বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে ন্যাশানাল থিয়েটারের অবদান আলোচনা কর।
ন্যাশনাল থিয়েটার
১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর ন্যাশনাল থিয়েটারের উদ্বোধন হয়। এই থিয়েটার প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোগ নেয় বাগবাজার এমেচার থিয়েটার (পরিবর্তিত নাম শ্যামবাজার নাট্যসমাজ) এর যুবকবৃন্দ। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মতিলাল সুর, রাধামাধব কর, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, গিরিশচন্দ্র ঘোষ (প্রতিষ্ঠার সময়ে ছিলেন না, পরে যোগ দেন), অমৃতলাল বসু, ক্ষেত্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ মধ্যবিত্ত শিক্ষিত যুববৃন্দ। পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ছিলেন প্রখ্যাত নাট্যকার মধ্যস্থ পত্রিকার সম্পাদক মনোমোহন বসু, অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক শিশিরকুমার ঘোষ, হিন্দুমেলার উদ্যোক্তা ও ন্যাশনাল পেপার পত্রিকার সম্পাদক ‘ন্যাশনাল’ নবগোপাল মিত্র।
এঁদের সকলের উদ্যোগে চিৎপুরের মধুসূদন সান্যালের বাড়ির সম্মুখের অংশ মাসিক চল্লিশ টাকায় ভাড়া নিয়ে সেখানে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করা হয়। ৩৬৫ নম্বর আপার চিৎপুরের সান্যালদের এই বাড়ি শ্রীকৃষ্ণ মল্লিকরা কিনেছেন। বাড়ির সামনে বড়ো ঘড়ি লাগানোর ফলে বাড়িটি ‘ঘড়িওয়ালা বাড়ি’ নামে পরিচিত হয়।
মঞ্চনির্মাণের প্রধান ছিলেন ধর্মদাস সুর। সহকারী ক্ষেত্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়। অর্ধেন্দুশেখর ছিলেন ‘জেনারেল মাষ্টার’ এবং নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সেক্রেটারী। দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক দিয়ে ন্যাশনাল থিয়েটারের উদ্বোধন হলো।
বাগবাজার এমেচার থিয়েটার ‘লীলাবতী’র অভিনয়ের সময়ে (১১ মে, ১৮৭২) নাম পালটে হয় শ্যামবাজার নাট্যসমাজ। প্রচুর খ্যাতি ও প্রশংসায় উল্লসিত যুবকবৃন্দ এবারে দীনবন্ধুর ‘নীলদর্পণ’ অভিনয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। তখনই অভাবিত দর্শক সমাগমে উৎফুল্ল নাট্যদল টিকিট বিক্রি করে পরবর্তী নাট্যাভিনয়ের প্রস্তাব নেয়। গিরিশচন্দ্র এতে তাঁর আপত্তি জানিয়ে দল ছেড়ে চলে যান। আপত্তির কারণ গিরিশের কথায়—ন্যাশনাল থিয়েটার নাম দিয়া, ন্যাশনাল থিয়েটারের উপযুক্ত সাজসরঞ্জাম ব্যতীত, সাধারণের সম্মুখে টিকিট বিক্রি করিয়া অভিনয় করা আমার অমত ছিল।
গিরিশকে বাদ দিয়েই টিকিট বিক্রি করে অভিনয়ের বন্দোবস্ত করা হলো এবং ১৮৭২-এর নভেম্বর মাস নাগাদ ‘নীলদর্পণ’ প্রস্তুতির সময়েই দলের নাম পালটে ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ রাখা ঠিক হয়। ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকার বিজ্ঞাপনে (২০-১১-১৮৭২) প্রস্তাবিত নাম দেখা যায় ‘দি ক্যালকাটা ন্যাশনাল থিয়েট্রিক্যাল সোসাইটি’। সুলভ সমাচার (১০-১২-১৮৭২) ‘নীলদর্পণ’ অভিনয়ের বিবরণ দিতে গিয়ে নাট্যদলের নাম ‘কলকাতা ন্যাসনেল থিয়েট্রিকেল সোসাইটি’ বলেই উল্লেখ করেছে। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে ন্যাশনাল থিয়েটার এই দীর্ঘ নামেরই সংক্ষিপ্ত রূপ।
