ধ্বনির সংজ্ঞা ও শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর।
ধ্বনি ও বর্ণ
ধ্বনিই হল ভাষার মূল উপকরণ। মানুষের বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনি থেকে ভাষার সৃষ্টি। কাজেই, এক বা একাধিক ধ্বনির সমবায়ে মানুষের মনের এক-একটি ভাব ব্যক্ত হয়। কালক্রমে, মানুষ মুখের ভাষাকে দূরে প্রেরণ করতে বা স্থায়িত্ব দান করতে চাইল। সেই তাগিদ থেকে সৃষ্টি হল লিপির। ‘আদিম স্তরে দেখা দিয়েছিল চিত্রাঙ্কন-প্রবৃত্তি।’ ‘মানুষ ছবি এঁকে মনের ভাব প্রকাশ করতে শিখলো। সেই চিত্রলিপি [Pictogram] বিবর্তিত হতে হতে ধ্বনিলিপির [alphabetic script] রূপ পরিগ্রহ করলো। তখন তার নাম হল ধ্বনি-চিহ্ন বা বর্ণ [letter]। কাজেই, বর্ণ হl ধ্বনির প্রতীক বা রূপচিত্র। এক-একটি ধ্বনির জন্যে এক-একটি পৃথক বর্ণ রচিত হল। এইভাবে রচিত হল বর্ণমালা [alphabet]। ভাষাতাত্ত্বিকগণের মতে, অশোকের ব্রাহ্মীলিপি থেকে কালক্রমে বাংলা লিপির উদ্ভব। বাগযন্ত্র ও নিশ্বাসবায়ুর সমবায়ে উচ্চারিত বর্ণকে ধ্বনি বলা হয়। আবার, ধ্বনির লিখিত রূপকেই বলা হয় বর্ণ। ধ্বনি বা বর্ণই শব্দের [word] মূল উপকরণ। কাজেই, উচ্চারিত শব্দসমূহকে বিশ্লেষ করলে ধ্বনি [sound] বা বর্ণ [letter] পাওয়া যায়।
কাজেই, ধ্বনিকে লিখিত আকারে ব্যক্ত করবার জন্যে যে চিহ্ন বা প্রতীক ব্যবহার করা হয়, তাকে বলা হয় বর্ণ। ধ্বনি হল বর্ণের উচ্চারিত রূপ এবং বর্ণ ধ্বনির লিখিত রূপ। যেমন: ‘আম’ শব্দটি বিশ্লেষণ করলে ‘আ’ ও ‘ম’ দুটি পৃথক ধ্বনি বা বর্ণ পাওয়া যায়। তেমনি, ‘রবি’ শব্দটি র্+অ+ব্+ই—এই চারটি ধ্বনি বা বর্ণের সমবায়ে গঠিত। বাংলা লিপি মূল ব্রাহ্মীলিপি থেকে জাত। কিন্তু বাংলায় ব্রাহ্মীলিপির রূপ পরিবর্তিত হয়েছে। অন্যদিকে, কোন কোন সংস্কৃত ধ্বনিও বাংলায় লুপ্ত হয়েছে। যেমন: ঋ, ৯, য ও ণ। বাংলায় সংস্কৃত শব্দের সংখ্যা প্রায় পঞ্চান্ন হাজার। কাজেই, অনাবশ্যক হওয়া সত্ত্বেও ঐ শব্দগুলির জন্য বাংলায় বহু সংস্কৃত বর্ণকে স্বীকৃতি জানাতে হয়েছে। সেই হিসাবে বাংলা বর্ণমালায় [alphabet] আছে মোট একান্নটি বর্ণ।
বর্ণ ও অক্ষর
