//
//

ট্রাজেডির সংজ্ঞা, স্বরূপ এবং একটি সার্থক ট্রাজেডি আলোচনা কর।

ট্র্যাজেডি

দৈব বা অদৃষ্টের অনিবার্যতায় পীড়িত, গভীর অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বহির্ঘদ্ধে পরাভূত অথচ নায়কোচিত আত্ম-প্রতিষ্ঠার ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে মহিমময় মানবজীবনের করুণরসাত্মক কাহিনিই সাধারণভাবে ট্র্যাজেডিরূপে পরিচিত। দেবতা কিংবা পুরাণকথিত বীরদের কীর্তিকলাপ, দুঃখ-যন্ত্রণা, সংঘাত বিনাশকে উপজীব্য করে প্রাচীন গ্রিস-এ উদ্ভব ও প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল এই বিষাদাত্মক নাট্যরূপের। এথেনীয় রঙ্গমঞ্চে গ্রিক ট্র্যাজেডির স্বর্ণযুগ অতিক্রান্ত হয়ে যাবার অনেক পরে, সাধারণভাবে কাব্যকলা ও বিশেষভাবে এই করুণরসাত্মক নাট্যরূপের এক সতর্ক, নীরক্ত অথচ রসজ্ঞ বিশ্লেষণ পাওয়া গেল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ অব্দে রচিত অ্যারিস্টটল-এর ‘দি পোয়েটিকস্’ গ্রন্থে। এক সংযত ও প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ সংজ্ঞায় তিনি ট্র্যাজেডির স্বরূপ ও লক্ষণসমূহ চিহ্নিত করলেন ওই গ্রন্থের ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে— ‘‘Tragedy is an imitation of an action that is serious, complete and of a certain magnitude, in language embellished with each kind of artistic ornament, the several kinds being found in separate parts of the play: in the form of action, not of narrative; through pity and fear effecting the proper purgation of these emotions.’’

ট্রাজেডির উপাদান

ট্র্যাজেডির সংজ্ঞা নির্ণয় করার পর পূর্বোক্ত গ্রন্থের ওই একই অনুচ্ছেদে অ্যারিস্টটল ট্র্যাজেডির উপকরণসমূহের একটি তালিকা উপস্থিত করেছিলেন যে উপকরণগুলি সবই তার প্রদত্ত সংজ্ঞারই স্বাভাবিক ফলশ্রুতি। করুণরসাত্মক নাটকের সমগ্র অবয়ব নির্মিত হয় যে ছটি প্রত্যঙ্গের সার্থক সন্নিবেশে সেগুলি তালিকাবদ্ধ করেছিলেন অ্যারিস্টটল এইভাবে— ‘আখ্যান বস্তু’ (Fable বা Plot) ‘চরিত্র’ (Character), ‘চিন্তন’ (Thought), ‘মঞ্চসজ্জা’ (Spectacle), ‘ভাষা’ (Diction) ও ‘সুর’ (Melody বা Song)। এদের মধ্যে ‘আখ্যানবস্তু’, ‘চরিত্র’, ও ‘চিন্তন’ উপকরণভুক্ত; ‘মঞ্চসজ্জা’ অনুকরণরীতি সংশ্লিষ্ট, ‘ভাষা’ ও ‘সুর’ উপাদান তথা মাধ্যমের অন্তর্ভুক্ত।