তাদের অভিনয় সাফল্যে উজ্জীবিত বাগবাজারের থিয়েটার-পাগল ছেলেরা পুরোপুরি নাট্যাভিনয়ে নামতে গিয়ে টিকিট বিক্রির কথা ভাবতে বাধ্য হয়েছিল। টিকিট বিক্রি করলে দর্শক নিয়ন্ত্রিত হবে। তার ওপর টিকিট বিক্রির টাকায় পরবর্তী অভিনয়ের খরচখরচা উঠে আসবে। পত্র-পত্রিকা ও শুভানুধ্যায়ীরা তাদের এই ব্যাপারে উৎসাহিত করেছিল। অভিনয়-সমাজের উন্নতি ও পুষ্টিসাধন করবার জন্যই এই প্রথা চালু করতে হলো। মাছের তেলে মাছ ভাজার প্রসঙ্গও অমৃতবাজার পত্রিকা উল্লেখ করেছিল। সাহেবদের থিয়েটারে টিকিট বিক্রি করে অভিনয় হতো। তারই মতো এখানেও টিকিট বিক্রি শুরু হলো। ধনীদের সখের নাট্যশালায় অভিনয় দেখা ছিল আমন্ত্রণমূলক। সকলের প্রবেশাধিকার ছিল না। ন্যাশনাল থিয়েটারে টিকিট বিক্রির ফলে যে কেউ টিকিট কেটে অভিনয় দেখার সুযোগ পাবে।
নানাদিকের তাগিদে, প্রয়োজনে, উদ্যোক্তাদের আর্থিক কারণে ও ব্যয়সঙ্কুলানের জন্য টিকিট প্রথা চালু করতে হলো। টিকিটের মূল্য ছিল—
প্রথম শ্রেণী—১ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণী—আট আনা, রিজার্ভ সিট—২ টাকা। দালানের সিঁড়িতে বসলে—৪ আনা। (তখন চার পয়সায় এক আনা এবং ষোল আনায় এক টাকা ছিল।]
ন্যাশনাল থিয়েটারে অভিনয় শুরু হলো। ঠিক যে অর্থে মধুসূদন জাতীয় নাট্যশালার আশা করেছিলেন এই ন্যাশনাল থিয়েটার সেরকম হলো না। মধুসূদন সখের নাট্যশালার খামখেয়ালিপনা পুরো ভোগ করে বুঝতে পেরেছিলেন যে, জাতীয় রঙ্গমঞ্চ না হলে স্বাধীন নাট্যকার সত্তার সম্যক বিকাশ সম্ভব নয়। অর্থানুকূল্যের জন্য তিনি চাঁদা তুলে রঙ্গমঞ্চ প্রস্তুতের প্রস্তাব করেন। একক কোনো ধনী ব্যক্তির আওতা থেকে মুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা তাতে ছিল। অথচ এই ন্যাশনাল থিয়েটার হলে অন্যরকম। কতিপয় যুবকের প্রাণপণ নাট্যপ্রয়াস ও পরিশ্রমে একটি অস্থায়ী রঙ্গমঞ্চ গড়ে উঠল, ভাড়া করা জায়গায়, ভাড়া করা মালমশলায়।
তবু এইসব প্রয়াসের মাধ্যমেই নবোদ্ভূত মধ্যবিত্ত যুবক সম্প্রদায়ের আত্মবিশ্বাস বেড়ে উঠেছিল। কাগজপত্রের প্রশংসা, জ্ঞানীগুণীজনের আগমন ও সদিচ্ছা প্রকাশ তাদের আরো উৎসাহিত করে তুললো। তাছাড়া সময়ের অনুকূল আবহাওয়াও কাজ করলো। অনেকদিনের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা, এবার বাগবাজারের যুবকবৃন্দের মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হতে দেখে সবাই একবাক্যে এদের অনুপ্রাণিত করলো। প্রাসাদ-মঞ্চের ঘেরাটোপ থেকে বাংলা নাট্যাভিনয় ও নাটক মুক্তির খোলা হাওয়ায় এসে পড়লো।
ন্যাশনাল থিয়েটারের উদ্বোধন হলো ৭ই ডিসেম্বর, ১৮৭২, শনিবার, দীনবন্ধুর ‘নীলদর্পণ’ নাটক দিয়ে। বেণীমাধব মিত্র প্রেসিডেন্ট, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সেক্রেটারী। স্টেজম্যানেজার ধর্মদাস সুর এবং অভিনয়-শিক্ষক অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি। অভিনয়ে ছিলেন—
অর্ধেন্দুশেখর—উড সাহেব, সাবিত্রী, গোলোক বসু, একজন চাষা রায়ত। নগেন্দ্রনাথ—নবীনমাধব। কিরণ—বিন্দুমাধব। শিবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়—গোপীনাথ দেওয়ান। মতিলাল সুর—তোরাপ ও রাইচরণ। মহেন্দ্রলাল বসু—পদী ময়রাণী। শশীভূষণ দাস—আমিন, পণ্ডিত মশাই, কবিরাজ। পূর্ণচন্দ্র ঘোষ—লাঠিয়াল। গোপালচন্দ্র দাস—আদুরী, একজন রায়ত। অবিনাশচন্দ্র কর—রোগ সাহেব। ক্ষেত্রমোহন গাঙ্গুলি—সরলা। অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়—ক্ষেত্ৰমণি। তিনকড়ি মুখোপাধ্যায়—রেবতী। অমৃতলাল বসু—সৈরিন্ধ্রী। [এখানেও পুরুষেরাই স্ত্রী ভূমিকায় অভিনয় করেছে।]
