ধ্রুপদী সাহিত্যতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর।
ধ্রুপদী বা ক্লাসিকাল সাহিত্যবিচার
সাহিত্য বিচারের শ্রেষ্ঠ উপায় কী? সাহিত্য বিচারের শেষ কথা কে বলবেন? নিঃসন্দেহে দুটি প্রশ্নের উত্তরেই নীরব থাকতে হয়। সাহিত্য বিচারের যেমন কোনো রাজপথ নেই, তেমনি শেষ কথাও কিছু নেই। এক্ষেত্রেও “যত মত তত পথ’’। তবে যিনি যে পথেই অগ্রসর হোন, যে কোনো মতাদর্শকেই শেষপর্যন্ত ফিরে আসতে হবে এক জায়গায়। এ ব্যাপারে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সর্বত্রই একই সত্য চোখে পড়ে। তাই ভারতের পর ভামহ, দণ্ডী, বামন, এসেছেন ও আসছেন। তবে ভারতীয় অলংকার শাস্ত্রের ধারা থেমে গিয়েছে কয়েক শতাব্দী আগে। কিন্তু পাশ্চাত্য সাহিত্য বিচারের ধারা আজও নানা চেহারায় অব্যাহত। আমরা বাংলায় যে-সব সাহিত্যবিচার পদ্ধতি ব্যবহার করি তা পাশ্চাত্য মতাদর্শের কাছ থেকেই সংগৃহীত। একালে জাতীয় ঐতিহ্যের গৌরবময় উত্তরাধিকারের অবিনাশী অহংকারে লাভ নেই। ঐতিহ্যসূত্রে কিছু কিছু শব্দ এবং ধারণা (Concept) একালেও হয়তো আমরা বহন করে চলেছি; কিন্তু অবশ্যই পুরোনো শব্দের আভিধানিক অর্থতাৎপর্য একালে আর চলে না। আমাদের প্রাচ্য অলংকারশাস্ত্রের রীতিকে পাশ্চাত্যের পরিভাষায় বলা যায়। কিন্তু ওদেশের মতো আমাদের সাহিত্যে Neoclassical আন্দোলন আসেনি। Romantic আন্দোলন যা এসেছে তা উনিশ শতকে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। পাশ্চাত্যের প্রভাবই সেক্ষেত্রে মুখ্য।
Classical শব্দটি বিশেষণ। মোটামুটি তিনটি অর্থে এই শব্দের ব্যবহার চোখে পড়ে—
- প্রাচীন গ্রিস ও রোমের ভাষা, পুরাতত্ত্ব, দর্শন, শিল্প, স্থাপত্য প্রভৃতির যা কিছু প্রাচীন তাই ক্লাসিকাল।
- স্থাপত্য, ভাক্ষর্য, নাটক, মহাকাব্য প্রভৃতি যা কিছু গ্রিক ও রোমান শিল্পের অনুকরণে সৃষ্ট হয় তাকেই বলা হয় ক্লাসিকাল অথবা নব্য-ক্লাসিকাল।
- যে শিল্পকর্ম গ্রিক ভাবাদর্শ বা মেজাজ (Spirit) অনুকরণ করেছে তাই ক্লাসিক। বিশেষ (Classic), এবং বিশেষণ (Classical) আরও বিভিন্ন অস্পষ্ট অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন—সেরা রচনা বলতে বুঝি ক্লাসিক। এ অর্থে হোমারের মহাকাব্য, শেক্সগীয়রের নাটক, রবীন্দ্রনাথের যে-কোনো ভালো রচনা, সবই ক্লাসিক। যখন এই অর্থে শব্দটি ব্যবহার করা হয়, তখন লাতিন ‘Classicus’ কথাটাই মনে থাকে, যার অর্থ ‘hightest mark, বা উচ্চ মানের। এই অর্থে ভালোজাতের রোমান্টিক রচনাকেও ক্লাসিক বলা যেতে পারে। যেমন—রবীন্দ্রনাথের ‘রন্তকরবী’ নাটক, ‘গোরা’ উপন্যাস, ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্য ক্লাসিক বলে গণ্য হতে পারে। ক্লাসিকাল মিউজিক (ধ্রুপদী সংগীত) কথাটায় যে ক্লাসিক শব্দটা পাচ্ছি তা, দু’রকমের অর্থ মনে আসে। এক অর্থে বুঝি, ধ্রুপদী সংগীত হল সেই সংগীত যার সঙ্গে রোমান্টিক মেজাজের গানের পার্থক্য আছে। অন্য অর্থে বুঝি, ক্লাসিকাল মিউজিক হল ‘high class’ মিউজিক।