মোটের উপর, ট্র্যাজেডি করুণরসাত্মক ও বিয়োগান্তক নাটক, দুর্জ্ঞেয় দৈবশক্তির নিষ্ঠুর লীলায় অথবা অন্তর ও বাইরের যুগপৎ দ্বন্দ্বে অধঃপতিত মানবাত্মার বেদনা যে নাটকে মূর্ত হয়ে ওঠে। অবশ্য ট্র্যাজেডি যে শেষ হবে মৃত্যু ও বিনাশে এমন পরামর্শ বা নির্দেশ অ্যারিস্টটল দেননি। এমনকি ট্র্যাজেডি যে মিলনান্তক হওয়া অসম্ভব নয় এমন ইঙ্গিতই করেছিলেন তিনি। কিন্তু আধুনিক সমালোচকবৃন্দ সাধারণভাবে বিয়োগান্তক পরিণতির পক্ষেই রায় দিয়েছেন। পরিণতি বিয়োগান্তক হোক বা নাই হোক ট্রাজেডির সারাৎসার যন্ত্রণা বা Suffering যাকে অ্যারিস্টটল সংজ্ঞায়িত করেছিলেন—‘‘an action of a destructive or painful nature’’ রূপে। ট্র্যাজেডির প্লট সেই যন্ত্রণার ইতিবৃত্তটিকে ফুটিয়ে তোলে রঙ্গমঞ্চে দৃশ্যপারম্পর্যে; দর্শকহৃদয়ে উদ্রেক করে ভয় ও সহানুভূতি ; ভাবনামোক্ষণের মধ্য দিয়ে দর্শকমন অর্জন করে সুস্থিতি, অভিভূত হয় করুণরসের আনন্দে।

ট্র্যাজেডির বৈশিষ্ট্য

অ্যারিস্টটল-এর এই সুপরিচিত ও কালাতিক্রমী সংজ্ঞাটিকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেই আমরা ট্র্যাজেডির স্বরূপ, বৈশিষ্ট্য তথা উপাদানসমূহের রেখাচিত্রটি চিত্রিত করতে পারি—

  • ট্র্যাজেডি বা করুণরসাত্মক নাটক মানুষের ‘কর্মবৃত্তি’ (Action)-র অনুকরণ তথা নির্মাণ যাকে অ্যারিস্টটল বলেছিলেন mimesis।
  • ট্র্যাজেডির সংজ্ঞায় অ্যারিস্টটল কর্মবৃত্তি’র অনুকরণের কথা বলেছেন; ব্যক্তিজীবনের অনুকরণ নয়। আখ্যানবস্তু (Mythos) ও নাট্যক্রিয়া (Praxis)-এর মধ্যে প্রভেদ করেননি তিনি। নাট্যক্রিয়াই রূপায়িত আখ্যানবস্তু এবং তা রূপায়িত নাট্যচরিত্রের সঙ্গে সম্পর্কবদ্ধ। দি পোয়েটিক-এর ত্রয়োদশ অনুচ্ছেদেও অ্যারিস্টটল জীবন ও কর্মবৃত্তির অনুকরণরূপে ট্র্যাজেডিকে চিহ্নিত করেছেন।
  • ট্র্যাজেডি যে কর্মবৃত্তি-কে অনুকরণ করে তাকে অ্যারিস্টটল বলেছেন গুরুগম্ভীর বা Serious; আর এখানেই কমেডি বা হাস্যরসাত্মক নাটকের সঙ্গে করুণরসাত্মক নাটকের পার্থক্য। হামফ্রি হাউস ‘Serious’ শব্দটিকে ব্যাখ্যা করেছেন ‘Weighty’ বা ‘Important’ অর্থে। যে-কোনো অর্থই আমরা করি না কেন, হাস্য-পরিহাস চপলতাকে অ্যারিস্টটল ট্র্যাজেডির পক্ষে উপযুক্ত বলে মনে করেননি। শেক্সপীয়রসহ এলিজাবেথীয় যুগের নাট্যকারদের ট্র্যাজেডি নাটকে হাস্যরস বা Comic Relief-এর যেসব উদাহরণ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ও আকর্ষণীয়। তেমন মিশ্রণ ধ্রুপদী নাটকে চোখে পড়ে না।