বর্ণ ও অক্ষর দুই স্বতন্ত্র বস্তু। ধ্বনি-নির্দেশক প্রতীক বা চিহ্নকে বলে বর্ণ। আর, একটি শব্দের যতখানি অংশ বাগযন্ত্রের স্বল্পতম প্রয়াসে একসঙ্গে সহজে উচ্চারিত হয়, তাকে বলা হয় অক্ষর [Syllable]। স্বরধ্বনি ছাড়া কোন ধ্বনি কিংবা কোন অক্ষর উচ্চারিত হতে পারে না। কাজেই, অক্ষরের মধ্যে অন্ততঃ একটি স্বরধ্বনি থাকা চাই। ব্যঞ্জনবর্ণ ছাড়া কেবল একটি স্বরবর্ণেই অক্ষর হতে পারে। কিন্তু স্বরবর্ণ ছাড়া কেবল ব্যঞ্জনবর্ণে কোন অক্ষর হতে পারে না। যেমন: ‘রবি’ শব্দের মধ্যে র্+অ+ব্+ই—এই চারটি বর্ণ আছে; কিন্তু এতে অক্ষর আছে মাত্র দুটি ও ‘র’ ও ‘বি’। কিন্তু লক্ষণীয় যে, প্রতি অক্ষরেই স্বরবর্ণ আছে। অক্ষর দু’প্রকার— স্বরান্ত ও ব্যঞ্জনান্ত বা হলন্ত। যে অক্ষরের অন্তে স্বরধ্বনি উচ্চারিত হয়, তাকে স্বরান্ত অক্ষর। বলে। যেমন: থাকো—থা+কো। অক্ষর দুটির প্রত্যেকটির অন্তে স্বরধ্বনি উচ্চারিত হয়েছে; কাজেই এরা স্বরান্ত অক্ষর [open syllable]। আবার, যে অক্ষরের অন্তে স্বরধ্বনি উচ্চারিত হয় না, তাকে ব্যঞ্জনান্ত বা হলন্ত অক্ষর বলে। যেমন: থাক্। এই অক্ষরটির অন্তে স্বরধ্বনি উচ্চারিত হয়নি; কাজেই, এটি ব্যঞ্জনান্ত বা হলন্ত অক্ষর [closed syllable]। এক-একটি অক্ষরের উচ্চারুণকালকে বলা হয় মাত্রা [mora]।
বর্ণের শ্রেণিবিভাগ
বর্ণ দু’প্রকার— স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ।
স্বরবর্ণ
যে সকল বর্ণ অন্য বর্ণের সাহায্য ছাড়া উচ্চারিত হতে পারে, তাদের স্বরবর্ণ বলে। অর্থাৎ, উচ্চারণ ব্যাপারে স্ব-নির্ভর বর্ণকে বলা হয় স্বরবর্ণ। বাংলায় প্রচলিত বর্ণমালায় রয়েছে— অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, [৯], এ, ঐ, ও, ঔ— এই বারোটি স্বরবর্ণ। এদের মধ্যে ৯-এর ব্যবহার বাংলায় নেই। কাজেই, বাংলায় ব্যবহৃত স্বরবর্ণের সংখ্যা এগারো। আবার, ঋ বাংলায় গৃহীত সংস্কৃত শব্দগুলিতেই শুধু ব্যবহৃত হয়। ঋ-র বাংলা উচ্চারণ ‘রি’।
স্বরধ্বনি প্রধানত দু’প্রকার— হ্রস্বস্বর ও দীর্ঘস্বর।
হ্রস্বস্বর
যে স্বরধ্বনিগুলিকে উচ্চারণ করতে অল্প সময় লাগে, তাদের বলে হ্রস্বস্বর। সংস্কৃতে হ্রস্বস্বর পাঁচটি— অ, ই, উ, ঝ, ৯।
দীর্ঘস্বর
