//
//

বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে নাট্যনিকেতনের অবদান আলোচনা কর।

নাট্যনিকেতন

(১৯৩১-১৯৪২)

প্রবোধচন্দ্র গুহের উদ্যোগে ‘নাট্যনিকেতন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মার্চ এই নাট্যগৃহের উদ্বোধন হয়। প্রথম নাটক ‘ধ্রুবতারা’ সেদিন অভিনীত হয়। যতীন্দ্রমোহন সিংহের উপন্যাসের নাট্যরূপ দেন হেমেন্দ্রকুমার রায়। এই নাটকে দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহৃত হয়। বাকি গানগুলি লেখেন হেমেন্দ্রকুমার রায়। সুর দিয়েছিলেন নজরুল। অভিনয়ে ছিলেন নির্মলেন্দু লাহিড়ী, মওরঞ্জন ভট্টাচার্য, নীহারবালা প্রমুখ।

মন্মথ রায়ের ‘সাবিত্রী’ অভিনীত হয় ১৯৩১-এর মে মাসে (১৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৮)। এই নাটকের সব গান লেখেন নজরুল এবং তিনিই সুর দেন। ‘সাবিত্রী’র গানগুলি সে সময়ে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।

এরপরে মন্মথ রায়ের সাড়া জাগানো নাটক ‘কারাগার’ এখানে অভিনীত হয় ৮ আগস্ট, ১৯৩১। এই নাটকটি প্রথমে মনোমোহন থিয়েটারে অভিনীত হয়েছিল (২৪.১২.৩০)। কিন্তু ১৮টি অভিনয়ের পর ব্রিটিশের রাজরোষে অভিনয় বন্ধ করে দিতে হয়, অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের জোরে। বন্ধ হয়ে যাওয়া এই নাটকটি নাট্যনিকেতনে পুনরায় অভিনীত হতে থাকে। এখানেও ‘কারাগার’ সাফল্য লাভ করে।

১৯৩১-এর ১৪ নভেম্বর এখানে শচীন সেনগুপ্তের ঝড়ের রাতে অভিনীত হয়। পরিচালক হিসেবে এই নাটকে সতু সেন প্রয়োগনৈপুণ্য ও শিল্প নির্দেশনা এবং আলোক-সম্পাতে অভিনবত্ব সৃষ্টি করে কলারসিকের প্রশংসা অর্জন করেন। গানে সুর সংযোজনা করেন নজরুল। অভিনয়ে নির্মলেন্দু লাহিড়ী (প্রশান্ত) এবং নীহারবালা (বিজলী) খুবই কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। পরিচালক হিসেবে সতু সেনের খ্যাতি বৃদ্ধি হয়। নাটক খুবই প্রশংসা পায় এবং দর্শক আনুকূল্য লাভ করেছিল।

নজরুলের গীতিনাট্যরূপক ‘আলেয়া’ এখানে প্রথম অভিনীত হয়। ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৩১। নৃত্যগীতের মধ্যে দিয়ে জীবনে প্রেমের রূপক এই নাটকে পরিবেশিত হয়েছে। নজরুলের লেখা গান এবং তাঁরই সুর এই গীতিনাট্যটিকে আস্বাদনীয় করে তুলেছিল।

১৯৩২ থেকে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এখানে সর্বমোট ১৬টি নাটকের অভিনয় হয়। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো—সতীতীর্থ (শচীন সেনগুপ্ত), মহাপ্রস্থান (সত্যেন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্ত), অনুরূপা দেবী’র ‘মা’ উপন্যাসের নাট্যরূপ (অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়), চক্রব্যুহ (মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য), প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর উপন্যাস ‘ব্রতচারিণী’র নাট্যরূপ (মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য), খনা (মন্মথ রায়) প্রভৃতি।

এই নাটকগুলি অভিনয়ে খুবই সাফল্য লাভ করে এবং নাট্যনিকেতনের নাট্য প্রযোজনার খ্যাতি প্রতিষ্ঠিত হয়। আর্থিক সঙ্গতিও বৃদ্ধি পায়।

তা সত্ত্বেও প্রবোধচন্দ্র ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে নাট্যনিকেতনের পরিচালনভার হস্তান্তরিত করেন। ‘ক্যালকাটা খিয়েটার্স লিমিটেড’ দায়িত্ব গ্রহণ করে। যশোদানন্দন ঘোষ প্রধান হিসেবে এই থিয়েটার পরিচালনা করতে থাকেন।

