বাংলা থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান আলোচনা কর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বাংলা থিয়েটার
রবীন্দ্রনাথের জন্মের (১৮৬১) এগারো বছরের মধ্যেই জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির অনতিদূরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ন্যাশনাল থিয়েটার (১৮৭২)। বছর ঘুরতেই ন্যাশনাল থিয়েটার ভেঙে গেছে, তৈরি হয়েছে নিজস্ব বাড়ি নিয়ে বেঙ্গল থিয়েটর (১৮৭৩) এবং গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার (১৮৭৩)। ব্যবসায়িক ও পেশাদারি সাধারণ রঙ্গালয় মালিকানা ভিত্তিক ও মুনাফাভিত্তিক উদ্দেশ্য ও আদর্শ নিয়ে চলতে শুরু করেছে।
সাধারণ রঙ্গালয়ে রবীন্দ্রনাথের নতুনদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা নাটকগুলি অভিনীত হয়ে সাফল্য লাভ করেছে। ঠাকুর বাড়ির মেয়ে পুরুষ সবাই একযোগে পুরো থিয়েটার ভাড়া নিয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘অশ্রুমতী’ অভিনয় দেয়েছে। সাধারণ রঙ্গালয়ে নতুনদার নাটক অভিনীত ও প্রশংসিত হওয়াতে রবীন্দ্রনাথ উৎসাহিত হয়েছিলেন। তবে প্রথম যুগে রবীন্দ্রনাথের নাটক বা কাব্যনাট্য-গীতিনাট্যগুলি লেখা হয়েছিল তাদের পরিবারের নিজস্ব প্রযােজনার জন্যই।
প্রতাপচাঁদ জহুরির মালিকানায় ন্যাশনাল থিয়েটারে ম্যানেজার কেদার চৌধুরী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পূর্ব অভিনীত ‘স্বপ্নময়ী’ নাটকের অভিনয় করালেন (সেপ্টেম্বর, ১৮৮৩)। তখনো রবীন্দ্রনাথের কোনো নাটক লিখিত বা প্রকাশিত হয়নি। সদ্য বেরিয়েছে উপন্যাস ‘বউ ঠাকুরানীর হাট’ (১৮৮৩)। এর আগে নানা উপন্যাসের প্রচুর নাট্যরূপ বাংলা থিয়েটারে অভিনীত ও অভিনন্দিত হয়েছে। কেদার চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের নতুন উপন্যাসটির নাট্যরূপ দিয়ে নাম রাখলেন ‘রাজা বসন্ত রায়’। অভিনীত হল প্রতাপচাঁদ জহুরির ন্যাশনাল থিয়েটারে, ৩ জুলাই, ১৮৮৬। রবীন্দ্রনাথের তখন বয়স ২৫ বৎসর। ততদিনে প্রতাপাদ মালিকানা ছেড়ে দিয়েছেন, ন্যাশনালের ‘লেসী’ হয়েছেন ভুবনমোহন নিয়োগী। রবীন্দ্রনাথও তখন রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেননি।
সাধারণ রঙ্গালয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রবেশ ঘটলো তাঁর নাটক নিয়ে নয়, সদ্য প্রকাশিত উপন্যাসের নাট্যরূপ নিয়ে। ‘রাজা বসন্ত রায়’ নাটকে অভিনয় করলেন সেযুগের খ্যাতনামা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। অর্ধেন্দুশেখর—মাই ভাঁড়। রাধামাধব কর—বসন্ত রায়। মতিলাল সুর—প্রতাপাদিত্য। মহেন্দ্রলাল বসু—উদয়াদিত্য। পূর্ণচন্দ্র ঘোষ—অনঙ্গমোহন। নীলমাধব চক্রবর্তী—রামচন্দ্র। হরিমতি—বিভা। ছোটরানী—সুরমা। ভবতারিণী—রানী। লক্ষ্মী—মঙ্গলা।
সেকালের পত্রপত্রিকায় অভিনয়ের সুখ্যাতি করা হয়েছিল। নাটকটিরও প্রশংসা করা হয়েছিল। রাধামাধব করের (বসন্ত রায় চরিত্র) অভিনয় ও গান খুবই প্রশংসিত হয়। হরিমতির বিভা চরিত্রে প্রাণবন্ত অভিনয়ের জন্য তার নামই হয়ে যায় ‘বিভাহরি’। রাধামাধবের কণ্ঠে ‘আজ তোমারে দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে’ প্রথম জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত।
নাট্যরূপটি এতই জনপ্রিয় হয় যে, উপন্যাসটির দ্বিতীয় সংস্করণে (১৮৮৭) রবীন্দ্রনাথ প্রচ্ছদ পৃষ্ঠায় লিখলেন বউঠাকুরানীর হাট (‘রাজা বসন্ত রায়’)। নাট্যরূপের অভিনয়ের সাফল্যকে রবীন্দ্রনাথ কতোখানি মূল্য দিয়েছিলেন, এতেই তা বোঝা যায়। ‘রাজা বসন্ত রায়’ অভিনয়ের সঙ্গে অর্ধেন্দুশেখরের নাম জড়িয়ে আছে। বোঝা যায়, তারই উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথ সাধারণ রঙ্গালয়ে গৃহীত হচ্ছেন। অর্ধেন্দুশেখর যখন যে রঙ্গালয়ে যুক্ত থেকেছেন, সেখানেই তিনি ‘রাজা বসন্ত রায়’ বা রবীন্দ্রনাথের অন্য নাটক বা নাট্যরূপের অভিনয়ের ব্যবস্থা করেছেন। এইভাবে রাজা বসন্ত রায় এমারেল্ডে হয়েছিল (১৮৮৭১৮৯৫), সেখানে অর্ধেন্দু প্রতাপাদিত্যর ভূমিকায় অভিনয় করতেন। মিনার্ভাতে হয়েছিল (১৯০১)। অর্ধেন্দু রমাই ভাঁড়।
রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা ও রানী’ নাটক তখন সবে বেরিয়েছে। এমারেল্ড থিয়েটার এই নাটকের অভিনয় করলো। প্রথম অভিনয় হলো, ৩০ নভেম্বর, ১৮৮৯। পরপর কয়েক রাত্রি অভিনয়ের পর আবার ৭ জুন থেকে দ্বিতীয় দফায় অভিনয় শুরু হয়।
এমারেল্ডের তখন খুবই দুরবস্থা। কেদার চৌধুরী নেই, থিয়েটারের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা, সংবাদপত্রে বিরূপ মন্তব্য। তবুও সেখানে রবীন্দ্রনাথের অনুমতি নিয়েই ‘রাজা ও রানী’র অভিনয় হলো। কুমার সেনের ভূমিকায় অভিনয় করে মহেন্দ্রনাথ বসু ‘ট্রাজেডিয়ান অফ বেঙ্গল’ নামে খ্যাতিলাভ করলেন। ‘বিষাদ’ নামে পরিচিত কুসুম অভিনয় করেছিল ইলা চরিত্র। মতিলাল বসুর ‘বিক্রম’ এবং গুলফনহরি ‘সুমিত্রা’। এই অভিনয়ের সাফল্যের কথা বলে অহীন্দ্র চৌধুরী (নিজেরে হারায়ে খুঁজি) বিশেষ করে মহেন্দ্রলাল বসুর অভিনয়ের উচ্চ প্রশংসা করেছেন। তাঁর সংলাপ উচ্চারণ আজো যেন অনুরণন তোলে।
শেক্সপীয়রীয়ান আদর্শে লেখা ঘটনা বহুল এই নাটক সাধারণ রঙ্গালয়ে খুবই আদৃত হয়েছিল। বিশেষ করে নাটকীয় অংশগুলি সবার ভালো লেগেছিল। আবার নৃত্যগীতের অংশগুলিও সবার মন জয় করেছিল। পাঁচ অঙ্কের বিস্তৃত ঘটনা প্রাধান্য ও নাটকীয় চরিত্র বিক্ষেপ, গীতিরস, সংলাপের আবেগ বাহুল্য সেযুগের সাধারণ রঙ্গালয়ের অভিনীত নাটকেরই উপযোগী হয়েছিল। স্বভাবতই জনসম্বর্ধনাও লাভ করেছিল।
বেঙ্গল থিয়েটার ‘রাজা ও রানী’র অভিনয় করেছিল ১৮৯৩-এর ১৮ জানুয়ারি। তবে এই নাটকের অভিনয় সবচেয়ে জমেছিল অমরেন্দ্রনাথ দত্তের ক্লাসিক থিয়েটারে। প্রথম অভিনয়, ২৪ জুলাই, ১৮৯৭। দশটির ওপর অভিনয় এখানে হয়েছিল। সেখানে অমর দত্ত (বিক্রম), মহেন্দ্রলাল বসু (কুমার সেন), কুসুমকুমারী (সুমিত্রা), হরিভূষণ ভট্টাচার্য (দেবদত্ত) খুবই উচ্চমানের অভিনয় করেছিলেন। নাচে গানে, অভিনয়ে সে সময়ে ‘রাজা ও রানী’ খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ রাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়কে সঙ্গে নিয়ে ক্লাসিকে এই নাটকের অভিনয় দেখতে এসেছিলেন (১১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৭)।
পরে ‘রাজা ও রানী’ অভিনীত হয়েছিল কোহিনূরে (২৩.১০.১৯১০), স্টারে (১৮.৫.১৯১২)। থেসপিয়ান টেম্পলে (৮.১.১৯১৬), মনোমোহন থিয়েটারে (২০.১১.১৯১৯), আর্ট থিয়েটারে (২৯.৮.২৩)।
‘রাজা বসন্ত রায়’ ও ‘রাজা ও রানী’র মতো সেই যুগে কম নাটকের ভাগ্যেই এত জনপ্রিয়তা জুটে ছিল। ১৮৯০-তে ২৬টি (‘রাজা ও রানী’-২০ + ‘রাজা বসন্ত রায়’-৬), ১৮৯১-তে ২১টি (১১+১০), ১৮৯২-তে ৭টি (৫+২), ১৮৯৫-তে ১৭ বার (৭+১০), এবং ১৮৯৭ থেকে ১৯০০-এর মধ্যে ১০টি অভিনয় (‘রাজা ও রানী’) সে যুগের হিসেবে নিঃসন্দেহে জনপ্রিয়তার প্রমাণ।
এমারেল্ড থিয়েটার রবীন্দ্রনাথের ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’ কৌতুক নাটককে ‘দুকড়ি দত্ত’ এই পরিবর্তিত নামে অভিনয় করে ৬ এপ্রিল, ১৮৯৫-তে, আড়াই মাসের মধ্যেই ৫ রাত্রি অভিনয় হয়। তৎকালে রঙ্গালয়ে যে ধরনের সামাজিক নক্সা, প্রহসন অভিনয় হত ‘দুকড়ি দত্ত’ তার থেকে অনেক ভিন্ন। এতে ব্যক্তিগত আক্রমণ নেই। নেই তীব্র ব্যঙ্গ কিংবা অশ্লীলতা; নির্মল মজার এই নাটিকা এমারেল্ড নতুন স্বাদ এনে দিয়েছিল।
১৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সাধারণ রঙ্গালয়ে অভিনীত হয়েছে এই তিনটি মাত্র নাটক তার একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক, একটি ছোট প্রহসন এবং আরেকটি উপন্যাসের নাট্যরূপ। এই সময়ের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ (রাজর্ষি উপন্যাসের কিছু অংশের রবীন্দ্রনাথ কৃত নাট্যরূপ), ‘মালিনী’ ছাড়া আর কোনো নাটক ছিল না। যা ছিল তা ‘গোড়ায় গলদ’ বা ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’র মতো ছোট প্রহসনধর্মী নাটক এবং কিছু ব্যঙ্গকৌতুক জাতীয় ছোট নাটিকা। বাদবাকি কিছু গীতিনাট্য এবং নাট্যকাব্য। আর কোনো উপন্যাসও প্রকাশিত হয়নি। ‘বিসর্জন’ নাটকে ধর্মীয় সংস্কার ও মানবতার যে দ্বন্দ্ব দেখানো হয়েছে এবং ধর্মের মোহমুক্তি ঘটানো হয়েছে, ১৯ শতকের শেষাংশে বাংলা রঙ্গালয়ে অভিনীত পৌরাণিক নাটকের ধর্মভাব ও হিন্দু ভক্তিবাদের সঙ্গে তার সংঘর্ষ অনিবার্য ছিল। সে যুগে কোনো রঙ্গমঞ্চ তাই ‘বিসর্জন’ অভিনয়ের সাহস দেখায়নি। মালিনীর ধর্মীয় বাতাবরণ, মানবত্ব এবং ট্রাজেডির ঋজু ও সংহত সমাপ্তি সে যুগের রঙ্গালয়ে দর্শকের মানস উপযোগী ছিল। এগুলির অভিনয়ও তাই হয়নি।
‘চোখের বালি’ (১৯০৩) উপন্যাস প্রকাশিত হয়ে এক বছরের মধ্যেই দ্বিতীয় সংস্করণ হয়ে গেল। উপন্যাসটির জনপ্রিয়তা দেখে অমরেন্দ্রনাথ তাঁর ক্লাসিক থিয়েটারে এর নাট্যরূপ অভিনয়ের ব্যবস্থা করলেন। নাট্যরূপ দিলেন অমরেন্দ্রনাথ নিজেই। অনেকের ধারণা নাট্যরূপ দিয়েছিলেন গিরিশচন্দ্র, কিন্তু ‘বেঙ্গলী’ পত্রিকার বিজ্ঞাপন (২৬/১১/১৯০৪) অমরেন্দ্রনাথকেই সমর্থন করে—’Choker Bali / Carefully dramatised by Amarendranath Dutt.
রবীন্দ্রনাথকে দেখিয়ে তাঁর অনুমতি নেওয়া হলো। ২৬ নভেম্বর, শনিবার, ১৯০৪ ক্লাসিকে প্রথম অভিনীত হলো। অভিনয় করলেন: অমরেন্দ্রনাথ—মহেন্দ্র। মনোমোহন গোস্বামী—বেহারী। কুসুমকুমারী—বিনোদিনী। হরিসুন্দরী (ব্লাকি)—আশা। জগত্তারিণী—অন্নপূর্ণা। পান্নারানী—রাজলক্ষ্মী।
রবীন্দ্রনাথ ঐদিন অভিনয় দেখতে উপস্থিত ছিলেন। ক্লাসিকে গিরিশের সঙ্গে অমরেন্দ্রনাথের মাইনেপত্র নিয়ে মতান্তর চলছিল। তার ওপর ক্লাসিকে রবীন্দ্রনাথের এই ধরনের ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ উপন্যাসের নাট্যরূপের অভিনয় গিরিশ পছন্দ করেননি। গিরিশ তাঁর অনুগতদের নিয়ে ক্লাসিক ছেড়ে চলে যান। এই সময়ে আর্থিক দিক দিয়ে অমরেন্দ্রনাথের অবস্থা খুবই খারাপ, একসঙ্গে মিনার্ভা ও ক্লাসিক দুটি থিয়েটার চালাতে গিয়ে এবং অন্য থিয়েটারের সঙ্গে উপহার দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে ও ‘রঙ্গালয়’ পত্রিকার আর্থিক ঝামেলা সামলাতে গিয়ে প্রায় সর্বস্বান্ত-আর্থিক, মানসিক এবং ‘ক্লাসিক’ সবদিক দিয়ে। এই অবস্থায় অনেক আশায় রবীন্দ্রনাথের সদ্য প্রকাশিত এবং জনপ্রিয় উপন্যাস চোখের বালির নাট্যরূপ ক্লাসিকে অভিনয় করা হলো। প্রথম দিকে নাটকটি জমলো না। এর পাঁচ মাসের মাথায় অমরেন্দ্রনাথ ক্লাসিক থিয়েটার ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন। ‘চোখের বালি’র অভিনয়ের ধারাবাহিকতা এই কারণেই নষ্ট হয়ে গেল। পরবর্তী কোনো সাধারণ রঙ্গালয়ে আর ‘চোখের বালি’র অভিনয়ের খবর পাওয়া যায়নি। ১৯ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের গোড়ায় যে ধরনের সামাজিক নাটক সাধারণ রঙ্গালয়ে অভিনীত হতো, ‘চোখের বালি’ তার থেকে স্বতন্ত্র। মানুষের অন্তৰ্জীবনের গহনলোকের উদ্ঘাটনের মাধ্যমে নরনারীর হৃদয়ের উন্মোচন যে উদার দৃষ্টিতে দেখানো হয়েছে সে বিষয় ও ভাবনা গ্রহণ করবার মতো মানসিক প্রস্তুতি তখনকার দর্শকদের ছিল না।
নতুন অবতার কৌতুক নক্সার নাট্যরূপ ‘ভগীরথ’ (ক্ষীরোদপ্রসাদ কৃত) মিনার্ভা অভিনয় করলো, ১৯০৯ এর ২৫ ডিসেম্বর। এক মাসের মধ্যে চার বার অভিনীত হয়।
আগের লেখা ‘গোড়ায় গলদ’ প্রহসনটি অনেকদিন বাদে অভিনয় করল কোহিনূর থিয়েটার, ৯ জানুয়ারি, ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে। কোহিনূর তখন চলছে এমারেল্ড থিয়েটারের মঞ্চে। এখানে ‘রাজা ও রানী’র নির্বাচিত অংশের অভিনয়ও করা হয়েছিল (২৩-৩১৯১০)।
রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তির উপায়’ গল্প অবলম্বনে ‘দশচক্র’ নাটক অভিনীত হলো স্টার থিয়েটারে। নাট্যরূপ দিলেন কবির স্নেহধন্য সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়। অমরেন্দ্রনাথ তখন ক্লাসিক ছেড়ে স্টারে এ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজার। তাঁরই উৎসাহে দশচক্র অভিনীত হলো স্টারে, ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ফেব্রুয়ারি। অভিনয়ে ছিলেন: অমরেন্দ্রনাথ—ফকিরচাঁদ। হীরালাল দত্ত—মাখনলাল দত্ত। কার্তিকচন্দ্র দে—ষষ্ঠীচরণ। সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ—চাকর। নরীসুন্দরী—হৈমবতী। কুসুমকুমারী—মুরলা। বসন্তকুমারী—পুবালা। হরিসুন্দরী (ব্লাকি)—কামিনী।
অমরেন্দ্রনাথের আগ্রহেই স্টার থিয়েটারে অনেকদিন বাদে ‘রাজা ও রানী’র অভিনয়ের আয়োজন করা হলো, ১৮ মে, ১৯১২। তখন অমরেন্দ্রনাথ নিজেই স্টার লীজ নিয়ে থিয়েটারের কর্ণধার হয়েছেন। মালিক হয়েই তিনি তার পূর্বের সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত ‘রাজা ও রানী’ স্টারে নামালেন।
বিক্রমদেব সাজলেন আগের মতো তিনিই। কুমারসেন হলেন ক্ষেত্রমোহন মিত্র। দেবদত্তকুঞ্জলাল চক্রবর্তী। অক্ষয় চক্রবর্তী অভিনয় করলেন ত্রিবেদীর ভূমিকায়। রানী সুমিত্রার চরিত্রে দারুণ অভিনয় করলেন সুশীলাবালা। সুশীলাবালার গান সে সময়কার দর্শকদের খুবই খুশি করেছিল। অমরেন্দ্রনাথের বিক্রমদেব সুধী দর্শকের প্রশংসা পেয়েছিল। কোনো কোনো রাত্রে অমরেন্দ্রনাথ বিক্রমদেব ও কুমারসেনদুটি ভূমিকাতেই অভিনয় করেছিলেন (৬ জুন, ১৯১২)। ‘রাজা ও রানী’ বেশ কয়েক রাত্রি স্টারে অভিনীত হয়েছিল।