আর, যে ও স্বরধ্বনিগুলিকে উচ্চারণ করতে বেশী সময় লাগে, তাদের বলে দীর্ঘশ্বর। সংস্কৃতে দীর্ঘস্বর আটটি: আ, ঈ, ঊ, ঋ, এ, ঐ, ও, ঔ। বাংলায় সংস্কৃতের মতো নির্দিষ্ট দীর্ঘস্বর নেই।
সংস্কৃতে স্বরধ্বনির উচ্চারণের হ্রস্বতা বা দীর্ঘতার ওপরে শব্দের অর্থ নির্ভর করে। কিন্তু বাংলায় তা নির্ভর করে না। তবু বাংলায় স্বরধ্বনির হ্রস্বতা-দীর্ঘতা সম্পর্কে কতকগুলি নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। সাধারণত শব্দের অন্তর্গত অক্ষর [syllable]-সংখ্যার ওপর স্বরধ্বনির হ্রস্বতা বা দীর্ঘতা নির্ভর করে। এক-অক্ষর-বিশিষ্ট শব্দের স্বরধ্বনির উচ্চারণ দীর্ঘ। যেমন: এক. ‘জল’ [জ+ল] শব্দের অ-কার দীর্ঘ, কিন্তু ‘জলা’ শব্দের অ-কার হ্রস্ব। আবার ‘কাক’ শব্দের আ-কার দীর্ঘ। কিন্তু ‘কাকা’ শব্দের আ-কার হস্ব। দুই. ‘দিন’, ‘দীন’ ও ‘দিন’ [দান করুন]—এক-অক্ষর-বিশিষ্ট এই তিনটি শব্দ যখন এককভাবে উচ্চারিত হয়, তখন এদের ‘ই’ বা ‘ঈ’ দীর্ঘ! কিন্তু অন্যপদে যুক্ত হলে বা কোন বাক্যে প্রযুক্ত হলে এদের উচ্চারণ হয় হ্রস্ব। যেমন: ‘দিন’-রাত, ‘দীন’-দুনিয়ার মালিক, ওকে বলে ‘দিন’ তো। তিন ‘গুণ’ [quality]-এর ‘উ’ কার দীর্ঘ, কিন্তু ‘গুণী’র ‘উ’-কার হ্রস্ব। তেমনি—‘রূপ’-এর ‘ঊ’-কার দীর্ঘ হলেও ‘রূপা’র ‘ঊ’ কার হ্রস্ব। চার. ‘এক’ শব্দের উচ্চারণ ‘অ্যাক’ হওয়ায় এখানে ‘এ’ দীর্ঘ; কিন্তু ‘একটি’ শব্দের উচ্চারণ স্বাভাবিক হওয়ায় তাতে ‘এ’র উচ্চারণ হ্রস্ব। পাঁচ. ‘লোক’ শব্দের ‘ও’-কার দীর্ঘ; ‘লোকটি’ শব্দের ‘ও’-কার হস্ব। বাংলা স্বরধ্বনির উচ্চারণের ধরাবাঁধা নিয়ম না-থাকায় ‘ই’ ও ‘ঈ’ এবং ‘উ’ ও ‘ঊ’-র বানানের ক্ষেত্রে সংস্কৃত নিয়ম-মতে প্রায়ই বিভ্রাট ঘটে। যেমন: দিঘি—দীঘি—দিঘী;ু চুন—চূন।
প্লুতস্বর
হ্রস্ব ও দীর্ঘস্বর ছাড়া আর-এক প্রকার স্বরধ্বনি আছে, তা প্লুতস্বর। কান্নার সময় বা দূর থেকে কাউকে ডাকতে গেলে ডাকের রেশ অনেকক্ষণ ধরে টেনে রাখতে হয়। যেমন: কেষ্টা—আ-আ; হরে-এ-এ। দুর থেকে ডাকা, কান্না, গান ও আবৃত্তির সময় টেনে টেনে যে স্বরধ্বনিকে উচ্চারণ করতে হয়, তাকে বলে প্লুতসর। যেমন: ‘হে ভবেশ’—হে এ-এ ভবেশ, ‘এসো হে আর্য—এসো হে আর্য-অ-অ।
স্বরধ্বনির শ্রেণিবিভাগ
স্বরধ্বনিকে অন্য দিক দিয়ে দু’শ্রেণিতে ভাগ করা যায়— মৌলিক স্বরধ্বনি ও যৌগিক স্বরধ্বনি বা সন্ধ্যাক্ষর।