‘নীলদর্পণ’ অভিনয়ে চারিদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। যদিও প্রয়োগ ব্যয়ের অসামর্থ্যে মঞ্চ এবং দৃশ্যসজ্জা ও আলো খুব ভালো হয়নি বলে কারো কারো মনে হয়েছে। কিন্তু উপস্থাপনার গুণে ও অভিনয়ের দক্ষতায় নাটকটি প্রচুর প্রশংসা লাভ করল। অর্ধেন্দুশেখর একাই নানাধরনের কয়েকটি চরিত্রে অভিনয়ে মাতিয়ে দিলেন। কখনো সাহেব, কখনো গোলোক বসু, কখনো স্ত্রী ভূমিকায়, কখনো চাষী—এমনি নানাবিধ চরিত্র রূপায়ণে অর্ধেন্দুশেখর অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিলেন। মতিলালের তোরাপ, অবিনাশ করের রোগ সাহেব, ক্ষেত্রমোহনের সরলা এবং অমৃত মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রমণি, তিনকড়ি মুখোপাধ্যায়ের রেবতী চরিত্রাভিনয় সকলেরই প্রশংসা অর্জন করলো।
এই নাট্যাভিনয়ের ঘটনাকে ‘The event is of national importance’ বললেও ন্যাশনাল পেপার এর অভিনয়ের অসম্পূর্ণতা ও বিধিব্যবস্থার দোষত্রুটির উল্লেখ করতে ভোলেননি। কলকাতার মানুষরা গ্রাম-বাংলার খবর রাখেন না এবং নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে দেশীয় কৃষকদের কী দুরবস্থা সে সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানও তাদের নেই। ফলে নাটকের বহু দৃশ্য তাদের কাছে হাস্যকর বলে মনে হয়েছিল। তাই সংবাদপত্রে প্রস্তাব হয়েছিল যে, এই নাটককে গ্রাম-বাংলায় নিয়ে গিয়ে অভিনয় করাতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়।
যাইহোক, নীলদর্পণের অসামান্য সাফল্যে উৎসাহিত যুবকবৃন্দ এবার পর পর সপ্তাহে প্রতি শনিবার অভিনয় চালিয়ে যেতে লাগলো। ‘লীলাবতী’ অভিনয়ের পর থেকে শনি ও বুধবার নিয়মিত অভিনয় চালু হয়। সপ্তাহে নতুন নতুন নাটক প্রযোজনার জন্য তখন থেকেই প্রম্পটার চালু করতে হয়। বাংলা নাট্যাভিনয়ের ইতিহাসে মঞ্চের পেছনের এই স্মারকের ভূমিকা ন্যাশনাল থিয়েটার থেকেই চালু হয়ে যায়।
এরা পরপর অভিনয় করলেন ১৮৭২-এ—
নীলদর্পণ—৭ ডিসেম্বর। জামাই বারিক—১৪ ডিসেম্বর। নীলদর্পণ—২১ ডিসেম্বর। সধবার একাদশী—২৮ ডিসেম্বর।
এরপর ১৮৭৩-এ করলেন—
নবীন তপস্বিনী—৪ জানুয়ারি। লীলাবতী—১১ জানুয়ারি। বিয়েপাগলা বুড়ো—১৫ জানুয়ারি। নবীন তপস্বিনী—১৮ জানুয়ারি। নবনাটক—২৫ জানুয়ারি। নীলদর্পণ—১ ফেব্রুয়ারি। নয়শো রুপেয়া (শিশির ঘোষ)—৮ ফেব্রুয়ারি। জামাই বারিক—১৫ ফেব্রুয়ারি (সঙ্গে কিরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভারতমাতা’র অংশ)। এছাড়া কুব্জার কুঘটন, নববিদ্যালয়, মুস্তাফিসাহেবের পাক্কা তামাশা, পরীস্থান প্রভৃতি ফার্স ও প্যান্টোমাইমগুলি এই নাটকের সঙ্গে সঙ্গে অভিনীত হয়েছিল।
এখানেই প্রায় সব নাটকই দীনবন্ধুর। বিশেষ করে ‘নীলদর্পণ’ হাতের কাছে থাকলেও ধনীবাড়িতে অভিনীত হয়নি, নাট্যপাগল এই মধ্যবিত্ত যুবকেরা সেই নাটক দিয়েই ন্যাশনাল থিয়েটারের উদ্বোধন করে। ফলে সাহেবদের বিরাগভাজন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কায়দা করে কোনরকমে এরা তা সামাল দেয়। কিন্তু নীলদর্পণের অভিনয় এরা বন্ধ রাখেনি।
নীলদর্পণের প্রথম অভিনয়ে টিকিট বিক্রি হয় দুশো টাকার। দ্বিতীয় অভিনয়ে চারশো পঞ্চাশ টাকা। এইভাবে টিকিট প্রথা চালু করেও দর্শকের ভিড় সামলানো গেল না। বহু দর্শক টিকিট না পেয়ে ফিরে যেতে লাগলো। ন্যাশনাল থিয়েটারের অভিনয়ের মাধ্যমে দীনবন্ধু যেমন নাট্যকার হিসেবে স্বীকৃতি ও সম্মান পেলেন, তেমনি অভিনেতা হিসেবে অর্ধেন্দুশেখর প্রধানতম হয়ে উঠলেন। গিরিশের ভাষায় ‘অতুলনীয় মধ্যে অতুলনীয়’। তাঁর অভিনীত গোলক বসু, উড সাহেব, সৈরিন্ধ্রী, জীবনচন্দ্র, জলধর ইত্যাদি ভূমিকা তাঁকে প্রথম শ্রেণীর চরিত্রাভিনেতার মর্যাদা এনে দিয়েছিল।
