মঙ্গলকাব্যের ধারায় ধর্মমঙ্গলের স্বতন্ত্রতা বিশ্লেষণ কর।
ধর্মমঙ্গল কাব্যের স্বতন্ত্র
প্রথমত: ধর্মঠাকুর হল পুরুষ দেবতা। কিন্তু চণ্ডীমঙ্গল ও মনসামঙ্গলে স্ত্রী দেবতা।
দ্বিতীয়ত: চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল বৃহৎ বঙ্গে প্রচলিত থাকলেও ধর্মমঙ্গল শুধুমাত্র রাঢ় অঞ্চলের কাব্য।
তৃতীয়ত: আর কোনো দেবতার পূজায় জাতিভেদ বিড়ম্বিত হিন্দু সমাজ এত ভেদবুদ্ধিহীন সর্বজনীন ভক্তির আশ্রয়ে ঐক্যের স্ফূরণ অনুভব করেনি। আর কোন দেবতার পূজায় এমন হাতেনাতে ফল পায়নি। আর কোন পূজায় ভক্তদের নেশাহীন বিশ্বাসের সঞ্চার হয়নি। কাজেই ধর্মঠাকুরের প্রভাব প্রতিপত্তি যে অন্যান্য লৌকিক দেবদেবীর পরোক্ষ আহ্বান ও বিলম্বিত বিপদমুক্তির ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত মর্যাদা অপেক্ষা বেশি সজীব ও সক্রিয় ছিল তা বোঝা যায়।
চতুর্থত: ধর্মমঙ্গলের কাহিনিতে অনেক কাল্পনিক গল্প আখ্যান থাকলেও এর পটভূমিকায় প্রাচীন গৌড়দেশের ঐতিহাসিক ঘটনা প্রচ্ছন্নভাবে রয়েছে। বিষয়বস্তুর প্রাচীনত্বে মঙ্গলকাব্য সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। এই কাব্যে বর্ণিত ঘটনাগুলি খ্রিস্টীয় দশম শতকের বলে মনে হয়। লাউসেন, ইছাই ঘোষ ঐতিহাসিক চরিত্র।
পঞ্চমত: অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের মতো ধর্মমঙ্গল কাব্যেও যুদ্ধের বর্ণনা আছে। কিন্তু সেইসব যুদ্ধ অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের মতো নেপথ্যবাসিনী মহামায়ার অদৃশ্য উপস্থিতিতে ঘটেনি, তা ঘটেছে ইতিহাসের প্রত্যক্ষ ঘটনার সন্নিবেশে। তাই ধর্মমঙ্গল কাব্যে যুদ্ধগুলি বিশুদ্ধ রাজনৈতিক প্রয়োজন ও মানবিক বৃত্তি সঞ্জাত। সামন্তরাজ কর্ণসেনের ছয় পুত্র একটি যুদ্ধে নিহত হয়। ছয় পুত্রবধূ সহমৃতা হন।
রানি দুঃখে আত্মঘাতী হন এবং বৃদ্ধ রাজার অন্তিম জীবনে নিঃসঙ্গতার বেদনা ঘনীভূত হয়। এই ঘটনা মনসামঙ্গলে লক্ষ করা যায়। সুতরাং নির্মম, সান্ত্বনাহীন, ভাগ্য বিড়ম্বনার উদাহরণ ধর্মমঙ্গলের কাহিনিতে যেভাবে দেখা যায় তা অন্য কোথাও দেখা যায় না।
ষষ্ঠত: এই কাব্যের সন্ধান পাওয়া যায় অপেক্ষাকৃত অর্বাচীনকালে।
সপ্তমত: অন্যান্য কাব্যের নায়ক-নায়িকার আবির্ভাব অভিশপ্তীয় রীতিতে। কিন্তু এ কাব্যে কোন স্পষ্ট নির্দেশ নেই।
অষ্টমত: দেবখণ্ড ও নরখণ্ডের মধ্যে স্পষ্টত কোনো বিভাগ এখানে লক্ষ করা যায় না। তাছাড়া ধর্মমঙ্গলের কাহিনি বারোটি পালায় (‘মতি’) বিভক্ত।
তথ্যসূত্র:
১. বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস: আশুতোষ ভট্টাচার্য
২. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত: অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস: সুকুমার সেন
Leave a Reply