যাই হোক, আমাদের প্রথমেই স্মরণে রাখতে হবে যে রেনেসাঁসের সময় থেকে শব্দটির জন্ম। শব্দটির জন্ম দুটি লাতিন শব্দের মিশ্রণ থেকে। একটি হল ক্লাসিকাস যার অর্থ উচ্চশ্রেণি এবং অপরটি ক্লাসিস, যার অর্থ হল ‘at school’ বা স্কুলের শ্রেণিতে। আসলে মনে করা হত যে গ্রিক এবং লাতিনেই প্রথম শ্রেণির সাহিত্যরচনা করা হয়ে থাকে এবং সেই সব সাহিত্য স্কুলের শ্রেণিকক্ষে পড়ানো হয়। আমাদের কিন্তু মেজাজের দিক থেকে ক্লাসিক বা ক্লাসিকাল কথাটা বুঝে নিতে হবে।
ক্লাসিক আদর্শ
প্রাচীন এথেন্স-এর আনন্দনীয় স্থাপত্যকীর্তি ‘পার্থেনন’। এই মন্দিরটি ছিল এথে্ন্স-এর সমতল থেকে ২৬০ ফিট উঁচুতে তৈরি এক বিরাট পাথরের উপর স্থাপত্যকর্ম। এই মন্দিরের প্রতিটি অংশ পরবর্তী অংশের সঙ্গে ছিল সুসামঞ্জস্য। প্রাচীন প্রিকদের এই স্থাপত্যকর্মে এমন দুটি সত্য ধরা পড়ে যার নিরিখে শিল্প সাহিত্যকেও বিচার করা যেতে পারে, সত্য দুটি হল– ১) একটি অখণ্ড সীমারেখার দ্বারা আবদ্ধ হবে সমগ্র অংশ। ২) অংশ ও সমগ্রের মধ্যে থাকবে যথার্থ অনুপাত। ক্লাসিক সৃষ্টির প্রতীক রূপে আমরা একটা Circle বা বৃত্তের কথা ভাবতে পারি। বৃত্তের কোনো অংশকেই ইচ্ছেমতো কমানো বা বাড়ানো যায় না তার পূর্বের সংগতি বজায়রেখে। গ্রিকদের শিল্পকর্মের এই যে বাঁধাবাঁধি নিয়ম ছিল তা তাদের জীবনে সত্য ছিল না। বোধহয় জীবনে অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা এবং ব্যস্তিস্বাতন্তত্র্যের উল্লাস ভোগ করে তারা বুঝেছিল এর নিরর্থকতা। তাই তাদের শিল্পকর্মে একটা সীমাশাসন থাকতই। পার্থেনন বা যে কোনো ক্লাসিকাল শিল্প আসলে এমন সৃষ্টিকর্ম যার মধ্যে আছে পরিমিতিবোধ, ঐক্য এবং সামগ্রিকতার মূর্ত প্রতীক। ঐহিকতা, মানবিকতা, বাহ্যরূপসৌন্দর্যে দৃষ্টির নিবদ্ধতা, প্রশান্তি ও ঐতিহ্যানুবর্তিতাই হচ্ছে ক্লাসিকাল শিল্পের লক্ষণ এবং ক্লাসিকাল বিচারপদ্ধতিও এসবের সঙ্গে যুক্ত। যার উজ্জ্বল নমুনা অ্যারিস্টটলের ‘পোয়াটিকস্’ এবং হোরেসের ‘আর্টস পোয়াতিকায়’ (Arts Poetica)।
