নাথ-সাহিত্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর।
নাথ-সাহিত্য
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে নাথধর্মের কাহিনি অবলম্বনে রচিত আখ্যায়িকা কাব্য নাথসাহিত্য নামে পরিচিত। এ দেশে প্রাচীন কাল থেকে শিব উপাসক এক শ্রেণির যোগী সম্প্রদায় ছিল, তাদের আচরিত ধর্মের নাম নাথধর্ম। হাজার বছর আগে ভারত জুড়ে এই সম্প্রদায়ের খ্যাতি ছিল। তাদের গতিবিধির ব্যাপকতার জন্য সারা ভারতে তাদের কীর্তি ও কাহিনি ছড়িয়ে আছে। নাথ অর্থ প্রভু, দীক্ষান্তে এই নাথ পদবী তারা নামের শেষে যুক্ত করতেন। অলৌকিক ক্ষমতায় তারা ছিলেন সিদ্ধ। বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে শৈবধর্ম মিশে এই ধর্মমতের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়। বিশেষ সাধনপ্রক্রিয়া ধারা মোক্ষ লাভ করা এ ধর্মাবলম্বীদের লক্ষ্য ও অন্যান্য ধর্মাদশের ন্যায় এই সাধকগণ দেহান্তে মুক্তির পরিকল্পনা করেনি; অশুষ্ক, মায়া-বিমুক্ত, ধ্বংসরহিত পক্কদেহে, অর্থাৎ আধ্যাত্মিক দেহে মুক্ত অবস্থায় বিচরণ করাই তাদের জীবনমুক্তির আদর্শ। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন—‘‘নাথপন্থ যে বৌদ্ধ মন্ত্রযান হইতে উদ্ভূত বা প্রভাবিত তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই। এই নাথপন্থ বৌদ্ধধর্মের মহাযান শাখার শূন্যবাদীদের ওপর প্রতিষ্ঠিত।’’ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে সাহিত্যরচনার যে বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল নাথসাহিত্য সৃষ্টির পেছনে তা কাজ করেছে।
অ-বিদ্যা বা অ-জ্ঞান মানুষের তত্ত্বজ্ঞানের বাধা বলে অ-বিদ্যা দূর করে মহাজ্ঞান লাভের মাধ্যমে বাসনাক্ষয় নাথগণের লক্ষ্য ছিল। এই মহাজ্ঞান তাদের অজর, অমর করে। সাধনার সাহায্যে দেহ পবিত্র করে মহাজ্ঞান লাভের যোগ করলে তাকে বলে পক্কদেহ। এই দেহেই ঘটে শিবশক্তির মিলন। শিবকে তারা আদিগুরু বলে বিবেচনা করেন। তাই শিব হলেন আদিনাথ। এঁর শিষ্য মীননাথ বা মৎস্যেন্দ্রনাথ। এই মীননাথই নাথধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। মীননাথের শিষ্য গোরক্ষনাথ। শিবের অপর শিষ্য হাড়িপা বা জালন্ধরিপা এবং হাড়িপার শিষ্য হলেন কানুপা বা কাহ্নপাদ। এই চারজন সিদ্ধাচার্যের মাহাত্ম্যসূচক অলৌকিক কাহিনি অবলম্বনেই নাথসাহিত্যের বিকাশ ঘটেছে। বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্মমতে উল্লিখিত চুরাশি সিদ্ধার মধ্যে এই নাথসিদ্ধারাও রয়েছেন। চর্যাগীতিকার পদে ও টীকায় নাথধর্ম ও নাথগুরুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মীননাথ বা মৎস্যেন্দ্রনাথের সময় সাত শতকের মধ্যভাগে মনে করেন। অবশ্য এ সম্পর্কে মতানৈক্য থাকলেও দশ-এগার শতকের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নাথাচার্যদের অবির্ভাব ঘটেছিল বলে অনুমান করা হয়। এ সময়ই নাথধর্ম বিকাশের সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক যুগ হিসেবে চিহ্নিত। হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানে নাথপন্থীরা সমাজে হেয় প্রতিপন্ন হতে থাকে এবং তারা হিন্দুরূপে পরিচয় দিতে আগ্রহশীল হয়। ক্রমে নাথ সম্প্রদায়ের বিপর্যয়ের পরিণামে ‘‘যুগী বা নাথ উপাধিধারী তথাকথিত নিম্নশ্রেণির হিন্দুসমাজের মধ্যে এই ধর্মের অবশেষ লাভ করেছিল।’’ মীননাথ ও গোরক্ষনাথ ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হলেও কাহিনির মধ্যে অলৌকিকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
