দৌলত উজির বাহরাম খানের লায়লী মজনু সম্পর্কে আলোচনা কর।

দৌলত উজির বাহরাম খান: লায়লী মজনু 

দৌলত উজির বাহরাম খান রচিত লায়লী-মজনু কাব্য রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান কাব্যধারায় একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে স্থান পেয়েছে। কবি তাঁর কাব্যে যে আত্মপরিচয় লিখে গেছেন তা থেকে তেমন কোন বিস্তারিত তথ্য অবগত হওয়া যায় না। কবির ব্যক্তিজীবনের পরিচয় থেকে জানা যায় যে, তিনি চট্টগ্রামের ফতেহবাদ বা জাফরাবাদের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর পিতা মোবারক খান চট্টগ্রামের অধিপতির কাছ থেকে দৌলত উজির উপাধি পেয়েছিলেন। কবির পূর্বপুরুষ হামিদ খান গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহের প্রধান অমাত্য ছিলেন। বাহরাম খান শিশু বয়সে পিতৃহীন হন। ‘চাটিগ্রাম অধিপতি মহামতি নৃপতি নেজাম শাহ সুর’ তাকে তার পিতার দৌলত উজির খেতাব প্রদান করেন। কবির পীরের নাম ছিল আসাউদ্দিন। কবির ওপর তার গভীর প্রভাব বিদ্যমান ছিল।

দৌলত উজির বাহরাম খান তাঁর কাব্যে নিজের আবির্ভাব কাল সম্পর্কে কোন তথ্য প্রদান করেননি। তবে পীর ও রাজপ্রশস্তি থেকে পণ্ডিতেরা কবির কাল বা কাব্য রচনার কাল সম্পর্কে অনুমান করেছেন। কিন্তু এ সম্পর্কে পণ্ডিতগণের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কবি ১৫৬০ সালের কাছাকাছি সময়ে নিজাম শাহ সুর কর্তৃক দৌলত উজির উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। ড. মুহম্মদ এনামুল হক এই সময়কাল বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত করেন যে, ১৫৬০ থেকে ১৫৭৫ সালের মধ্যে কবি লায়লী-মজনু কাব্য রচনা করেছিলেন। ড. আহমদ শরীফ ১৫৪৩ থেকে ১৫৫৩ সালের মধ্যে কাব্যের রচনাকাল বলে মনে করেন। কবি জানিয়েছেন, গৌড়ের অধীনতা দূর হবার পরে নিজাম শাহ নৃপতি হয়েছিলেন এবং তাঁর দৌলত উজির থাকাকালে তিনি লায়লী-মজনু রচনা করেছেন। নিজাম শাহ সম্ভবত একজন সামন্ত জমিদার ছিলেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে লায়লী-মজনু কাব্যের রচনাকাল ১৬৬৯ সাল। কাব্যটি কবির পরিণত বয়সের রচনা। ইমাম বিজয় কবির অপর কাব্য—জীবনের প্রথম দিকে কাব্যটি রচিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। আত্মপরিচয়বিষয়ক প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের বর্ণনা আছে তাঁর কাব্যে—

নগর ফতেয়াবাদ          দেখিয়া পুরএ সাধ 

চাটিগ্রাম সুনাম প্রকাশ।

মনোভব মনোরম            অমরাবতীর সম

সাধু সৎ অনেক নিবাস॥

লবণাম্বু সন্নিকট           কর্ণফুলী নদীতট

তাতে সাহা বদর আলম।

আদেশিলা গৌড়েশ্বরে     উজির হামিদ খারে 

অধিকারী হৈতে চাটিগ্রাম॥

কবি দৌলত উজির বাহরাম খান রচিত ‘লায়লী-মজনু’ কাব্যটি ফারসি কবি জামীর লায়লী-মজনু নামক কাব্যের ভাবানুবাদ। লায়লী ও মজনুর প্রেমকাহিনি সারা বিশ্ব জুড়ে পরিচিত। এই কাহিনির মূল উৎস আরবি লোকগাথা। কাহিনিটিকে ঐতিহাসিক দিক থেকে সত্য বিবেচনা করা হয়। ফারসিতে দশ জন কবি এই প্রেমকাহিনি অবলম্বনে কাব্য রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়।

আমির-পুত্র কয়েস বাল্যকালে বণিক-কন্যা লায়লীর প্রেমে পড়ে মজনু বা পাগল নামে খ্যাত হয়। লায়লীও মজনুর প্রতি গভীর আকর্ষণ অনুভব করে। কিন্তু উভয়ের বিবাহে আসে প্রবল বাধা; ফলে মজনু পাগলরূপে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে থাকে। অন্যদিকে লায়লীর অন্যত্র বিয়ে হলেও তার মন থেকে মজনুর সরে যায়নি। তাদের দীর্ঘ বিরহজীবনের অবসান ঘটে করুণ মৃত্যুর মাধ্যমে। এই মর্মস্পর্শী বেদনাময় কাহিনি অবলম্বনেই লায়লী-মজনু কাব্য রচিত। দৌলত উজির বাহরাম খান ফারসি কাব্যের ভাবানুবাদ অবলম্বন করলেও তার স্বাধীন রচনা এতে স্থান পেয়েছে। কাব্যটির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ড. মুহম্মদ এনামুল হক মম্ভব্য করেছেন— “নিছক কাব্যরস, লিপিচাতুর্য, ভব্যতা ও শালীনতায় ‘লায়লী মজনু’র সমকক্ষ কাব্য খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে একটিও নাই বলিলে অত্যুক্তি হয় না।’’ কবি কাব্যের বক্তব্য রূপায়ণে গতানুগতিক ঐতিহ্য অনুসরণ করেছেন বলে ভাবের ক্ষেত্রে কোন নতুনত্বের পরিচয় নেই। কিন্তু কবিতৃশক্তি প্রকাশে কবি যথেষ্ট সার্থকতা লাভ করেছেন। তাঁর বিষয়জ্ঞান, নাগরিক বৈদগ্ধ্য, পরিমার্জিত ভাষা, সাবলীল প্রকাশভঙ্গি এবং শিল্পসচেতনতা, তার শিরোদেশে গৌরবমুকুট পরিয়ে দেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!