//
//

সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে নাট্যকার ভাসের অবদান আলোচনা কর।

নাট্যকার ভাস

কালিদাস পূর্বযুগের নাট্যকারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভাস। কালিদাসের মালবিকাগ্নিমিত্রম্, বাণভট্টের হর্ষচরিত, রাজশেখর-এর সুক্তিমুক্তাবলী প্রভৃতি গ্রন্থে ভাসের উল্লেখ রয়েছে।  ভাষের ব্যক্তি পরিচয় সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। নাটকে তিনি নিজের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেননি। তাঁর রচনাবলী থেকে এটুকু অনুধাবন করা যায়—তিনি জাতিতে ছিলেন বর্ণ ব্রাহ্মণ এবং ভারতবর্ষের উত্তরাঞ্চলের অধিবাসী। ব্যক্তি পরিচয়ের মতো ভাসের আবির্ভাবকালও ধোঁয়াশাপূর্ণ। সমালোচকদের মতে খ্রিঃপূঃ পঞ্চম শতক থেকে খ্রিঃপূঃ একাদশ শতকের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন। তবে তিনি যে কালিদাসের পূর্ববর্তী কালের নাট্যকার এবিষয়ে সবাই নিশ্চিত।

ভাসের প্রচলিত নাটকগুলিকে কাহিনির দিক থেকে মূলত চারভাগে ভাগ করা যায়—

ক) রামায়ণমূলক নাটক:- প্রতিমা এবং অভিষেক।

খ) মহাভারতমূলক নাটক:- দূতবাক্য, কর্ণভার, দূতঘটোৎকচ, মধ্যম ব্যায়োগ, পঞ্চরাত্র, উরুভঙ্গ, বালচরিত।

গ) বৃহৎ কথামূলক উদয়নকথা অবলম্বনে রচিত নাটক:স্বপ্নবাসবদত্তা, প্রতিজ্ঞা যৌগন্ধরায়ণ

ঘ) কথামূলক বা অজ্ঞাতমূলক নাটক:অবিমারক, চারুদত্ত।

প্রতিমা

রামায়ণের কাহিনি অবলম্বনে লেখা সাতটি অংকের নাটক। নাটকের অংকগুলি হল—রামের বনবাস১ম অংক), দশরথের মৃত্যু (২য় অংক), মাতুলালয় থেকে ভরতের অযোধ্যায় আগমন ও প্রতিমা গৃহ থেকে পিতা দশরথের মৃত্য (৩য় অংক), সুমন্ত্রসহ রামকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভরতের চিত্রকূটে গমন ও পাদুকাসহ প্রত্যাবর্তন(৪র্থ অংক), সীতাহরণ ও জটায়ুবধ (৫ম অংক), রামের বিপদ আশঙ্কা করে ভরতের লংকা গমনের সংকল্প (৬ষ্ঠ অংক), রাবণবধ ও সীতাসহ বনাশ্রমে প্রত্যাবর্তন, ভরতের পঞ্চবটী গমন, রামের অযোধ্যায় গমন ও অভিষেকের পর রাজ্যভার গ্রহণ (৭ম অংক)।

অভিষেক

নাটকটি ছয়টি অংকে বিভক্ত। বালিবধ ও সুগ্রীবের এভিষেক থেকে নাটকটির সূত্রপাত। রাবণবিজয়ের পর সীতার অগ্নিপরীক্ষা ও রামের অভিষেকে তার সমাপ্তি।

দূতবাক্য

মহাভারতের কাহিনি অবলম্বনে রচিত একাঙ্ক নাটক। পাণ্ডবদের অর্ধেক রাজ্য প্রার্থনায় শ্রীকৃষ্ণের দৌত্য, দুযোর্ধনের বিরক্তি ও কোপপ্রকাশ এবং ধৃতরাষ্ট্রের অনুরোধে শ্রীকৃষ্ণের ক্রোধের উপশম— এই হল নাটকের বিষয়বস্তু।

কর্ণভার

এটিও মহাভারতের কাহিনি অবলম্বনে রচিত একাঙ্ক নাটক। ছদ্মবেশী ইন্দ্রকর্তৃক কর্ণের কবচকুণ্পল গ্রহণই এর কাহিনি।