এরপর ১৮৭৩-এর ২২ ফেব্রুয়ারি ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক অভিনয়ের সময়ে গিরিশচন্দ্র পুনরায় দলে ফিরে এলেন এবং ভীমসিংহের ভূমিকায় নামলেন। ধনদাস—অর্ধেন্দুশেখর, কৃষ্ণকুমারী—ক্ষেত্রমোহন গাঙ্গুলি।
ন্যাশনাল থিয়েটারের প্রথম পর্বের শেষ অভিনয় ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ৮ই মার্চ। শেষ রাতে অভিনীত হয় ‘বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ’, ‘যেমন কর্ম তেমনি ফল’। সঙ্গে প্যান্টোমাইম—বিলাতিবাবু, সাবস্ক্রিপসান বুক, গ্রীন রুম অফ এ প্রাইভেট থিয়েটার, মডেল স্কুল, মুস্তাফি সাহেব কা পাক্কা তামাশা। অভিনয় শেষে অর্ধেন্দুশেখর বিদায় ভাষণ দেন এবং বিহারীলাল বসুর গান দিয়ে অনুষ্ঠান পর্ব শেষ হয়।
এরপরেই দল ভেঙে যায়। নাটক-উন্মাদ কিছু স্বার্থত্যাগী যুবক যে কষ্ট স্বীকার করে ন্যাশনাল থিয়েটার গড়ে তুলেছিলেন বহু মানুষের শুভেচ্ছা নিয়ে, তা নিজেদের মধ্যেকার বিরোধের ফলে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। দল ভেঙে যাওয়ার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ—
- টিকিট বিক্রির ফলে এদের উপার্জন ভালোই হচ্ছিল—নীলদর্পণের প্রথম ও দ্বিতীয় অভিনয়ে যথাক্রমে দুশো এবং সাড়ে চারশো টাকা, জামাই বারিকে আড়াইশো টাকা। অমৃতলাল লিখেছেন—“আমরাও অভিনয়ে প্রথম টিকিট বিক্রি আরম্ভ করি ঐ চাঁদা হিসেবে খরচ চালাবার জন্য—আপন আপন উদরপুর্তির জন্য নয়। কিন্তু যখন তারা টিকিট বিক্রি করে টাকার মুখ দেখলেন, তখন অনেকের প্রলোভন জেগে উঠল। খরচপত্রেরও প্রয়োজন ছিল। অনেকে নিজেদের ব্যক্তিগত খরচপত্র দাবী করলেন। তাও দেওয়া শুরু হলো। পয়সার জন্য দর্শক বৃদ্ধির প্রয়োজনে তাই দেখি এরা মূল নাটকগুলির সঙ্গে কিছু প্যান্টোমাইম, হাল্কা রঙ্গ-ব্যঙ্গ-প্রহসন এবং মুস্তাফি সাহেবকা পাক্কা তামাশা জুড়ে দিচ্ছিলেন। ভালো টাকা উপার্জনের ফলে টাকাকড়ি নিয়েই প্রাথমিক মতান্তর দেখা দিল। হিসেবপত্র ঠিক রাখা, কে কত টাকা পাবে, কে পাবে না—এইসব নিয়েই দলের মধ্যে মতান্তর ও আত্মকলহ তুঙ্গে উঠল।
- কর্তৃত্ব এবং দায়িত্ব নিয়েও দলে মতভেদ স্পষ্ট হয়ে উঠল। তার ওপর প্রভুত্ব নিয়েও গোলমাল দেখা দিল। সাংগঠনিক দিক দেখার দায়িত্বে মূলত ছিলেন নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিনয়গত দিক মূলত দেখতেন অর্ধেন্দুশেখর। এই নিয়ে দল চলছিল ভালোই। গিরিশচন্দ্র প্রথমে দলের বাইরে ছিলেন। অভিনয় জমে যাওয়ার ফলে প্রথম দিকে তিনি কাগজে বেনামে এদের নিন্দে করেছিলেন। পরে ‘কৃষ্ণকুমারী’ অভিনয়ের সময়ে তিনি দলে যোগ দেন এবং প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেন। তিনি আসার পরেই দলে মতভেদ আরো বেড়ে গেল। বিশেষ করে, গিরিশের সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পাদক নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার দাদা দেবেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংঘর্ষ হল বেশি। অভিনয় শিক্ষক ও প্রধান অভিনেতা অর্ধেন্দুশেখরের সঙ্গেও মতভেদ স্বাভাবিক। সাংগঠনিক দিক, অভিনয়গত দিক এবং টাকা-পয়সার হিসাবপত্রের দিক—এই তিনে মিলে দলে দুটো ভাগ স্পষ্ট হয়ে গেল। একদিকের নেতৃত্বে অর্ধেন্দুশেখর, নগেন্দ্রনাথ অন্যদিকে গিরিশচন্দ্র। গিরিশ সব দিকেই নিজের কর্তৃত্ব কায়েম করতে চেয়ে গণ্ডগোল আরো ঘনীভূত করে তুললেন।
- খ্যাতি প্রতিপত্তি প্রশংসার দিকও গৌণ ছিল না। কাগজেপত্রে এবং বিদ্বজ্জনের মধ্যে ন্যাশনাল থিয়েটারের অভিনয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। খ্যাতির ভাগবাটোয়ারা নিয়েও মনোমালিন্য মধ্যবিত্তসুলভ স্বাভাবিকতায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