  • ট্র্যাজেডির Action-কে হতে হবে স্বয়ংস্বপূর্ণ। আদি-মধ্য-অন্ত্য—এই তিনটি পর্বে। বিন্যস্ত হবে একটি সমগ্র ও নিটোল কাঠামো। অ্যারিস্টটল একটি সু-পরিকল্পিত ও পূর্ণাঙ্গ নাট্যগঠনের অপরিহার্যতা উল্লেখ করেছিলেন, অবশ্যম্ভাবিতা (Necessity) ও সম্ভাব্যতা (Probability)-র সূত্রে যা এক চূড়ান্ত ও অনিবার্য পরিণতিতে পৌঁছোয়। আর এইভাবেই কাব্যনির্মাণক্রিয়া পরিস্ফূট করে সামান্য সত্যকে।
  • নাটকে রূপায়িত ক্রিয়া বা কর্মবৃত্তির থাকবে একটি মাত্রা বা Magnitude। এর থাকবে একটি মাপ বা দৈর্ঘ্য যাতে করে নাট্যক্রিয়া সংহত ও যুক্তিপূর্ণ বিন্যাসের মধ্যে দিয়ে। সম্ভাব্য ও অবশ্যম্ভাবী উপসংহার (Catastrophe)-এ উপনীত হতে পারে।
  • ট্র্যাজেডির আলোচ্য সংজ্ঞায় অ্যারিস্টটল অলংকরণের উপাদানরূপে বহুবিধ Embellishments-এর উল্লেখ করেছেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছন্দ (Verse) ও সুর বা গীত (Song) ; কথোপকথন অংশে ছন্দ আর কোরাস-এর গানগুলিতে সুর সংযোজন করে থাকে আলংকারিক সৌন্দর্যের সুষমা।
  • ট্র্যাজেডির অনুকরণরীতি বর্ণনাত্মক নয়, ঘটনার গতি ও পরিণতি তথা চরিত্র ও ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্কবদ্ধতায় নাটকোচিত প্রক্রিয়ায় তাকে উপস্থাপিত করতে হয়। অনকরণরীতির এই পার্থক্যে মহাকাব্য বা এপিকের সঙ্গে ট্র্যাজেডির প্রভেদ।
  • আলোচ্য সংজ্ঞার শেষাংশে অ্যারিস্টটল ট্র্যাজেডির চুড়ান্ত উদ্দেশ্য বা কারণটি বিবৃত করেছেন। ‘করুণা’ (Pity) ও শঙ্কা’ (Fear) উদ্রেক এবং উক্তি অনুভব বা প্রক্ষোভের মোক্ষণের দ্বারা চিত্তশোধন তথা মানসিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা ট্র্যাজেডির উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য। এই প্রসঙ্গে ব্যবহৃত Catharsis শব্দটি ভাবমোক্ষণ (Purgation of Emotions), শুদ্ধিকরণ (Purification) ইত্যাদি বিভিন্ন অর্থে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মুখ্যত প্রয়োগবাদী ও জীববিজ্ঞানী। অ্যারিস্টটল চিকিৎসাশাস্ত্রের পরিধি থেকে আহৃত এই পরিভাষায় করুণা, শঙ্কা ও অনুরূপ অনুভবসমূহের উদ্দীপনা ও নিষ্কাশন দ্বারা চিত্তশোধনকেই বুঝিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। অবশ্য সমালোচক মহলে ‘Catharsis’-এর ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক ও মতান্তর আছে।

