দলবৃত্ত ছন্দ কাকে বলে? এর বৈশিষ্ট্যগুলি উদাহরণসহ আলোচনা কর।
স্বরবৃত্ত ছন্দ বা দলবৃত্ত ছন্দ
যে ছন্দে সাধারণত সকল দলই অপ্রসারিত হওয়ায় একমাত্রা করে হয় এবং লয় হয় দ্রুত, শ্বাসাঘাত থাকে ও মূল পর্ব হয় চারমাত্রার তাকে দলবৃত্ত বা স্বরবৃত্ত ছন্দ বলে। এই ছন্দে প্রতি পর্বে সাধারণত আদি অক্ষরে একটি প্রবল প্রস্বর বা শ্বাসাঘাত অনুভূত হয় এবং নৃত্যচপলতা অনুভূত হয়।
দলবৃত্তের নাম বিচিত্রা
(১) প্রচলিত নাম— স্বরবৃত্ত (২) দলবৃত্ত (প্রবোধচন্দ্র সেন) (৩) স্বাসাঘাত প্রধান, বলপ্রধান, প্রাস্বরিক (অমূল্যধন) (৪) বলবৃত্ত (তারাপদ ভট্টাচার্য)। (৫) দলমাত্রিক (প্রবোধচন্দ্র) (৬) লৌকিক (প্রবোধচন্দ্র) (৭) ছড়ার ছন্দ, বাংলা প্রাকৃত (রবীন্দ্রনাথ), (৮) চিত্রা, ঝর্ণা ঝামর (সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত), (৯) মাত্রিক (মোহিতলাল), (১০) কথ্য ছন্দ (মোহিতলাল), (১১) পর্ব-ভূমক (মোহিতলাল)।
স্বরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য
স্বরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্যগুলিকে সূত্রাকারে লিপিবদ্ধ করা যেতে পারে। যেমন—
- মূল পর্ব সাধারণত চার মাত্রার হয়। (ব্যতিক্রমও আছে)
উদাহরণ
রায় বেশে নাচ । নাচের ঝোঁক । মাথায় মারলে । গাঁট্টা।। ৪+৪+৪+২
শ্বশুর কাঁদে । মেয়ের শোকে । বর হেসে কয় । ঠাট্টা!।। ৪+৪+৪+২
- প্রতি পর্বে প্রথম অক্ষরে শ্বাসাঘাত থাকে। (ব্যতিক্রমও আছে)
বাঁশ বাগানের । মাথার ওপর । চাঁদ উঠেছে । ওই।।
মাগো আমার । শোলক বলা । কাজলা দিদি । কই।।
- যে কোন অক্ষরে বা দলে একমাত্ৰা হয়। অর্থাৎ রুদ্ধ দল ও মুক্তদল সবই অপ্রসারিত হওয়ায় একমাত্ৰা হয়। যুক্ত ব্যঞ্জনের সংশ্লিষ্ট উচ্চারণ বজায় থাকে। তবে কোথাও কোথাও প্রসারিত উচ্চারণে যে কোন দল দু-মাত্রা হতে পারে।
- দ্রুত লয় হয়।
- সাধারণত প্রতি পূর্ণ পর্বে চারটি দল থাকে। অবশ্য কখনো কখনো দলের সংখ্যা তিন বা দুই হতে পারে, এমনকি পাঁচও হতে পারে।
আমার ঘরে । ছুটির বন্যা । তোমার লাফে । ঝাঁপে।। ৪+৪+৪+২
কাজকর্ম । হিসাবকিতাব। থরথরিয়ে । কাঁপে।। ৪+৪+৪+২
- যৌগিক স্বরের লক্ষণীয় ব্যবহার দেখা যায়।
যৌবনেরি পরশমনি । করাও তবে । স্পর্শ
দীপক তালে । উঠুক ধ্বনি । দীপ্ত প্রাণের । হর্ষ।
- ঐ, ঔ ছাড়া যে সমস্ত যৌগিক স্বর আছে সেগুলির বিচিত্র ব্যবহার দেখা যায় । উদাহরণ—‘নাইতে’—এখানে নাই যৌগিক স্বরটি একটি রুদ্ধদলের মত ব্যবহার করে। অনুরূপ যেমন ‘না চাও’—এখানে ‘চাও’ একটি রুদ্ধদল। কিন্তু ‘ঘুমিয়ে পড়া’–“মিয়ে’ যৌগিক স্বরান্ত দল।
- একপদী থেকে চৌপদী, পয়ার প্রভৃতি এই ছন্দের অনুকূল।
- নৃত্য চপলতা ধ্বনি স্পন্দ সৃষ্টি করে।
- সাধারণতঃ প্রতিটি চরণে চারটি পর্ব থাকে, অপূর্ণ পর্ব সহ। (তবে ব্যতিক্রম আছে)
- স্বরবৃত্ত ছন্দে রুদ্ধদল/অক্ষর কখনো কখনো দ্বিমাত্রিক হতে পারে।
- প্রবোধচন্দ্র সেন বলেছেন দলবৃত্ত ছন্দে পঙক্তির সর্বশেষ পর্বের পরও যদি একটি মাত্র রুদ্ধদল থাকে, তবে তার মাত্রা ধরতে হবে ২ মাত্রা। কারণ চরণের শেষ পর্বের শেষ স্বাধীন রুদ্ধদলটি প্রসারিত হয়।
- দলবৃত্তের বাচনভঙ্গীর বিশিষ্টতা ও নমনীয়তার জন্য পর্বের মাত্রা সংখ্যা ২, ৩ ও ৫ থাকলে প্রসারিত ও সংকুচিত করে মাত্রা সমতা রক্ষা করতে হয়।
- সাধারণত কথ্য রীতি হলেও সাধু রীতিতেও দলবৃত্তের দৃষ্টান্ত দুর্লভ নয়।
Leave a Reply