মৌলিক স্বরধ্বনি
যে স্বরধ্বনিগুলিকে আর বিশ্লেষণ করা যায় না, তাদের বলা হয় মৌলিক স্বরধ্বনি। সংস্কৃত ভাষায় স্বরধ্বনির সংখ্যা তেরো। তার মধ্যে বাংলা ভাষায় গৃহীত স্বরধ্বনির সংখ্যা বারো। কিন্তু মৌলিক স্বরধ্বনি আছে মাত্র সাতটি। যেমন: অ, আ, ই, উ, এ, অ্যা, ও। আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক উচ্চারণে এক প্রকারের বিকৃত ‘আ’ ধ্বনির পরিচয় পাওয়া যায় । এই ‘আ’ সম্মুখ দিকে প্রসারিত জিহ্বার সাহায্যে উচ্চারিত হয়। এই ‘আ’-কে তালব্য [Palatal]-‘আ’ বলা যায়। যেমন: কাইল [tomorrow=কাল] বা আইজ [today=আজ], মাইর [=মার]— এই শব্দগুলির ‘আ’-এর উচ্চারণ বিকৃত তালব্য উচ্চারণ। উচ্চারণে জিহ্বার অবস্থান-অনুসারে স্বরধ্বনিগুলিকে দু”শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা হয়। যেমন: সম্মুখস্থ স্বরধ্বনি ও পশ্চাদ্ভাগস্থ স্বরধ্বনি। ই, এ, অ্যা, আ— এদের উচ্চারণে জিহ্বা সম্মুখদিকে প্রসারিত হয়, সেজন্যে এদের বলা হয় সম্মুখস্থ স্বরধ্বনি বা প্রসারিত স্বরধ্বনি [Front or Refracted vowels]। আবার, উ, ও, অ, আ— এদের উচ্চারণে জিহ্বা পশ্চাদ্ভাগের দিকে আকৃষ্ট হয়, সেজন্যে এদের নাম পশ্চাদ্ভাগস্থ স্বরধ্বনি [Back vowels]। এদের মধ্যে অ, উ, ও— এই তিনটি স্বরধ্বনি উচ্চারণ করবার সময় ওষ্ঠদ্বয় কুঞ্চিত হয় বলে এদের বলা হয় কুঞ্চিত স্বরধ্বনি [Rounded vowels]। ই, উ—এই স্বরধ্বনি-যুগলের উচ্চারণে মুখ-বিবর সংবৃত বা সংকুচিত থাকে; তাই এদের বলা হয় সংবৃত স্বরধ্বনি [Closed vowels)। ‘অ্যা’ এবং ‘আ’-র উচ্চারণে মুখ-বিবর বিবৃত বা প্রসারিত হয়, সেজন্যে এদের বলা হয় বিবৃত স্বরধ্বনি [Open vowels]। সম্মুখস্থ স্বরধ্বনির মধ্যে ‘ই’ উচ্চস্বর [high], ‘এ’, ‘অ্যা’-মধ্যস্বর [middle], ‘আ’ নিম্নস্বর [low] পশ্চাদ্ভাগস্থ স্বরধ্বনির মধ্যে ‘উ’ উচ্চস্বর [high]; ‘ও’, ‘অ’ মধ্যস্বর [middle]; ‘আ’ নিম্নস্বর [low]।
যৌগিক স্বরধ্বনি