একটি সার্থক বাংলা ট্র্যাজেডি

টাজেডির সংজ্ঞা এবং বিভিন্ন লক্ষণ সম্পর্কে যা আলোচনা আমরা এতক্ষণ করলাম তার আলোকে একটি বাংলা ট্র্যাজেডির শিল্পসার্থকতা বিচার করা যেতে পারে। বাংলা নাট্যসাহিত্যের স্বীকৃত প্রতিভা গিরিশচন্দ্র ঘোষ এবং ‘জনা’ তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকীর্তি। সুতরাং বিচারের জন্য এই নাটকটিই আমরা গ্রহণ করবো।

‘জনা’ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র রাজা নীলধ্বজের পত্নী জনা এবং তার ট্র্যাজেডিই যখন নাট্যকারের ঈপ্সিত তখন এটিকে ইংরেজি ট্র্যাজেডির আদর্শে She-tragedy ধরনের নাটক ভাবাই ভালো। মহাভারতের বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুন অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছেন এবং দিগ্বিজয় করার উদ্দেশ্যে সেই অশ্ব নিয়ে বিভিন্ন রাজ্যপরিক্রমায় বার হয়েছেন অর্জুন ও কৃষ্ণ। তাঁরা নীলধ্বজের রাজ্যে উপস্থিত হয়েছেন, এই খবর জানিয়ে অগ্নিদেব রাজাকে অনুরোধ করেন। আকৃষ্ণকে পুজোপচারে বরণ করে নেবার জন্য। রাজ্যের সকলেই এই প্রস্তাবে একমত, শুধু জনা এ কথা মানতে পারেন না। তিনি বলেন, শ্রীকৃষ্ণ যদি পূজা পাবার জন্যই তাদের কাছে মাহিষ্মতী পুরীতে আসতেন, তাহলে তাকে বরণ করে নিতে তার কিছুমাত্র আপত্তি ছিল না, কারণ তিনি নিজেও কম হরিভক্ত নন। কিন্তু তিনি বলেন, হরিভক্তি নহে রাজা হীনতা বাকার। শ্রীকৃষ্ণ এখন ঈশ্বর হিসাবে এখানে আসছেন না, ‘অরিরূপে নারায়ণ আসিয়াছে ঘরে’ সুতরাং তাকে যদি যুদ্ধক্ষেত্রেই আহ্বান না জানানো হয় তবে ক্ষাত্র ধর্মের অসম্মান ঘটে। জয়-পরাজয় মানুষের হাতে নয়, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের এই রণের আহ্বান উপেক্ষা করা কোনও ক্ষত্রিয় বীরেরই উচিত নয়।

জনার এ কথা সকলে অগ্রাহ্য করে, করতে পারে না মাতৃভক্ত ও তার বীরপুত্র প্রবীর। প্রবীর অর্জুনের অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব আটকায় এবং অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে সে এ ভীত নয়, কারণ মাতভক্তি তার অপরিসীম–“মাতৃনাম কবচ আমার’’ এবং সে জানে মায়ের আশীর্বাদ যদি থাকে—‘‘ধরি তোর পদধুলি শঙ্কুরে না ডরি।’’ সকলে প্রবীরকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে, যজ্ঞের অশ্ব ফিরিয়ে দেবার পরামর্শ দেয়, কিন্তু জনার কথা—‘‘রণে যেতে পুত্রে আমি কভু না বারিব। শেষ পর্যন্ত প্রবীরের সঙ্গে অর্জুনের যুদ্ধ হয় এবং এই যুদ্ধের প্ররোচনাও কৃষ্ণেরই পরিকল্পনা, কারণ—

মহাবীর প্রবীর না পতন হইলে।

পাণ্ডবের সমকক্ষ বীর রবে ভবে।

কাজেই প্রবীরের সঙ্গে অর্জুনের যুদ্ধ হয়, অন্যায় ভাবে ছলনাময় কৃষ্ণ তার সমস্ত শক্তি হরণ করে নেন, অর্জুনের হাতে সে নিহত হয় এবং জনার রোষবহ্নি থেকে কেমন করে অর্জুন নিজেকে বাঁচাবে, সে উপায়ও কৃষ্ণ বলে দেন অর্জুনকে। অসহায় জনা শেষ অবলম্বন হিসাবে অনুরোধ জানান ভাইকে কৃষ্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবার জন্য। ভাই অসম্মত হওয়ায় শেষপর্যন্ত জাহ্নবীর জলে জীবন বিসর্জন করা ছাড়া কোনো উপায় তার থাকে না। ক্রোড় অঙ্কে অবশ্য দেখা যায় জনার যাবতীয় ক্লেশের অবসান ঘটেছে—তিনি প্রসন্ন মুখে মাতা জাহ্নবীর কোলে বসে আছেন।