অ্যারিস্টটলের গুরু প্লেটো কাব্য-সাহিত্যের আনন্দদায়কতার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে এক শ্রেণির কবি-সাহিত্যিককেই তার আদর্শরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত করতে চেয়েছিলেন। প্লেটো মনে করতেন, মহৎ কাব্য-সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণা আসে আদর্শলোক থেকে। এই আদর্শজগতের প্রতিবিম্বন ঘটে বাস্তবে এবং বাস্তবের সত্যই প্রতিবিম্বিত হয় সাহিত্যে। যেহেতু, সাহিত্যিক আদর্শজগতের পরবর্তী স্তরকে প্রতিবিম্বিত করেন। তাই সাহিত্যে প্রকৃত সত্য কখনও রূপ পায় না। প্লেটো তার এই ধারণা থেকেই কবিদের মিথ্যার সেবকরূপে উপেক্ষা করতে চেয়েছিলেন। একটি আদর্শ নাগরিক গড়ে তোলার উপযোগী হয়ে উঠুক সাহিত্য-শিল্প—এই ছিল প্লেটোর কামনা। আদর্শায়ন ছিল প্লেটোর কাব্য সাহিত্য সম্পর্কিত ক্লাসিকাল, ধারণার বৈশিষ্ট্য। শুধু তাই নয়, সৌন্দর্য সম্পর্কিত ধারণাতেও প্লেটো আদর্শের অনুরাগী ছিলেন। অর্থাৎ তিনি ছিলেন বিশেষ অপেক্ষা নির্বিশেষের উপাসক। ক্লাসিকাল সাহিত্যাদর্শও নির্বিশেষের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এমনকি যে অ্যারিস্টটল গুরু প্লেটোর মতাদর্শের বিরোধী ছিলেন এবং সাহিত্যকে আনন্দদায়ক বলে গ্রহণ করেছিলেন তিনিও ট্রাজেডি তথা সাহিত্যের উপাদান রূপে তাকেই স্বীকার করেছিলেন যার মধ্যে সম্ভাব্যের ইঞ্জিত আছে— ‘‘Not what has happened, but what may be happen according to the law of probability”। এই সম্ভাব্যতা হল কার্যকারণের সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে যা ঘটেছে তার সঙ্গে অতীতে যা ঘটেছে এবং ভবিষ্যতে যা ঘটতে পারে তার একটি অনিবার্য সম্পর্ক থাকে। পোয়েটিকস-এ অ্যারিস্টটলের এই সম্ভাব্যতার উপরে গুরুত্ব দেওয়ার জন্যই ইতিহাসের তুলনায় “more philosophical and higher than History” বলেছিলেন। সাহিত্য বিশেষকে অবলম্বন করে নির্বিশেষে সার্বভৌমকে মিথ্যার কারবারি ভাবতেন, শিষ্য অ্যারিস্টটল সেখানে সাহিত্যিককে মনে করতেন সূক্ষ্মতর ও মহত্তর সত্যের রূপকার। সাহিত্যের নির্বিশেষ লক্ষ্য যেমন অ্যারিস্টটলের বিচার্য ছিল, তেমনি সাহিত্যের একটি বিশেষ শাখা—ট্রাজেডি ছিল তাঁর বিশেষ আলোচ্যবস্তু। ট্রাজেডিকে তিনি প্রথমে সম্পর্কিত করেন যাবতীয় শিল্পের সাধারণ লক্ষণের সঙ্গো। তিনি যাবতীয় শিল্পে যে-নির্বিশেষ লক্ষণটি দেখেছিলেন তা হল ‘মাইমেসিস’ বা অনুকরণ। এই অনুকরণ শব্দটিকে কেন্দ্রে রেখেই তিনি লিখেছিলেন ট্রাজেডির সংজ্ঞা। ট্রাজেডি নামক বিশেষ শিল্পধর্মকে বিভক্ত করলেন ছ’টি উপাদানে— কাহিনীবৃত্ত, চরিত্র, মনন, ভাষা, সংগীত ও দৃশ্যসজ্জা। এই ছ’টিই হল বহিরঙ্গ উপাদান। ক্লাসিকাল সাহিত্য সমালোচনার একটি মৌলিক লক্ষণ-ই হল বহিরঙ্গের রূপবিচার।