অমরেন্দ্রনাথ থাকাকালীনই স্টারে ‘বিনি পয়সার ভোজ’ মঞ্চস্থ হল ১০ অক্টোবর, ১৯১২। অমরেন্দ্রনাথ কৌতুকাভিনয়েও খ্যাতিলাভ করেন।
এর আগেই অমরেন্দ্রনাথ স্টার থিয়েটার ছেড়ে দিয়ে বেঙ্গল থিয়েটারের বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার খুলেছিলেন। এই নবপ্রতিষ্ঠিত থিয়েটারের উদ্বোধন করলেন রবীন্দ্রনাথের ‘দালিয়া’ গল্প অবলম্বন করে লেখা ‘জীবনে মরণে’ নাটক দিয়ে। নাট্যরূপ দিলেন অমরেন্দ্রনাথ স্বয়ং। অভিনয় হলো ১৭ জুন, ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে। সঙ্গে অমরেন্দ্রনাথের নিজের প্রহসন ‘আহামরি’।
‘জীবনে মরণে’র নাট্যরূপে অমরেন্দ্রনাথ দুটি নতুন চরিত্র সৃষ্টি করলেন। তাহের ও রঙ্গিলা। তাহের আরাকান রাজের (সাহজেনান) অভিন্নহৃদয় বন্ধু। রঙ্গিলা আরাকান রাজের প্রধানা বাঁদি। সম্রাটের বিশ্বস্ত। তাহের ও রঙ্গিলা সম্রাটের বন্ধুত্ব লাভ করেছে। আগের ‘আলিবাবা’ নাটকের মর্জিনা-আবদালাকে মনে পড়িয়ে দেয়।
নতুন থিয়েটারের উদ্বোধন রজনীর নাটক বাছাই যে ভুল হয়নি, তার প্রমাণ পাওয়া গেল এর অভূতপূর্ব সাফল্যে। বেশ কয়েকরাত্রি দর্শক ঠাসা প্রেক্ষাগৃহে জীবনে-মরণের অভিনয় চলেছিল। উদ্বোধন রাত্রে অমরেন্দ্রনাথ প্রত্যেক দর্শককে রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি বিশিষ্ট ব্রোচ বিতরণ করেন। তাঁর নাট্যরূপায়িত ‘জীবনে-মরণে’ নাটিকাটি রবীন্দ্রনাথের অনুমতি নিয়েই অমরেন্দ্রনাথ ছাপিয়ে প্রকাশ করেছিলেন এবং কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে রবীন্দ্রনাথকে ‘বাণীর বরপুত্র’ রূপে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। জীবনে-মরণের ভূমিকালিপি: অমরেন্দ্রনাথ—সাহজেনান। সুশীলাবালা—তাহের। অবিনাশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়—রহমৎ আলি। গোপাল ভট্টাচার্য—মেসরু। বসন্তকুমারী—জুলিয়া। রানীসুন্দরী—আমিনা। চারুবালা—রঙ্গিলা।
সুশীলাবালা ও অমরেন্দ্রনাথের অভিনয় নাটকটির সাফল্যের প্রধান কারণ হয়েছিল। ‘রাজা ও রাণী’র পর এই নাট্যরূপটিই রঙ্গালয়ে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
‘বিদায় অভিশাপ’ অভিনয় করল মিনার্ভা থিয়েটার, ৯ আগস্ট, ১৯১৩। এতদিনে মিনার্ভা প্রথম রবীন্দ্রনাটকের অভিনয় করলো। এই নাট্যকাব্যটিতে কচ-এর ভূমিকায় দানীবাবু এবং দেবযানী চরিত্রে তারাসুন্দরী তাদের স্বভাবগত আভিনয়ধারা থেকে সরে এসে অভিনয়ের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ‘বিদায় অভিশাপ’ দর্শক মনে কোনো রেখাপাত করতে পারলো না। মোট একরাত্রি অভিনয় হয়।
স্টার থিয়েটার আবার রবীন্দ্রনাথের গল্পের নাট্যরূপ মঞ্চস্থ করল। ‘শাস্তি’ গল্পের নাট্যরূপ দিলেন অমরেন্দ্রনাথ, সহায়তা করলেন রামলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। নাট্যরূপের নাম হলো ‘অভিমানিনী’। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুন স্টারে অভিনীত হও। সবটাই অমরেন্দ্রনাথের উৎসাহে ও উদ্যোগে।
প্রথম রজনীতে অমরেন্দ্রনাথ কোনো ভূমিকা নেননি, দ্বিতীয় রজনী থেকে তিনি ‘ছিদাম’ অভিনয় করেন। প্রথম রাতে ‘ছিদাম’ করেন মন্মথনাথ পাল। দুখীরাম—ক্ষেত্রমোহন মিত্র। রামলোচন—কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায়। সিভিল সার্জেন—ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। চন্দরা—কুসুমকুমারী। ললিতা—নরীসুন্দরী। রাধা—মৃণালিনী। ‘অভিমানিনী’ একাধিক রজনী বেশ ভালভাবেই চলেছিল। গল্পের নতুন বিষয়বস্তু দর্শকের ভালো লেগেছিল।
চার মাস বাদেই স্টার আবার রবীন্দ্রনাথের গল্পের নাট্যরূপ অভিনয় করল। ‘দিদি’ গল্পের নাট্যরূপ দিলেন রামলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। স্টারে অভিনীত এই নাটকের নাম দেওয়া হলো ‘অকলঙ্ক শশী’। প্রথম অভিনয় ৩১ অক্টোবর, ১৯১৪। বিভিন্ন ভূমিকায় ছিলেন অমরেন্দ্রনাথ, কুসুমকুমারী, মন্মথনাথ পাল, নরীসুন্দরী, ক্ষেত্রমােহন মিত্র, অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
১৯১০ থেকে ১৯২০, এই বছরগুলিতে রবীন্দ্রনাথের লেখা কোনো উল্লেখযোগ্য নাটকের অভিনয় সাধারণ রঙ্গালয়ে হয়নি। যা হয়েছে বেশির ভাগই তাঁর গল্প বা উপন্যাসের নাট্যরূপ। তার মধ্যে বেশির ভাগ প্রচেষ্টাই দেখা যাচ্ছে অমরেন্দ্রনাথের। এককভাবে তার এই প্রচেষ্টা সে যুগে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। (এর পূর্বযুগে অর্ধেন্দুশেখর উদ্যোগ নিয়ে রবীন্দ্র নাটকের অভিনয় করেছিলেন। এগুলির মধ্যে একমাত্র ‘জীবনে মরণে’ (দালিয়া গল্পের নাট্যরূপ) ভালোই সাফল্য পেয়েছিল এবং আর্থিক উপার্জনও ভালোই হয়েছিল। অন্যগুলি সেভাবে সাফল্য পায়নি। রাজা ও রানী, দত্ত, বা ‘গোড়ায় গলদ’-এর পর মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের লেখা কোনো নাটকের আর অভিনয় দেখা যাচ্ছে না প্রায় কুড়ি বছর। এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের নামে যেগুলির অভিনয় সাধারণ রঙ্গালয়ে হচ্ছিল, তার সবই সহজ সরল নাট্যরূপ মাত্র। কয়েকটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নাম জড়িত ছিল বটে, সেগুলি কিন্তু তার গল্প বা উপন্যাসের নাট্যরূপ বিভিন্ন নাট্যরূপদাতা নিজেদের এবং মঞ্চের মর্জি অনুসারে নাট্যরূপ দিয়েছেন। মূল কাহিনীর গ্রহণ বর্জন তাদের খেয়ালখুশি মতো হয়েছে। কোনো কোনো নাটকে তাদের নিজেদের লেখা গানও এর মধ্যে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।
তবে মনে রাখতে হবে, ১৯১০-২০ এই সময়কালের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ যে নাটকগুলি লিখেছেন, তার সবগুলিই রূপক-সাঙ্কেতিক নাটক। শারদোৎসব, প্রায়শ্চিত্ত, রাজা, ডাকঘর, অচলায়তন, ফাল্গুনী, গুরু, ঋণশোধ, মুক্তধারা প্রভৃতি। রবীন্দ্রনাথের নাট্যভাবনা এই যুগে পরিবর্তিত হয়েছে। তিনি তার অন্তর্মুখীন ভাবনার এই নাটকগুলি লিখছেন এবং নিজের উদ্যোগে নিজের পরিচালনায় অভিনয়ের আয়োজন করছেন। এই গভীর ভাবাত্মক, ব্যঞ্জনাধর্মী এবং তত্ত্বপ্রধান নাটকগুলির বেশির ভাগেরই দর্শক-উদ্যোক্তা এবং অংশগ্রহণকারী সকলেই রবীন্দ্রভাবনায় অনুপ্রাণিত। পেশাদার সাধারণ রঙ্গালয় স্বাভাবিকভাবেই এই নাটকগুলির অভিনয়ের দুঃসাহস দেখাতে পারেনি। যা করেছে, তার সবই ওই গল্প উপন্যাসের নাট্যরূপ, যেগুলির অভিনয় খুব উচ্চাঙ্গের হয়নি এবং দর্শকরাও খুব উল্লসিত হতে পারেনি।
এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়ে বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছেন (১৯১৩) এবং সাধারণ বাঙালির কাছেও পরিচিত ও আদৃত হচ্ছেন। যৌবনের রবীন্দ্রনাথ এতদিনে ‘পঞ্চাশোর্ধ্ব রবীন্দ্রনাথে’ পরিণত হয়েছেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে (১৯১৪-১৮) ও পরে দেশের অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ রঙ্গালয়েরও খুবই দুরবস্থার সময়। রঙ্গমঞ্চগুলি কোনো রকমে পুরনো গতানুগতিক নাটকগুলির অভিনয় চালিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছিল।
তার মধ্যেও ‘থেসপিয়ান টেম্পল’ থিয়েটার বেঙ্গল থিয়েটারের মঞ্চে ‘রাজা ও রানী’ অভিনয় করে (৮ জুন, ১৯১৬), মনোমোহন থিয়েটার ‘রাজা ও রানী’ নামায় ২০ নভেম্বর, ১৯১৯। মিনার্ভায় অভিনীত হয় ‘বশীকরণ’ (২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯২০)। অভিনেত্রী চারুশীলা এই নাটকে খুবই কৃতিত্ব দেখান ও খ্যাতিলাভ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে স্টাব থিয়েটারের খুবই দুরবস্থার কালে সেখানে আর্ট থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়, ৩০ জুন, ১৯২৩। উদ্বোধনের দুই মাসের মধ্যেই আর্ট থিয়েটার ‘রাজা ও রানী’র অভিনয় শুরু করে, ২৯ আগস্ট, ১৯২৩ থেকে। ‘কর্ণাজুন’ নাটকের অভূতপূর্ব সাফল্যের মধ্যেও ‘রাজা ও রানী’ ভালই চলেছিল। অভিনয় করেন: অহীন্দ্র চৌধরী—কুমার দেব। তিনকড়ি চক্রবর্তী—বিক্রম দেব। নরেশ মিত্র—শঙ্কব। অপরেশ মুখোপাধ্যায়—দেবদত্ত। কৃষ্ণভামিনী—সুমিত্রা। নীহারবালা—ইলা।
এবারে আর্ট থিয়েটার নামাল ‘চিরকুমার সভা’। এই নাটকের অভিনয় সাধারণ রঙ্গালয়ে খুবই সাফল্য লাভ করেছিল এবং জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। প্রথম অভিনয় হল ১৮ জুলাই, ১৯২৫। রবীন্দ্রনাথের অনেক আগে লিখিত ও প্রকাশিত ‘প্রজাপতির নির্বন্ধ’কে কবি স্বয়ং ঠিকঠাক করে দিয়ে অভিনয় উপযোগী করে তোলেন। নাম দেন ‘চিরকুমার সভা’। সাধারণ রঙ্গালয় আর্ট থিয়েটারের অহীন্দ্র চৌধুরীরা তার নাটক অভিনয়ের কথা ভাবছেন শুনে রবীন্দ্রনাথ ২৪ বৎসর আগে লেখা ‘প্রজাপতির নির্বন্ধ’-এর নতুন নাট্যরূপ দানে প্রবৃত্ত হলেন। হেমেন্দ্রকুমার বায় জানিয়েছেন (সৌখিন নাট্যকলায় রবীন্দ্রনাথ) যে, শিশিরকুমার ভাদুড়িদের জন্যই তিনি একাজে হাত দেন। দৌত্য করেছিলেন মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়। ‘চিরকুমার সভা’কে নাট্য অভিনয়ের উপযোগী করে তুললেন বটে শিশির সম্প্রদায়ের জন্যে, কিন্তু তা অভিনীত হলো স্টার রঙ্গমঞ্চে আর্ট সম্প্রদায়ের দ্বারা। মহাসমারোহে এবং বিপুল পরিশ্রমে নাটকটি মঞ্চস্থ হলো। চরিত্রলিপি: অহীন্দ্র চৌধুরী—চন্দ্রবাবু। তিনকড়ি চক্রবর্তী—অক্ষয়। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়—পূর্ণ। অপরেশ মুখোপাধ্যায়—রসিক। নীহারবালা—নীরবালা।
আর্ট থিয়েটারের কুশলী নট-নটীদের অভিনয় গুণে ‘চিরকুমার সভা’ অচিরেই দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করলো। রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর্ট থিয়েটারে গিয়ে নাটকের প্রস্তুতিতে সাহায্য করেন। গগন ঠাকুর দেখে দিয়েছিলেন মঞ্চ, দৃশ্যসজ্জা, সিনসিনারি আর দিনেন ঠাকুর নাটকের গানের ব্যাপারে তত্ত্বাবধান করেছিলেন, নিজে গান শিখিয়ে দিয়েছেন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের। বিজ্ঞাপনেও তাদের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজেও নানাভাবে সাহায্য করলেন এবং দ্বিতীয় রজনীতে নিজে অভিনয় দেখতে এলেন (২৫ জুলাই, ১৯২৫) ঠাকুরবাড়ির অনেকের সঙ্গে। পরের দিন অভিনেতারা ঠাকুরবাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা করলে তিনি অভিনয়ে তার সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং রসিকের ভূমিকায় অপরেশচন্দ্রের ভূয়সী প্রশংসা করে তার নাম দেন রসিকবাবু।
আর্ট থিয়েটার প্রাণপণ যত্নে নাটকটি অভিনয় করে। বেশভূষা, মঞ্চের সাজসরঞ্জাম, আসবাবপত্র, দৃশ্যপট, সঙ্গীত, বক্তৃতা, সংলাপ, অভিনয়—সব দিকেই নিখুঁত করার চেষ্টা ছিল। পালিশ করা কাঠের দরজা, কাচের শার্সি, ঝিলিমিলি—এসব দিয়ে মঞ্চে ঘর সাজানো হয়। দলের অভিনেতৃবর্গের আন্তরিক অভিনয় এবং সঙ্গীত—নাটকটিকে মঞ্চসফল করে তুললো। দিনেন্দ্রনাথের শিক্ষায় নীহারবালা ও তিনকড়ি চক্রবর্তীর গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গান খুবই জনপ্রিয় হয়। নীহারবালার (নীরবালা) গাওয়া-জয়যাত্রায় যাও গো’, ‘যেতে দাও গেল যারা’, ‘না বলে যায় পাছে সে’, ‘জ্বলেনি আলো অন্ধকারে এবং তিনকড়ি চক্রবর্তী (অক্ষয়)-না, না গো না, কোর না ভাবনা’, ‘চলেছে ছুটিয়া পলাতকা হিয়া’—প্রভৃতি গান জনপ্রিয়তালাভের ফলে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রসারে খুবই কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল।
শিশিরকুমার ভাদুড়ি খ্যাতির তুঙ্গে থাকাকালীন আর্ট থিয়েটারের আমন্ত্রণে একরাত্রির জন্য (২৯ জুলাই, ১৯২৯) চন্দ্রবাবুর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, নিয়মিত অভিনেতা অহীন্দ্র চৌধুরীর অনুপস্থিতিতে। পরের বছর আর্ট থিয়েটারের দুর্দিনে শিশির ভাদুড়ি তাঁর সম্প্রদায়ের অনেককে নিয়ে আর্ট থিয়েটারের হয়ে ‘চিরকুমার সভা’ নতুন করে অভিনয় করেন। সেই অভিনয় দর্শকদের কাছে নতুন করে আগ্রহের সঞ্চার করেছিল। সেখানে অভিনয় করেছিলেন শিশিরকুমার (চন্দ্র), বিশ্বনাথ ভাদুড়ি (পূর্ণ), প্রভাদেবী (শৈলবালা), কৃষ্ণভামিনী (পুরবালা), সরস্বতী (নৃপবালা), সুশীলাবালা (নির্মলা) এবং কঙ্কাবতী (নীরবালা)।
‘আর্ট থিয়েটার’ তাদের অভিনয়ে কমেডি নাটকটিকে হাল্কা রঙ্গ ব্যঙ্গ ও রসিকতার ঢঙে উপস্থাপন করেছিল। কোনো অংশ বেশ স্থূল ও ভাঁড়ামোর পর্যায়েও নিয়ে গিয়েছিল। চরিত্রগুলির সূক্ষ্ম বিকাশের চাইতে মোটা দাগের অভিনয়ে সেগুলিকে কৌতুকাত্মক করে তোলার চেষ্টা করেছিল। স্বভাবতই সেই সময়ের সাধারণ রঙ্গালয়ের দর্শকের কাছে এর আবেদনই বেশি ছিল। এবং ‘চিরকুমার সভা’ সাধারণ রঙ্গালয়ে রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে ‘মঞ্চ সফল’ নাটক। অথচ শিশির ভাদুড়ি বাহুল্য, গ্রাম্যতা বা স্থূলতা বর্জন করে নাটকের সূক্ষ্ম রসিকতা প্রকাশ করতে চেয়েছেন। শিশিরবাবুর অভিনয়ে ‘চন্দ্রবাবু’ আত্মভোলা দার্শনিক শ্রেণীর মানুষ হিসেবেই (অনেকটা রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দার্শনিক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো) উপস্থিত হয়েছে, স্থূল ভাঁড় নয়। অহীন্দ্র চৌধুরীর অভিনয়ে দর্শকেরা হেসে গড়াগড়ি যেত, শিশিরকুমারের অভিনয়ে রসিকবোদ্ধা দর্শক পরিতৃপ্ত হয়েছিল। শিশিরকুমার কখনো রসিকের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, যে চরিত্রে অপরেশ মুখখাপাধ্যায়, তখনকার থিয়েটারের ভাষায় একেবারে ‘জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন’। বোঝাই যায়, রঙ্গালয়ের বৃহত্তর দর্শক কোনটা পছন্দ করেছিল!