যশোদানন্দনের নেতৃত্বে ‘ক্যালকাটা থিয়েটার্স লিমিটেড’ এখানে প্রথম অভিনয় শুরু করে রমেশ গোস্বামীর ‘কেদার রায়’ নাটক দিয়ে, ১৯৩৬-এর ৪ এপ্রিল। ‘কেদার রায়’ সে সময়ে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।

তারপরে সুধীন্দ্রনাথ রাহার ‘আলাদীন’ নাটক অভিনীত হয়। এই নাটকেও নজরুল গান লিখে দিয়েছিলেন।

১৯৩৬-এর ১৯ ডিসেম্বর অভিনীত হয় রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসের নাট্যরূপ (নরেশ মিত্র)। এছাড়া মন্মথ রায়ের ‘সতী’ নাটক এখানে অভিনীত হয় ১৯৩৭-এর ২৮ এপ্রিল। প্রযোজক হিসেবে তখন নরেশ মিত্র নাট্য নিকেতনের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেছেন। ‘সতী’ নাটকে নজরুল গীত রচনা ও সুর সংযোজনা করেন।

এবারে প্রবোধচন্দ্র গুহ আবার নাট্যনিকেতনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ১৯৩৮-এর জুন মাস থেকে। পুনরুদ্যমে এবার নাট্যনিকেতন আবার চলা শুরু করে।

১৯৩৮-এর ২৯ জুন নামানো হলো শচীন সেনগুপ্তের ‘সিরাজদ্দৌলা’। নতুন করে এখানে ‘সিরাজদ্দৌলা’র অভিনয় শুরু হয়। এই নাটকের জন্য নজরুল গান লেখেন এবং সুর দেন। নাটকটি পরিচালনা করেন নির্মলেন্দু লাহিড়ী ও সতু সেন। অভিনয়ে—নির্মলেন্দু (সিরাজ), রবি রায় (গোলাম হোসেন), নীহারবালা (আলেয়া), সরযূ দেবী (লুৎফাউন্নিসা)। প্রত্যেকেই অসামান্য অভিনয় করেন। নির্মলেন্দুর সিরাজ, রবি রায়ের গোলাম হোসেন এবং নীহারবালার আলেয়া, বাংলা থিয়েটারের অভিনয়ের ধারায় উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

মন্মথ রায়ের ‘মীরকাশিম’ এখানে অভিনীত হয় ডিসেম্বর, ১৯৩৮। শরৎচন্দ্রের উপন্যাস ‘পথের দাবী’র নাট্যরূপ (শচীন সেনগুপ্ত) অভিনীত হয় ১৩ মে, ১৯৩৯। এখানেই প্রথম তারাশঙ্করের বিখ্যাত উপন্যাস ‘কালিন্দী’র নাট্যরূপ (তারাশঙ্কর) অভিনয় করা হয়। প্রথম অভিনয় হয় ১৯৪১-এর ১২ জুলাই।

১৯৩৭-এ এখানে টিকিটের দাম কমানো হয় সিনেমার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে। অভিনয়ের সময়ও কমিয়ে আনা হয় সিনেমার মতো করে। নাট্যনিকেতনে শচীন সেনগুপ্তের ‘গৈরিক পতাকা’ অভিনীত হয়েছিল। প্রবোধচন্দ্র গুহ পুলিশের সঙ্গে যোগসাজসে এক নির্দেশনামায় বলিয়ে নেন যে, নাটকটি রাজরোষে নিষিদ্ধ। পরে আবার এই আদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এবার নতুন করে নাটকটি নাট্যনিকেতনে অভিনয় শুরু হলে দর্শকের ভিড় ক্রমশই বাড়তে থাকে। দর্শক আকর্ষণের এ-এক অভিনব কৌশল সেদিন প্রবোধচন্দ্র গুহ নিয়েছিলেন।

কিন্তু এতদসত্ত্বেও নাট্যনিকেতন ভালোভাবে চলছিল না। শেষ পর্যন্ত থিয়েটারটি ভাড়া দেওয়া হলো শিশিরকুমার ভাদুড়িকে। তিনি এই মঞ্চ ভাড়া নিয়ে সেখানে খোলেন তাঁর বিখ্যাত ‘শ্রীরঙ্গম’ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে।

পরবর্তীকালে সেই থিয়েটার বাড়িতে ‘বিশ্বরূপা থিয়েটার’ গড়ে ওঠে। ২০০১-এর ১৪ নভেম্বর এই থিয়েটার বাড়ি অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেখানে অভিনয় বন্ধ হয়ে যায়।

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!