অ্যারিস্টটল ট্রাজেডির কাহিনীবৃত্ত আলোচনায় জোর দিলেন Unity বা ঐক্যের উপর। পার্থেননের শিল্পকর্মের সঙ্গে অ্যারিস্টটল প্রদত্ত ট্রাজেডির সংজ্ঞার মিল এখানে যে, উভয়ক্ষেত্রে অংশ এর সঙ্গে সমগ্রের একটি নিবিড় ঐক্যের সন্ধান মেলে। অংশ সমগ্রেরই অঙ্গীভূত, সুতরাং অবিচ্ছেদ্য। আ্যারিস্টটল বলেছিলেন, ট্রাজেডির কাহিনীর শুরু—মধ্যভাগ সমাপ্তি কার্ষ-কারণের যোগসূত্র পরস্পরের সঙ্গে অনিবার্য সম্পর্কে যুক্ত। অ্যারিস্টটল কার্ধ-কারণের ঐক্যের ব্যাপারটির উপরই জোর দিয়েছিলেন বেশি। তা ছাড়া বলেছিলেন যে, কাহিনীর বিস্তার হবে সূর্যের একতার আবর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং কোরাসের সর্বক্ষণ মঞ্চে উপস্থিত থাকার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে অভিনীত হতে হবে কাহিনীকে। একটি ক্লাসিকাল ভাস্কর্য বা স্থাপত্যে যেমন প্রতিটি অংশের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য খুঁজে পাওয়া যায়, ক্লাসিকাল সাহিত্যকর্মেরও তাই। সাহিত্যবিচারের সময় সমালোচককে দৃষ্টি রাখতে হয় এই সামগ্রিকতার দিকে। অ্যারিস্টটল যে প্লটকে ট্রাজেডির ‘আত্মা’ বলে অভিহিত করেছিলেন, তার অন্যতম কারণ সম্ভবত কাহিনীর ভিতরকার totality বা Unity-র বোধ। সার্থক প্লট থেকে ঘটনার কোনো অংশকে বর্ণনা করা যায় না অথবা প্লটের সঙ্গে যোগ করা যায় না নতুন কোনো ঘটনা।
অ্যারিস্টটল ট্রাজেডি তথা শিল্প-সাহিত্যের জগতে ইহজগতের আদর্শায়িত বূপায়ণ লক্ষ করেছিলেন। শুধু প্লট নির্মাণের ক্ষেত্রে নয়, চরিত্র রূপায়ণের ক্ষেত্রেও একই সূত্র তিনি কামনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ট্রাজেডির চরিত্রকে হতে হবে বাস্তবানুগ, যথাযথ, সদৃশ ও সুসংগত। ট্রাজেডির নায়কের পতনের কারণ তাঁর চরিত্রের কোনো প্রবণতার সীমাতিক্রমণ। নায়ক চরিত্র বাস্তবের রক্তমাংসের মানুষের মতোই হবে না। অতি ভালো, না অতি মন্দ। প্রাচীন গ্রিক নাটকের Dues ex machina অ্যারিস্টটল উপেক্ষা করেননি, কারণ সেকালে জটিল পরিস্থিতি থেকে পরিণতিকে রক্ষার দায়িত্ব নিয়েই মঞ্চে আবির্ভূতি হতেন অলৌকিক চরিত্র। কিস্তু তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ট্রাজেডি হবে ‘imitation of men in action’। ট্রাজেডি মানুষের অনুকরণ, মানুষের কর্মের অনুকরণ। প্রাচীন গ্রিক ক্লাসিকাল সাহিত্যতাত্ত্বিক অ্যারিস্টটল যেমন আদর্শায়িত জীবনের রূপায়ণের কথা বলেছিলেন, তেমনি বাস্তব সম্পর্কশূন্য নিছক কাল্পনিক জীবনসত্যের কথাও ভাবতে পারেননি। চরিত্র এবং প্লট—ট্রাজেডির এই দুই মুখ্য উপাদানকেই অ্যারিস্টটল বেঁধেছিলেন পূর্বাপর সংগতির জোরে। ক্লাসিকাল সাহিত্য বিচার যে মূলত ন্যায়শাস্ত্রের দ্বারা অনুমোদিত সত্যে প্রতিষ্ঠিত অ্যারিস্টটলের পোয়েটিকস্ এই ধারণাতেই পৌছে দেয়।
