরবাড়ির নাটকের ঐতিহ্য, উৎসাহ ও চেষ্টার মধ্যে দিয়ে জোড়াসাঁকো নাট্যশালা প্রতিষ্ঠিত হয়। নাট্যপ্রযোজনা, নাট্যনির্বাচন ইত্যাদির জন্যে ‘কমিটি অফ ফাইভ’ নামে পাঁচ জনের কমিটি তৈরি হয়। তাতে ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, গুণেন্দ্রনাথ, কৃষ্ণবিহারী সেন, অক্ষয় চৌধুরী ও যদুনাথ মুখখাপাধ্যায়। কৃষ্ণবিহারী সেন ছিলেন নাট্যশিক্ষক, তিনি এর আগে ‘বিধবাবিবাহ’ নাটকে পড়ুয়ার ভূমিকায় অভিনয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। এরা ছাড়া দুই বাড়ির প্রত্যেকেই কোনো না-কোনোভাবে যুক্ত থেকে এখানে অভিনয়ের ব্যাপারে সাহায্য করেন।
কলকাতায় তখন ধনী বাড়ির সখের নাট্যশালায় অভিনয়ের যে ধুম পড়েছিল, জোড়াসাঁকো নাট্যশালা তার থেকে একটু পৃথক ছিল। এখানে ইংরেজি থিয়েটারের আদলের সঙ্গে দেশীয় রীতির মিশ্রণে নাট্যোপস্থাপনার চেষ্টা করা হয়। দেশীয় যাত্রারীতির পরিশোধন করে, বিলিতি থিয়েটারের মধ্যে তাকে ফেলে অভিনয়ের চেষ্টা এখানে দেখা গেল।
ঠাকুরবাড়িতে এর আগে তিন দিন ধরে যাত্রানুষ্ঠান হয়েছিল। তার বিবরণ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি থেকে জানা যায়। সেখানে সাধারণ লোকের, বিশেষকরে নিম্নশ্রেণীর ভীড়ই ছিল বেশি। এদের নাট্যশালার অভিনয়ে ওই নিম্নরুচির যাত্রাকে উন্নত করে থিয়েটারের প্রেক্ষাপটে স্থাপন করাই বোধ হয় এদের উদ্দেশ্য ছিল। গোপাল উড়ের যাত্রা দেখেই যে তারা নাট্যশালা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন, তা জানা যায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের একটি চিঠি থেকে। ১৪ জুলাই, ১৮৬৭, গুণেন্দ্রনাথকে আমেদাবাদ থেকে চিঠিতে লেখেন—‘‘It was Gopal Ooria’s Jatra, that suggested us the idea of projecting a theatre. It was Gangooly (Saradaprasad), you and I that proposed it.’’
পাঁচ নম্বর ঠাকুরবাড়ির দোতলার হলঘরে মঞ্চ তৈরি করা হয়। সেখানে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে অভিনয় করা হয় মধুসূদনের ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক। এবং তার কিছুদিন পরেই অভিনীত হয় মধুসূদনের ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ প্রহসন। এই অভিনয়ের বিস্তারিত খবর পাওয়া না গেলেও, এটুকু জানা যায় যে, দুটির অভিনয়ই খুবই উচ্চাঙ্গের হয়েছিল। বাড়ির অনেকেই অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার মধ্যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রথম নাটকে কৃষ্ণকুমারীর মাতা এবং দ্বিতীয় প্রহসনে পুলিশ সার্জনের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
এরপর অভিনয়ের জন্য মনোমত নাটক না পেয়ে উদ্যোক্তারা অভিনয় উপযোগী এবং লোকশিক্ষার উপযুক্ত নাটক অনুসন্ধান করতে থাকেন। অবশেষে, বহুবিবাহ, হিন্দুমহিলার দুরবস্থা এবং পল্লীগ্রামস্থ জমিদারের অত্যাচার বিষয়ে নাটকের জন্য সংবাদপত্রে (ইন্ডিয়ান মিরর, ১৫ জুলাই, ১৮৬৫) বিজ্ঞাপন দেন। রামনারায়ণ নাটক লিখে দিতে রাজি হন এবং বহুবিবাহ বিষয়ে ‘নবনাটক’ রচনা করে দেন। নাটকটি মুদ্রিত হয়ে প্রকাশ পায় ১৮৬৬-এর মে মাসে। এই নাটকের জন্য নাট্যশালা কমিটি নাট্যকারকে একটি রৌপ্যপাত্রে দুশো টাকা পুরস্কার দেন। অনুষ্ঠানে সভাপতি ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র।
‘নবনাটক’ অভিনয়ের সময়ে বাড়ির ‘বড়’র দল যোগ দেয়। গণেন্দ্রনাথ (গুণেন্দ্রনাথের দাদা) প্রধান দায়িত্ব নেন। তখনকার শ্রেষ্ঠ পটুয়াদের দিয়ে দৃশ্যপট অঙ্কন করানো হয়, সামনের যবনিকা পর্দায় রাজস্থানের ভীমনিংহের সরোবর-তটস্থ ‘জগমন্দির’ প্রাসাদ অঙ্কিত হয়। প্রায় ছয় মাস ধরে মহড়া চলে অভিনয় ও গীতবাদ্যের।
নবনাটকের প্রথম অভিনয় হলো ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ৫ জানুয়ারি। অভিনয়ে ছিলেন—
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ—নটী, নীলকমল মুখোপাধ্যায়—নট, যদুনাথ মুখোপাধ্যায়—চিত্ততোষ, সারদাপ্রসাদ—গবেশবাবুর স্ত্রী, অক্ষয় মজুমদার—গবেশবাবু, মতিলাল চক্রবর্তী—কৌতুক, অমৃতলাল গঙ্গোপাধ্যায়—ছোট গিন্নী, বিনোদলাল গঙ্গোপাধ্যায়—সুবোধ। এরা সবাই ঠাকুরবাড়ির আত্মীয় পরিজন এবং নিকট বন্ধ।