নাথধর্মের শ্রেষ্ঠ যুগেই সম্ভবত নাথসাহিত্যের বিকাশ হয়। মীননাথ, গোরক্ষনাথ, হাড়িপা, কানুপা, ময়নামতী ও গোপীচন্দ্রের ঠিক জীবদ্দশাতে না হলেও তাদের অব্যবহিত পরে এ সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছে বলে অনুমান করা যায়। তবে আঠার শতকের আগে লেখা নাথসাহিত্যের কোন পুঁথি পাওয়া যায়নি। নাথসাহিত্যের কাল সম্পর্কে ড. আহমদ শরীফ মন্তব্য বলেছেন— “আদিনাথ-মীননাথ কাহিনির শুরু আট শতকে এবং মীননাথ-গোরক্ষনাথ কিংবা হাড়িপী-কানুপার কাহিনির উদ্ভব তার পরে পরেই। এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকলেও মাণিকচাঁদ ময়নামতী গোপীচাঁদ কাহিনি দশ শতকের আগেকার নয়। অতএব, আট-দশ শতকে কায়া সাধনার রূপক কাহিনি মুখে মুখে চালু ছিল। ষোল শতকের মীননাথ-গোরক্ষনাথ কাহিনি ‘গোরক্ষবিজয়’ রূপে লিখিত রূপ পায়। গোপীচাঁদ গানও সতের আঠার শতকে লিখিত পাঁচালিতে স্থিতি পায়, কিন্তু মাণিক-ময়নামতী গাঁথা লোকসাহিত্য রূপে বিশ শতকেই সংগৃহীত ও মুদ্রিত হয়। মৌখিক সাহিত্যের ভাষা আঞ্চলিক ও আধুনিক।
নাথপন্থ বাংলাদেশের বাইরে সম্প্রসারিত হলেও এদেশের সঙ্গে নাথযোগীদের সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। বাংলা ভাষায় নাথপন্থ সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনার এটাই প্রধান কারণ। ড. শশিভূষণ দাশগুপ্ত মনে করেছেন—যে সকল তথাকথিত অন্ত্যজ শ্রেণির হিন্দু তুর্কি আক্রমণের পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে, তাদের হিন্দুজীবনের ঐতিহরূপে ঐ সকল আখ্যায়িকা পরবর্তীকালেও সমাদৃত ও সংরক্ষিত হয়েছিল। কিন্তু সেসব সাহিত্য নিদর্শন তার যথাযথ ভাষারূপ নিয়ে বর্তমান থাকেনি। তাই নাথসাহিত্যের ভাষা অর্বাচীন। চর্যাপদের সমসাময়িক কালে এগুলোর সৃষ্টি। চর্যাপদ লিখিত ছিল বলে তাতে ভাষার প্রাচীন রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়; কিন্তু নাথসাহিত্য সৃষ্টির পর মুখে মুখে প্রচলিত ছিল এবং লিখিতরূপ লাভ করেছে বহু পরে। তাই এর ভাষায় প্রাচীনত্বের নিদর্শন বর্তমান নেই। মৌখিক ভাবে প্রচলিত নাথসাহিত্যের ভাষা আঞ্চলিক ও আধুনিকতার পরিচয়বাহক। তবে সাহিত্যে বিধৃত কাহিনির মধ্যে হাজার বছর আগেকার জীবন-চেতনা, জীবনযাত্রা, সমাজ ও সংস্কৃতির বেশ কিছু নিদর্শন ও আভাস লক্ষ করা যায়।