‘চিরকুমার সভা’ সবাক চলচ্চিত্ররূপে মুক্তি পেল ১৯৩২-এর ২৮ মে, কলকাতার ‘চিত্রা’ সিমেনায়। রবীন্দ্রনাথের কাহিনী অবলম্বনে প্রথম সবাক চলচ্চিত্র। পরিচালনায় প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। অভিনয়ে: দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনকড়ি চক্রবর্তী, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, ইন্দুবালা, নিভাননী, মলিনাদেবী প্রমুখ।
‘চিরকুমার সভা’র সাফল্যে উৎসাহিত আর্ট থিয়েটার রবীন্দ্রনাথের ‘গৃহপ্রবেশ’ নাটকটি মঞ্চস্থ করলো। ৫ ডিসেম্বর, ১৯২৫, প্রথম অভিনয় হলো। ‘শেষের রাত্রি’ গল্পের নাট্যরূপ এটি, নাট্যরূপ দিলেন রবীন্দ্রনাথ নিজে, আর্ট থিয়েটারের অভিনয়ের জন্য। ১৯২৫-এর সেপ্টেম্বরে গ্রন্থাকারে প্রকাশের তিনমাসের মধ্যেই (ডিসেম্বর) অভিনয় করা হলো। ভূমিকালিপি: অহীন্দ্র চৌধুরী—যতীন। তিনকড়ি চক্রবর্তী—ডাক্তার। কুমার কনকনারায়ণ ভূপ—অখিল। সুশীলাসুন্দরী—মাসী। নীহারবালা—হিমি। সেবাবালা—মণি।
তৃতীয় অভিনয় রজনীতে রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীসাথী নিয়ে সপরিবারে ‘গৃহপ্রবেশে’র অভিনয় দেখতে গিয়েছিলেন (১৯ ডিসেম্বর, ১৯২৫)। রবীন্দ্রনাথের খুবই ভালো লেগেছিল এই অভিনয়, অহীন্দ্র চৌধুরীর এই মন্তব্য সত্ত্বেও, দেখছি, গৃহপ্রবেশ কোনো দিক দিয়েই সাফল্য লাভ করতে পারেনি। গৃহপ্রবেশের অভিনয়েও রবীন্দ্রনাথ অনেক সাহায্য করেছিলেন। থিয়েটারের সন্তোষ দাস রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে গানগুলি কণ্ঠে তুলে নিয়ে এসেছিলেন। অহীন্দ্র চৌধুরীর ‘পার্টের রিডিং’ পর্যন্ত শিখিয়ে দিয়েছেন। গগন ঠাকুর মঞ্চ এবং দিনেন ঠাকুর সঙ্গীতের দিকটা দেখেছিলেন। একই মঞ্চে পাশাপাশি দুটো ঘর এবং এঘর থেকে সে ঘর চলাচল অব্যাহত—এই রকম সেট বাংলা মঞ্চে প্রথম দেখা গেল গগন ঠাকুরের মঞ্চ নির্দেশনায়।
এই নাটকের অভিনয় দেখে রবীন্দ্রনাথ অনেক পরিবর্তন করে দিলেন। অতিরিক্ত সংলাপ যোজনা, সম্পাদনা করে দৃশ্য বাড়ানো কমানো, নতুন চরিত্র সৃষ্টি করা (‘টুকরি’ ও ‘বৈষ্ণবী’); নীহারবালার (হিমি) কণ্ঠে গান পছন্দ হওয়াতে তাঁর গলায় গান বাড়িয়ে দেওয়া এসব করেছিলেন।
‘গৃহপ্রবেশ’ ততোখানি সাফল্য পেল না, ‘চিরকুমার সভা’ যতোটা পেয়েছিল। তবু আর্ট থিয়েটার এবারে দুটি নাটক নামাল রবীন্দ্রনাথের, ‘বশীকরণ’ ও ‘বিদায় অভিশাপ’। এই দুটি আগেই মিনার্ভায় অভিনীত হয়েছিল। আর্ট থিয়েটারে ‘বশীকরণের’ অভিনয়ে (প্রথম অভিনয়: ১০ জানুয়ারি, ১৯২৬) ছিলেন: রানীসুন্দরী—মাতাজী। রাধিকা মুখখাপাধ্যায়—অন্নদা।
এর তিন মাসের মাথায় (১৫ এপ্রিল) নামাল ‘বিদায় অভিশাপ’। কচ-রাধিকানন্দ এবং দেবযানী—সুশীলাবালা। মিনার্ভায় দানীবাবু ও তারাসুন্দরীর কচ-দেবযানী চরিত্রের অভিনয় সত্ত্বেও একরাত্রির বেশি অভিনয় হয়নি। এখানে কিন্তু কয়েক রাত্রি চলল। তবে তেমন দর্শক সাড়া পাওয়া গেল না।
ঐ ১৯২৬-এই আর্ট থিয়েটার রবীন্দ্রনাথের ‘শোধবোধ’ নাটকটি অভিনয় করল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘কর্মফল’ গল্পের নাট্যরূপ দিলেন নিজেই। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন (রবীন্দ্রজীবনী-৩। পৃ., ২৩৪)—‘‘চিরকুমার সভা’ ও ‘শোধবোধ’ নাটক দুইটি অভিনয়ের জন্য রচিত-খানিকটা ফরমাইসিই বলিব।…পাবলিক রঙ্গালয়ে মঞ্চস্থ হইবে বলিয়া লোকরঞ্জনের দিকে কবির দৃষ্টি ছিল বেশী।’’ অভিনয় হল ২৬ জুলাই। চরিত্রলিপি: অহীন্দ্র চৌধুরী—সতীশ। রাধিকাদ মুখোপাধ্যায়—শশধর ও মিঃ নদী। সুশীলা—সুকুমারী। নীহারবালা—নলিনী। কনকনারায়ণ—মিঃ লাহিড়ী। রাণীসুন্দরী—বিধুমুখী। সরস্বতী—চারুবালা। দুর্গাপ্রসন্ন বসু—মন্মথ।
রবীন্দ্রনাথ অভিনয় দেখে গেলেন ২ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৭। খুশিও হলেন। আর্ট থিয়েটারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ ঘনিষ্ঠতর হচ্ছে। এই একই সময়ে শিশির ভাদুড়ির প্রয়োগ-নৈপুণ্যে ভরসা রেখে তাকে অনেক নাটক করতে দিচ্ছেন। আবার আর্ট থিয়েটারের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছেন।
এবারে রবীন্দ্রনাথ নিজেই উদ্যোগী হয়ে তাঁর পুরনো উপন্যাস ‘বউঠাকুরাণীর হাট’-এর নাট্যরূপ নিজেই দিলেন, নামকরণ হল ‘পরিত্রাণ’। অবশ্য এই উপন্যাস থেকে রবীন্দ্রনাথ নিজে ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটক লেখেন। সেই নাটক সাধারণ রঙ্গালয় নেয়নি। এবারে রবীন্দ্রনাথ একই উপন্যাসের দ্বিতীয় নাট্য রূপান্তর করলেন ‘পরিত্রাণ’ নামে। অনেক আগে ‘রাজা বসন্ত রায়’ নামে রূপান্তর করেছিলেন কেদার চৌধুরী। সে যুগে এই নাট্যরূপান্তরর চলেছিলও খুব।
রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে নাট্যরূপ দিইয়ে আর্ট থিয়েটার ‘পরিত্রাণ’ অভিনয় করলো। প্রথম অভিনয় ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯২৭। উল্লেখযোগ্য অভিনয় করলেন—তিনকড়ি চক্রবর্তী (ধনঞ্জয় বৈরাগী), নরেশচন্দ্র মিত্র (রাজা বসন্ত রায়), তুলসী বন্দ্যোপাধ্যায় (প্রতাপাদিত্য), মণীন্দ্রনাথ ঘোষ (রামচন্দ্র)। সন্তোষ সিংহ (উদয়াদিত্য), নীহারবালা (বিভা), সরস্বতী (সুরমা)।
প্রথম যুগের মতোই এযুগেও ‘বউঠাকুরানীর হাট’ উপন্যাসের নাট্যরূপ বেশ ভালই সাফল্যলাভ করলো।
আর্ট থিয়েটারের একেবারে শেষের দিকে ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ অভিনয় করে, ১৫ জুন, ১৯৩৩। মনোমোহন নাট্যমন্দিরে এর অনেক আগে বৈকুণ্ঠের খাতা অভিনয় হয়েছিল (১৯২৪)। অহীন্দ্র চৌধুরী (বৈকুণ্ঠ), মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য (কেদার), জহর গাঙ্গুলি (অবিনাশ) উল্লেখযোগ্য অভিনয় করেন। তাছাড়া তিনকড়ি চক্রবর্তী ও শৈলেন চৌধুরীও অভিনয়ে অংশ নেন। শিশির ভাদুড়ি একদিন (১ জুলাই, ১৯৩৩) এখানে কেদারের ভূমিকায় নেমেছিলেন। পরে অবিনাশের চরিত্রেও অভিনয় করেছিলেন।
আর্ট থিয়েটার এবং বিশেষ করে অন্যতম কর্ণধার প্রবোধচন্দ্র গুহের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে উঠেছিল। প্রবোধচন্দ্র আর্ট থিয়েটার ছেড়ে মনোমোহন থিয়েটারে যুক্ত হলে রবীন্দ্রনাথ তাকে তাঁর ‘মুক্তির উপায়’ গল্পের নিজে নাট্যরূপ দিয়ে অভিনয় স্বত্ত্ব দিয়েছিলেন। ‘মুক্তির উপায়’ মনোমোহনে অভিনীত হলো ১৭ মে, ১৯৩০। আর্ট থিয়েটারের অনেক অভিনেতা অভিনেত্রী সেখানে যুক্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে রাধিকানন্দ (ফকির), দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (মাখনলাল), নীহারবালা (হৈমবতী) প্রভৃতি অভিনয় করলেন। অনেক আগে সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের নাট্যরূপে ‘দশচক্র’ নামে এটি স্টার থিয়েটারে অভিনীত হয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আর্ট থিয়েটারই উদ্যোগ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের পর পর আটটি নাটক ও নাট্যরূপের অভিনয়ের ব্যবস্থা করেছিল। তারা রবীন্দ্রনাথের সক্রিয় সাহায্যও পেয়েছিল। দলের ক্ষমতাশালী নটনটীদের সহযোগিতা এবং অপরেশচন্দ্রের পরিচালনার কৃতিত্বে কয়েকটির অভিনয় সাফল্যলাভ করেছিল। আর্ট থিয়েটার যথাযোগ্য মর্যাদায় রবীন্দ্র নাটক বা নাট্যরূপের অভিনয়ের চেষ্টা করেছে। তখনকার পত্রপত্রিকায় এই অভিনয়গুলির প্রশংসাই করা হয়েছিল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা, আশীর্বাদ, সহযোগিতা, সমর্থন ও সাহায্যও তারা পেয়েছিল। রবীন্দ্রনাটকের অভিনয়ে সাধারণ রঙ্গালয়ের মধ্যে আর্ট থিয়েটারের প্রচেষ্টাকে তাই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতেই হবে।
শিশির ভাদুড়ির রঙ্গালয়ে রবীন্দ্র নাটকের বা নাট্যরূপের অভিনয়ের উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁর ‘প্রয়োগনৈপুণ্যে’ খুশি রবীন্দ্রনাথ ‘নটরাজ’ শিশিরকুমারকে তাঁর কয়েকটি নাটকের অভিনয়ের ভার দিতে কুণ্ঠিত হননি। রবীন্দ্রনাথ-ও মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা এক পত্রে স্বীকার করেছিলেন—“শিশির ভাদুড়ির প্রয়োগ-নৈপুণ্য সম্বন্ধে আমার বিশেষ শ্রদ্ধা আছে। সেই কারণেই ইচ্ছাপূর্বক আমার দুই একটি নাটক অভিনয়ের ভার তার হাতে দিয়েছি।’’ (তারিখ: ১২ ভাদ্র, ১৩৩১)। নতুন যুগের ভাবনাচিন্তা ও উপস্থাপনার পরিকল্পনায় তিনি রবীন্দ্র নাটকের অভিনয়ের যথাযযাগ্য মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
সাধারণ রঙ্গালয়ে অভিনয় শুরু করার পাঁচ বছর বাদে শিশিরকুমার রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ অভিনয় করলেন। নাট্যমন্দিরের উদ্বোধন হলো বিসর্জন দিয়ে, ২৬ জুন, ১৯২৬। শিশির ভাদুড়ির পরিচালনায় অভিনয় করলেন: রঘুপতি—শিশির ভাদুড়ি। জয়সিংহ—রবি রায়। গোবিন্দমাণিক্য—মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য। নক্ষত্র রায়—নরেশ মিত্র। চাঁদপাল—অমিতাভ বসু। রাণী গুণবতী—চারুশীলা। অপর্ণা—ঊষাবতী (পটল)। পরের দিকে শিশির জয়সিংহ করেছেন। নরেশ মিত্র ও রবি রায়ও কখনো রঘুপতি সেজেছেন। দৃশ্যপট, সাজসজ্জা, অভিনয় এবং প্রয়োগ-নৈপুণ্যে বিসর্জনের অভিনয় বাংলা থিয়েটারে নতুন মাত্রা এনে দিল। দিনেন ঠাকুর সঙ্গীত এবং অবনীন্দ্র-শিষ্য রমেন চট্টোপাধ্যায় দৃশ্যপট নির্মাণে সাহায্য করেছিলেন। নাট্যমন্দিরে অভিনয়ের জন্য ‘বিসর্জনে’ দৃশ্য সংস্থানের পরিবর্তন এবং কিছু নতুন গান যোজনা করা হয়েছিল কবির সমর্থনেই। এবং নাটকেরও কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়েছিল। গানে কৃষ্ণচন্দ্র দে (কানাকেষ্ট) এবং কঙ্কাবতী নৈপুণ্য দেখালেন।
রবীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ তথা সে যুগের বিদগ্ধ রসিক দর্শকেরা এই প্রযোজনা দেখে প্রীত হয়েছিলেন। কিন্তু বৃহত্তর দর্শকের সাড়া তেমনভাবে পাওয়া যায়নি। মনে রাখতে হবে ১৯ শতকে যেমন, তেমনি বিশ শতকের এই এক-চতুর্থাংশ সময়ের মধ্যে এই প্রথম সাধারণ রঙ্গালয়ে বিসর্জন অভিনীত হলো। ধর্মীয় আবেগ ও সংস্কারে আঘাত এবং কালীমূর্তির বিসর্জন সাধারণ রঙ্গালয়ের দর্শকের মনঃপুত হয়নি কখনোই। পরের বছরেই নাট্যমন্দির ‘শেষরক্ষা’ প্রযোজনা করলো। অন্য মঞ্চে আগেই অভিনীত ‘গোড়ায় গলদ’ প্রহসনের এটি পরিবর্তিত ও পূর্ণাঙ্গ নাট্যরূপ। প্রথম অভিনয়: ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯২৭। পরিচালনা ও অভিনয়ে শিশিরকুমার। চরিত্রলিপি: শিশিরকুমার-চন্দ্রবাবু। রবি রায়—বিনোদ। যোগেশ চৌধুরী—নিবারণ। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য—শিবরতন। শৈলেন চৌধুরী—গদাই। রাধিকা—নন্দললিত। চারুশীলা—ক্ষান্তমণি। কৃষ্ণভামিনী—কমল। প্রভা দেবী—ইন্দুমতী। উষাবতী (পটল)—ঠাকুরাণী।
‘শেষরক্ষা’র অভিনয় স্বত্ত্ব পাওয়ার জন্য নাট্যমন্দির ও স্টার উভয় সম্প্রদায়ই চেষ্টা করেছিল। রবীন্দ্র-নাটকের অভিনয়ের জন্য দুই রঙ্গালয়ের রেষারেষি উল্লেখযোগ্য খবর। ঢেলে সাজানো নাটকটির নতুন নামকরণ রবীন্দ্রনাথ করলেন এবং শিশিরের হাতে দিয়ে মজা করে বললেন—গোড়ায় গলদ ছিল, এবারে শেষরক্ষা হল। অবশ্যই শিশিরের অনুরোধে মঞ্চোপযোগী করে তোলার জন্য। দৃশ্যপট, সাজসজ্জা ও সম্প্রদায়ের প্রথম শ্রেণীর নটনটীদের অসামান্য অভিনয়ে শেষরক্ষা খুবই সাফল্য পেল। বাহুল্যবিহীন মঞ্চসজ্জা ও দৃশ্যপট পত্রপত্রিকার প্রশংসালাভ করলো। অভিনয়ে, গানে ও প্রয়োগে নাটকটি জমে গেল। বহুবিচিত্র চরিত্র অভিনয়ের ফাঁকে শিশিরকুমারের চন্দ্রবাবুর চরিত্রে অভিনয় সবাইকে মাতিয়ে দিল।
নাটকের শেষ দৃশ্য গদাই-ইন্দুমতীর বিবাহ। স্টেজের মাঝ থেকে একটি প্লাটফর্ম ও সিঁড়ি দিয়ে প্রেক্ষাগৃহের দর্শকদের সঙ্গে যোগসাধন করা হয়েছিল। চন্দ্ররূপী শিশির ভাদুড়ি বর-কর্তার বেশে মঞ্চ থেকে নেমে এসে দর্শকদের নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে আপ্যায়ন করতে থাকেন। মঞ্চে গান শুরু হয়—যার অদৃষ্টে যেমনি জুটেছে, সেই আমাদের ভালো। আমাদের ওই আঁধার ঘরে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালো। ওগো তোমরা সবাই ভালো। দর্শকাসনে ছড়িয়ে থাকা গায়কের দল তার সঙ্গে গলা মেলাতে থাকে। মঞ্চ ও প্রেক্ষাগৃহ উৎসব মুখরিত বিবাহ-প্রাঙ্গণের রূপ ধারণ করে। শেষ দৃশ্যের এই উপস্থাপনা রবীন্দ্রনাথ সহ অনেকেরই সপ্রশংস অভিনন্দন লাভ করে। শিশির ভাদুড়ি এইভাবে দর্শক ও মঞ্চের ভেদরেখা তুলে দিয়েছিলেন।
এই উপলক্ষে মজাদার সব বিজ্ঞাপনও দেওয়া হতো—‘মহাশয়গণ, সবান্ধবে, মদীয় নাট্যমন্দির ভবনে শুভাগমন করিয়া মহাসমারোহে শুভকার্য সুসম্পন্ন করাইবার ব্যবস্থা করিবেন। ইতি বিনীত চরদা।’’ ‘হাউসফুল’ অভিনয় চলেছিল বহুদিন। সাধারণ ও বোদ্ধা-রুচিশীল—উভয় শ্রেণীর দর্শকের আগমনে ‘শেষরক্ষা’ সাফল্যলাভ করেছিল।
নাট্যমন্দিরে এরপর অভিনীত হল ‘তপতী’। প্রথম অভিনয়: ২৫ ডিসেম্বর, ১৯২৯। ভূমিকালিপি: বিক্রমদেব—শিশির ভাদুড়ি। নরেশ—জীবন গাঙ্গুলি। দেবদত্ত—যোগেশ চৌধুরী। ত্রিবেদী ও চন্দ্রসেন—অমলেন্দু লাহিড়ী। কুমার সেন ও রত্নেশ্বর—রবি রায়। সুমিত্রা—প্রভা দেবী। বিপাশা—কঙ্কাবতী। গৌরী—সুশীলাবালা (ছোট)।
বহুপূর্বে অভিনীত মঞ্চসফল ‘রাজা ও রানী’ নাটকের রবীন্দ্রনাথকৃত পরিবর্তিত রূপ ‘তপতী’। সাধারণ রঙ্গালয়ে এই নাটক চলবে না—এরকম আপত্তি সত্ত্বেও শিশিরকুমার ‘তপতী’ প্রযোজনা করলেন। রবীন্দ্রনাথও আরো কিছু ঘষামাজা করেছিলেন। প্রচুর অর্থব্যয়ে ও পরিশ্রমে ‘তপতী’ নামানো হলো। মঞ্চসজ্জা-শিল্পী রমেন চট্টোপাধ্যায়। সঙ্গীত—দিনেন ঠাকুর। প্রত্যেকের অভিনয় পত্র-পত্রিকায় উচ্চ প্রশংসিত হলো। সাজসজ্জা, মঞ্চ, সঙ্গীত, আলো-উপস্থাপনার মান বাড়িয়ে দিল। কঙ্কাবতীর কণ্ঠে গান—‘প্রলয়-নাচন নাচলে যখন’, ‘আলোক চোরা লুকিয়ে এলো ঐ’, ‘তোমার আসন শূন্য আজি’—খুবই ভালো হয়েছিল।