ভিন্ন ভিন্ন স্বরের সাহায্যে গঠিত স্বরধ্বনিকে বলা হয় যৌগিক স্বরধ্বনি বা মিশ্র স্বরধ্বনি বা সংযুক্তর বা সন্ধিস্বর বা দ্বিস্বরধ্বনি বা সন্ধ্যক্ষর [Diphthong)। যেমন: ‘ঐ’ এবং ‘ঔ’। বাংলায় এই দুটি যৌগিক স্বরের উচ্চারণ যথাক্রমে ও+ই=ওই এবং ও+উ=ওউ। আচার্য সুনীতিকুমার বাংলায় দুই স্বরধ্বনির সহাবস্থানে সর্বমোট পঁচিশটি যৌগিক স্বর বা সন্ধ্যক্ষরের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছেন। যেমন: অয়=বয়, ভয়, কয়, নয়; আ আ [অওয়া]=লওয়া; অও=হও, বও; আয়=যায়, খায়, দায়; আই=খাই, ভাই; আউ=ঢাউস, চাউল, বাউল; আও=দাও, নাও; আও=ম্যাও; ইয়া=নাইয়া, খাইয়া; ইএ, ইয়ে=বিয়ে, টিয়ে; ইউ=শিউলি বিউলি; ইয়, ইও, ইয়ো=প্রিয়, দিও, নিয়ো; উই=যুঁই, রুই, গলুই, উয়ে=ভুঁয়ে, কুঁয়ে; উও, উয়ো=কুয়ো, দুও; এয়, অ্যায়=নেয়, দ্যায় [দেয়]; এয়া=দেয়া [মেঘ], খেয়া, কেয়া; এই এও যেও, সেও, এয়ো; এউ=ঢেউ ফেউ কেউ; ওয়= শোয়, দোয়; ওআ, ওয়া=মোয়া, সোয়া; ওউ, অউ=হউক, বউ; ওই=কই, রই, সই।
তাছাড়া, তিন. স্বরধ্বনির সহাবস্থান=গিয়েও; চার. স্বরধ্বনির সহাবস্থান=আনাইয়াও; পাঁচ. স্বরধ্বনির সহাবস্থান=ধোওয়াইয়া; ছয়. স্বরধ্বনির সহাবস্থান=খাওয়াইয়াও ইত্যাদি দেখা যায়।
সানুনাসিক বা অনুনাসিক স্বরধ্বনি ও নিরনুনাসিক স্বরধ্বনি
নাসিকার সাহায্যে উচ্চারণের ভিত্তিতে স্বরধ্বনিকে আবার দু’ভাগে ভাগ করা যায়: সানুনাসিক বা অনুনাসিক স্বরধ্বনি ও নিরনুনাসিক স্বরধ্বনি। নাসিকার সাহায্যে উচ্চার্য স্বরধ্বনিকে সানুনাসিক বা অনুনাসিক স্বরধ্বনি বলে। যেমন: আঁকা, বাঁকা, ফাঁকা, শাঁখা ইত্যাদি। নাসিকার সাহায্য ব্যতীত উচ্চার্য স্বরধ্বনিকে বলে নিরনুনাসিক স্বরধ্বনি। যেমন: শাখা, হাসা, কাদা ইত্যাদি।
ব্যঞ্জনবর্ণ
যে-সব বর্ণ স্বরবর্ণের সাহায্য ছাড়া স্বয়ং উচ্চারিত হতে পারে না, তাদের ব্যঞ্জনবর্ণ বলে। অর্থাৎ, উচ্চারণ ব্যাপারে স্বর-নির্ভর বর্ণকে ব্যঞ্জনবর্ণ বলা হয়। বাংলায় ব্যঞ্জনবর্ণ উনচল্লিশটি। ক, খ, গ, ঘ, ঙ; চ, ছ, জ, ঝ, ঞ; ট, ঠ, ড, ঢ, ণ; ত, থ, দ, ধ, ন; প, ফ, ব, ভ, ম; য, র, ল, ব; শ, ষ, হ; ড়, ঢ়, য়; ৎ, ং, ঃ। এদের মধ্যে ড, ঢ, য ও ত থেকে যথাক্রমে ড, ঢ, য়, ও হয়েছে।
উচ্চারণ-রীতি অনুসারে বিভিন্ন ব্যঞ্জনবর্ণের বিশেষ বিশেষ পরিচয়:
স্পর্শবর্ণ [Stops]
