//
//

ধ্বনিরাত্মা কাব্যস্য— মতটি কতটা গ্রহণযোগ্য, তা বিশ্লেষণ কর।

ধ্বনিরাত্মা কাব্যস্য

বিভিন্ন সমালোচনায় অবিচলিত থেকে ধ্বনিবাদীরা মত প্রকাশ করেছেন যে কাব্যের ধ্বনি তার বাচ্যার্থের মতো এত স্পষ্ট জিনিস নয়। তাঁদের মতে যেসব পাঠকের বিন্দুমাত্র কাব্যবোধ আছে সেইসব পাঠককে বোঝানো যায় যে কাব্যের আত্মা হচ্ছে ‘ধ্বনি’, বাচ্যাতিরিক্ত এক বিশেষ বস্তুর ব্যঞ্জনা। কারণ বাচ্য বা বক্তব্য এক অথচ এই ধ্বনির অভাবে এক বাক্য কাব্য নয় আর ধ্বনি আছে বলেই অন্য বাক্যটি শ্রেষ্ঠ কাব্য তা সহজেই বোঝানো যায়। সমালোচক অতুলচন্দ্র গুপ্ত ধ্বনিবাদীদের সপক্ষে উদাহরণ দিয়েছেন—

কৃতে বরকথালাপে কুমার্যঃ পুলকোদগমৈঃ।

সূচয়ন্তি স্পৃহামন্তর্লজ্জায়বনতাননাঃ।।

অর্থাৎ বিবাহ বিষয়ে বর প্রসঙ্গে কথালাপ আরম্ভ হলে কুমারীগণ লজ্জায় অবনতমুখী হয়েও পুলকোদ্‌গমের সাহায্যে অন্তর্গত স্পৃহা সূচনা করে। কিন্তু কোনো কাব্যরসিক এই শ্লোকটিকে কাব্য বলবেন না। অথচ একই কথা নিয়ে কালিদাস তার ‘কুমারসম্ভব কাব্যে’ লিখলেন—

এবংবাদিনি দেবর্ষৌ পার্শ্বে পিতুরধোমুখী।

লীলাকমলপত্রাণি গণয়ামাস পার্বতী।।

অর্থাৎ দেবর্ষি অঙ্গিরা যখন মহাদেবের কাছে পার্বতীর বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন তখন পার্বতী অধোমুখী হয়ে পদ্মের পাতাগুলি গণনা করতে লাগলেন। কিন্তু এই বাক্যের কাব্যত্ব কোথায়? ধ্বনিবাদীরা বলবেন এই কবিতার শব্দার্থ লীলাকমলের পত্রগণনাকে ছাড়িয়েও এখানে পূর্বরাগের লজ্জা ফুটে উঠেছে। এখানেই এর কাব্যত্ব। সমালোচক অতুল গুপ্ত এরপর দুটি শ্লোক এবং একটি বাংলা কবিতাংশ তুলে ধরে একথা প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন যে, দুটি শ্লোকের বক্তব্য এক হলেও ব্যঞ্জনা বা ধ্বনির অভাবে তা কাব্য হয়নি। আর তৃতীয় বাংলা কবিতাটিতে বাচ্যের অতিরিক্ত বস্তুর ব্যঞ্জনা থাকায় তা কাব্য হয়েছে—

মদনের দেহ ভস্ম হয়েছে কিন্তু তার প্রভাব সমস্ত বিশ্বময়। এই ভাব নিম্নের কবিতাদুটিতে বলা হয়েছে—

১)   স একস্ত্রীণি জয়তি জগন্তি কুসুমায়ুধঃ।

হরতাপি তনুং যস্য শম্ভুনা ন হৃতং বলম্।।

এর অর্থ করলে দাঁড়ায় সেই এক কুসুমায়ুধ যিনি তিনলোক জয় করেন। শম্ভু তাঁর দেহ হরণ করলেও তাঁর বল হরণ করতে পারেননি।