দূতঘটোৎকচ

এটিও মহাভারতের কাহিনি অবলম্বনে রচিত একাঙ্ক নাটক। এই নাটকে অভিমন্যুর মৃত্যুর পর অর্জুন শত্রুদের শাস্তি দেওয়ার জন্য উদ্যত হয়েছেন—এই সংবাদ নিয়ে ঘটোৎকচ কৌরবসভায় উপস্থিত হলে দুযোর্ধনের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল তাই বর্ণিত হয়েছে।

মধ্যম ব্যায়োগ

মহাভারতের কাহিনি অবলম্বনে রচিত একাঙ্ক নাটক। মাতা হিড়িম্বার আহারের জন্য তার আদেশে পুত্র ঘটোৎকচ ব্রাহ্মণ পরিবারের মধ্যম পুত্রকে আনতে চায়। মধ্যম পাণ্ডব ভীম তাতে বাধা দেন এবং নিজেই সেকানে যাওয়ার জন্য স্বীকৃত দেন। শেষপর্যন্ত ভীমের সঙ্গে হিড়িম্বার পুনর্মিলন ঘটে—এই হল নাটকের কাহিনি।

পঞ্চরাত্র

মহাভারতের কাহিনি অবলম্বনে রচিত তিন অংকের রূপকজাতীয় নাটক। দুযোর্ধন যজ্ঞশেষে দক্ষিণা দিতে চাইলে আচার্য দ্রোণ পাণ্ডবদের জন্য অর্ধেক রাজ্য প্রার্থনা করেন। এতে শকুনি একটি শর্ত আরোপ করে যে-পাঠচ রাত্রের মধ্যে পাণ্ডবদের সংবাদ এনে দিতে হবে। বিরাটরাজ যজ্ঞের নিমন্ত্র রক্ষা করতে পারেননি। কারণ কীচক নিধনের জন্য তিনি শোকাচ্ছন্ন ছিলেন। বাহুবলে কীচক নিধনের সংবাদে ভীষ্ম বুঝতে পারেন যে, তা ভীমের কাজ। তারই পরামর্শে বিরাটরাজের বিরুদ্ধে গোহরণযুদ্ধ আরম্ভ হয় এবং পাণ্ডবদের পরিচয় প্রকাশ পায়।

উরুভঙ্গ

মহাভারতের কাহিনি অবলম্বনে রচিত। এই নাটকের বর্ণনীয় ঘটনা গদাযুদ্ধে ভীম কর্তৃক দুযোর্ধনের উরুভঙ্গ। দুযোর্ধনের বেদনা ও অনুতাপের কারুণ্যের মধ্যেই নাটকটির সমাপ্তি।

বালচরিত

মহাভারতের হরিবংশ বা পুরাণ অবলম্বনে রচিত পঞ্চাংক নাটক। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম, রাত্রির অন্ধকারে বসুদেব কর্তৃক কৃষ্ণকে নিয়ে যমুনার অপর পারে নন্দ গোপগৃহে উপস্থিতি এবং কালে কৃষ্ণ কর্তৃক কংসবধ—এই হল বিষয়বস্তু।