এই অভিনয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মুক্তোর মালা, হীরের গয়না পরে নটীর বেশে সংস্কৃতে বসন্ত বর্ণনার গান গাইতেন। নটী যে মেয়ে নয়, তা বোঝাই যেত না। এই নাটকে তিনি আবার কনসার্টে হারমোনিয়াম বাজিয়েছিলেন।
‘নবনাটক’ এখানে নয় বার অভিনীত হয়। প্রত্যেক অভিনয়েই গণ্যমান্য ব্যক্তি ও সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত আত্মীয়বর্গ উপস্থিত থাকতেন। নবনাটকের স্টেজ ও দৃশ্যপট তৈরির পর মঞ্চব্যবস্থা করতে গিয়ে আঁকা দৃশ্যগুলির সামনে বাস্তবসম্মত উপচার হাজির করা হয়েছিল। একটি ‘বন-দৃশ্যে’ দৃশ্যপটের সামনে তরুলতা এবং তাতে জীবন্ত জোনাকি পোকা আঠা দিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। অনেকের মতো জ্যোতিরিন্দ্রনাথও জানিয়েছেন যে, অতি সুন্দর ও সুশোভন এই দৃশ্যকে দূর থেকে দেখলে সত্যিকারেব বনের মতই বোধ হত। সূর্যাস্ত ও সন্ধ্যার দৃশ্যগুলিও মনোহর হয়েছিল।
প্রথমবারের অভিনয়ে নাট্যকার রামনারায়ণ উপস্থিত ছিলেন এবং অভিনয় দর্শনে খুবই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। অভিনয়ে গবেশবাবু (অক্ষয় মজুমদার) এবং চিত্ততোষ (যদুনাথ মুখখাপাধ্যায়) সবাইকে মাতিয়ে দেন। কৌতুক ও রসময়ীর অভিনয়ও ভালো হয়েছিল। ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকা এই অভিনয়ের কিছু ত্রুটি উল্লেখ করলেও, এর সর্বাঙ্গীণ সাফল্যের জন্য নাট্যশালার উদ্যোক্তাদের সাধুবাদ দেন।
নবনাটকের অভিনয় এই উচ্চাঙ্গের হয়েছিল যে, পরবর্তীকালের অভিনেতা অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি পরে বলছিলেন যে, এই অভিনয় দেখেই তাঁর অভিনয় সম্বন্ধে কিছু দেখবার, শোনবার ও জানবার বাকি ছিল তা সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। [ব্যোমকেশ মুস্তাফি: বঙ্গীয় রঙ্গালয়] কথাটির মধ্যে অতিশয়োক্তি থাকতে পারে, কিন্তু পরবর্তী সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও একজন প্রথম শ্রেণীর অভিনেতা ও পরিচালকের এই মুগ্ধতা জোড়াসাঁকো নাট্যশালার উপস্থাপনার কৃতিত্বকেই উজ্জ্বল করে তোলে।
১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞাপনের উত্তরে আরেকটি নাটক রচনা করে বিপিনবিহার সেনগুপ্ত দুশো টাকা পুরস্কার পান। ‘হিন্দু মহিলা নাটক’টি অবশ্য এখানে অভিনীত হয়নি। কারণ তার আগে এই নাট্যশালার অভিনয় বন্ধ হয়ে যায়।
জোড়াসাঁকো নাট্যশালা প্রতিষ্ঠিত হয় এদেশে সখের থিয়েটারের জোয়ারের সময়। ধনী বাঙালির প্রাসাদ-মঞ্চের সঙ্গে এই নাট্যশালার পার্থক্য এই, এখানে বাড়ির সবাই যুক্ত হয়ে অভিনয় করতো এবং শুধুমাত্র আমোদ-প্রমোদ বা রাজবাড়ির জৌলুষ দেখানোই এখানে মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না। পাশ্চাত্য নাট্যরীতির সঙ্গে ভারতীয় নাট্যরীতি এবং বাংলার নিজস্ব দেশজ নাট্যরীতির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নাট্য-উপস্থাপনা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একটা নতুন নাট্যধারা সৃষ্টির প্রয়াস এখানে লক্ষ করা যায়।
এই সময়েই ঠাকুড়বাড়িতে হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠিত হয়ে জাতীয়তাবোধের উদ্বোধন ঘটে চলেছে। ন্যাশনাল ভাবের উদ্গাতা নবগোপাল মিত্র এই অভিনয়ের মধ্যে জাতীয়তাবোধের প্রকাশ লক্ষ করে উল্লসিত হয়েছিলেন—‘‘It had no borrowed airs, and was quite in keeping with national taste (The National Paper: January, 1867)’’ দৃশ্যসজ্জার সবকিছুর প্রশংসা করে ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকা (২-১-১৮৬৭) সবকিছুই যে এতদ্দেশীয় শিল্পজাত তার প্রশংসা করেছিল।
পরবর্তীকালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের নাট্য-প্রযোজনার মধ্যে এই জাতীয় প্রচেষ্টা লক্ষ করা গিয়েছিল। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘অলীকবাবু’ নাটক অভিনয়ের মাধ্যমে জোড়াসাঁকো নাট্যশালা পুনর্জীবিত হয়।
Leave a Reply