মনসামঙ্গল কাব্য রচনায় নারায়ণ দেবের কৃতিত্ব আলোচনা কর।

নারায়ণ দেব

মনসামঙ্গল কাব্যধারার অন্যতম প্রতিভাশালী কবি নারায়ণ দেব। কবি তাঁর কাব্যের ভণিতায় ‘সুকবিবল্লভ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তাঁর কাব্যের নাম ‘পদ্মপুরাণ’। তাঁর নামে অনেক পুঁথি পাওয়া গেছে। ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে লিপিকৃত একটি প্রাচীন পুথির আলোকচিত্র কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুঁথি বিভাগে রক্ষিত আছে। নারায়ণ দেৱে কাব্যের একাধিক পুঁথি পাওয়া গেলেও এমনকি পুঁথির পাঠগত বৈষম্য থাকলেও অন্যান্য কবির কাব্যের পুঁথি অপেক্ষা এই পুথি অনেকখানি প্রামাণ্য।

নারায়ণ দেব তাঁর কাব্যে যে আত্মপরিচয় দিয়েছেন, তা থেকে জানা যায় এই দেব-উপাধিক কায়স্থ কবির পূর্বপুরুষের নিবাস ছিল রাঢ়দেশ। তাঁর বৃদ্ধ পিতামহ উদ্ধারণ দেব (উদ্ধবরাম) রাঢ়দেশ ছেড়ে ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত বোরগ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর পিতার নাম নরসিংহ, মাতার নাম রুক্মিণী। কবিরা কায়স্থ, মৌদগল্য গোত্র, গুণাকর গাঞি।

নারায়ণ দেবের আবির্ভাব কাল নিয়েও মতভেদ আছে। তাঁর কাব্যের কোথাও কালনির্ণয় জ্ঞাপক শ্লোক উল্লিখিত হয়নি। তবে পুথির ভাষার সাক্ষ্যে তাঁকে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকের অথবা ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকের কবি বলা যেতে পারে।

নারায়ণ দেবের ‘পদ্মপুরাণ’ আসামে, উত্তরবঙ্গে প্রচলিত ছিল। তাঁর কাব্য তিন খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে কবির আত্মপরিচয় ও দেববন্দনা, দ্বিতীয় খণ্ডে পৌরাণিক আখ্যানের সমাহার এবং তৃতীয় খণ্ডে চাঁদ সদাগরের কাহিনি উপস্থাপিত হয়েছে। নারায়ণ দেব তাঁর কাব্যের প্রথম খণ্ডে তাঁর কাব্যপ্রেরণার মূলে দেবতার স্বপ্নাদেশের কথা উল্লেখ করেছেন—

বারয় বৎসর কালে দেখিলাম স্বপন।

মহা পরিশ্রম মনে হইল দরশন।।

শিশুকালে গোপরূপে হাতে লইয়া বাঁশী।

আলিঙ্গন দেন মোকে বড় সুখে হাসি।।

নারায়ণ দেবের কবিকৃতিত্ব

প্রথমত: বিজয়গুপ্ত যেমন লৌকিক কাহিনিকে বেশি করে গ্রহণ করেছেন, তেমনি নারায়ণ দেব পৌরাণিক কাহিনিকে বেশি মর্যাদা দিয়েছে। সংস্কৃত পুরাণে অভিজ্ঞ ছিলেন বলেই কবি মহাভারত, শৈবপুরাণ ও কালিদাসের কুমারসম্ভব থেকে কাহিনি সংগ্রহ করে তাঁর কাব্যের দেবখণ্ডটিকে পৌরাণিক কাহিনি ও রসে সমৃদ্ধ করেছেন।

দ্বিতীয়ত: বিজয়গুপ্ত যেখানে ধর্মের শিথিলতার উপর জোর দিয়েছেন সেখানে নারায়ণ দেব মানবধর্মের পূর্ণতার দিকটিকে তার কাব্যে রূপায়িত করেছেন।

তৃতীয়ত: বিজয়গুপ্ত যেখানে কাহিনির পরিণতিতে চাঁদের পুরুষকারের অপহ্নব ঘটিয়েছেন, নারায়ণ দেব সেক্ষেত্রে চাঁদের অনমনীয় ব্যক্তিত্বকে সমুন্নত রূপে চিত্রিত করেছেন। পরিণতিতে চাঁদের অন্তর্দ্বন্দ্ব আধুনিকতাকে সূচিত করেছে।

চতুর্থত: বেহুলা চরিত্র চিত্রণেও তিনি বিজয়গুপ্তের থেকে স্বতন্ত্র। কারণ নারায়ণ দেবের বেহুলা শুধু গৃহচারিণী নারী নন, তিনি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যময়ী বীরাঙ্গনা নারী।

পঞ্চমত: বিজয়গুপ্ত করুণরসের রূপাঙ্কনে কৃতিত্ব প্রদর্শন করলেও সমধিক কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন নারায়ণ দেব। সেজন্য আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন— “এই করুণরসের স্বাভাবিক বর্ণনায় নারায়ণ দেবের সমকক্ষ বড় কেহ নাই। …বেহুলার প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা কি স্নেহময়ী সুমিত্রার সন্তান-স্নেহাতুর জননী হৃদয়ে প্রতিফলিত অলীক সুখস্বপ্নের ছায়া? নারায়ণ দেব তাহার অশ্রুভারাক্রান্ত পাঠকের নিকট এই জিজ্ঞাসা রাখিয়া গিয়াছেন।”