বাংলা বর্ণমালার ক্ থেকে ম্ পর্যন্ত পঁচিশটি ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণের জিহ্বার অগ্রভাগ, মধ্যভাগ বা মূলভাগ বাগ্যন্ত্রের বিশেষ বিশেষ অংশকে স্পর্শ করে কিংবা তাতে ঠোঁটে স্পর্শ হয় বলে এদের স্পর্শবর্ণ বলা হয়। আচার্য রামেন্দ্রসুন্দরের মতে, এগুলির উচ্চারণকালে “কণ্ঠ—তন্ত্রী কাপাইয়া কণ্ঠনালী হইতে বায়ু মুখ-কোটরে আসিতেছে, এমন সময় ক্ষণেকের মত জিহ্বার গোড়াকে উপরে তুলিয়া কণ্ঠের দুয়ার আটকাইয়া দিলাম, আর ধ্বনি বাহির হইল ‘ক’; জিহ্বামূলের ‘স্পর্শকালে’ উহার উৎপত্তি; কাজেই, উহা জিহ্বামূলীয় স্পর্শবর্ণ।”
স্পর্শবর্ণগুলিকে আবার পাঁচটি করে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা হয়। এই ভাগগুলিকে বলা হয় বর্গ। বর্গের আদ্যক্ষর দিয়ে বর্গের নামকরণ হয়। যেমন : ক-বৰ্গ—ক, খ, গ, ঘ, ঙ। চ-বর্গ— চ, ছ, জ, ঝ, ঞ। ট-বর্গ— ট, ঠ, ড, ঢ, ণ। ত-বৰ্গ— ত, থ, দ, ধ, ন। প-বর্গ— প, ফ, ব, ভ, ম।
স্মরণীয় কোন বর্ণের উচ্চারণে বাগযন্ত্রে শ্বাসবায়ু পূর্ণ বাধাপ্রাপ্ত হলে হয়ে যায় স্পৃষ্টবর্ণ; আংশিক বাধাপ্রাপ্ত হলে হয়ে যায় উষ্মবর্ণ।
উষ্মবর্ণ [Spirants]
শ, ষ, স ও হ— এই বর্ণগুলিকে উচ্চারণ করবার সময় নিশ্বাসবায়ুকে, আংশিক বাধাপ্রাপ্ত করে শিধ্বনির [Sibilant] মতো প্রবাহিত করতে হয় বলে এদের উষ্মবর্ণ বলা হয়। অর্থাৎ, আংশিক বাধাপ্রাপ্ত শ্বাসবায়ুর প্রাধান্য-যুক্ত বর্ণ-চতুষ্টয়কে উষ্মবর্ণ বলে।
অন্তঃস্থ বর্ণ
স্পর্শবর্ণ ও উষ্মবর্ণের অন্তর্বর্তী য, র, ল, ব— এই বর্ণ-চতুষ্টয়কে অন্তঃস্থ বর্ণ বলে। এদের মধ্যে ‘য’ ও ‘ব’-কে অর্ধস্বর [Semi-vowels] এবং ‘র’ ও ‘ল’-কে তরল স্বর [Liquids] বলা হয়ে থাকে। ‘ই’-কার এবং
‘উ’-কার এই দুই স্বরধ্বনি উচ্চারণ করবার সময় যদি জিহ্বাগ্র অধিক উচ্চ অথবা ওষ্ঠদ্বয় অধিক সঙ্কীর্ণ হয়ে বায়ুপথ আংশিকভাবে রুদ্ধ করে এবং ধ্বনি ঈষৎ উষ্ম হয়ে যায়, তখন ধ্বনি দুইটিকে অর্ধস্বর বলে।’—ড. সুকুমার সেন। ‘র’ ও ‘ল’ ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে যুক্তভাবে স্বরবর্ণের আচরণ করে বলে এদের ‘তরল স্বর’ বলা হয়।
স্মরণীয়: য=ই+অ এবং ব=উ+অ। য়=বিন্দুযুক্ত য। ‘য’—এর সংস্কৃত উচ্চারণ বজায় রাখতে ‘য়’-এর সৃষ্টি।