অ্যারিস্টটল সাহিত্যের ভাষার মধ্যে অলংকারের ব্যবহার পছন্দ করতেন। কিন্তু ‘মেটাফর’ বা রূপক অলঙ্কার সম্পর্কে আলোচনাকালে বলেছিলেন যে, অতিরিক্ত অলংকারের ব্যবহার বর্জনীয় কারণ তা দুর্বোধ্যতার সৃষ্টি করতে পারে। সাহিত্যের সমালোচনার সম্পর্কে আলোচনাকালে অ্যারিস্টটল বললেন যে, তাঁর পূর্বকাল পর্যন্ত সমালোচকেরা কোনো সাহিত্যকর্মের মধ্যে খুঁজে পেতেন বিশেষ কতকগুলি ত্রুটি, যেমন—অস্বাভাবিকতা, নিরবুদ্ধিতা, অনৈতিকতা, ভ্রান্তি ও পরস্পর-বিরোধিতা। তিনি শিল্পকে চেয়েছিলেন শিল্পরূপেই বিচার করতে। অ্যারিস্টটল নিঃসন্দেহে সমালোচনার জগতে ক্লাসিকাল পদ্ধতির প্রবর্তক যিনি অখণ্ড সীমারেখার দ্বারা সমগ্রকে আবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন এবং অংশ ও সমগ্রের আনুপাতিক সম্পর্কে ছিলেন আস্থাশীল।
ইতালির হোরেস ছিলেন সাহিত্যবিচারে ক্লাসিকাল পদ্ধতিতে বিশ্বাসী। তিনি অ্যারিস্টটলের পন্থায় ‘মাইমেসি’ তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেননি ঠিকই, কিন্তু বলেছিলেন একজন অভিজ্ঞ কবির উচিত মানবজীবন ও মানবচরিত্রকে আদর্শরূপে দেখা এবং সেখান থেকে এমন ভাষার সন্ধান করা যাবে যা জীবনসত্য বলে গণ্য করা যেতে পারে। কিস্তু হোরেস কাব্যের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের দুটি পৃথক মতাদর্শকে একীভূত করে উত্তরকালে রেনেসাঁসের সাহিত্য সমালোচকদের আদর্শ রূপে গণ্য হয়েছিলেন। তিনি বলেন—“কবি লক্ষ্য রাখেন উপকার বা আনন্দদানের দিকে অথবা আনন্দের মিশিয়ে দিতে পেরেছেন তিনি পেয়েছেন সকলের সমর্থন, কারণ তিনি পাঠককে দিয়েছেন আনন্দ, যখন তিনি নির্দেশ দিচ্ছিলেন। হোরেসের মনের মধ্যে গ্রিক আদর্শ ছিল বদ্ধমূল, তাই তিনি বলেছিলেন, “you must give yours days and nights to the study of Greek models.”। গ্রিক মডেল নিজেও অনুসরণ করেছিলেন বলে হোরেস ‘Organic Unity’-র প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করে নিয়েছিলেন এবং উপযুস্ত ভাষা ও বিষয়বস্তু নির্বাচনকে দিয়েছিলেন অগ্রাধিকার। অ্যারিস্টটল বহুক্ষেত্রে কাব্যকে তুলনা করেছিলেন চিত্রের সঙ্গে। হোরেসও বলেছেন, “A poem, is like a painting”। হোরেস কল্পনাশক্তির সামর্থ্যের ওপর জোর দেননি কিন্তু বিষয়নির্বাচন ছাড়াও জোর দিয়েছিলেন ভাবনার উপর এবং তিনি মনে করতেন যে মানুষ যথাযথ বিষয় নির্বাচন করতে পেরেছে তার কখনও ভাষা বা শব্দের অভাব হয় না। ভাষার সুনিপুণ বিন্যাসের জন্যই পুরোনো পরিচিত শব্দে লাগে নতুনত্বের