এতদসত্ত্বেও ‘তপতী’ চললো না। রসিকজন ফুরিয়ে গেলেই, দর্শকাসন শূন্য থাকতে লাগলো। দর্শক-শূন্য অডিটোরিয়াম দেখে নায়িকা প্রভাদেবী অনুযোগ করলে শিশিরকুমার বলেছিলেন—ঐ শূন্য চেয়ারগুলিকে দর্শক ভেবে অভিনয় চালিয়ে যাও। স্টারে এই সময়ে সামাজিক আবেগধর্মী নাটক ‘মন্ত্রশক্তি’র সঙ্গে ‘তপতী’ পাল্লা দিতেই পারল না। প্রচুর আর্থিক লোকসান দিয়ে তপতীর অভিনয় বন্ধ করে দিতে হলো। অবশ্য লীজ শেষ হওয়ায় শিশিরকুমারকে কর্ণওয়ালিস থিয়েটার ছেড়ে দিতে হলো, সেটাও ‘তপতী’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ। অবশ্য পরে আর শিশিরকুমার কোথাও ‘তপতী’র অভিনয় করেননি। ‘নাচঘর’ পত্রিকা দুঃখ করে লিখেছিল (২৩ ফাল্গুন, ১৩৩৬)—‘‘রবীন্দ্রনাথের নাটকের মর্মগ্রহণ করবার মতো শিক্ষার উৎকর্য ও রসবোধ এদেশের দর্শক সাধারণের নেই, তাই ‘মুক্তধারা’, ‘রক্তকরবী’ এদেশের সাধারণ রঙ্গমঞ্চে আজও অভিনীত হয়নি। তপতীর অভিনয়ে দর্শকের অভাব একথা সপ্রমাণ করছে।’’
‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের নাট্যরূপ শিশিরকুমার মঞ্চস্থ করলেন নব প্রতিষ্ঠিত নবনাট্য মন্দিরে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ২৪ ডিসেম্বর। শিশিরের অনুওধে রবীন্দ্রনাথ নিজেই নাট্যরূপ দিলেন। অভিনয় করলেন: মধুসূদন—শিশির ভাদুড়ি। বিপ্রদাস—শৈলেন চৌধুরী। কুমুদিনী—কঙ্কাবতী। নবীন—কানু বন্দ্যোপাধ্যায়। মতির মা—রানীবালা। শ্যামা—ঊষাবতী (পটল)।
রবীন্দ্রনাথ অভিনয় দেখতে আসেন এবং শিশির ও বিশেষ করে কঙ্কাবতীর অভিনয়ের প্রশংসা করেন। কিন্তু ‘যোগাযোগ’ নাট্যরূপের দুর্বলতা, অহেতুক গান (কয়েকটি গান আবার রবীন্দ্রনাথের লেখা নয়। প্রযোজনার স্বার্থে মেনে নিয়েছিলেন) ও পরোক্ষ চরিত্র বিশ্লেষণ সার্থক প্রযোজনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে।
‘যোগাযোগ’ অভিনয়ে সেরকম দর্শক সমাগম হলো না। কিছু দিনের মধ্যেই আবার আর্থিক লোকসান দিয়ে অভিনয় বন্ধ করে দিতে হলো।
শিশির ভাদুড়ি ও রবীন্দ্রনাথ-পারস্পরিক মানসিক সান্নিধ্যের জন্যই রঙ্গালয়ে দুজন একত্রিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ খুশি হয়ে তাঁর নাটক ও নাট্যরূপগুলি শিশিরকে অভিনয় করতে দিয়েছেন। আবার শিশিরও অনেক পরিশ্রমে রবীন্দ্রনাথের নাটক বা নাট্যরূপগুলি অভিনয় করেছেন। কিন্তু তাঁর অন্য প্রযোজনার তুলনায় তা খুবই স্বল্প। ‘রক্তকরবী’, ‘বাঁশরী’ নাটকের অভিনয়ের অনুমতি রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দিয়েছিলেন। সেগুলিও করা হয়নি। ‘চিরকুমারসভা’ বা ‘শেষরক্ষা’ ছাড়া কোনোটিই সাফল্যলাভ করেনি, বরং প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল। শেষের দিকে, রবীন্দ্রনাথ শিশির ভাদুড়ির ওপর আগের মতো ভরসা রাখতে পারেননি। শিশির যে সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রচলিত আবেষ্টনীর বাইরে যেতে পারছেন না—তা রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন। তাই নিজের নাটকের অভিনয় ছাড়া তিনি শিশির প্রযোজিত অন্য নাটক আর দেখতে যাননি। এমন কি ‘যোগাযোগে’র অভিনয়ও দেখতে গেছেন মনে কুণ্ঠা নিয়ে।
রবীন্দ্রনাথের নাটককে শিশির ভাদুড়ি কিছু বোদ্ধা দর্শকের রসিক-মনের কাছে গ্রহণীয় করে তুললেও, সাধারণ রঙ্গালয়ের দর্শকের কাছে আদরণীয় করে তুলতে পারেননি। অথচ অন্যান্য কতো নাট্যকারের কতো নাটকে তিনি অসামান্য জনপ্রিয়তা ও সাফল্য একসঙ্গে লাভ করেছেন, সেখানে সুধী দর্শকেরও সাধুবাদ পেয়েছেন।
শিশির ভাদুড়ির ‘যোগাযোগ’ অভিনয়ের পাঁচদিন আগেই পার্শ্ববর্তী নাট্যনিকেতন রঙ্গালয়ে ‘গোরা’র অভিনয় অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। প্রথম অভিনয়: ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৩৬। নাট্যরূপ দেন নরেশ মিত্র এবং পরিচালনা তারই। ভূমিকালিপি: আনন্দময়ী—রাজলক্ষ্মী। বরদাসুন্দরী—মনোরমা। সুচরিতা—শান্তি গুপ্তা। ললিতা—চারুবালা। পরেশ—অহীন্দ্র চৌধুরী। পানুবাবু—নরেশ মিত্র। গোরা—ভূমেন রায়। বিনয়—জহর গাঙ্গুলি। মহিম—রবি রায়।
১৯৪১-এ রবীন্দ্রনাথের মৃত্য পর্যন্ত আর কোনো নতুন নাটক বা নাট্যরূপের অভিনয় সাধারণ রঙ্গালয়ে হয়নি। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে স্টার ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসের নাট্যরূপের প্রথম অভিনয় করে ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ৭ মে। নাট্যরূপ: মহেন্দ্র গুপ্ত, পরিচালনাও তারই। মহেন্দ্র গুপ্ত (রমেশ), ফিরোজাবালা (কমলা) মুখ্য দুটি চরিত্রে অভিনয় করেন। তাছাড়া সন্তোষ সিংহ, পঞ্চানন ভট্টাচার্য, বন্দনা, সুহাসিনী অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন। ‘নৌকাডুবি’ বেশিদিন স্টারে চলেনি।
তারপরে নতুন বলতে স্টার নামায় ‘কাবুলিওয়ালা’। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গল্পের নাট্যরূপ দেন দেবনারায়ণ গুপ্ত। রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীর বছরে (১০ মে, ১৯৬১) প্রথম অভিনয় হয়। এদিন একই সঙ্গে পূর্ব অভিনীত রবীন্দ্রনাথের মুক্তির উপায় গল্পের নাট্যরূপটিও স্টারে অভিনীত হয়। কাবুলিওয়ালায় অনবদ্য অভিনয় করেন ছবি বিশ্বাস (কাবুলিওয়ালা)। অন্যান্য চরিত্রে অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় (মিনির বাবা), অপর্ণা দেবী (মিনির মা), মালা বাগ (মিনি ছোট), মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় (মিনি বড়), প্রেমাংশু বোস (ভোলা), সুখেন দাস (পাঁচু), শ্যাম লাহা (জগন্নাথ) মানানসই অভিনয় করেন।
‘মুক্তির উপায়’ অভিনয়ে ছিলেন, কমল মিত্র (গুরু), শ্যাম লাহা (বলদেও), ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় (ফকির), অনুপকুমার (মাখন), তুলসী চক্রবর্তী (ষষ্ঠিচরণ), সুখেন দাস (চরণ দাস), লিলি চক্রবর্তী (হৈম), গীতা দে (পুষ্পবালা) প্রমুখ।
১৯৩৬-এ ‘গোরা’ ও ‘যোগাযোগ’-এর পরে একযুগ রবীন্দ্রনাথের কোনো নতুন নাটক সাধারণ মঞ্চে অভিনীত হয়নি। ১৯৬১-তে শতবার্ষিকীর বছরেই সাধারণ রঙ্গালয়ে রবীন্দ্রনাথের নাটকের মোটামুটি শেষ অভিনয়। মাঝে ১৯৯০-এর দশকে রঙ্গনা থিয়েটার রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবি উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়ে ‘কি বিভ্রাট’ নামে ও নানা মজাদার ঘটনার সন্নিবেশে কিছুদিন অভিনয় চালাবার চেষ্টা করেছিল। এবং সাফল্য লাভ-ও করতে পেরেছিল, অন্তত দর্শক আকর্ষণের দিক দিয়ে। তারপরে আজ পর্যন্ত (জানুয়ারি, ২০০৩) কোনো বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়ে পেশাদারিভাবে রবীন্দ্রনাথের নাটক বা নাট্যরূপের অভিনয় হয়নি।
১৯ শতকের শেষ দিকে বেশ জনপ্রিয় রবীন্দ্র নাটক বিশ শতকে আর লেখা হলো না। রঙ্গালয় তখন রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস, ছোটগল্প, ব্যঙ্গ নাটিকা এগুলিকেই রূপান্তরিত করে অভিনয় করতে লাগল। নাটকের মধ্যে হাল্কা কমেডি জাতীয় শেষ রক্ষা, চিরকুমার সভা, নাচ গান ও মজায় সহজ সাফল্য লাভ করল। ছোটগল্পের ছোট নাট্যরূপ অন্য নাটকের সঙ্গে একই রাতে অভিনয় করা হলো। এইভাবে অর্ধেন্দুশেখর, অমরেন্দ্রনাথ, অপরেশচন্দ্র ও শিশিরকুমারের চেষ্টায় রবীন্দ্র নাটক ও নাট্যরূপের অভিনয় চলল। ১৯১৩-তে নোবেল পুরস্কারের খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে সাধারণ রঙ্গালয় রবীন্দ্রনাথের নাটকের অভিনয় করতে চেয়েছে। কিন্তু রূপক-সাংকেতিক ছাড়া অন্য তেমন কোনাে সাধারণ রঙ্গালয়ের উপযোগী নাটক তারা পায়নি। তাই বাধ্য হয়েই গল্প উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়ে তাদের মতো অভিনয় করেছে। দেখা যাচ্ছে, সাধারণ রঙ্গালয় রবীন্দ্র নাটক থেকে একেবারে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি, আবার রবীন্দ্রনাথও সাধারণ রঙ্গালয়ে তার নাটক অভিনয়ে কোনোরকম আপত্তি করেননি। বরং অনেকক্ষেত্রে সাহায্যই করেছেন, পরিবর্তন মেনে নিয়েছেন, নিজে পরিবর্তন করে দিয়েছেন, অভিনয় দেখতে গেছেন, প্রশংসাসূচক অভিনন্দনও জানিয়েছেন। নাট্যরূপ ধরলে রবীন্দ্রনাটক খুবই অল্প হয়েছে রঙ্গালয়ে একথা যেমন মানা যায় না, তেমনি রবীন্দ্রনাথ সাধারণ রঙ্গালয় থেকে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন একথাও মানা যায় না। তবে সাধারণ রঙ্গালয়ের পরিবেশ, তাদের উপস্থাপনার বিশেষ কৌশল, বাণিজ্যিক থিয়েটারের মনোবৃত্তি ও দর্শকের সাধারণ মানরবীন্দ্রনাথের পছন্দসই ছিল না। তাই তিনি কোনোদিনই সাধারণ রঙ্গালয়ের সঙ্গে যুক্ত থেকে, তাদের মতো অভিনয়যোগ্য নাট্যরচনা করেননি। অনুরোধে উপরোধে নাট্যরূপ দিয়ে দিয়েছেন মাত্র, অভিনয়ের সম্মতিও দিয়েছেন, কিন্তু কখনোই কোনোদিন মানসিক সাজুয্য পাননি। তবে তিনি চেয়েছিলেন, তার নাটক সাধারণ রঙ্গালয়ে অভিনীত হোক তবে তার নিজের রুচি ও রসবোধের কাছাকাছি হোক। অথচ তিনি স্বয়ং কিছুতেই সাধারণ রঙ্গালয়ের সঙ্গে যুক্ত হলেন না। তা হলে, গ্যয়টে, শেক্সপীয়র, চেক, হাউপ্টম্যান, বার্নার্ড শ, মায়ারহোল্ড, ইবসেন, আর্থার মিলার প্রমুখ নাট্যকারদের মতো সে এক অনন্য ঐতিহাসিক সংযোগ স্থাপিত হতো।
অথচ সাধারণ রঙ্গালয়ের বাইরে থেকে ‘শারদোৎসব’ এবং তারপর যেসব নাটক লিখতে লাগলেন, সেখানে অভিনীত নাটকের একশো যোজন দূরে সেগুলির অবস্থান।
১৮৮৬ থেকে ১৯৬১ এই পঁচাত্তর বছরে সাধারণ রঙ্গালয়ে ২৭টি নাটক/নাট্যরূপের অভিনয় ১৪টি রঙ্গালয় নতুনভাবে কিংবা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অভিনয় করেছে। রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখা ৪১টি নাটকের বেশিরভাগই অভিনীত হয়নি। অতি সাধারণ হাল্কা প্রহসন, ব্যঙ্গকৌতুক এবং সাধারণ ছোটগল্পের এবং উপন্যাসের নাট্যরূপ অভিনীত হয়েছে। নাটক বলতে, রাজা ও রানী, বিসর্জন, শেষরক্ষা, তপতী, চিরকুমার সভা, ছোট আকারের মুকুট কিংবা গৃহপ্রবেশ। তাই পুরোপুরি রবীন্দ্রনাথ সাধারণ রঙ্গালয়ে গৃহীত না হওয়ার কয়েকটি কারণ—
- সাধারণ রঙ্গালয়ের দর্শক রবীন্দ্ৰনাটক গ্রহণের উপযুক্তভাবে তৈরী হয়নি। ফলে বেশিরভাগই সাফল্যলাভ করেনি।
- বহির্ঘটনাপ্রধান, হাল্কা রঙ্গরস এবং নৃত্যগীতে ভরা তদানীন্ত নাটকগুলির সঙ্গে রবীন্দ্রনাটকের কোনো মিল ছিল না।
- রবীন্দ্র নাটক উপস্থাপনার যে পরিশীলিত দক্ষতা প্রয়োজন-সে দক্ষতা বা নিষ্ঠা এবং সময় (তখন মঞ্চে তাড়াতাড়ি নাটক নামাতে হতো) কোনো রঙ্গালয়েরই ছিল না। তার নাটকের যথার্থ মুল্য তাই স্বীকৃত হয়নি।
- রবীন্দ্র নাটক অভিনয়ের উপযুক্ত নির্দেশক বা অভিনেতা-অভিনেত্রী তখনো তৈরী হয়নি। চরিত্রের অন্তর্মুখিনতা ফোটাবার দক্ষতা, বিশেষ করে নারী চরিত্রের, সকলের ছিল না। অভিনয়ের ব্যর্থতার দায় নাট্যকারের উপর পড়েছে। রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত তার বিশ্বাসভাজন শিশিরকুমারের উপর ভরসা রাখতে পারেননি। অন্যদের কথা তো, বলাই বাহুল্য।
- সাধারণ রঙ্গালয়ের মঞ্চব্যবস্থা ও পরিবেষ্টনী রবীন্দ্রনাথের জানা ছিল না। রবীন্দ্রনাথের নিজের থিয়েটার পরিমণ্ডলের উপযোগী নাটকগুলির অভিনয় সাধারণ রঙ্গালয়ে করতে তাই অসুবিধে হতো। অনেক পরিবর্তনের প্রয়োজন হতো। পৃথিবীর অন্য শ্রেষ্ঠ নাট্যকারদের মতো রবীন্দ্রনাথ যদি সাধারণ রঙ্গালয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে পারতেন, তাহলে রবীন্দ্রনাথের মানসজগৎ ও থিয়েটারের আবেষ্টনী উভয়ে মিলে বাংলায় অসাধারণ নাটকের সৃষ্টি হতে পারত। তার নিজের থিয়েটারের অভিনয় তাঁর নিজের পরিমণ্ডলেই সীমাবদ্ধ ছিল, বৃহত্তর জনমানসে কোনো সাড়া ফেলতে পারেনি।
- বাংলা নাটক ও অভিনয় মঞ্চকে ধরে এগিয়েছে এবং বাণিজ্যিক থিয়েটারের ব্যবস্থার মধ্যেই লিখিত ও অভিনীত হয়েছে। রবীন্দ্র নাটক শৌখিনভাবে অভিনয়ের প্রেরণাতেই রচিত। সাধারণ রঙ্গালয়ের বিষয়বস্তু, ভাবধারা ও প্রয়োগব্যবস্থার কোনোটার সঙ্গেই রবীন্দ্রমানসের যোগ ছিল না।
- প্রথম যুগ ছাড়া পরবর্তীকালে কোনো নাটকই (চিরকুমার সভা ও শেষরক্ষা বাদে) তেমন সাফল্য পায়নি। ব্যর্থতার আর্থিক দায়িত্বের কারণে অনেক মঞ্চমালিকই রবীন্দ্র নাটকের অভিনয় করতে চাননি। যারা করেছেন (অমর দত্ত, অপরেশচন্দ্র, শিশিরকুমার এবং অর্ধেন্দুশেখর) তারাও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ব্যক্তিগত অনুরাগে করেছেন এবং বিশ্বখ্যাতি পাওয়ার পর (১৯১৩) অনেকে তার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছিলেন।
- প্রথম যুগ থেকেই রবীন্দ্রসাহিত্যকে দুর্নীতি ও অশ্লীলতার দায়ে পড়তে হয়েছে। তাঁর নাটকও এর থেকে মুক্ত নয় বলে অনেকের ধারণা ছিল, তাই সে যুগের অমৃতলাল বসু বা গিরিশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের কোনো নাটকের অভিনয় তাদের থাকাকালীন মঞ্চে অভিনীত হোক, তা চাননি।
- রবীন্দ্র নাটকের ভাষা ও সংলাপ এবং ভাবভঙ্গির মধ্যে সে যুগে অনেকেই ‘মেয়েলিপনা’ ও ‘ন্যাকামি লক্ষ করেছেন, পৌরুষ ভাবের অভাব ছিল বেশি বলে নাটক ও রবীন্দ্র অনুরাগীদের ব্যঙ্গ করা হতো। সে যুগের থিয়েটারে দর্শকেরা অভিনয়ের পৌরুষ ও দাপট পছন্দ করতো বেশি।
- রক্ষণশীল, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও ধর্মান্ধ থিয়েটারে উদার উন্মুক্ত মানবতাবাদের রবীন্দ্র নাটক গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। রবীন্দ্র জীবনাদর্শের বিরোধী অনেকেই ছিলেন।
- জীবনাবেগের অভাব এবং কৃত্রিমতা রবীন্দ্র নাটকে বর্তমান-সাধারণ রঙ্গালয় তার বিপরীত ছিল।
- দেবনারায়ণ গুপ্তের মতে (দীর্ঘকাল স্টার থিয়েটারের মঞ্চাধ্যক্ষ, পরিচালক ও নাট্যকাররূপে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতায় বলেন)—‘‘জীবনটাকে সাধারণভাবে দেখা আর জীবনদর্শন উপলব্ধি করা এক কথা নয়। সাধারণ রঙ্গালয়ের দর্শকেরা জীবনটাকে দেখতে এসেছেন, জীবনদর্শনের আস্বাদ গ্রহণ করতে আসেননি বলেই, সাধারণ রঙ্গালয়ে রবীন্দ্রচর্চা ব্যর্থ হয়েছে।’’
- প্রখ্যাত নট ও সেযুগের নাট্য পরিচালক অহীন্দ্র চৌধুরীর মত—‘‘আমি মনে করি তাঁর (রবীন্দ্রনাথ) নাটকের অভিনয় বিশ্বকবির বিশেষভাবে পরিকল্পিত রঙ্গমঞ্চ ছাড়া অন্য কোথাও হতে পারে না।’’ (বাঙালির নাট্যচর্চা)