- ব্যক্তিত্বের সংঘাত তো ছিলই। একই দলে অত বড় মাপের অভিনেতা বেশ কিছু থাকলে স্বভাবতই ব্যক্তিত্বের সংঘাত স্পষ্ট হয়ে দেখা দিতে বাধ্য।
- তাছাড়া পর পর অভিনয়ের জন্য এই দলের অনেক অভিনয়োপযোগী সাজসরঞ্জাম তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সেগুলি ঠিকমত রাখার জায়গা ছিল না, তার ওপর রক্ষণাবেক্ষণের অসুবিধেও দেখা দিল। অন্য কারণে মতান্তর স্পষ্ট হওয়ার ফলে এইসব সরঞ্জাম কারা দখলে রাখবে—তা নিয়েও মতভেদ বেড়ে গেল।
- তার ওপরে এই সময়েই বর্ষা এসে যাওয়াতে তখন খোলা জায়গায় অভিনয় সম্ভব হচ্ছিল না বলে এমনিতেই অভিনয় বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। এইভাবে ভেতরে কলহ এবং বাইরে প্রকৃতির বিবাদ—দুই কারণেই ন্যাশনাল থিয়েটারের অভিনয় বন্ধ হলো এবং দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। ন্যাশনাল থিয়েটারের প্রথম পর্বের এইখানেই শেষ।
৮ মার্চ, ১৮৭৩ ন্যাশনাল থিয়েটারের দলবদ্ধ শেষ অভিনয়ের পর দল ভেঙে দুটো দল হয়ে গেল—
১. একটি রইলো ন্যাশনাল থিয়েটার নামে।
২. অপরটির নাম হলো হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার।
প্রথম দল, অর্থাৎ ন্যাশনাল থিয়েটার নামের দলে রইলেন গিরিশচন্দ্র, ধর্মদাস সুর, মহেন্দ্রলাল বসু, মতিলাল সুর, তিনকড়ি মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। তারা ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ নামটি নিজেদের জন্য রেজিষ্ট্রি করে নিলেন। স্টেজের সরঞ্জাম এবং সিনসিনারি তারা পেলেন। নেতৃত্বে রইলেন গিরিশচন্দ্র।
নেটিভ হাসপাতালের সাহায্যার্থে এরা প্রথম নতুন দল নিয়ে ‘নীলদর্পণ’ করতে চাইলো, কিন্তু দলাদলিতে তাঁদের প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। অভিনয় হলো না। তারপরেই দল ভাগ পরিষ্কার হয়ে গেল। নতুন দল ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ নাম নিয়ে টাউন হলে এবং রাধাকান্ত দেবের বাড়িতে স্টেজ বেঁধে অভিনয় করতে থাকে। এদের অভিনয়ের তালিকা—
নতুন ন্যাশনাল থিয়েটার—নীলদর্পণ (টাউন হল, ২৯ মার্চ, ১৮৭৩)। সধবার একাদশী (টাউন হল, ৫ এপ্রিল, ১৮৭৩)। কৃষ্ণকুমারী (রাধাকান্ত দেবের বাড়ি, ১২ এপ্রিল, ১৮৭৩)। নীলদর্পণ (১৯ এপ্রিল, ১৮৭৩, ঐখানে)। তাছাড়া কিঞ্চিৎ জলযোগ (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর), একেই কি বলে সভ্যতা, কপালকুণ্ডলার নাট্যরূপ অভিনয় করে।
‘নীলদর্পণ’ নেটিভ হাসপাতালের সাহায্যার্থে অভিনয় করে ২১০ টাকা তুলে দেয় এবং ‘সধবার একাদশী’ অভিনয় করল ইন্ডিয়ান রিফর্মস এসোসিয়েশনের সাহায্যার্থে।
এবারে এরা দলবল নিয়ে ঢাকায় যায়। গিরিশচন্দ্র যাননি। সেখানে ন্যাশনাল থিয়েটার সুবিধে করতে পারেনি। ঋণগ্রস্ত হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। পরে ভাঙা দুই দলের অনেকে মিলে মৃত মধুসূদনের অনাথ সন্তানদের সাহায্যার্থে ‘কৃষ্ণকুমারী’ অভিনয় করে।
দ্বিতীয় দল, হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার নাম দিয়ে অভিনয় চালাতে থাকে। এই দলের নেতৃত্বে রইলেন অর্ধেন্দুশেখর। সঙ্গে রইলেন অমৃতলাল বসু, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়, কিরণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ক্ষেত্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ। এরা পেল পোষাক-পরিচ্ছদ।
এই দল প্রথম দিকে লিন্ডসে স্ট্রিটে অপেরা হাউস ভাড়া নিয়ে অভিনয় চালাতে থাকে। প্রথম দিকে কিছু প্রহসন, প্যান্টোমাইম অভিনয় করে। পরে অভিনয় করে বিধবা বিবাহ, নীলদর্পণ।