ছোঁয়া। অ্যারিস্টটল পরিচিত ভাষার মধ্যে অপরিচয়ের ছোঁয়া আনার জন্যই ‘মেটাফর’ ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কবি-সমালোচক হোরেস উপমার তশ্রয় নিয়ে বললেন—যেমন করে গাছ বৎসরান্তে পাতা ঝরিয়ে ফেলে, জন্ম দেয় নতুন পাতার, তেমনি কালে কালে পুরোনো শব্দ শেষ হয়ে যায় আসে নতুন শব্দ। একথাই যেন ভারতীয় আলংকারিকেরাও বলেছিলেন। আলংকারিক আনন্দবর্ধন বলেছিলেন, গাছের পুরোনো পাতা খসে নতুন পাতা একে যেমন গাছটাকেই নতুন বলে মনে হয়, তেমনি কাব্যের ক্ষেত্রেও পুরোনো শব্দ চলে গিয়ে নতুন শব্দ এলে কাব্যকেও নতুন মনে হয়। সাহিত্যলোচনায় ভারতীয় আলংকারিকেরাও ছিলেন ক্লাসিকাল আদর্শে বিশ্বাসী। তাঁরা শব্দ, অর্থ, অলংকার, রীতি প্রভৃতি বাহ্য উপাদানে যেমন মনোযোগী ছিলেন, তেমনি ছিলেন শব্দ-নির্ভর ধ্বনি বা ব্যঞ্জনায় এবং বিভাবাদি উপাদান নির্ভর রসের উপর। খণ্ড থেকে অখণ্ডে, খণ্ডের বিভিন্ন অংশের সামঞ্জস্যে ছিলেন বিশ্বাসী। ক্লাসিকাল সাহিত্যবিচারে ‘সামঞ্জস্য’ একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব-প্রসঙ্গ। প্লেটো ইহজগতের প্রকৃত সুন্দরের সঙ্গে অলৌকিক আদর্শজগতের সামঞ্জস্য সন্ধান করেছিলেন। অ্যারিস্টটল সৌন্দর্য ব্যাখ্যায় সন্ধান করেছিলেন শৃঙ্খলা (order) সামঞ্জস্য (symmetry) এবং স্পষ্টতা (Definiteness)। শৃঙ্খলা-সামঞ্জস্য-স্পষ্টতার সমন্বয়েই তো প্রাচীন পার্থেনন। প্রাচীন গ্রিকেরা খুঁজেছিলেন সীমার মধ্যে Perfection এবং তাঁদের কল্পনার উপর নিয়ন্ত্রণ থাকত যুক্তির। ক্লাসিকাল সাহিত্যবিচার এই কথাগুলিই মুখ্য।
তথ্যসূত্র:
কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্ত | Download |
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাস | Download |
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরী | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাস | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যাল | Download |
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাস | Download |
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত | Download |
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দী | Download |
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যাল | Download |
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেন | Download |
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায় | Download |
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষ | Download |
Leave a Reply