অ্যারিস্টটলের ট্র্যাজেডির সংজ্ঞা হিসাবে বিচার করলে আমরা বলতে পারি—

  • ঘটনাটি যে গুরুগম্ভীর এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অন্য সকলে যখন ভক্তির আবেগে প্রবাহিত তখন যুক্তির বলিষ্ঠতায় জনা নিজের চিন্তাশক্তি অটল রাখতে পেরেছেন। ক্ষাত্র ধর্মের সঙ্গে ভক্তি ধর্মের এই সংঘাত যথার্থ ট্র্যাজেডির উপযুক্ত বিষয়, এ সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই।
  • নাটক হিসাবে এটি স্বল্পায়তন নয়।
  • একটি পূর্ণাঙ্গ ট্র্যাজেডি গঠিত হবার মতো আয়তন এই নাটকের আছে। এর সুস্পষ্ট আরম্ভ আছে, দ্বন্দ্বময়তায় কাহিনীর স্পষ্ট নাট্যদেহ আছে এবং একটি সুনির্দিষ্ট উপসংহারও আছে।
  • জনা নাটকের গঠনশৈলী বা ভাষার আলোচনা পৃথকভাবে করা অর্থহীন। মোটামুটিভাবে বলা যায় গিরিশচন্দ্র তার নাট্যভাষা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং চরিত্র অনুযায়ী ভাষা ব্যবহারে সমর্থ ছিলেন। শুধু গৈরিশ ছন্দের আবিষ্কারক হিসাবে নয়, চরিত্রের মানসিকতা এবং বক্তব্যের প্রকৃতি অনুযায়ী ভাষা-পরিবর্তনে তিনি দক্ষ ছিলেন। সেই জন্যই প্রবীরের মুখে যখন দিয়েছেন উচ্ছ্বসিত সংলাপ, বিদূষকের মুখে তখন রেখেছেন দ্ব্যর্থবোধক সরস সংলাপ। সাধারণভাবে গদ্যসংলাপে ঘটনা এগিয়ে চলে, অথচ যখনই তা ভাবগম্ভীর বা আবেগবিহ্বল হয়ে পড়ে তখনই ভাষা পরিবর্তিত হয়ে যায় পদ্যমাধ্যমে। প্রকৃতি অনুযায়ী এই ভাষারীতির পরিবর্তন সর্বত্রই যে স্বাদু হয়েছে তা নয়, কোথাও তা রসাভাসও ঘটিয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসাবে উল্লেখ করা যায় জনার মস্তিষ্কবিকৃতির সময় এই সুসংবদ্ধ সংলাপ—