প্রতিজ্ঞা যৌগন্ধরায়ণ

মন্ত্রী যৌগন্ধরায়ণের কৌশলে বৎসরাজ উদয়ন কর্তৃক অবন্তী রাজকন্যা বাসবদত্তার অপহরণ। নাটকটির গতিবেগ দর্শকদের কৌতূহল জাগ্রত করে। অবন্তীর রাজা প্রদ্যোতের কন্যা ছিল রূপলাবণ্যবতী বাসবদত্তা। বাসবদত্তাকে বিবাহ করতে চেয়ে বহু রাজ্যের রাজা প্রস্তাব পাঠালেও বৎসরাজ উদয়ন কাউকে পাঠাননি। অথচ রূপে-গুণে উদয়ন যোগ্য পাত্র। এদিকে প্রদ্যোত কৌশলে উদয়নকে বন্দি করার চেষ্টা করেন। বংশপরম্পরায় উদয়ন ঘোষবতী বীণার অধিকারী ছিলেন, এই বীণার ঝংকারে তিনি হস্তি বশীভূত করতে পারতেন। প্রদ্যোৎ নাগবনে নীলহস্তি ন্যাস করার ছলে উদয়নকে বন্দি করলেন। উদয়নের বিচক্ষণ সচিব যৌগন্ধপরায়ণ প্রতিজ্ঞা করলেন যেমন করে হোক তিনি উদয়নকে শত্রুর কবল থেকে রক্ষা করবেন। তার এই প্রতিজ্ঞার জন্যই নাটকটির নাম প্রতিজ্ঞা যৌগন্ধপরায়ণ। বলাবাহুল্য তিনি সেই প্রচেষ্টায় সফল হয়েছিলেন এবং রাজা উদয়নকে মুক্ত করেছিলেন। পরবর্তীকালে প্রদ্যোৎ এবং যৈগন্ধপরায়ণের সন্ধি অনুসারে উদয়ন-বাসবদত্তার বিবাহ সম্পন্ন হয়।

স্বপ্নবাসবদত্তা

এটি প্রতিজ্ঞা যৌগন্ধপরায়ণ নাটকের পরবর্তী কাহিনি। নাটকটি ছয়টি অংকে বিভক্ত। উদয়ন স্বপ্নে বাসবদত্তাকে দেখেছিলেন এবং ভেবেছিলেন  এটি যদি স্বপ্ন হয় তাহলে ঘুমই ভালো ছিল এবং এটি যদি বিভ্রম হয়, তাহলে সেই বিভ্রম যেন চিরস্থায়ী হয়। বাসবদত্তাকে স্বপ্নে দর্শন, এট নাটকের মূল ঘটনা বলে এই নাটকের নাম ‘স্বপ্নবাসবদত্তা’। মন্ত্রী যৌগন্ধপরায়ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য বাসবদত্তার সম্মতিক্রমনে রটনা করেন যে অগ্নিদগ্ধে বাসবদত্তার মৃত্যু ঘটেছে। এবং রাজা দর্শকের ভগিনি পদ্মাবতীর পরিচায়িকা হয়ে রইলেন। এদিকে বাসবদত্তার বিয়োগে উদয়ন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং একসময় পদ্মাবতীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাকে বিবাহ করেন। পদ্মাবর্তীর অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে বাসবদত্তা পদ্মাবর্তীর ঘরে এসে বাদবদত্তার মুখোমুখি ধরা পড়ে যান। পুনরায় তাদের মিলন ঘটে।

অবিমারক

এটি কথামূলক দৃশ্যকাব্য। নাটকটি ছয়টি অংকে বিভক্ত। অবিমারকের সঙ্গে কুন্তীভোজ রাজার কন্যা কুরঙ্গার মিলন নাটকটির প্রতিপাদ্য ঘটনা। অবিমারক ছিলেন সৌবীর রাজপুত্র। কিন্তু অভিশপ্ত হয়ে নীচজাতির মতো বাস করতো। যুবক চোরের ছদ্মবেশে কুরঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়। পরে রাজগৃহ থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। যুবক আত্মহতায় উদ্যত হলে বিদ্যাধরের কাছে অঙ্গুরি লাভ করে। তার সাহায্যে সে অদৃশ্য হয়ে পুনরায় কুরঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়। পরে যুবকের যথার্থ পরিচয় প্রকাশ পায় এবং কুরঙ্গরা সঙ্গে তার বিবাহ হয়। এর প্রকৃতি বর্ণনায় বাস্তবতার স্পর্শ রয়েছে। নাটকটিতে অতিলৌকিক ঘটনার সন্নিবেশ থাকলেও তা দর্শকদের কাছে কৌতূহলোদ্দীপক। এটি মূলত শৃঙ্গার রসের নাটক। এর ভাষাভঙ্গিতে ওজঃ, মাধুর্য ও প্রসাদগুণের সমন্বয় ঘটেছে।