অর্ধ-ব্যঞ্জন [Sonant]
ন, ম, র, ও ল— এরা স্বরধ্বনির মতো একা অথবা ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে যুক্ত হয়ে অক্ষর [Syllable] গঠন করতে পারে। আবার, এরা এককভাবে ব্যঞ্জনধ্বনির মতো এবং ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে যুক্তভাবে স্বরধ্বনির মত আচরণ করে বলে এদের অর্ধ-ব্যঞ্জন বলা হয়।
অনুনাসিক বর্ণ [Nasals]
বর্গের পঞ্চম বর্ণের বা অন্তিম বর্ণের [অর্থাৎ ঙ, ঞ, ণ, ন, ম] এবং অনুস্বারের [ং] উচ্চারণ-কালে নিশ্বাস-বায়ু আংশিকভাবে নাসিকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় বলে এদের অনুনাসিক বর্ণ বা নাসিক্য বর্ণ বলা হয়।
মহাপ্রাণ বর্ণ [Aspirate]
কণ্ঠনালীর পেশী আকুঞ্চিত করে অতিরিক্ত বাধা সৃষ্টি করে বর্গের দ্বিতীয় ও চতুর্থ বর্ণকে উচ্চারণ করা হয় বলে এদের মহাপ্রাণ বর্ণ বলা হয়। প্রাণ, কথাটির অর্থ ‘নিশ্বাস’; উচ্চারণ কালে ‘হ’ জাতীয় ধ্বনিতেই তার প্রকাশ। যেমন: ক+হ=খ, গ+হ=ঘ, চ+হ=ছ, জ+হ=ঝ, ট+হ=ঠ, ড+হ=ঢ, ত+হ=থ, দ+হ=ধ, প+হ=ফ, ব+হ=ভ।
অল্পপ্রাণ বর্ণ [Unaspirated]
বর্গের প্রথম ও তৃতীয় বর্ণের উচ্চারণ ‘হ’ জাতীয় ধ্বনির আকারে নিশ্বাস বা প্রাণ যুক্ত হয় না বলে তাদের অল্পপ্রাণ বর্ণ বলে। যেমন: ক, গ; চ, জ; ট, ড; ত, দ; প, ব।
এদের মধ্যে চ [ক্+শ] ও জ [গ্+জ] উচ্চারণের শুরুতে স্পর্শবর্ণের মতো এবং শেষে ও উষ্মবর্ণের মতো উচ্চারিত হয়; সেজন্যে এদের ঘৃষ্টধ্বনি [Affricate] বলা হয়।
দ্বিব্যঞ্জন ধ্বনি
দুটি ব্যঞ্জনধ্বনি একসঙ্গে উচ্চারিত হয়ে একটি ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণ সম্পন্ন করলে তাকে দ্বিব্যঞ্জন ধ্বনি বলা হয়। যেমন: খ=ক্+হ, চ=ক্+শ। অর্থাৎ, মহাপ্রাণ ও ঘৃষ্টধ্বনি মাত্রই দ্বিব্যঞ্জন ধ্বনি।
অঘোষ বর্ণ [Unvoiced]
উচ্চারণে বর্গের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ণ মৃদু বা গাম্ভীর্যহীন বলে এদের অঘোষ বর্ণ বলা হয়। যেমন: ক, খ; চ, ছ; ট, ঠ; ত, থ; প, ফ।
ঘোষ বর্ণ [Voiced]
উচ্চারণে বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম বর্ণ গাম্ভীর্যযুক্ত বলে এদের ঘোষ বর্ণ বা নাদ বর্ণ বলা হয়। যেমন: গ, ঘ, ঙ; জ, ঝ, ঞ; ড, ঢ, ণ; দ, ধ, ন; ব, ভ, ম।