২)   কর্পূর ইব দগ্ধোহপি শক্তিমান যো জনে জনে।

 নমোহস্ত্ববার্যবীর্যায় তস্মৈ কুসুমধধন্বনে।।

এর অর্থ করলে দাঁড়ায় যে মদন  দগ্ধ হলেও কর্পূরের মতো প্রতিজনকে তাঁর গুণ জানাচ্ছে, অবার্যবীর্য সেই কুসুমধনু মদনকে নমস্কার।

অভিনব গুপ্ত বলেছেন এই শ্লোকদুটিতে বাচ্যাতিরিক্ত ব্যঞ্জনা না থাকায় এরা কাব্য হয়ে ওঠেনি। প্রথম কবিতাটি মদনের শক্তির কারণ অচিন্ত্য এই ভাব প্রকাশ করেই শেষ হয়েছে। আর দ্বিতীয়টি কর্পূরের স্বভাবের সঙ্গে মদনের স্বভাবের তুলনাতেই শেষ হয়েছে। কিন্তু ঠিক এই কথাই রবীন্দ্রনাথ ‘মদনভস্মের পর’ কবিতায় কাব্য হয়ে উঠেছে—

পঞ্চস্বরে দগ্ধ ক’রে করেছ একি সন্ন্যাসী!

বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে।

ব্যাকুলতর বেদনা তার বাতাসে ওঠে নিশ্বাসি,

অশ্রু তার আকাশে পড়ে গড়ায়ে।

এই কবিতার কথা তার বাচ্যকে ছাড়িয়ে মানব মনের যে চিরন্তন বিরহ যা মিলনের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে তারই ব্যঞ্জনা প্রকাশ করেছে। এবং সেখানেই এর কাব্যত্ব।

উপরোক্ত তিনটি উদাহরণেই দেখা গেল— কাব্যের আত্মা হচ্ছে তার বাচ্য নয়, ‘ব্যঞ্জনা’, কথা নয়, ‘ধ্বনি’-এ ব্যঞ্জনা কিসের ব্যঞ্জনা, এ ধ্বনি কিসের ধ্বনি? ধ্বনিবাদীরা এর উত্তরে বলেছেন, এটি রসের ধ্বনি। তাঁরা আরো বলেছেন, বাক্য যদি কেবলমাত্র বস্তু বা অলংকারের ব্যঞ্জনা প্রকাশ করে তবে তা কাব্য হয় না। রসের ব্যঞ্জনাই বাক্যকে কাব্য করে। কাব্যের ধ্বনি হচ্ছে রসের ধ্বনি। তিনটি উদাহরণেই কবিতার বাচ্য রসের ব্যঞ্জনাকে প্রকাশ করেছে বলেই তা কাব্য। এই রসের যোগেই অতিপরিচিত সাধারণ কথা নবীনত্ব লাভ করে কাব্যে পরিণত হয়—

দৃষ্টপূর্বা অপি হ্যর্থাঃ কাব্যে রসপরিগ্রাহাৎ।

সর্বে নবা ইবাভান্তি মধুমাস ইব দ্রুমাঃ।।

অর্থাৎ পূর্ব পরিচিত অর্থও রসের সমাগমে কাব্যত্ব লাভ করে ঠিক যেমন করে বসন্তের সমাগমে নতুন পাতার আগমন বৃক্ষকে নতুন করে তোলে। অর্থাৎ কাব্যের আত্মা ‘ধ্বনি’ বলে যাঁরা আরম্ভ করেছেন, কাব্যের আত্মা ‘রস’ বলে তাঁরা উপসংহার করেছেন। সেদিক থেকে বলা যায় ‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্’। কাব্য হচ্ছে সেই বাক্য, রস যার আত্মা।

তথ্যসূত্র:

১. কাব্যজিজ্ঞাসা: অতুলচন্দ্র গুপ্ত

২. কাব্যালোক: সুধীরকুমার দাশগুপ্ত

৩. ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব: অবন্তীকুমার সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!