ষষ্ঠত: সমকালীন সামাজিক ও রাষ্ট্রিক জীবনের পরিচয় বিজয়গুপ্তের কাব্যে নিষ্ঠার সঙ্গে বর্ণিত হলেও নারায়ণ দেবের কাব্যে ঐতিহাসিক উপাদান যথেষ্ট। যেমন চাঁদের বাণিজ্যযাত্রা, নানা দেশ ও নদনদীর বিবরণ, সামাজিক আচার-আচরণ ও রীতিনীতি প্রভৃতি বাংলাদেশের সামাজিক চিত্রের পরিচয়ে তার কাব্য এক সামাজিক দলিল।

সপ্তমত: বিজয়গুপ্তের কাব্যে কৌতুকরস থাকলেও নারায়ণ দেবের কাব্যে সেই কৌতুক ব্যঙ্গে পরিণত হয়েছে। যেমন, ডোমিনীবেশিনী চণ্ডীর প্রতি মহাদেবের কামাসক্তি ও সেই প্রসঙ্গে দেবীর ব্যঙ্গোক্তি—

বানরের মুখে যেন ঝুনা নারিকেল।

কাকের মুখেতে যেন দিবা পাকাবেল।।

বৃদ্ধ হইলে পাইকের ভাবকীমাত্র সার।

তোমার মুখে চাহ আমাক বশ করিবার।।

অষ্টমত: নারায়ণ দেব সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন। তাই তাঁর কাব্যে পাণ্ডিত্যের অভাব নেই, আবার তার কাব্যের ভাষাও হয়ে উঠেছে সুললিত। কবি মুকুন্দ ও ভারতচন্দ্রকে বাদ দিলে কবি নারায়ণ দেব মঙ্গলকাব্য ধারার অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ কবি। সেজন্য অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন—“চরিত্রসৃষ্টি, রসবৈচিত্র্য ও কাহিনি গ্ৰন্থনে নারায়ণ দেব বিশেষ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। এদিক থেকে তার স্থান বিজয়গুপ্ত ও বিপ্রদাসের চেয়ে অনেক উঁচুতে।”

বিষয়টি বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা যেতে পারে। নারায়ণ দেবের কবিত্ব ছিল প্রশংসনীয়। কুমারসম্ভবের প্রভাবে রচিত তার ‘রতিবিলাপ’ অংশটি বেশ সুন্দর—

পতিশোকে রতি কান্দে ললাটাইয়া ধরণী।

কেন হেন কর্ম কৈলা দেব শূলপাণি।।

দেবের দেবতা তুমি ভুবনের পতি।

স্ত্রীবধ দিব আজি গলায় দিব কাতি।।

আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন— “নারায়ণ দেবের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, তাঁহার কাব্যের পরিসমাপ্তির পরিকল্পনা চাঁদ সদাগরের চরিত্রের আনুপূর্বিক সামঞ্জস্য রক্ষায় সার্থক হইয়াছে। তিনিই চাঁদ সদাগরকে দিয়া বাম হস্তে মুখ না ফিরাইয়া একটি ফুল দিয়া ‘পূজা’ করিয়াছেন, কিন্তু অন্যান্য কোন কোন কবি, এমনকি, বিজয়গুপ্তও তাহাকে দিয়া ঘটা করিয়া মনসার পূজা করাইয়া কাব্যের উপসংহার করিয়াছেন। এই দিক দিয়া নারায়ণ দেবের রচনায় কাব্যগুণ অধিক প্রকাশ পাইয়াছে বলিতে হইবে।”

নারায়ণ দেব যে প্রতিভাশালী কবি ছিলেন তার বড় প্রমাণ পরবর্তীকালের কবিদের উপর তিনি প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেন। যেমন সপ্তদশ শতকের কবি ক্ষেমানন্দ তার কাব্যের প্রারম্ভে ব্যাস বাল্মীকির সঙ্গে নারায়ণ দেবের বন্দনা করেছেন—

ব্যাস বাল্মীকি মুনি নারায়ণ তত্ত্ব জানি।

তোমাকে সেবিয়া হৈল কবি।।

এমন কি দ্বিজ বংশীদাসও নারায়ণ দেবের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। আসামেও নারায়ণ দেবের পদ্মাপুরাণ বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল এবং অসমিয়া ভাষায় তার নিদর্শনও পাওয়া যায়।

সুতরাং পৌরাণিক কাহিনির সমাবেশে, বাস্তবধর্মী চরিত্রচিত্রণে, বিশেষ করে চাঁদ চরিত্রের মহনীয়তার রূপায়ণে, বেহুলার বীরাঙ্গনার স্বরূপের উদঘাটনে মনসামঙ্গলের একজন উৎকৃষ্ট কবি হলেন নারায়ণ দেব।

১. বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস: আশুতোষ ভট্টাচার্য

২. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত: অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

৩. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস: সুকুমার সেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!