- রবীন্দ্র সমালোচক অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশীর রবীন্দ্র নাটকের অভিনয় যোগ্যতা সম্বন্ধে মত—‘‘তাঁর নাটক এতই সূক্ষ্ম বায়বীয় ব্যাপার যে, মঞ্চে রূপ নেবার মতন ওজন ও নির্দিষ্ট রেখার বন্ধন সেগুলির কোনদিনই হবে না।…দেশে যতই শিক্ষা বিস্তারিত হোক, রুচির যতই উন্নতি হোক, রবীন্দ্র নাটক কখনো সাধারণ রঙ্গমঞ্চের বস্তু হইয়া উঠিবে না।’’ (রবীন্দ্রনাট্য প্রবাহ)।
- রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মত—‘‘রবীন্দ্রনাথের নাটক যতটা পাঠযোগ্য ততখানি অভিনয়যোগ্য নয়, আসলে মঞ্চসাফল্যের গৈরিশী নৈপুণ্য রবীন্দ্রনাথের আয়ত্ত ছিল না—রবীন্দ্রনাথ নিজেও এই ত্রুটি সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন। তাই ক্রমশ তিনি তার নাটকগুলিকে ঘটনামুখ্যতা থেকে ভাবধর্মিতারদিকে অগ্রসর করে নিয়েছেন।’’ (স্বাধীনতা পত্রিকা, ৪-১২-১৯৬০)।
- বাংলা থিয়েটারের উদ্ভব ও বিকাশ বিলিতি থিয়েটারের প্রভাবে। বাংলা নাটকের বিবর্তনও সেই মঞ্চব্যবস্থার মধ্যেই হয়েছে। তাই এদেশের থিয়েটার ও নাটক ইংলন্ডের মঞ্চব্যবস্থা ও নাট্যরচনা থেকে এসেছে। বাংলা দেশজ প্রাণের সঙ্গে কোনো যোগ গড়ে ওঠেনি। তার ওপরে বাণিজ্যিক থিয়েটারে অভিনয় সাফল্য মানেই দর্শক আনুকূল্য বোঝায়। সাধারণ রঙ্গালয় এই সব ভাবনার পরিমণ্ডলেই ঘুরপাক খেয়েছে। দেশীয় রীতি ও ভাবনা থেকে দূরে সরে থেকে বাংলা নাটক ও মঞ্চের কোনো বিস্তৃতি ঘটেনি। একই গলিপথে ঘুরে পথ হারিয়েছে। কেউ, এমনকি শিশিরকুমার পর্যন্ত তাই মুক্তি পাননি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ প্রথম দিকে বিদেশী থিয়েটার ও নাটকের প্রভাবে থাকলেও ক্রমে তা কাটিয়ে দেশজ রীতি, রূপ, আঙ্গিক, ভাষা ও প্রকাশের ভাব ও রূপাঙ্গিককেই গ্রহণ করেছিলেন। নিজের থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথ নিজের নাটকের সেই রূপাঙ্গিককেই ধরতে চেয়েছিলেন। বিলিতি থিয়েটারের নকলে গঠিত নাটক ও মঞ্চের ধারণা থেকে তা অনেক ভিন্ন ও স্বপ্রতিষ্ঠ। সাধারণ রঙ্গালয় অন্ধভাবে নিজের গণ্ডীতেই পথ হাতড়েছে—সম্মুখে উপস্থিত ভাস্বর আলোকবর্তিকা উপলব্ধি করার প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা তাদের ছিল না।
- স্তানিস্লাভস্কি যেমন সাধারণ রঙ্গালয়ের দর্শককে তৈরি করে নিতে নিতে ‘চেকভে’র নাটক জনপ্রিয় করেছিলেন, বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়ে সেরকম কোনো রবীন্দ্র-প্রযোজক আসেনি। শিশিরকুমারের ক্ষমতা থাকলেও তিনি সাধারণ রঙ্গালয়ের ব্যবস্থাতেই নিজেকে হারিয়ে ফেললেন। শিশিরকুমারের মন্তব্য—‘‘আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য, আমাদের রঙ্গমঞ্চের দুর্ভাগ্য, সাধারণ রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধ ঘনিষ্ঠভাবে গড়ে উঠল না।’’
- বিংশ শতাব্দীর শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাটক প্রযোজনার অনীহা প্রসঙ্গে প্রখ্যাত নাট্য পরিচালক ও অভিনেতা শ্ৰী বিভাস চক্রবর্তী মনে করেন—‘‘ক. রবীন্দ্রনাথের সব নাটকই দারুণ ভালো বলা চলে না। কয়েকটি নাটক অত্যন্ত সাধারণ স্তরের, কয়েকটি বড়ো বেশি ছকে বাঁধা, কয়েকটি কোন বিশেষ উপলক্ষে রচিত। খ. ‘আইডিয়ার স্তরে যখন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেন, তখন উভয়পক্ষকে সমানভাবে তুলে ধরতে পারেন না তিনি। তাই বিসর্জনের প্রতিটি প্রযোজনায় রঘুপতিরা ব্যর্থ হন (বিশেষ ক্ষেত্রে সীমিত ক্ষমতার অভিনেতাদের কথা বাদ দিলেও)। গ. রবীন্দ্রনাথের বেশিরভাগ চরিত্রকে আপাতভাবে বাস্তব বলে মনে হয় না, বিশেষ করে তারা যখন রবীন্দ্রনাথের ভাষায় কথা বলে, নিজের ভাষায় নয়। [বিভাস : ব্যক্তিগত ও শিল্পগত)। আবার বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্য প্রযোজক ও পরিচালক উৎপল দত্তের মত অন্য কথা বলে—‘‘রবীন্দ্রনাথ জীবিত অবস্থায়ই জনপ্রিয় নাট্যকার হিসেবে জনতার প্রণাম কুড়িয়ে গেছেন। ভালো নাটক মাত্রেই একাধারে মঞ্চ সচেতন এবং সাহিত্য সচেতন। সেই মঞ্চসাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে রবীন্দ্রনাথে। মাইকেলের কৃষ্ণকুমারীতে ওর শুরু; ক্ষীরোদপ্রসাদে ওর পুষ্টি; রবীন্দ্রনাথে ওরচরম বিকাশ।’’ (চায়ের ধোঁয়া)।
- রবীন্দ্রনাথই রবীন্দ্র নাটকের শ্রেষ্ঠ প্রযোজক—কিন্তু সে স্বতন্ত্র ইতিহাস।
রবীন্দ্রনাথের থিয়েটার
(রবীন্দ্রনাথের থিয়েটার অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব থিয়েটার। নিজের লেখা। নাটক রবীন্দ্রনাথ নিজেই প্রযোজনা করছেন যেখানে, সেটাই রবীন্দ্রনাথের থিয়েটার। এই থিয়েটারের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাট্যভাবনা এবং থিয়েটার ভাবনার যুগ্ম পরিচয় পাওয়া যাবে। বাংলা নাট্যাভিনয়ের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের থিয়েটার একটি ব্যতিক্রমী প্রয়াস।)
রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) যখন নাটক লেখা শুরু করেন তখন বাংলা থিয়েটারে পেশাদারি-নাট্যশালার যুগ চলছে। থিয়েটারের ইতিহাসে যাকে পাবলিক থিয়েটার বা সাধারণ রঙ্গালয় বলা হয়ে থাকে। গিরিশচন্দ্র, অর্ধেন্দুশেখর, অমৃতলাল, কেদার চৌধুরী প্রভৃতির নেতৃত্বে সাধারণ রঙ্গালয়ের সে বেগবান যুগে একের পর এক থিয়েটার গড়ে উঠছে, নানা ধরনের নাট্যাভিনয় চলেছে। অভিনয়ে নাচে গানে বাংলা থিয়েটার তখন মাতোয়ারা।
রবীন্দ্রনাথের বাড়ির অনতিদূরে অবস্থিত এইসব নাট্যশালাগুলির সঙ্গে তাঁর কোনো প্রত্যক্ষ যোগ ছিল না। বরং বলা যেতে পারে, তাদের ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক মঞ্চ ও অভিনয়ধারাই তাঁকে নাটক লিখতে ও অভিনয় করতে অনুপ্রাণিত করেছিল।
রবীন্দ্রনাথের বাল্যকালে তাদের বাড়িতেই নাটকের একটা আবহাওয়া তৈরি হয়েছিল। শিশুকালে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘জোড়াসাঁকো নাট্যশালা’, বাড়ির লোকজনের উদ্যোগে। ১৮৬৫ থেকেই সেখানে নাট্যাভিনয় শুরু হয়েছিল। ধনী বাঙালি বাড়ির সখের নাট্যশালাগুলির মতো জৌলুষ ও জাঁকজমক দেখানোর চেয়ে এখানে পাশ্চাত্য ও ভারতীয় নাট্যরীতি এবং দেশজ নাট্যকলার ভাবনা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার একটা প্রয়াস ছিল। তারও অনেক আগে, পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর সাহেবদের থিয়েটারের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত ছিলেন, একসময়ে মালিকানাও গ্রহণ করেছিলেন। পিতা দেবেন্দ্রনাথ সঙ্গীত ও নাটকে অনুরাগী ছিলেন। আত্মীয় পাশের বাড়ির গনেন্দ্রনাথ, গুনেন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ অভিনয়ে উৎসাহী ছিলেন। নতুনদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সঙ্গীত ও নাটকে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। দিদি স্বর্ণকুমারীরও অনুপ্রেরণা ছিল। পারিবারিক উত্তরাধিকার এবং সমসাময়িক পরিবেশ তাকে নাট্যরচনা, প্রযোজনা এবং অভিনয়ে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
রবীন্দ্র প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাথের থিয়েটারকে তিনটি পর্বে ভাগ করে নেওয়া যায়। নাট্যরচনা শুরু করা থেকে প্রথম একুশ বছর (১৮৮১-১৯০১) তাঁর কলকাতার প্রথম পর্বে দুটি ভাগ—১) জোড়াসাঁকো বাড়ির থিয়েটার পর্ব। (২) সঙ্গীত-সমাজের থিয়েটার-পর্ব। তারপরে ১৯০১ থেকে ১৯১৫ পর্যন্ত দ্বিতীয়, শান্তিনিকেতন পর্ব। পরবর্তী ২৫ বছর তৃতীয়, মিশ্রপর্ব—কখনো কলকাতায়, কখনো শান্তিনিকেতনে।
ঠাকুরবাড়ির অভিনয় হতো তিনতলার ছাদে, প্রাঙ্গণে এবং বিচিত্রা ভবনে। কোনো কোনো অভিনয় হয়েছে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কলকাতা পার্ক স্ট্রিটের বিরজিতলার বাড়িতে। সঙ্গীত সমাজের সদস্যদের অভিনয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রায় দশ বছর নাটক লেখা, অভিনয় করা এবং নাট্য পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন। শান্তিনিকেতনে তার কর্মজীবনে অভিনয় হত কখনো খোলা আকাশের নিচে মুক্ত প্রাঙ্গণে, কখনো নাট্যঘরের মেঝেতে। আবার শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় এসে অভিনয় করতেন কখনো বাড়িতে, কখননা সাধারণ রঙ্গালয় ভাড়া নিয়ে।
বাড়ির থিয়েটারে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবেরাই অভিনয় ও প্রযােজনায় নানা বিষয়ে অংশ নিতেন। সঙ্গীত সমাজের ক্ষেত্রে তার সদস্যেরাই বেশি ছিলেন। শান্তিনিকেতনে তার ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক এবং পরিচিত কেউ কেউ অভিনয় করতেন। শেষ পর্বে কলকাতায় এসে অভিনয়ের সময়ে শান্তিনিকেতন দলের সঙ্গে কলকাতায় পরিচিত কেউ কেউ মিশে অভিনয় করতো। তবে সব প্রযোজনারই মূলে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁরই নাটক, পরিচালনা তাঁরই, এবং বহুক্ষেত্রে প্রধান অভিনেতা তিনিই। শিশিরবাবু (শিশির ভাদুড়ি) একাধিকবার বলেন যে; রবীন্দ্রনাথই তার মতে দেশের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। (ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়—মনে এলো)
রবীন্দ্রনাথের থিয়েটার সাধারণ রঙ্গালয়ের মতো পেশাদারি বা ব্যবসায়িক ছিল না। বেশির ভাগই বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন জ্ঞানীগুণী মানুষের সমাবেশে অভিনয় করা হয়েছে। দর্শকের সবাই আমন্ত্রিত। শান্তিনিকেতনেও ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, শুভানুধ্যায়ী এবং অন্য বিদ্বজ্জনের উপস্থিতিতেই মঞ্চস্থ হয়েছে। টিকিট বিক্রি করে যখন অভিনয় করেছেন, সে অর্থ থিয়েটারের ব্যবসায়ের জন্য নয়, কোনোনা-কোনো ব্যাপারে সাহায্য হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে। তা শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের উন্নতি বা দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মানুষজনের সাহায্য, যেভাবেই হোক। আর অভিনেতা-অভিনেত্রী বা অন্য সাহায্যকারীবৃন্দ সকলেই নাটকের প্রতি আগ্রহে ও উৎসাহে কাজ করেছে, অর্থকরী লাভালাভের প্রসঙ্গই সেখানে নেই।
রবীন্দ্রনাথের থিয়েটার পেশাদারি থিয়েটারের মতো যেমন পরিচালিত হয়নি, তেমনি তদানীন্তন শৌখিন নাট্যাভিনয়ের মতোও এগুলি ছিল না। ধারাবাহিকতাহীন, স্বল্পস্থায়ী শখ-শৌখিনতার এই নাট্যাভিনয়গুলির সঙ্গে রবীন্দ্র প্রযোজনার সাযুজ্য ছিল না। রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ ষাট বৎসর ধরে তার থিয়েটারের প্রযোজনা চলেছে, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে এবং ‘ভীষণ সীরিয়াস’ রবীন্দ্রনাথের নাটকের যাবতীয় সৃষ্টি ও বিকাশ তাঁর থিয়েটারের মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠেছিল। বিস্তৃত ও অসামান্য নাট্যজীবনের পরীক্ষাগার ছিল তাঁর নিজস্ব থিয়েটার। রবীন্দ্রনাথের থিয়েটার।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে, রবীন্দ্রনাথের কিছু নাটক বা গল্প উপন্যাসের নাট্যরূপ সাধারণ পেশাদারি রঙ্গালয়েও অভিনীত হয়েছিল। কখনো সেখানে তিনি বাইরে থেকে সাহায্য করেছেন। কিন্তু কোনোটার সঙ্গেই তিনি নিজস্বভাবে বা পেশাদারিভাবে যুক্ত ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের থিয়েটার আলোচনা প্রসঙ্গে সেগুলির আলোচনার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
প্রথম পর্ব: বাড়ির থিয়েটার
রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিককার নাট্যাভিনয়ের হাতেখড়ি তার বাড়ির অভিনয়েই। অন্য কারো লেখা নাটকের অভিনয়ের মধ্যে দিয়েই তার নাট্যজীবনের শুভারম্ভ।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের লেখা ‘এমন কর্ম আর করব না’ প্রহসনে, ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে অলীকবাবুর ভূমিকায়। সাহেব চিত্রকর দিয়ে ‘সীন আঁকিয়ে’ এই নাটকের অভিনয় হয়। রবীন্দ্রনাথ প্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ চরিত্রে অভিনয় করলেন এবং খুবই প্রশংসিত হলেন। অলীকবাবুর চরিত্রেই তার মঞ্চে প্রথম অভিনয় বলে রবীন্দ্রনাথ নিজেই স্বীকার করেছেন।
অনেকে মানময়ী গীতিনাট্যের ঘরোয়া অনুষ্ঠানে মদনের চরিত্রে অভিনয়কেই তাঁর প্রথম অভিনয় হলে অনুমান করেছেন। কিন্তু মানময়ী অভিনয় হয়েছিল ১৮৮০-তে। তাহলে, ১৮৭৭-এর অভিনীত ‘এমন কর্ম আর করব না’-কেই রবীন্দ্রনাথের অভিনয়ের হাতেখড়ি বলা যায়।
কেউ কেউ মানময়ীকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের যৌথ রচনা বলে উল্লেখ করেছেন। অনেকে আবার এই রচনায় অক্ষয় চৌধুরীর হাত আছে বলে মনে করেন। প্রশান্তকুমার পাল (রবিজীবনী-২) সর্বশেষ অনুমান করেছেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সুরে কথা বসিয়ে গীতিনাট্যটি বস্তুত অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর লেখা। তবে আখ্যাপত্রে রচয়িতা হিসেবে কারো নাম নেই, একথা মনে রাখতে হবে। এই গীতিনাট্যের ৭টি গানের মধ্যে ৩টি রবীন্দ্রনাথের রচনা। তার মধ্যে রবীন্দ্ররচিত শেষ গানটি (আয় তবে সহচরী) উল্লেখওগ্য। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই গীতিনাট্যে বসন্তের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
মানময়ীর পরিবর্তিত রূপ পুনর্বসন্ত। তাতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ৪টি এবং রবীন্দ্রনাথের ২১টি গান সংযোজিত হয়। অনেক পরে সঙ্গীত সমাজে অভিনীত হয়েছিল, ২৩ ডিসেম্বর, ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে।
বিবাহ উৎসব নামে গীতিনাট্যে রবীন্দ্রনাথ এক নারীর ভূমিকায় নেমে গান গাইতেন।
একেবারে নিজের নাটক, নিজের পরিচালনায় এবং নিজের অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ থিয়েটারে প্রথম অবতীর্ণ হলেন বাল্মীকি প্রতিভায়, ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ফেব্রুয়ারি। বিদ্বজ্জন সমাগম সভার (প্রতিষ্ঠা: ১৮ এপ্রিল, ১৮৭৪) বার্ষিক অভিনয় উপলক্ষে জোড়াসাঁকোর মহর্ষি ভবনের তেতলার ছাদে পাল খাটিয়ে।