অযোগবাহ বর্ণ
ং এবং ঃ অন্য বর্ণের সঙ্গে সংযোগ ব্যতীত এদের ‘বাহ’ বা প্রয়োগ হয় না। সেইজন্যে এরা অযোগবাহ বা আশ্রয়স্থানভাগী বর্ণ।
ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণ-স্থান
সংস্কৃত বর্ণমালা অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে গঠিত। বাংলা বর্ণমালা উত্তরাধিকার-সূত্রে সংস্কৃত বর্ণমালার সেই বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে। মানুষের বাগ্যন্ত্র অনুক্রমিকভাবে কণ্ঠ, তালু, মূর্ধা, দন্ত ও ওষ্ঠ নিয়ে গঠিত। নিশ্বাসবায়ু প্রথমে কণ্ঠদেশে, পরে তালুদেশে, তারপর মূর্ধাদেশে, তারও পরে দন্ত-পঙ্ক্তিতে এবং অবশেষে ওষ্ঠদেশে প্রহৃত হয়ে নির্গত হয়ে যায়। বাংলা বর্ণমালাও সেইভাবে ঠিক পারম্পর্য রক্ষা করে সংগঠিত।
ক-বর্গ
ক খ গ ঘ ঙ: উচ্চারণ-কালে জিহামল ও তালুর কোমল অংশের সাহায্যে অবরোধ সৃষ্টির ফলে নিশ্বাস-বায়ু কণ্ঠদেশে প্রহৃত হয়। সেজন্যে এদের কণ্ঠ্য বর্ণ [Gutturals] বলা হয়। এদের উচ্চারণে জিহ্বামূলের ভূমিকা প্রধান বলে আচার্য ‘রামেন্দ্রসুন্দর’ এদের জিহ্বামূলীয় স্পর্শবর্ণ নামেও অভিহিত করেছেন।
চ-বর্গ
চ ছ জ ঝ ঞ: এদের উচ্চারণ-কালে জিহ্বার মধ্যভাগ তালুর কঠিন অংশকে স্পর্শ করে এবং উচ্চারণে তার ভূমিকা প্রধান বলে এদের তালব্য বর্ণ [Palatals) বলা হয়।
ট-বর্গ
ট ঠ ড ঢ ণ: এদের উচ্চারণে জিহ্বার অগ্রভাগ উলটে গিয়ে মূর্ধা [তালুর সামনের খাঁজকাটা অংশ] স্পর্শ করে এবং তাতে মূর্ধার ভূমিকা প্রধান বলে এদের মূর্ধন্য বর্ণ [Cerebrals] বলা হয়। এদের প্রতিবেষ্টিত বর্ণও বলা হয়।
ত-বর্গ
ত থ দ ধ ন: এদের উচ্চারণকালে জিহ্বার অগ্রভাগ উপরের দাঁতের গোড়ায় ঠোক্কর খায় এবং এতে দাঁতের ভূমিকা প্রধান বলে এদের দন্ত্যবর্ণ [Dentals] বলা হয়।
প-বর্গ
প ফ ব ভ ম: “দুই ঠোট পরস্পর স্পর্শ করিয়া তাহার মধ্য দিয়া জোরে বাতাস ছাড়িয়া দিলাম, অমনি ধ্বনি জন্মিল ‘প’।”— আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর। এদের উচ্চারণকালে ওপরের ওষ্ঠ নীচের অধরকে স্পর্শ করে এবং এতে ওষ্ঠের ভূমিকা প্রধান বলে এদের ওষ্ঠ্যবর্ণ [Labials] বলা হয়।
Leave a Reply