তারপর এরাও ঢাকায় যায়। সেখানে গিয়ে নীলদর্পণ, রামাভিষেক মঞ্চস্থ করে। একমাস ঢাকায় সাফল্যের সঙ্গে নীলদর্পণ, নবনাটক, সধবার একাদশী, নবীন তপস্বিনী, জামাই বারিক, কৃষ্ণকুমারী নাটকের অভিনয় করে এই দল কলকাতায় ফিরে আসে। এরপরে দুই দলের অনেকেই মিলেমিশে আবার অভিনয় চালাবার চেষ্টা করতে থাকে। তারপর আবার রাজশাহী, বোয়ালিয়া, রামপুর, বহরমপুর প্রভৃতি জায়গায় গিয়ে অভিনয় করে আসে। চুঁচুড়ায় অভিনয় করে ‘মোহান্তের এই কি কাজ!’ নাট্যকার যোগেন্দ্রনাথ ঘোষ।
এইভাবে মফঃস্বল বাংলায় অভিনয় করে এরা বাংলা থিয়েটারের প্রচারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। অর্ধেন্দুশেখরের নেতৃত্বে এইভাবে নানা অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে অভিনয়ের মাধ্যমে থিয়েটার প্রচারের সাফল্যের জন্য অর্ধেন্দুশেখরকে ‘মিশনারি অফ দি বেঙ্গলি স্টেজ’ বলা হতো।
এইখানে ন্যাশনাল থিয়েটারের দ্বিতীয় পর্বের শেষ। প্রথম পর্বে একটি দল। দ্বিতীয় পর্বে দুটি দল। তারপর দুটি দলই অভিনয় বন্ধ করে দিল।
১৮৭৩-এর ৭ ডিসেম্বর দুই দলই সাড়ম্বরে আলাদা করে বাৎসরিক উৎসব পালন করলো। ন্যাশনাল থিয়েটার নামের দল পুরনো সান্যাল বাড়িতে সভা করে এবং এইখানেই কিছু দিন অভিনয় চালাবার চেষ্টা করে। হরলাল রায়ের হেমলতা (১৩ ডিসেম্বর ১৮৭৩), নীলদর্পণ (৩ জানুয়ারি ও ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৮৭৪), বঙ্কিমের মৃণালিনীর নাট্যরূপ প্রভৃতি অভিনয় তিন মাস ধরে চালিয়ে যায়। ১৮৭৪-এর এপ্রিল মাসে এরা গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের সঙ্গে মিশে যায়।
অন্যদিকে হিন্দু ন্যাশনাল দল, গ্রেট ন্যাশনাল নাম গ্রহণ করে অভিনয়ের চেষ্টা করতে থাকে। নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ধর্মদাস সুরের উদ্যোগে এবং ধনী ভুবনমোহন নিয়োগীর অর্থে তারা বিডন স্ট্রিটে মহেন্দ্রনাথ দাসের জমি ভাড়া নিয়ে কাঠের থিয়েটার বাড়ি তৈরি করে, ১৮৭৩-এর ৩১ ডিসেম্বর গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের উদ্বোধন করলেন। অমৃতলাল বসুর লেখা ‘কাম্যকানন’ নাটক দিয়ে এর শুরু। প্রথম রাতেই রঙ্গমঞ্চটি আগুন লেগে পুড়ে যায়। নতুন করে তৈরি করে এই মঞ্চে আবার অভিনয় শুরু হয়। নানা হাত ঘুরে গ্রেট ন্যাশনাল যায় উপেন্দ্রনাথ দাস ও অমৃতলাল বসুর হাতে। তখন স্বদেশাত্মক নাট্যাভিনয়ের অপরাধে গ্রেট ন্যাশনাল রাজরোষে পড়ে। এরপরেই অভিনয়নিয়ন্ত্রণ আইন চালু হয় (ডিসেম্বর, ১৮৭৬)। গ্রেট ন্যাশনালের অভিনয় বন্ধ হয়ে যায়।
গিরিশচন্দ্র এই নির্জীব গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার নিয়ে ন্যাশনাল থিয়েটার নাম দিয়ে আবার থিয়েটার চালু করেন, জুলাই, ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর চেষ্টায় ও উদ্যোগে এই নতুন ন্যাশনাল থিয়েটার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তখন ম্যানেজার কেদার চৌধুরী। কিন্তু পারিবারিক কারণে, বিশেষত ভ্রাতার আপত্তিতে আগমনী ও অকালবোধন অভিনয়ের পর গিরিশ স্বত্ত্ব ত্যাগ করেন, শ্যালক দ্বারকানাথ দেব কর্তৃত্বভার গ্রহণ করেন। এর পরে গিরিশ আর কখনো কোনো থিয়েটারের মালিক হননি, যদিও বার এই সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