স্টেজ বেঁধে, জ্ঞানীগুণী আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের সামনে অভিনয় হয়েছিল। নিজের লেখা গীতিনাট্যের সুরকার ও পরিচালক ছিলেন তিনি নিজেই। বাল্মীকি—রবীন্দ্রনাথ এবং সরস্বতী—প্রতিভা দেবী (ভাইঝি)। রবীন্দ্রনাথ নিজস্ব ভাব-পরিকল্পনায় গীতিনাট্যটির উপস্থাপনা করেছিলেন। তার অভিনয় ও গান এই অভিনয়ের সম্পদ।
‘গানের সূত্রে নাট্যের মালা’ ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ অনেকবার অভিনীত হয়। পরের দিকে রবীন্দ্রনাথ এতে সঙ্গীতের সঙ্গে সক্রিয় অভিনয়ের দিকেও গুরুত্ব দেন। দৃশ্যসজ্জাতেও বাস্তবধর্মিতা ফুটিয়ে তোলা হতো। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ঘরোয়া’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, আয়নার ওপর আলো ফেলে বিদ্যুৎ, টিন বাজিয়ে ও ছাদে ডাম্বেল গড়িয়ে বজ্রের শব্দ আর গাছের ডালপালা সাজিয়ে জঙ্গল করা হয়েছিল।
জনপ্রিয় এই গীতিনাট্যটি পরে আদি ব্রাহ্মসমাজের সাহায্যার্থে ঠাকুর বাড়িতেই অভিনয় করা হয়েছিল দুবার (২০ এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৬)। টিকিট ছিল—৮, ৫, ৪, ৩, ২ টাকা। এই অভিনয় থেকে বেশ কয়েক হাজার টাকা উঠেছিল। এই অভিনয়ের সময়েই প্রথম সংস্করণের অনেক পরিবর্তন করা হয়। ‘কালমৃগয়া’ গীতিনাট্যের অনেকগুলি গান এবং বনদেবীর চরিত্র এখানে গৃহীত হয়।
বোঝা যায়, অভিনয়ের গোড়া থেকেই রবীন্দ্রনাথ নাট্য প্রযোজনার বিষয় নিয়ে ভাবছেন এবং নাটকের পরিবর্তন ও পরিমার্জন করছেন। এবং বলা যায়, নাট্য রচনার ও মার্জনার প্রেরণাই আসছে অভিনয়ের তাগিদ থেকে।
‘কালমৃগয়া’ গীতিনাট্যটিও বিদ্বজ্জন সভার অধিবেশনে তেতলার ছাদে একইভাবে অভিনীত হয়েছিল। ১৮৮২ সালের ২৩ ডিসেম্বর। মূল উদ্যোক্তা ও প্রযোজনার দায়িত্ব রবীন্দ্রনাথের। অভিনয়ে রবীন্দ্রনাথ (অন্ধমুনি), জ্যোতিরিন্দ্রনাথ (দশরথ), ঋতেন্দ্রনাথ (অন্ধমুনির পুত্র), অভিজ্ঞতাদেবী (অন্ধমুনির কন্যা) অংশ নেন। বাল্মীকি প্রতিভার অভিনয় সাফল্যে উৎসাহিত হয়েই কালমৃগয়া রচিত ও অভিনীত হয়।
ঠাকুর বাড়ির ছেলেদের সঙ্গে মেয়েরাও অভিনয়ে মেতে ওঠে। দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘মহিলা সমিতি’র অভিনয়ের জন্য-রবীন্দ্রনাথ ‘মায়ার খেলা’ গীতিনাট্য লিখেছেন। মহিলা সমিতি ও ঠাকুর বাড়ির মেয়েরা একসঙ্গে অভিনয় করে বেথুন কলেজে, ১৮৮৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। শুধুমাত্র মেয়েরাই অভিনয় করবে বলে গীতিনাট্যটি সেইভাবে লেখা। পরিচালনায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘মায়ার খেলা’ পরে নানান স্থানে অভিনয় করা হয়। একবার অভিনয়ে বসন্ত ও মদন সেজে রবীন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ গান গেয়ে মাতিয়ে দিয়েছিলেন। ‘ভারতী’ পত্রিকার সাহায্যের জন্যও গীতিনাট্যটি বিরজিতলার বাড়িতে মঞ্চস্থ করে প্রাপ্ত টাকা পত্রিকাকে দেওয়া হয়।
‘রাজা ও রানী’ প্রথম অভিনয় করলেন ১৮৯০, (আশ্বিন, ১২৯৬) সালে, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরজিতলার বাড়ির প্রশস্ত বারান্দায়, রীতিমতো মঞ্চ তৈরি করে। অভিনয় করেন: রবীন্দ্রনাথ—বিক্রমদেব। জ্ঞানদানন্দিনী—সুমিত্রা। সত্যেন্দ্রনাথ—দেবদত্ত। মৃণালিনী—নারায়ণী। প্রমথ চৌধুরী—কুমারসেন। নীতিন্দ্রনাথ—সেনাপতি। অবনীন্দ্রনাথ নিয়েছিলেন ছোট ছোট ছয়টি ভূমিকা।
সে যুগে এইভাবে বাড়ির মেয়েদের নিয়ে, বিশেষ করে দেওর-বৌদি, ভাসুর-ভাদ্রবৌ, অভিনয় করাতে ব্যঙ্গবিদ্রুপ ও সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। সাধারণ রঙ্গালয়ে ১৮৭৩-এই অভিনেত্রীরা এসে গেছেন, কিন্তু ভদ্রঘরের মেয়েরা এইভাবে প্রকাশ্যে অভিনয় করছে, এটা মেনে নিতে পারেনি অনেকেই। অবশ্য এই সমালোচনা ঠাকুরবাড়ি বা রবীন্দ্রনাথ কাউকে বিচলিত করেনি। রবীন্দ্রনাথ এর আগে এবং পরেও তার পরিচিত গণ্ডির মেয়েদের নিয়েই সব অভিনয় করে গেছেন। সাধারণ রঙ্গালয়ের অভিনেত্রীদের মুখাপেক্ষি হননি কখনো।
পূর্ণ অভিনেতারূপে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বময় প্রকাশ এই নাটকাভিনয়েই প্রথম দেখা গেল। শেক্সপীয়রের আদলে লেখা এই নাটকে বিষয়বিন্যাস, চরিত্র নির্মাণ ও আঙ্গিক গঠনে প্রবৃত্তির সংঘাত, হৃদয়ের ঘাত-প্রতিঘাত যেভাবে বিন্যস্ত হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ ও অন্যদের অভিনয়ে সেগুলির প্রকাশ সকলকে মুগ্ধ করেছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক জনের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় যে, এমারেল্ড থিয়েটারের নট-নটীরা গোপনে এসে এই অভিনয় দেখে যায়। এমারেল্ডে ‘রাজা ও রানী’র অভিয়ে (প্রথম অভিনয় ৭ জুন, ১৮৯০) ঠাকুরবাড়ির অভিনয়ের পারা, নারীচরিত্রের অভিনয়কৌশল, পোষাক-পরিচ্ছদ অনুকরণ করেছিল। অভিনেত্রী গুলফনহরি (সুমিত্রা) জ্ঞানদানন্দিনীর সাজসজ্জা, বলবার ভঙ্গি অনুকরণ করেছিল। যদিও মূল প্রযোজনায় তফাৎ ছিল অনেক। দৃষ্টিভঙ্গির তফাৎ থাকাটাই স্বাভাবিক।
নাচগানের পালা গীতিনাট্য থেকে সরে এসে রবীন্দ্রনাথ এই প্রথম পূর্ণাঙ্গ ঘটনাবহুল ও দ্বন্দ্বজাত নাটকের প্রযোজনা করলেন। তাঁর পরিচালনার অভিজ্ঞতা, নায়কচরিত্রে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা, পঞ্চাঙ্ক নাটকের দৃশ্যসজ্জা ও পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি সব কিছু নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ নাট্য উপস্থাপনার মানসভঙ্গি গড়ে তুলেছেন।
‘বিসর্জন’ নাটকটির প্রথম অভিনয় হয়েছিল বিরজিতলার বাড়িতে, ১৮৯০ তে। ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ (জয়সিংহের মৃত্যু অবধি ঘটনা অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ নাট্যরূপ দেন, তার নাম হয় ‘বিসর্জন’। গ্রন্থাকারে প্রকাশ হয় ১৫ মে, ১৮৯০।
১৯০২-এর শীতকালে শান্তিনিকেতনে বিসর্জন-এর অভিনয়ের কথা লিখেছেন রথীন্দ্রনাথ। নাট্যঘর তৈরি হয়নি তখনো। তাই বিদ্যালয়ের পেছনে খাবার ঘরে রঙ্গমঞ্চ তৈরি হয়। হ, চ, হ. (হরিশচন্দ্র হালদার) ‘সীন’ এঁকেছিলেন। জগদানন্দ রায় রঘুপতি এবং নয়নমোহন চট্টোপাধ্যায় নক্ষত্রমাণিক্য রূপে অভিনয় করেন। প্রশান্তকুমার পাল (রবিজীবনী-৫) অনুমান করেছেন, এই অভিনয় হয়েছিল ১৯০২-এর পৌষ-উৎসবে আগে কিংবা পরে।
প্রথম অভিনয়ের পর অনেকবার বিসর্জনের অভিনয় হয়, কলকাতার নানা স্থানে, শান্তিনিকেতনে এবং শেষের দিকে এম্পায়ার থিয়েটার ভাড়া নিয়ে (১৯২৩) পর পর তিনরাত্রি।
রবীন্দ্রনাথের পরিচালনায় ‘বিসর্জন’-এর অভিনয় সুসংবদ্ধ রূপলাভ করে। ক্রমে আঁকা সীন তুলে দিয়ে সমতল মঞ্চকে কয়েকটি ধাপে ভাগ করে অভিনয় করতেন। পোষাক পরিচ্ছদের পরিকল্পনাও নতুনভাবে করেছিলেন। প্রথমদিকের অভিনয়ে রঘুপতির ভূমিকায় তিনি নামতেন, জয়সিংহ অরুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর। অনেকের মতেই রঘুপতির ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথের অভিনয় তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয়। ভাবপ্রকাশের ক্ষমতা, তেজোদৃপ্ত কণ্ঠস্বর, উচ্চারণ ভঙ্গি, অনন্যসাধারণ রূপ ও সজ্জা, শোকোচ্ছ্বাসের ভাবাভিব্যক্তি এবং মঞ্চে চলাফেরা-অভিনয়ের নতুন মাত্রা এনে দিয়েছিল।
শান্তিনিকেতনে বিসর্জনের অভিনয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রযোজনা ও পরিচালনার সব দায়িত্ব পালন করলেও, নিজে অভিনয় করেননি। কলকাতার এম্পায়ার মঞ্চে ১৯২৩-এর ২৫, ২৭, ২৮ আগস্টের অভিনয়ে জয়সিংহের চরিত্রে বাষট্টি বছরের রবীন্দ্রনাথ অভিনয় করেন। মেক-আপে বয়স কমানো যায়, কিন্তু অভিনেতার শক্তিতে ও গুণে তিনি শারীরিক পরিবর্তনকে সহজসাধ্য করে তুলেছিলেন। রঘুপতি করেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। অপর্ণা, প্রথম রাতে মঞ্জু ঠাকুর; দ্বিতীয় রাত থেকে রাণু অধিকারী। নতুন যোজিত কিছু গান সাহানা দেবী বিনা সঙ্গতে গেয়েছিলেন। আর গোবিন্দমাণিক্য সেজেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ।
প্রথম অভিনয়ের পর থেকেই রবীন্দ্রনাথ প্রযোজনার স্বার্থে ‘বিসর্জন’ নাটকটির অনেক পরিবর্তন করেন। প্রথমের ২৯টি দৃশ্য ক্রমে ২১ এবং শেষে ১৯টি দৃশ্যে এসে দাঁড়ায়। হাসি ও কেদারেশ্বর এবং অপর্ণার অন্ধ পিতাও বাদ যায়। ধ্রুব ও চাঁদপাল চরিত্রের সংস্কার হয়। শেষ অঙ্কেরও কিছু পরিবর্তন করা হয়।
পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথ কতোখানি পরিপক্ক অভিনেতা হতে পেরেছিলেন তার সাক্ষ্য পাওয়া যাবে সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রবীণ অভিনেতা অমৃতলাল বসুর কথায়। ইন্ডিয়ান ডেইলি নিউজ পত্রিকায় (৪-৯-১৯২৩) বিসর্জনের অভিনয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে লেখেন—‘‘নাটক যতো এগোতে লাগল, আমি—এক ঘাঘী মঞ্চঘোটক—অনুভব করলাম আমি অভিনয়ের শিল্পের বাস্তব শিক্ষা লাভ করছি।’’ সাধারণ রঙ্গালয়ের তুলনায় এই অভিনয় নতুন ধরনের, একেবারে হাল আমলের, সে কথা স্বীকার করে তিনি লিখেছিলেন, এই মহান কবি একজন মহান অভিনেতা, মঞ্চবিজ্ঞান শৈলীর একজন অধিকর্তা।
অহীন্দ্র চৌধুরী থেকে আরম্ভ করে সে যুগের অনেক খ্যাতিমান অভিনেতাও এই অভিনয়ের উচ্চ প্রশংসা করেছেন, ‘প্রথম শ্রেণীর শিল্পী’ বলে তাদের মনে হয়েছে। শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, তার হাতে গড়া অন্য চরিত্রগুলির অভিনয়েরও উচ্চ প্রশংসা করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের প্রযোজনায় অনুপ্রাণিত হয়ে শিশির ভাদুড়ি তাঁর থিয়েটারে বিসর্জন অভিনয় করে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। পরবর্তীকালে শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় ‘বহুরূপী’ গোষ্ঠিও এর অভিনয়ে কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় পর্ব: ভারতীয় সঙ্গীত সমাজ
প্রতিষ্ঠা: ২৭ জানুয়ারি ১৮৯৮। ১৫ মাঘ, ১৩০৪। সম্পাদক জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীতসমাজ ছিল অনেকটা মহারাষ্ট্রের গায়েন সমাজের আদলে তৈরি। অনেকটা বিলিতি ক্লাব ও স্বদেশী বাবুদের বৈঠকখানার মিশ্রণে তৈরি। ঠাকুর বাড়ির অনেকের মতোই রবীন্দ্রনাথ এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর সঙ্গে দশ বৎসর যুক্ত থেকে তিনি বেশ কয়েকটি নাটক রচনা, অভিনয়ের ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনে অভিনয় করেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথেরও বেশ কয়েকটি নাটকও এখানে অভিনীত হয়েছিল।
‘গোড়ায় গলদ’ (প্রকাশ: ৩১ ভাদ্র, ১২৯৯/১৮৯২) খামখেয়ালি সভার তাগিদে লেখা। অভিনীত হয় ১৮৯২ সালে। রবীন্দ্রনাথ পরিচালনা ও অভিনয়ে অংশ নেন। তবে খুব পরিশ্রম করে নাটকটি তৈরি করলেও উচ্চবিত্ত সদস্যদের অনভ্যস্ত অভিনয়ের জন্য নাটকটির প্রযোজনা ভালো হয়নি। চন্দ্রবাবুর ভূমিকাভিনেতা শ্রীশচন্দ্র বসু গান ভালো গাইতে পারতেন না। নাটকের শেষ দৃশ্যে তাই রবীন্দ্রনাথ নিজেই মঞ্চে এসে কিছু সংলাপের সঙ্গে গান গেয়ে সমস্যা সামাল দিতেন।
কারো কারো মতে ‘গোড়ায় গলদ’ অভিনীত হয়েছিল ১৯ জানুয়ারি, ১৯০০ (২২ মাঘ, ১৩০৬) সঙ্গীত সমাজের উদ্যোগে। এই অভিনয় যে উচ্চমানের হয়েছিল অভিনেতা অমৃতলাল বসু তা দ্বিধাহীনভাবে জানিয়েছেন।
তবে এই অভিনয়ের ফলে রবীন্দ্রনাথ গোড়ায় গলদ নাটকে অভিনয়গত ত্রুটিগুলি ধরতে পারেন এবং পরবর্তীকালে ত্রুটিগুলি সংশোধন করার জন্য শিশির ভাদুড়ির অনুরোধমত পরিমার্জনাও করেন। ‘শেষরক্ষা’ নামে সেই পরিবর্তিত নাটকটি শিশির ভাদুড়ি নাট্যমন্দিরে অভিনয়ও করেছিলেন সাফল্যজনকভাবে। অভিনয় করতে গিয়ে নিজের লেখা নাটকের ত্রুটি রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন। পরবর্তীকালে এইভাবে তিনি তাঁর বহু নাটকের অভিনয়যোগ্য রূপ দেবার জন্যই নানা পরিবর্তন করেছিলেন। এই পরিবর্তন কোনো ভাবাবেগের ফলে নয়, একেবারে নাট্য প্রযোজক রবীন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতার উৎসাহেই করা হয়েছিল।
‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ লেখা হয় ‘খামখেয়ালি’র আসরে পড়বার জন্য। অনেকে অনুমান করেন যে, ১৮৯৭-তে বৈকুণ্ঠের খাতা প্রথম অভিনীত হয়। তার কোনো তথ্য প্রমাণ নেই। অবনীন্দ্রনাথ ড্রামাটিক ক্লাবের কথা বলেছেন, যাকে ‘গার্হস্থ্য নাট্য সমিতি’ বলে অনেকে মনে করেন। সেখানেও এর অভিনয়ের কোনো তথ্য নেই। বলা যায়, বৈকুণ্ঠের খাতা সঙ্গীত সমাজে একবার অভিনীত হয়, ১৯০৩-এর জানুয়ারি মাসে। ঐখানেই রবীন্দ্রনাথ—কেদার। জগদীন্দ্রনাথ রায়—অবিনাশ। অবনীন্দ্রনাথ—তিনকড়ি। গগনেন্দ্রনাথ—বৈকুণ্ঠ। তিনকড়ির হাস্য ও চটুল ভূমিকায় অবনীন্দ্রনাথ খুব খ্যাতিলাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ কেদারের কুটিলতা স্বাভাবিক অভিনয়ে ফুটিয়ে তোলেন। পরবর্তীকালে শিশির ভাদুড়ির ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ অভিনয় দেখে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—‘‘বৈকুণ্ঠের খাতা’র এমন সুনিপুণ অভিনয় এক আমাদের বাড়িতে গগন-অবনদের ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। কেদার আমার ঈর্ষার পাত্র, একদা ঐ পার্টে আমার যশ ছিল।’’ (অমল হোমকে লেখা চিঠি, ২৩ মাঘ, ১৩১৮)
শান্তিনিকেতন পর্ব
১৮৯৭-এর পর কলকাতাপর্ব শেষ হলো। তারপর শান্তিনিকেতন পর্ব শুরু হতে রবীন্দ্রনাথের মাঝে, প্রায় এগারো বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই এগারো বছর তিনি তেমন কোনো নাটক রচনা করেননি, প্রযোজনাও করেননি। কাহিনী, হাস্যকৌতুক, ব্যঙ্গ কৌতুকের ছোট নাটিকাগুলি শুধু এই সময়কার রচনা।