যথা নিবিড় আঁধারে

ঘোর রোলে পরমাণু ঘূর্ণ্যমান।

যথা জড় জড়িমায় প্রকৃতি জড়িত

ঘোর ঘুম মাঝে

চলে প্রলয় জীমূতশ্রেণী

বজ্র-অগ্নিধারা ঝরে।

তবে এগুলিকে ব্যতিক্রম হিসাবে মেনে নেওয়াই ভালো।

  • ট্র্যাজেডি সার্থক করে তুলতে হলে যে বর্ণনামূলক রীতি বর্জন করে নাটকীয় রীতি, অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ঘটনা সংঘটনমূলক রীতির দিকে নজর রাখতে হয়, ‘জনা’ নাটকে সর্বত্র তা নাট্যকারের ছিল। এই নাটকে প্রবীরের সঙ্গে অর্জুনের যুদ্ধ, মোহিনী মায়ায় প্রবীরের বর্ম ও তীর ধনুক অপহরণ, প্রবীরের মৃত্যু, পুত্রশোকে উন্মাদিনী জনাকে সামলানোর প্রচেষ্টা, প্রাণ বিসর্জন ইত্যাদি ঘটনাই নাট্যকার প্রত্যক্ষভাবে দেখিয়েছেন, অন্য চরিত্রের মুখে বর্ণনা করেননি।
  • যে নাটকীয় ঘটনাগুলি দেখানো হয়েছে তা আমাদের মনে করুণা ও সহানুভূতির সঞ্চার করে কিনা—এ প্রশ্নটি ট্র্যাজেডি-বিচারের পক্ষে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর এরই যথার্থ ট্র্যাজিক সংবেদন নির্ভর করে। জনার মানসিকতার যে দ্বন্দ্ব অনাবৃতভাবে এই নাটকে তুলে ধরা হয়েছে তাতে তার প্রতি করুণা ও সহানুভূতি আমাদের মনে নিশ্চয়ই জাগবে। সকলেই যখন কৃষ্ণের প্রতি ভক্তিতে আপ্লুত তখন জনা যে যুক্তিতে কৃষ্ণকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে পেতে চান বা পুত্রের রণস্পৃহা সমর্থন করেন তা আমাদের কাছে যুক্তিগ্রাহ্য বলেই মনে হয়। নিজের যুক্তিতে অটল থেকে বহুর বিরুদ্ধে একা তিনি যেভাবে সংগ্রাম করেন তাতে spectacle of doing something terrible যেমন ফুটে ওঠে, তেমনি প্রবীরের মৃত্যুতে এবং ভাইয়ের প্রত্যাখানে ফুটে ওঠে তার suffering of something terrible; তাই চরিত্রটির ট্র্যাজিক উপাদান এবং সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে তার ব্যবহারের প্রতি কোও সন্দেহই আমাদের থাকতে পারে না। গঙ্গার জলে তার অসহায় আত্মহত্যা ট্র্যাজেডির উদ্দিষ্ট pity এবং fear দুইই জাগিয়ে তোলে আমাদের মনে। শুধু অসুবিধা এই যে, নাটকটি যেখানে শেষ হলে আমরা তাকে নির্দ্বিধায় একটি মহৎ ট্র্যাজেডি হিসাবে স্বীকার করে নিতে পারতাম, গিরিশচন্দ্র সেখানে নাটকটি সমাপ্ত করেননি। তিনি পৌরাণিক নাটক হিসাবে জনা’-র প্রতি সুবিচার করতে গিয়ে এর পরেও একটি ক্রোড়-অঙ্ক সংযুক্ত করেছেন এবং তাতেই ট্র্যাজিক সংবেদন দ্রুত পরিবর্তিত হয়েছে। জনার সুবিশাল প্রতিরোধ, অপরিমেয় যন্ত্রণা এবং ট্র্যাজিক সমুন্নতি একেবারে হাস্যকর হয়ে যায় যদি এ সমস্ত মর্ত্যলীলাই ‘প্রপঞ্চ’ হয়ে দাঁড়ায়। কৃষ্ণ এই বলে সান্ত্বনা দিতে পারেন যে জনা ‘এখন নহে আর পুত্রশোকে উন্মাদিনী’ কিন্তু পুত্রশোকের যে বেদনা আমাদের মনে ট্র্যাজিক অনুভূতির গভীর দাগ রেখে যায়, তা কিন্তু তাতে সান্ত্বনা লাভ করে না। ফলে ক্রোড়অঙ্ক পুরাণ ও ধর্মপ্রিয় পাঠকের চিত্তে ভক্তিরস সঞ্চার করতে পারে কিন্তু যথার্থ ট্রাজিক সংবেদনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
  • ‘ক্যাথারসিস’ বলতে অ্যারিস্টটল সঠিকভাবে কী বুঝিয়েছিলেন তা নিয়ে যদিও জল্পনা কল্পনা এখনও শেষ হয়নি, এবং ক্রোড় অঙ্কে গঙ্গার কোলে জনাকে আদর খেতে দেখে আমাদের মনে যদিও আনন্দই হয়—তবু এ আনন্দ যে ক্যাথারসিস বা বিমোক্ষণজনিত আনন্দ। নয়, তা একেবারে নিশ্চিত করে বলা যায়। এই জন্যই বলা যায় যে, দুটির প্রকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ট্র্যাজিক সংবেদনও যেমন মানবিক, তার আনন্দও তেমনি মানবিক। জনাকে দেখে আমরা যে অভিভূত হই, তার আচরণ ও পরিণতি যে আমাদের মনে ট্রাজিক সংবেদন জাগায়, তার কারণ একেবারে মানবিক। পক্ষান্তরে জনাকে জাহ্নবীর কোলে আদর খেতে দেখে যে আনন্দ আমাদের মনে জাগে তা আধ্যাত্মিক-সুতরাং ট্র্যাজেডি বা তার অন্তরঙ্গ লক্ষণ ক্যাথারসিসের সঙ্গে তার কোও সম্পর্ক থাকতে পারে না। তাই উপযুক্ত ক্যাথারিদিস ঘটার পেছনেও সবচেয়ে বড় বাধা ওই ক্রোড় অঙ্ক, একথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে।

তথ্যসূত্র:

কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্তDownload
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাসDownload
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরীDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাসDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যালDownload
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাসDownload
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
সাহিত্যের রূপরীতি ও অন্যান্য – কুন্তল চট্টোপাধ্যায়Download
সাহিত্য ও সমালোচনার রূপরীতি – উজ্জ্বলকুমার মজুমদারDownload
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তDownload
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দীDownload
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যালDownload
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেনDownload
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায়Download
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষDownload

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!