চারুদত্ত

চার অংকে রচিত অসম্পূর্ণ নাটক। এর বিষয়বস্তু দরিদ্র ব্রাহ্মণ চারুদত্ত ও নটী বসন্তসেনার প্রেমকাহিনি। শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক সম্ভবত এই নাটক অবলম্বনে রচিত।

ভাসের নাট্য-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য

  • ভাসের রচনা বিষয়-বৈচিত্রে পরিপূর্ণ। তিনি মহাভারত, রামায়ণ এবং প্রচলিত প্রাচীন কাহিনি অবলম্বনে নাট্যবস্তু রচনা করেছেন। তবে তিনি তাঁর কল্পনার রঙে এবং নাট্যপ্রতিভার স্পর্শে নাটকগুলিকে উপাদেয় করে তুলেছেন।
  • ভাসের নাট্যপ্রতিভার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল বাস্তব চিত্রাঙ্কন দক্ষতা এবং সহজ সরল ভাষা। ভাসের ভাষা সাধারণত শুদ্ধ, তবে কোথাও কোথাও অপাণিনীর প্রয়োগ স্থান পেয়েছে। মহাক্যবের ভাষা অনুযায়ী ভাষাশৈলীর সরলতা এবং ভাবগাম্ভীর্য ভাসের নাটকের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।
  • ভাষের নাটকে অলৌকিকতার আমদানি কম, নেই অযথা প্রকৃতির বর্ণনাও, রয়েছে জীবনধর্মিতা এবং ঘটনার অনুকূল পরিবেশ রচনার ক্ষমতা। বিপরীতধর্মী চরিত্রের সমাবেশে বা তথাকথিত নিন্দিত চরিত্রের মহিমা খ্যাপনে বৈচিত্র্যের স্বাদ এনেছেন তিনি।
  • তাঁর নাটকে ছন্দ প্রয়োগের মুন্সিয়ানা রয়েছে। অনুষ্টুপ, ইন্দ্রবজ্রা, উপজাতি, শালিনী বসন্ততিলক, বংশস্থবিল, মালিনী, শার্দুলবিক্রীড়িত প্রভৃতি প্রসিদ্ধ ছন্দই ভাষ তাঁর নাটকে নব্যবহার করেছেন।
  • চরিত্র চিত্রণে ভাসের দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর চরিত্রগুলি অলৌকিক নয়, বরং বাস্তবতার স্পর্শে সঞ্জীবিত। এমনকি রাম-সীতার মতো দেবচরিত্রও মানবোচিত দোষগুণের সমাবেশে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
  • বিভিন্ন রসের প্রকাশেও ভাস সিদ্ধহস্ত। বীর, হাস্য, অদ্ভুত, শৃঙ্গার, করুণ প্রভৃতি রসের অবতারণ একদিকে যেমন চমৎকারিত্বের সংকেত দেয়, তেমনি নাটকীয় ঘটনার সুসংবদ্ধ ক্রমপরিপাটি, সাবলীল গতিভঙ্গি নাটকগুলিকে আস্বাদনযোগ্য করে তুলেছে।
  • ভাসের উদ্ভাবনী শক্তি প্রশংসনীয়। যেমন প্রতিমা নাটকে প্রতিমাগৃহের কল্পনা।, মধ্যম ব্যায়োগে পরিকল্পিত কাহিনির নাটকীয়তা, দূতবাক্যে কৃষ্ণের মহিমার পাশে দুযোর্ধনের লক্ষ্যণীয় কদর্যতা, স্বপ্নবাসবদত্তা নাটকে বাসবদত্তার অগ্নিপরীক্ষা প্রভৃতি।
  • ইংরেজিতে যাকে বলে Verbal Irony এবং Irony of Action বলে ভাসের নাটকে তাই পতাকা রূপে চিহ্নিত। ভাসের নাটকে এই পতাকার ব্যবহার নাটকগুলিকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছে।
  • ভাসের নাটকে নাট্যশাস্ত্রের নির্দেশ পালনে অনেকক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা যায়। যেমন—নান্দী অন্তে সূত্রধারের প্রবেশ এবং যুদ্ধ, মৃত্যু, অগ্নিকাণ্ড প্রভৃতি ঘটনা যা সাধারণত নাটকে পাওয়া যায় না।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!