নাথধর্মের সম্প্রসারণের কালে নাথসাহিত্যের যেসব নিদর্শন সৃষ্টি হয়েছিল তার কোন অস্তিত্বই আবিষ্কৃত হয়নি। পুরানো আমলে তা সৃষ্টি হলেও মুখে মুখে গীত হয়ে তা আধুনিক কালে চলে এসেছে। স্যার জর্জ আব্রাহাম গ্ৰীয়ার্সন (১৮৫১-১৯৪১) উত্তরবঙ্গের কৃষকদের মুখ থেকে নাথসাহিত্যের যে কাহিনি সংগ্রহ করেছেন তার ভাষা অর্বাচীন কালের। অবশ্য ড. দীনেশচন্দ্র সেন নাথসাহিত্যের অন্যতম শাখা ‘ময়নামতীর গানে’র ভাষা সম্পর্কে বলেছেন যে তা পূর্ববর্তী যুগের প্রাকৃত-প্রধান বাংলা। কিন্তু ভাষাতত্ত্বের বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করলে এগুলোকে আদৌ প্রাচীন বলে মনে হবে না। নাথসাহিত্যে বিধৃত কাহিনি বহুকাল থেকে জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত থাকলেও ভাষা আধুনিক যুগের, যেসব শব্দ প্রাচীন মনে হয় তা আঞ্চলিক শব্দ। বিষয়বস্তুর প্রাচীনতার জন্য কেউ কেউ নাথসাহিত্যকে বাংলা সাহিত্যের আদি যুগে স্থান নির্ধারণ করেছেন; কিন্তু ভাষার অর্বাচীনতার জন্য একে মধ্যযুগের অন্তর্গত বলে অনেকে বিবেচনা করেন।
নাথসম্প্রদায়ের জন্যই নাথসাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছিল। নাথধর্মের সাধনতত্ত্ব ও প্রাসঙ্গিক গল্পকাহিনি এতে বিধৃত। কিন্তু পরবর্তী কালে এর বিশেষ সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্য দূর হয়ে যায় এবং তার মানবিক ভাবের বিকাশ ঘটে। তাতে জাতিধর্মনির্বিশেষে সকলের কাছে সমাদৃত হয়। নাথসাহিত্য প্রকৃত পক্ষে গীতিকা বা ব্যালাড হিসেবে প্রচলিত। এগুলো লোকসাহিত্যধর্মী রচনা, শিল্প সাহিত্যধর্মী নয়। ড. সুকুমার সেন এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন—‘‘যোগী-সিদ্ধাদের পুরাণকথা সাম্প্রদায়িক গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকায় তাহা কখনই পূর্ণ পাঁচালি কাব্যের আকার পায় নাই। আর সে সব কাহিনিতে গৃহস্থকল্যাণের কোন ইঙ্গিতই না থাকায়, বরং বিপরীত ভাব থাকায়, ‘মঙ্গল’ নাম পাইতে পারে না। সুতরাং শেষ অবধি গাথা-ছড়ার রূপেই এগুলি আমাদের দিন পর্যন্ত চলিয়া আসিয়াছে। নাথগীতিকার উপকরণ ও ভাষার ক্ষেত্রে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ড. দীনেশচন্দ্র সেন মন্তব্য করেছেন—‘‘পরবর্তী সাহিত্যে বঙ্গভাষার উপরে সংস্কৃত শব্দের যে সৌধ নির্মিত হইয়াছিল, এই সকল গাথায় তাহার চিহ্নমাত্র নাই। চিরপরিচিত বঙ্গকুটির, মেয়েলি ছড়া, প্রাচীন প্রবাদবাক্য এই সমস্ত গাথার প্রাণ স্বরূপ এবং ইহাতে বঙ্গীয় কাব্যশ্রী সামান্য বসন পরিহিতা বঙ্গীয় পুর-স্ত্রীর মতই অনাড়ম্বর ভাবে আমাদিগকে দর্শন দিতেছে।’’
নাথসাহিত্যে আদিনাথ শিব, পার্বতী, মীননাথ, গোরক্ষনাথ, হাড়িপা, কানুপা, ময়নামতী ও গোপীচন্দ্রের কাহিনি স্থান পেয়েছে। এ সব কাহিনি দু ভাগে বিভক্ত; একটিতে আছে সিদ্ধাদের ইতিহাস এবং গোরক্ষনাথ কর্তৃক মীননাথকে নারীমোহ থেকে উদ্ধার; অপরভাগে আছে রানী ময়নামতীও তাঁর পুত্র গোপীচন্দ্র বা গোবিন্দচন্দ্রের কাহিনি। প্রথমটি গোরক্ষবিজয়, অপরটি ময়নামতী বা গোপীচন্দ্রের গান নামে পরিচিত। প্রথমটিতে ধর্মীয় মর্তবাদ প্রতিষ্ঠা প্রাধান্য পেয়েছে। অপরটিতে ধর্মীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার চেয়ে কাব্যগুণ প্রাধান্য লাভ করেছে। গোরক্ষবিজয়ের কাহিনি জীবন-বিমুখ। ধর্মপ্রতিষ্ঠার জন্য নাথপন্থীদের এ কাহিনি গঠন করতে হয়েছিল বলে এই বৈশিষ্ট্য দেখা দিয়েছে। তবে গোরক্ষবিজয়ের চেয়ে ময়নামতী বা গোপীচন্দ্রের গানে মানবিক আবেদন অপেক্ষাকৃত বেশি।
Leave a Reply