বিশ শতকের গোড়া থেকেই রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে বসবাস শুরু। আশ্রমে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, তার সুষ্ঠু পরিচালনা ইত্যাদির জন্য শান্তিনিকেতনে থাকতে থাকতে সেখানকার ছাত্রশিক্ষকদের নিয়ে নানা উৎসব অনুষ্ঠানে নাটক অভিনয়ের ব্যবস্থা করলেন। এই পর্বের নাটকগুলি তাই শান্তিনিকেতনের পরিস্থিতি ও পরিবেশ অনুযায়ী লেখা হল ও সেইভাবে প্রযোজিত হলো। মঞ্চ নেই, মঞ্চ তৈরি করা, কিংবা দৃশ্য সজ্জার মতো অর্থ নেই, মেয়েরা নেই, অভিনেতা বলতে ছাত্র-শিক্ষক, নিজে এবং কিছু শুভানুধ্যায়ী। কলকাতার মতো কোনো দিকের কোনো সুবিধেই এখানে নেই। তাই এই পর্বের নাট্য পরিকল্পনা, রচনা ও প্রযোজনা কলকাতা পর্বের চেয়ে পরিবর্তিত হয়ে গেল। মঞ্চবাহুল্যহীন যাত্রাঙ্গিকে অভিনয়, আড়ম্বরহীন সাজসজ্জা, দৃশ্য পরিকল্পনা নেই, থাকলেও ইঙ্গিতবহ, বাস্তবানুযায়ী নয়। পুরুষরাই নারীচরিত্রে অভিনয় করছে, ফলে নারীচরিত্রবিহীন কিংবা স্বল্প সংখ্যক নারীচরিত্র রেখে নাটক লেখা হচ্ছে। শান্তিনিকেতন পর্বে লেখা তিনটি নাটক শারদোৎসব, অচলায়ন এবং ফাল্গুনীতে কোনো নারী চরিত্র নেই। আশ্রমে তখন স্ত্রী ভূমিকা অভিনয় করবার মেয়ে ছিল না বলেই, তাঁকে প্রয়োজনে স্ত্রী ভূমিকা বর্জন করতে হয়েছিল। এর আগে আশ্রমে ‘বিসর্জন’ অভিনয়ে স্ত্রী চরিত্রগুলি পুরুষেরাই অভিনয় করেছিল। উন্মুক্ত পরিবেশে অভিনয়ের ফলে এইসব নাটকে ঘটনা ও চরিত্রের মধ্যেও প্রকৃতি যেন একটা ভূমিকা পালন করে চলেছে।
এই পর্ব শুরুর মুখেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধটি লেখেন (বঙ্গদর্শন, পৌষ, ১৩০৯)। এই সময়কার নাট্যমানসিকতা এখানে প্রতিফলিত হয়েছে। বাস্তবানুসারী দৃশ্যসজ্জাকে তাঁর স্ফীত পদার্থ বলে মনে হয়েছে। নারীচরিত্র অভিনয়ে অভিনেত্রীর অবশ্য প্রয়োজনীয়তা তিনি অস্বীকার করেছেন। যাত্রাঙ্গিকের মধ্যে নিজের প্রযোজনার সাজুয্য পাচ্ছেন। বিলিতি নকলের বর্বরতার থিয়েটারকে তিনি বরবাদ করে দিতে চাইছেন। এই প্রবন্ধে শান্তিনিকেতন পর্বে রবীন্দ্রনাথের নাট্য প্রযোজনার প্রস্তুতিটুকু কাজ করেছে। পরবর্তীকালে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি তাঁর নিজের নাট্য প্রযোজনায় এর অনেকগুলিকেই আবার অস্বীকার করে নিজের মতো ব্যবহার করেছেন। মঞ্চসজ্জা, সাজসজ্জা, নারীচরিত্রে অভিনেত্রী গ্রহণ শুরু করেছেন। যেগুলি শান্তিনিকেতনপর্বের আগে কলকাতায় করেছিলেন। নাট্য প্রযোজক রবীন্দ্রনাথ তাঁর থিয়েটার ভাবনা গড়ে তুলছে সমসাময়িক প্রযোজনাগত পরিস্থিতি ও প্রাপ্ত সুযোগ এবং ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে। পরিস্থিতির প্রযওজনে প্রযোজক হিসেবে অনেক কিছু করেছেন। কিন্তু এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে তাঁর নাট্যওধ ও মানসিকতা যে স্তরে উন্নীত হচ্ছে, বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে তা অনন্য সংযোজন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকছে।
মঞ্চ ভাবনা ও প্রয়োগরীতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার নাট্যরচনার মধ্যেও সেই নৃত্য পরিকল্পনা কাজ করলো। তাঁর প্রথম ‘যৌবনের সাহিত্যদেবতা’ শেক্সপীয়রের আদর্শে তিনি রোমান্টিক নাটকগুলি লিখছিলেন। তার সঙ্গে রোমান্টিক কাব্যনাট্য, গীতিনাট্য হাস্যরসাত্মক প্রহসন রচনা করছিলেন। এখন লিখতে শুরু করলেন রূপক-সাঙ্কেতিক নাটক। সেখানে ঘটনা ও চরিত্রের দৃশ্যরূপ অপেক্ষা ব্যঞ্জিত রূপই প্রধান হয়ে উঠলো। অঙ্ক-দৃশ্যভাগ উঠে গেল। দৃশ্যের পর দৃশ্য রচিত হলো।
মঞ্চের ‘চিত্রপটে’র চেয়ে দর্শকের ‘চিত্তপটে’র ওপর ভরসা রেখে রবীন্দ্রনাথ দেশীয় যাত্রার ধরনটিকে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন—‘যাত্রার পালাগানে লোকের ভিড়ে স্থান সঙ্কীর্ণ হয় বটে, কিন্তু পটের ঔদ্ধত্যে মন সঙ্কীর্ণ হয় না।’—শান্তিনিকেতনের উন্মুক্ত পরিবেশে ও নতুন অবস্থায় তার নাটক রচনা ও প্রয়োগের দিকে এই নতুন ভাবনাচিন্তার প্রবণতা আসা স্বাভাবিক ছিল।
আরেকটি কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এই পর্বে রবীন্দ্রনাথ যে রূপক-সাঙ্কেতিক নাটকগুলি রচনা করেন সেগুলির অভিনয় যেমন শান্তিনিকেতনে, তেমনি কলকাতাতেও হয়েছিল। শান্তিনিকেতনের অভিনয় আঙ্গিকগত দিক দিয়ে অনেকাংশে যাত্রাধর্মীয় হতো। আবার কলকাতায় অভিনয়ের সময়ে গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ প্রভৃতি শিল্পীর প্রতীকী মঞ্চ ও দৃশ্যনির্মাণের সাহায্য নিতেন। কলকাতার বাড়ির ও বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে দক্ষ অভিনয়শিল্পীরা অংশ নিতেন। তাই স্থান পরিবর্তন ও সুযোগ সদ্ব্যবহারের কারণে একই নাটকের অভিনয়ে মঞ্চ ও দৃশ্য ব্যবস্থারও পরিবর্তন হয়ে যেত। দু’জায়গাতেই রবীন্দ্রনাথ নির্দেশকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এই দ্বৈত ভাবনা তাঁর ছাপানো ‘তপতী’ নাটকটি থেকে ভালো বোঝা যায়। ভূমিকায় দৃশ্যপট তুলে দেবার জন্য দাবী করেছেন। আবার নাটকের প্রতিটি দৃশ্যে দৃশ্যপটের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
শান্তিনিকেতন পর্বের প্রথম নাটক ‘শারদোৎসব’ অভিনীত হল ১৯০৮ সালে। ‘নাট্যঘর’ নামে একটি মাটির ঘরে একদিকের উঁচু মেঝেতে মঞ্চ করে, দর্শকদের বসবার জন্য সতরঞ্চি বিছিয়ে, একেবারে দৃশ্যপটবিহীন অভিনয় হয়েছিল। মঞ্চের দু’ধারে গাছের ডাল লাগিয়ে তাতে দেবদারু পাতা বেঁধে নানা রঙের পট্টবস্ত্র টাঙিয়ে নিখরচায় রুচিসম্মত মঞ্চ তৈরি হয়েছিল। বেনারসে ‘ঠাকুরদা’ নামে পরিচিত ক্ষিতিমোহন সেন শান্তিনিকেতনে শিক্ষক হয়ে এসেছেন। তার দিকে তাকিয়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরদা চরিত্রটি সৃষ্টি করেন এবং কণ্ঠে অনেক গান দেন। ভয়ে ক্ষিতিমোহন এই ভূমিকায় শেষ পর্যন্ত নামেননি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নাটকে ‘ঠাকুরদা’ চরিত্রটি নানাভাবে ও রূপে স্থান পেয়ে গেছে।
এইভাবে শান্তিনিকেতনে অভিনয় করলেন ‘মুকুট’। প্রথম অভিনয় ২২ ডিসেম্বর, ১৯০৮। দ্বিতীয় অভিনয় হয় ১৯০৯-এর মার্চ-এপ্রিলের কোনো সময়ে। নাটকটির ভূমিকায় লেখা আছে—‘‘বোলপুর ব্রহ্মচর্যাশ্রমের বালকদের দ্বারা অভিনীত হইবার উদ্দেশ্যে ‘বালক’ পত্রে প্রকাশিত ‘মুকুট’ নামক ক্ষুদ্র উপন্যাস হইতে নাট্যাকৃত।’’ শারদোৎসবের সাফল্যে উৎসাহিত হয়েই তিনি মুকুট লেখেন, একথা প্রভাতকুমার মুখখাপাধ্যায় জানিয়েছেন। মুকুট গল্প ও নাটকে কোনো তফাৎ নেই। শুধু গল্প শেষ হয়েছে ট্রাজেডিতে, নাটক সেখানে মিলনান্তক। বোধকরি অভিনয়স্থলের পরিবেশের কারণেই এই পরিবর্তন।
প্রায়শ্চিত্ত ১৯০৯-য়ে প্রকাশিত হলেও ঐ সময়েই অভিনীত হয়নি। কবির পঞ্চাশতম জন্মদিনে, ৮ মে, ১৯১১ (২৫ বৈশাখ, ১৩১৭), অভিনয়ের খবর পাওয়া যায়।
১৯১০-এ লেখা রাজা নাটক গ্রন্থাকারে প্রকাশ হয় ৬ জানুয়ারি, ১৯১১। প্রথম অভিনয় করলেন ১৯ মার্চ ১৯১১-তেই। পরে ‘রাজা’ এখানে ও কলকাতায় অনেকবার অভিনীত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ—ঠাকুরদা। অজিতকুমার চক্রবর্তী—সুদর্শনা। সুশীল চক্রবর্তী—সুরঙ্গমা। জগদানন্দ রায়—কাঞ্ছীরাজ।
শান্তিনিকেতন ও কলকাতা পর্ব
কলকাতায় এই নাটক অভিনয়ের পর কথা ওঠে, রবীন্দ্রনাথের এই সমস্ত নাটক অস্পষ্ট ও ধোঁয়াটে এবং অর্থহীন। এবং একেবারেই গতিহীন। নতুন ধরনের এইসব নাটক ও তাঁর উপস্থাপনা বুঝে ওঠা অনেকের পক্ষেই সম্ভব ছিল না। রবীন্দ্রনাথকে তাই বারে বারে এই জাতীয় নাটক নিয়ে কলকাতায় এসে অভিনয় করে যেতে হয়েছে। ৭৪ বছর বয়সেও ‘রাজা’র পরিবর্তিত রূপ ‘অরূপরতন’ নিয়ে কলকাতায় অভিনয় করে গেছেন, ১৯৩৫-এর শেষদিকে। তখন ঠাকুরদা তো করেইছিলেন, আবার নেপথ্যে থেকে অন্ধকারের ‘রাজা’র ভূমিকাও পালন করেছিলেন।
‘অচলায়তন’ নাটকের প্রথম অভিনয় ২৬ এপ্রিল ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে, (১৩ বৈশাখ ১৩২১), দীনবন্ধু এন্ড্রুজ সাহেবের সম্বর্ধনা উপলক্ষে। শান্তিনিকেতনে এই অভিনয়ে ছিলেন: রবীন্দ্রনাথ—আচার্য অদীনপুণ্য। সন্তোষ মজুমদার—উপাচার্য। দিনেন্দ্রনাথ—পঞ্চক। জগদানন্দ রায়—মহাপঞ্চক। ক্ষিতিমোহন—দাদাঠাকুর। পিয়ার্সন সাহেবও নেমেছিলেন একজন ‘শোনাপাংশু’ হয়ে। প্রমথনাথ বিশী—সুভদ্র। সন্তোষ মজুমদার—উপাচার্য।
‘ফাল্গুনী’র প্রথম অভিনয় শান্তিনিকেতনের ‘নাট্যঘরে’ ২৫ এপ্রিল, ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে। রবীন্দ্রনাথ-অন্ধবাউল। ক্ষিতিমোহন—চন্দ্রহাস। জগদানন্দ রায়—দাদা। প্রভাত মুখোপাধ্যায়—সর্দার। অসিত হালদার—কোটাল।
এই পর্বের অভিনয়ে চিত্রবিচিত্র ‘সীন’ ব্যবহার আগেই বর্জিত হয়েছিল। ফাল্গুনীতেও তাই হল। পরিবর্তে একটা আস্ত বাগান-গাছে ফুল ফুটে আছে, গাছের ডালে দোলনা বাঁধা এইভাবে মঞ্চ সাজানো হয়েছিল। ১৯১৬-র জানুয়ারিতে জোড়াসাঁকোতেও ফাল্গুনীর অভিনয় হল। এই প্রথম শান্তিনিকেতন ও জোড়াসাঁকোয় সম্মিলিত সহযোগিতায় রবীন্দ্রনাথের অভিনয় হলো। এরপর থেকে সব নাটকের অভিনয় এইভাবে মিলিত উদ্যোগেই হয়। কলকাতার এই অভিনয় বাঁকুড়ার দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের সাহায্যার্থে অভিনীত হবে। পয়সা দিয়ে যারা দেখতে আসবে তাদের কাছে নাটকটি খুবই ছোট বলে মনে হবে। এই কারণে রবীন্দ্রনাথ ফাল্গুনীর পূর্বে ‘বৈরাগ্যসাধন’ নামে একটি দৃশ্য জুড়ে দেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, একটু introduction গোছের scene, এটা ছোট হবে, মেয়ে থাকবে না, শুরুতে যারা আসতে দেরী করবে disturbance-টা ঐ দৃশ্যের ওপর দিয়েই যাবে।
কলকাতার মঞ্চসজ্জায় অবনীন্দ্রনাথ ইঙ্গিতধর্মিতার দিকে নজর দিতেন। খরচ কমের দিকেও খেয়াল রাখতে হতো। পেছনের আঁকা সীনের বদলে দেওয়া হল নীল মখমলের বনাত। দেখতে হল যেন গাঢ় নীল রঙের রাতের আকাশ। ডালপালা কিছু এখানে ওখানে দিয়ে স্টেজ সাজানো হল। বাঁশের গায়ে দড়ি ঝুলিয়ে দোলনা হলো। মনে হতে লাগলো যেন উঁচু গাছের ডালের সঙ্গে দোলনা ঝুলছে।
রবীন্দ্রনাথের পরিচালনায় ফাল্গুনীর শেষ অভিনয় হয় শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে, ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে। ফাল্গুনী অভিনয়ের সময়েই রবীন্দ্র উপলব্ধির (মঞ্চের চিত্রপটের চেয়ে দর্শকের চিত্তপটের ওপর নির্ভরতা) সার্থক প্রকাশ ঘটে।
‘ডাকঘর’ ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে লেখা হলেও প্রথম অভিনয় হয়েছিল কলকাতায় ৩ মে, ১৯১৭-তে। এটি শান্তিনিকেতন ও কলকাতায় অভিনীত হয়েছিল। শান্তিনিকেতনেই প্রথম অভিনয়, ১৯১৭-তেই। এর অনেক আগে ‘The Post office’ ইংরেজি অনুবাদ কবি ইয়েটসের উদ্যোগে ডাবলিনে (১৭ মে, ১৯১৩) এবং লন্ডনে (১০ জুলাই, ১৯১৩) অভিনীত হয়। প্রথম অভিনয়টি হয়েছিল মেরী কার্পেন্টার হলে। এই অভিনয় রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে হয়নি। তবে শান্তিনিকেতনের চাইতে কলকাতায় জোড়াসাঁকোর বিচিত্রাভবনে ‘ডাকঘরে’র অভিনয়ই সবদিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য। ভূমিকালিপি: রবীন্দ্রনাথ—ঠাকুরদা। গগনেন্দ্রনাথ—মাধব। অবনীন্দ্রনাথ—মোড়ল। অসিত হালদার—দইওয়ালা। সুরূপা (অবনীন্দ্রনাথের ছোটমেয়ে)—সুধা। আশামুকুল—অমল।
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে অভিনয় হয়েছিল সাতবার। মঞ্চ বাঁধা হয়েছিল বিচিত্রাঘরের একপাশে, দর্শকাসন ছিল দেড়শো। মঞ্চ পরিচালনায় গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ ও রথীন্দ্রনাথ। ‘ডাকঘর’ অভিনয়ের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের নানা বর্ণনা থেকে জানা যায়-হলঘরের একপাশে উঁচু-স্টেজ বাঁধা হয়েছিল। মঞ্চে একটি সত্যিকার কুঁড়েঘর তৈরি হয়েছিল, তার খড়ের চাল, ছিটে বাঁশের বেড়া, আসবাবপত্র, আলনা, পিলসুজ, খড়ের চালে বাবুই পাখির শূন্য বাসা—এইভাবে নানা খুঁটিনাটি জিনিসের সমাবেশে মঞ্চটি চমৎকার বাস্তবানুগ রূপ পেয়েছিল। গোবরমাটি লেপে, আলপনা কেটে, পেছনে গবাক্ষের গাঢ়নীল বনাতে রূপালী কাগজে চাঁদ কেটে লাগানো হয়েছিল। অভ্রের টাসেল দেওয়া শিকেতে রং করা মাটির হাঁড়ি ঝুলিয়ে, মাটির পিলসুজে প্রদীপ জ্বেলে দেওয়া হয়েছিল। সামনের যবনিকায় নীলপর্দা টানা হলো। চালাঘরের তজায় লাল রঙ, ঘরে কুলুঙ্গি, চৌকাঠের মাথায় লতাপাতা, ঠিক যেখানে যেমনটি দরকার, যেন একটি পাড়াগেঁয়ে ঘর। তারপরে ‘ফিনিশিং টাচ’ হিসেবে একপাশে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো একটি পিতলের দাড়, পাখি নেই তাতে, গল্পের আইডিয়ার সাথে মিলে গেল। তারপরে খুব রং-চংয়ের একটি পট উইংয়ের পাশে আটকে দেওয়া হয়।
নাট্যপরিচালক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ এখানে ‘দ্বিধাগ্রস্ত’। তার রঙ্গমঞ্চ প্রবন্ধে যা বলেছিলেন—‘ডাকঘরের’ কলকাতা প্রযোজনায় তা মেলেনি। আড়ম্বরপূর্ণ ও বাস্তবানুগামিতা লক্ষ করা গেল মঞ্চসজ্জায়। মঞ্চসজ্জা অবন-গগনরা করেছে বললেও পরিচালক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ সেই দায় এড়াতে পারেন না।
‘ডাকঘর’ নাটকটি রবীন্দ্রনাথ নানাভাবে অনেক স্থানে অভিনয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। কলকাতার অভিনয়ের দ্বিতীয় দিনে মহাত্মা গান্ধী, লোকমান্য তিলক, মদনমোহন মালব্য, এ্যানি বেসান্ত প্রমুখ খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ববর্গ উপস্থিত ছিলেন। অনেকের কাছেই ‘ডাকঘরে’র সাজসজ্জা ও অভিনয় রুচি, সৌন্দর্য, দৃশ্যসংস্থান ও পরিকল্পনার দিক দিয়ে অনন্য সাধারণ বলে মনে হয়েছে।
‘রাজা ও রানী’র পরিবর্তিতরূপ তপতী অভিনীত হয় জোড়াসাঁকোয় ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের পরপর চারদিন, সেপ্টেম্বর মাসের ২৬, ২৭, ২৮ এবং অক্টোবরের ১ তারিখে। (১৩৩৬ সালের আশ্বিন মাসের ১১, ১২, ১৩ এবং ১৫ তারিখে)। চরিত্রলিপি: রবীন্দ্রনাথ—বিক্রম। অমিতা ঠাকুর—সুমিত্রা। অজিন ঠাকুর-নরেশ। সুমিতা চক্রবর্তীবিপাশা। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর-দেবদত্ত। কালীমোহন ঘোষ—কুমার সেন। নলীন মিত্র—চন্দ্রসেনা। নিতাইবিনোদ গোস্বামী—ত্রিবেদী।
রবীন্দ্রনাথ ও অমিতার অভিনয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছিল দুটি চরিত্রের সংঘাত ও সংক্ষোভ। শান্তিনিকেতনের অভিনয়ে সুমিত্রা ও বিক্রম সেজেছিলেন অমিতা ঠাকুর ও অজিন ঠাকুর। ১৯২৯-এই শিশিরকুমার ভাদুড়ি এই তপতী নাটক সাধারণ রঙ্গালয় নাট্যমন্দিরে অভিনয় করেছিলেন। দর্শক আনুকূল্যে ব্যর্থ হয়ে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন।
এখানে ‘তপতী’ সম্পর্কিত দুটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। এক, কলকাতায় তপতী অভিনয় হওয়ার কিছু আগে (২ আশ্বিন, ১৩৩৬) শান্তিনিকেতনে খবর আসে বিপ্লবী যতীন দাস লাহোর জেলে অনশনে প্রাণত্যাগ করেন। ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে তাঁর এই প্রতিবাদে মৃত্যুবরণ রবীন্দ্রনাথকে উত্তেজিত করে। তিনি ওই দিনই রচনা করেন ‘সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহ’ গানটি। তপতী নাটক তখন ছাপা হয়ে গেছে। তাই গ্রন্থে গানটি দেওয়া যায়নি। কিন্তু অভিনয়ে ভৈরব মন্দিরের ভৈরবের উপাসক দলের গান হিসেবে নাটকের প্রথমেই রাখা হয়। অভিনয়ের ক্রোড়পত্রে এই গানটি প্রথমেই ছাপা হয়। [শান্তিদেব ঘোষ—রবীন্দ্রসঙ্গীত, বিচিত্র)
দুই. ‘রাজা ও রানী’তে রত্নেশ্বরের চরিত্র ছিল না। তপতীতে এই চরিত্রটিকে কেন্দ্র করে প্রজাদের প্রতি শীলাদিত্যের অত্যাচারের যে চিত্রটি তিনি এঁকেছেন, সেটি সে যুগের ইংরেজ শাসকেরই যে চিত্র তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। এই অত্যাচারকে রুখতে হলে জনসাধারণকে কী করতে হবে বা তাদের কী করা উচিত, রানী সুমিত্রার মুখ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ তা-ও বলিয়ে দিয়েছেন। এই সংলাপ যে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক মতবাদের প্রতিধ্বনি তা সহজেই বোঝা যায়। (ঐ)
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের শেষ অভিনয় ‘শারদোৎসব’ নাটকে সন্ন্যাসী চরিত্রে, ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ১১ ও ১২ ডিসেম্বর । ওই বছরেই কলকাতার নিউ-এম্পায়ারে করেন ‘অরূপরতন’, রাজা নাটকের রূপান্তরিত রূপ। রবীন্দ্রনাথ রাজার ভূমিকায় অভিনয় করেন। কিছুদিন আগে অচলায়তন ভেঙে ‘গুরু’ লিখেছিলেন। এবার ‘রাজা’ দেখা দিল ‘অরূপরতন’ রূপে (১৯২০)। এই রূপান্তরের কারণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ভূমিকায় বলছেন—“এই নাট্যরূপটি ‘রাজা’ নাটকের অভিনয়যোগ্য সংক্ষিপ্ত সংস্করণ-নূতন করিয়া পুনর্লিখিত।’’ রাজাতে সুদর্শনা ছিল রাজার বিবাহিতা স্ত্রী। রূপান্তরে সে অনূঢ়া, পিতৃগৃহস্থিত। পরের রূপান্তরে আবার সে রাজার স্ত্রী। বর্তমানে এই শেষ রূপান্তরই গৃহীত ও প্রচলিত। প্রথম অরূপরতন থেকে দ্বিতীয় অরূপরতন অনেক বড়ো এবং তাতে কয়েকটি নতুন গানও যোগ করা হয়েছে।
‘অরূপরতন’ রবীন্দ্রনাথের কলকাতায় শেষ অভিনয়। বলা যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথের নাট্যজীবনে এটাই শেষ অভিনয়।
‘রক্তকরবী’ একবার অভিনয়ের খবর পাওয়া যায়। ১৯৩৪-এর ৬ এপ্রিল ‘দি টেগোর ড্রামাটিক গ্রুপ’ রক্তকরবী মঞ্চস্থ করেছিল কলকাতার ‘নাট্যনিকেতন’ থিয়েটারে। তবে এই নাট্যাভিনয়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ততোটা যুক্ত ছিলেন না। তাঁর ‘আত্মীয়বর্গ’ রক্তকরবীর এই অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথ তাঁদেরি আহবানে শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় এসে সেই অভিনয় দেখে গিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ হেমন্তবালা দেবীকে একটি চিঠিতে (২৯ মার্চ, ১৯৩৪) লিখছেন—‘‘সম্ভবত: আগামী সোম কিংবা মঙ্গলবার কলকাতা অভিমুখে যাব। সেখানে আমার আত্মীয়বর্গ রক্তকরবী অভিনয়ে প্রবৃত্ত, তাদেরি আহ্বানে আমাকে যেতে হচ্ছে। কর্তব্য সমাধা হলেই ফিরে আসতে হবে।’’
১৯৩৪-এর ৭ এপ্রিলের চিঠি থেকে (হেমন্তবালা দেবীকে লেখা) আরো জানা যাচ্ছে যে, আগের দিন অর্থাৎ ৬ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথ ‘রক্তকরবী’ অভিনয় থেকে শ্রান্ত দেহে ‘ক্লান্ত মনে’ জোড়াসাঁকোয় ফিরেছেন।
রবীন্দ্রনাথের এই চিঠি দুটি থেকে ‘রক্তকরবী’ প্রযোজনা সম্পর্কে তেমন কোনো খবর পাওয়া না গেলেও, এটুকু বোঝা যায় যে, তিনি এই প্রযোজনার সঙ্গে তেমনভাবে যুক্ত ছিলেন না এবং এই প্রযোজনায় তিনি পরিতৃপ্ত হননি। নিজের নাটকের অভিনয় দেখতে যাওয়াটা তাঁর কাছে নিছক কর্তব্য বলে মনে হয়েছে। এবং অভিনয় দেখে ফিরেছেন শ্রান্ত দেহে ক্লান্ত মনে।
১৯২৬-এ ‘নটীর পূজা’ অভিনয় থেকেই রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যগুলি নতুন আঙ্গিকে গড়ে উঠতে থাকে। নটীর পূজায় সব চরিত্রই নারী চরিত্র। ভদ্রঘরের মেয়েরা এইভাবে মঞ্চে নাচবে, সকলের মনঃপুত হয়নি। তবে সামাল দেওয়ার জন্য ‘উপালি’ চরিত্র সৃষ্টি করে রবীন্দ্রনাথ নিজে সেই চরিত্রে মঞ্চে নেমে মেয়েদের অভিভাবকের মতো বাইরের বিরোধিতাকে কাটাতে চেয়েছিলেন। পরেও এই ধরনের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ কোন ভূমিকা না থাকলেও সাধারণ মঞ্চে বসে থাকতেন। রবীন্দ্রনাথের মহিমান্বিত ও শ্রদ্ধেয় উপস্থিতিতে সব কিছু মানানসই ও গ্রহণীয় হয়ে উঠতো।
পূর্বযুগের গীতিনাট্য-নৃত্যনাট্যগুলির সঙ্গে এবারের এই সৃষ্টিগুলির তফাৎ অনেক। ভেতরে ভাবপ্রকাশের একটা আবেগ ছিল। তার ওপর শান্তিনিকেতনে তখন অনেক ছাত্রী নাচগান শিখছে তালিম নিয়ে। ভালো গানের ও নাচের মাস্টার এসেছে। এইসব উপকরণ কাছে পাওয়াতে ভেতরের আবেগ বাইরে প্রকাশের ভঙ্গির সহায়তা করলো। নাচে গানে নতুন চেহারা ও মাত্রায় এ একেবারে স্বতন্ত্র জিনিস। সাধারণ রঙ্গালয়ের অপেরা—গীতিনাট্যের সঙ্গে এর তফাৎ যোজন-বিস্তৃত। সূক্ষ্মরুচি, মর্যাদা এবং রসসম্ভোগে এই নৃত্যনাট্যগুলির বিচার অন্যভাবে করতে হবে। তাসের দেশ, নটীর পূজা, শ্যামা, চণ্ডালিকা, চিত্রাঙ্গদা, শাপমোচন প্রভৃতি নৃত্যনাট্যে নাচ ও গানের আলাদা শিক্ষক ছিলেন, কিন্তু সামগ্রিক পরিচালনা ও পরিকল্পনার দায়িত্ব ছিল রবীন্দ্রনাথের। একেবারেই স্বতন্ত্র এই নৃত্যনাট্যগুলির আলােচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক।
শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথ নাট্যরচনা ও প্রযোজনার জগৎ থেকে ফিরে নৃত্যসহযোগী নাট্যে আর ‘রেখানাট্যে’ (ছবি আঁকায়) মগ্ন। বাস্তবতার ঊর্ধ্বে উঠে এক অকৃত্রিম নিবিড় বাস্তবতাকে ছোঁয়ার জন্য তার চৈতন্য অন্তঃপুরে অদ্ভুত প্রকাশলীলা দেখা যাচ্ছিল।
রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ ষাট বৎসর ধরে নাট্যরচনা এবং সেগুলির প্রযোজনা করেছেন। প্রথমদিকের কলকাতা-পর্বে, বিরজিতলায় ‘বিসর্জন’ অভিনয় পর্যন্ত, তার প্রযোজনায় বিলিতি রঙ্গমঞ্চের অনুকরণে গড়ে ওঠা দেশের সাধারণ রঙ্গালয়গুলির মঞ্চব্যবস্থার অনুকরণ দেখা যায়। বা অনুকৃতিও বলা যায়। যে হ.চ.হ. (হরিশ্চন্দ্র হালদার) নামে ব্যক্তিটি রবীন্দ্রনাথের মঞ্চ নির্মাণে সহায়তা দিতেন, তিনি সাধারণ রঙ্গালয়েও মঞ্চ তৈরি করতেন। পরে অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথরা এসেছেন। রবীন্দ্রনাথ এই সময়ে অভিনয় (Acting) এবং উপস্থাপনার অন্য দিকগুলি নিয়ে ভাবলেও মঞ্চভাবনা, দৃশ্যসজ্জা এবং সাজসজ্জার দিকে মনোযোগ দেননি। প্রধান নির্দেশকের নির্দেশে মঞ্চ ভাবনা স্থিরিকৃত হয়নি।
পরিবর্তন শুরু হল ‘শারদোৎসব’ (১৯০৮) থেকে। বাস্তবানুসারী মঞ্চভাবনা থেকে সরে এসে ব্যঞ্জনাধর্মিতার দিকে যাওয়া। সাজসজ্জা, পোষাক, মেকআপ এবং সর্বোপরি নাট্যবিষয় ও ভাবনা, সবকিছুর মধ্যেই এই পরিবর্তনের পরিক্রমা শুরু হল। এর যথার্থ রূপ পাওয়া গেল ১৯১৬-তে ‘ফাল্গুনী’ অভিনয়ের সময় থেকেই। মাঝে ডাকঘরের কলকাতায় অভিনয়ের সময় মঞ্চবাহুল্য ও বাস্তবানুসারিতার অতিরেক লক্ষ করা গিয়েছিল। এর অনেক কিছুই রবীন্দ্রনাথের পছন্দ না হওয়ার কথা। না-হলেও পাঁচজনের চেষ্টায় যেটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ স্মিতহাস্যে তা মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু পরের সব নাট্য প্রযোজনাতেই রবীন্দ্রনাথ ‘suggestive’-এর দিকে চলে গেছেন। ১৯২৩-এ কলকাতায় বিসর্জন অভিনয়ের সময়ে তার সফলতম প্রকাশ দেখা গেল। কয়েকটি চৌকো সংস্থান সাজিয়ে বেদি, একটি দুটি ধাপ, বেদিতে দীপবৃক্ষ ও পুষ্পথালা-মন্দিরের দৃশ্য রচনা হয়েছে। কোনো উপকরণ বাহুল্য নেই। প্রতীকগুলিকে স্পষ্টতর করবার প্রয়াস ডাকঘরে যা ঘটেছিল, সেরকম নেই। ‘তপতী’ প্রযোজনায় (১৯২৯) সেই ভাবনার ‘perfection’ দেখা গেল।
প্রথম ভাগের প্রযোজনার ভাবনা যদি হয় প্রতিফলনাত্মক বা Representational, তাহলে দ্বিতীয় ভাগের উপস্থাপনা হবে প্রতিফলন বর্জিত, প্রতীকী, ব্যঞ্জনাময় suggestive. এই পরিবর্তন নিঃসন্দেহে নাট্য প্রযোজক রবীন্দ্রনাথের নাট্য উপস্থাপনার ভাবনা থেকেই ক্রম-সঞ্জাত।
থিয়েটার যেহেতু মঞ্চ ব্যবস্থার উপকরণের মধ্যে দিয়ে নাট্য উপস্থাপনার ব্যাপার, তাই তাঁর প্রযোজনায় সব সময়েই পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে সেই রকম মঞ্চ ব্যবস্থা করা হয়েছে। কলকাতা ও শান্তিনিকেতনের প্রযোজনার পার্থক্যটি সেইভাবে তৈরি হয়েছে। তবে সব সময়েই তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার নিজস্ব রুচি, নাট্যবোধ ও পরিশীলিত রসজ্ঞান। উপস্থাপনের কারণে তার অনেক নাটকের অনেক পরিবর্তন ও রূপান্তর করতে হয়েছে। উপস্থাপনাতেও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলেছেন। কিন্তু সবার ওপরে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের শিল্পীমনের সৃষ্টিশীল ক্রিয়াশীলতা।
তবে এখানে সেখানে কয়েকটি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মন্তব্য ছাড়া নাট্যপ্রয়োগরীতি সম্পর্কে সুচিন্তিত কোনো তত্ত্ব বা নির্দেশাবলী তিনি রেখে যাননি। ফলে থিয়েটারের ছাত্ররা চেখভ বা ইবসেনকে বিশ্লেষণ বা বোঝার যে সুযোগ পায়, স্তানিস্লাভস্কি বা ব্রেখট-এর প্রয়োগরীতি অধ্যয়ন, অনুধাবন বা অনুশীলনের যে সুযোগ পায়, রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে সেটা কখনোই পাওয়া যায় না। তাই প্রত্যক্ষদর্শী, অংশগ্রহণকারী কিংবা পরোক্ষ মানুষজনের বিবরণ ও সাক্ষ্য থেকে রবীন্দ্রনাথের নাট্য প্রযোজনার পরিপূর্ণ রূপটি পাওয়া যায় না।
সমসাময়িক সাধারণ রঙ্গালয়ের নাট্যাভিনয় ধারার সঙ্গে তাই রবীন্দ্রনাথের প্রযোজনার কোনো মিল নেই। তাঁর ষাট বৎসরের নাট্যরচনা ও উপস্থাপনার পাশাপাশিই কলকাতাতেই সাধারণ রঙ্গালয়ে প্রচুর নাট্যরচনা ও নাট্যাভিনয় হয়ে চলেছিল। রবীন্দ্রনাথেরও কয়েকটি নাটক ও বেশকিছু গল্প-উপন্যাসের নাট্যরূপ এখানে অভিনীত হয়েছিল। তা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রযোজনার সঙ্গে একাত্ম হতে পারেননি। নাটকের ভাববস্তু, চরিত্রচিত্রণ ও ঘটনা বর্ণনা এবং উপস্থাপনার নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা রবীন্দ্রনাথ তাঁর থিয়েটারে যেভাবে করতে চেয়েছেন, পেশাদারি সাধারণ রঙ্গালয়ের সঙ্গে তার কোনো সামঞ্জস্য ছিল না। বিশ্বাসভাজন ‘প্রয়োগকর্তা’ শিশির ভাদুড়িকে কয়েকটি নাটক প্রযোজনা করতে দিলেও রবীন্দ্রনাথের মন শেষ পর্যন্ত ভরেনি। সেই সময়ে এক সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথের মনোভাব পরিষ্কার বোঝা যায়—‘‘যেভাবে এখন সাধারণ রঙ্গালয় চলছে, তা মোটেই আশাপ্রদ নয়। যাঁর মনে রসবোধ ও কলাজ্ঞান আছে সেখানে গিয়ে তার প্রাণ কিছুতেই তিষ্ঠুতে পারবে না।’’—এই প্রসঙ্গেই তিনি তার নিজস্ব থিয়েটারের পরিকল্পনা দেন—‘‘সর্বসাধারণের জন্য নয়-যাঁরা ললিতকলার সুক্ষ্মসৌন্দর্য উপভোগ করতে চান তাদের জন্যে কি বাংলাদেশে একটি অতিরিক্ত রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠা করা চলে না?…সাধারণ রঙ্গালয় দর্শকদের মুখ চেয়ে যেমন চলছে চলুক, অতিরিক্ত রঙ্গালয়ের সঙ্গে তার কোন সম্পর্কই থাকবে না। এখানে যেসব নাটক নির্বাচিত হবে, কলারসিকের উন্নতমনে তা ভাবের রেখাপাত করতে পারবে। [নাচঘর, ৩ জুন, ১৯২৭] ।
এইরকম থিয়েটারের কল্পনা রবীন্দ্রমানসে ছিল। প্রযোজনার মাধ্যমে এমনি একটি থিয়েটারের দিকে তিনি যেতে চেয়েছিলেন।–‘‘নাটক দৃশ্যকাব্য; যাহা দেখা যায় সেই উপকরণ লইয়া যাহা দেখা যায় না সেই ভাবরসকে নাটকে অভিব্যক্ত করিতে হইবে।’’ [প্রবাসী, ভাদ্র ১৩২৭)।
তাঁর সময়ে সাধারণ রঙ্গালয়ের পেশাদারি অভিনয়ের ধারাই প্রবলতর ছিল। তার পাশেই রবীন্দ্রনাথ একটি সমান্তরাল নাট্য প্রযোজনার ধারা প্রচলন করতে চেয়েছিলেন। ভাবনায়, চিন্তায়, উপস্থাপনায় ও রসপ্রয়োগে এ তার একান্তই নিজস্ব সৃষ্টি। তার সহযোগী অন্য সব প্রথিতযশা অনুগামীদের নানা সাহায্য তিনি নানাভাবে পেয়েছেন। শক্তিমান উচ্চক্ষমতার বেশ কয়েকজন অভিনেতা তার কাছেই ছিলেন। চারুশিল্পী, সঙ্গীতবিদ এবং নৃত্য বিশারদ বিশেষজ্ঞের সর্বাঙ্গীন সহযোগ সব সময়েই পেয়েছেন। সম্মিলিত প্রয়াসে এবং রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পনায় এদেশে গড়ে উঠেছিল একটি পরিণত থিয়েটার। এই থিয়েটারে নাটক উপভোগের মতো বাছাই পরিশীলিত বিদগ্ধ দর্শকও তিনি পেয়েছেন। সব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের থিয়েটার প্রায় ষাট বৎসর ধরে অবিচ্ছিন্নভাবে নানা ভাব ও রসের, নানা নাটকের উপর্যুপরি অভিনয়ের ধারা অব্যাহত রেখেছে। সে এক স্বতন্ত্র ও অনন্য এবং একমাত্র থিয়েটার।
সাধারণ রঙ্গালয়ের নাট্যাভিনয়ের প্রবল বাণিজ্যিক ধারার পাশে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব প্রযোজনা এক সমান্তরাল থিয়েটারের (Parallel Theatre) ধারা তৈরি করেছে। সেই ধারা পরবর্তী বাংলা নাট্য আন্দোলনের বহুমুখী প্রচেষ্টার মধ্যে এক উজ্জ্বল দিক নির্দেশের কাজ করেছে। সম্পূর্ণভাবে দেশীয় ভাবনায় ভাবিত এবং গভীর অর্থে মৌলিক রবীন্দ্রনাথের থিয়েটার পেশাদারি রঙ্গালয়ের পাশাপাশি আধুনিক বুদ্ধিদীপ্ত থিয়েটারের ঐতিহ্যসৃষ্টিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।
Leave a Reply