১৮৭৮-এর প্রথম থেকে মালিক হন কেদার চৌধুরী। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে গিরিশ ন্যাশনাল থিয়েটারের লীজ ছেড়ে দিলেন। দ্বারকানাথ দেব, কেদারনাথ চৌধুরী, গোপীচাঁদ শেঠ প্রমুখ ব্যক্তির মালিকানায় ন্যাশনাল থিয়েটার কিছু দিন চলে। কিন্তু কেউই ভালভাবে চালাতে পারেনি। বিনোদিনী এই সময়ের ন্যাশনাল থিয়েটারের এই দুরবস্থাকে থিয়েটারে অশুভ গ্রহ বলে উল্লেখ করেছেন।
এই সময়েই থিয়েটারে রবিবারে অভিনয় শুরু হয়। দুপুরবেলা। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে গোপীচাঁদ শেঠের ন্যাশনাল থিয়েটারে ম্যানেজার ছিলেন অবিনাশচন্দ্র কর। তাঁর সময়ে অর্থাভাবে গ্যাস কোম্পানীর বকেয়া বিলের টাকা দিতে না পারায়, গ্যাসের পাইপ লাইনের সংযোগ কেটে দেওয়া হয়। তখন গ্যাসের আলোতেই অভিনয় হতো। অবিনাশচন্দ্র গ্যাস না জ্বালিয়েই অভিনয় করবার অভিপ্রায়ে রবিবার বেলা দুটোর সময়ে অভিনয় করবার ব্যবস্থা করেন। এই নতুন ব্যবস্থায় আগ্রহী দর্শকের ভিড় বেড়ে যায়। সেই থেকে রবিবার দুপুর বেলায় ‘ম্যাটিনী শো’-এর অভিনয় চলতে থাকে। [নাচঘর, শারদীয় সংখ্যা, ১৩৩৮]
ন্যাশনাল থিয়েটার নীলামে উঠল। কিনে নিলেন ব্যবসায়ী প্রতাপচাঁদ জহুরী। পাকাপাকি ভাবে বাংলা থিয়েটার বাণিজ্যিক থিয়েটারে পরিণত হলো। গিরিশ এই ন্যাশনাল থিয়েটারেই ম্যানেজার হয়ে যোগ দিলেন—বেতন মাসিক একশো টাকা। বাংলা থিয়েটারে প্রথম ব্যক্তি গিরিশচন্দ্র, যিনি পুরোপুরি পেশাদারিভাবে রঙ্গমঞ্চে যোগ দিলেন। বাংলা থিয়েটারের সে এক অন্য ইতিহাস।
ন্যাশনাল থিয়েটার কি আরেকটি পেশাদার থিয়েটার অথবা ব্যবসায়িক থিয়েটার? নাকি শৌখিন থিয়েটার? এ প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠতে পারে।
ধনী ব্যক্তির তৈরি গৃহাঙ্গনের নাট্যশালাগুলি পুরোপুরি সখের নাট্যশালা ছিল। ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আর্থিক দায় বহনের ইচ্ছা ও ক্ষমতা এবং মর্জি, তার ওপরে বন্ধু বান্ধব আত্মীয়স্বজনের উৎসাহ—এইসব নিয়েই সখের নাট্যশালা গড়ে উঠেছিল। সেখানে সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না—তাদের দাবী-দাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
সখের নাট্যশালার গণ্ডি ভেঙে কলকাতায় ও আশেপাশে ধীরে ধীরে অন্য ধরনের নাট্যাভিনয়ের প্রচেষ্টা শুরু হয়ে যায়। সেখানে একক ধনী ব্যক্তির উদ্যম রইলো না। অনেকে মিলে সমবেত প্রয়াসে নাট্যাভিনয়ের প্রচেষ্টা দেখা যেতে শুরু করলো। অথচ এই ধরনের স্টেজ বেঁধে নাট্যাভিনয়ের খরচ-পত্র অনেক বেশি। ধনী ব্যক্তিরা তা বহন করতে পারতেন। সাধারণের পক্ষে তা সম্ভব নয়। তাই অনেকে যাত্রাকে উন্নত করে গীতাভিনয় করে সেই আস্বাদ পেতে চেষ্টা করেছিল। তাতে মঞ্চ লাগে না, আবার যাত্রার নিম্নরুচিও বাদ দেওয়া গেল। কিন্তু তাতে থিয়েটারের আমেজ ছিল না।
নানাজনের উৎসাহে বাগবাজারের এমেচার থিয়েটার যখন ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করলো, তখন পূর্ববর্তী শখ-শৌখিনতা বাদ গেল। নাট্যাভিনয়ের আন্তরিক উদ্যম লক্ষ করা গেল। নাটকের নেশা নতুন করে দেখা দিল। সকলে নাটক দেখার সুযোগ পেল।
কিন্তু বিপত্তি হলো, টিকিট বিক্রি করা নিয়ে। ধনী ব্যক্তির বাড়ির রঙ্গালয়ে টিকিট বিক্রির কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাদের নিজেদের আর্থিক দায়িত্ব বহনেই সেই অভিনয়গুলি চলতো। কিন্তু মধ্যবিত্ত যুবকসম্প্রদায়ের নাট্যাভিনয়ের ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক সঙ্গতি ছিল না। ফলে প্রথমে স্টেজ বেঁধে থিয়েটার শুরু করা এবং বারবার অভিনয়ের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন, তা এদের ছিল না। অথচ তাদের অভিনয়ে দর্শকের উপস্থিতি অত্যধিক ছিল। ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য নানাবিধ পন্থা অবলম্বন করা হয়েছিল। কিছু অংশে দর্শক নিয়ন্ত্রণ এবং বেশি অংশে খরচ বহনের জন্যই টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রথমে চাঁদা তুলেও খরচ চালাবার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা নেওয়ার মধ্যে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি ছিল না। পেশাদারিত্বের ব্যাপার তো নয়ই। কিন্তু কয়েকটি অভিনয়ের পরই দেখা গেল, ওদের নাট্যানুষ্ঠানে টিকিট বিক্রি ভালো হওয়ার জন্য আর্থিক লাভ যথেষ্ট হচ্ছে। ফলে শুধুই নতুন প্রযোজনার খরচ-খরচা নয় ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই অর্থ নিতে লাগলেন। ঠিক চুক্তিবদ্ধ অর্থ নয়, প্রয়োজনে কিছু টাকা ভাগ করে নেওয়া হতে থাকলো। অর্থকরী চুক্তি বা বিধিবদ্ধতা না থাকার জন্যই এদের টাকাপয়সার হিসেব নিয়ে গোলমাল ছিল।
যুবক দলের বেশির ভাগই বেকার ছিল। অনেকেরই আর্থিক প্রয়োজন ছিল। তবুও শুধুমাত্র অর্থের প্রাপ্তির জন্য কেউ ন্যাশনাল থিয়েটারে আসেনি। উদ্বৃত্ত অর্থ কেউ কেউ গ্রহণ করেছেন—যাদের সংসারে খুবই প্রয়োজন, যেমন অর্ধেন্দুশেখর।
ব্যবসায়িক থিয়েটারের বা পেশাদারি থিয়েটারের যেটি মূল লক্ষ্য বা ‘মোটিভ’ তা হলো, ব্যক্তিগত মালিকানায় মূলধন বিনিয়োগ এবং লগ্নীকৃত অর্থ থেকে মুনাফা লাভ—তা এই থিয়েটারের মূল উদ্দেশ্যর মধ্যে ছিল না। তাছাড়া কোনো ব্যক্তিই এই থিয়েটারকে তখনো পেশা হিসেবে গ্রহণ করেনি। ‘অবৈতনিক’ শব্দটি সর্বক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়েছে।
ন্যাশনাল থিয়েটার বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। ধনীদের সখের নাট্যশালা থেকে এরা বাংলা থিয়েটারকে মুক্তি দিয়েছে। অথচ তখন শৌখিনতার কিছু গন্ধ ওদের গায়ে লেগেছিল।
আবার পেশাদারি ব্যবসায়িক থিয়েটারের আদর্শ ও উদ্দেশ্য এদের ছিল না। কিন্তু থিয়েটারে টিকিট বিক্রির মধ্যে দিয়ে এরা প্রমাণ করেছিল, বাংলা থিয়েটারের মধ্যে একটি লাভজনক ব্যবসার সম্ভাবনা রয়েছে। লগ্নীকৃত মূলধন বেশি হয়ে ফিরে আসার সম্ভাবনা এখানে রয়েছে। যদিও এই দল নিজেরা ব্যবসায়িক মওবৃত্তিতে থিয়েটার চালায়নি। কিন্তু ব্যবসায়িক থিয়েটারের প্রাথমিক প্রস্তুতির সম্ভাবনা এরা তৈরি করে দিয়েছিল।
ন্যাশনাল থিয়েটারের দলাদলির পরে কিছু দিনের মধ্যেই ব্যক্তিগত মালিকানার থিয়েটার তৈরি হতে থাকে। শরৎচন্দ্র ঘোষের অর্থে ও অন্যদের শেয়ার নিয়ে বেঙ্গল থিয়েটার (আগস্ট, ১৮৭৩), ভুবনমোহন নিয়োগীর অর্থে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার (ডিসেম্বর, ১৮৭৩) প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। ভেঙে যাওয়া ন্যাশনাল থিয়েটারের অনেকেই এই দুটি থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লেন।
ন্যাশনাল থিয়েটারের নিজস্ব মঞ্চ ছিল না। সেই অবস্থায় পেশাদারিত্ব গ্রহণে অসুবিধেও ছিল। গ্রেট ন্যাশনাল এবং বেঙ্গল, নিজের স্থায়ীমঞ্চ ও থিয়েটার বাড়ি তৈরি করে পেশাদারি থিয়েটারের সূচনা করে দিল। তার কিছু দিনের মধ্যেই অবাঙালি ব্যবসায়ী প্রতাপচাদ জহুরী ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ চালু করে (১৮৮১) বাংলা থিয়েটারকে পাকাপোক্ত কমার্শিয়াল থিয়েটার বা বাণিজ্যিক থিয়েটারে পরিণত করলেন। ব্যবসায়িক থিয়েটারের সম্ভাবনা এইভাবেই বাংলা থিয়েটারে পূর্ণ হলো। এরপরেই গুর্মুখ রায় স্টার থিয়েটার করে (১৮৮৩) সেই ধারা অক্ষুণ্ন রাখেন। এইভাবে ন্যাশনাল থিয়েটারের প্রচেষ্টার মধ্যেই ব্যবসায়িক এবং পেশাদারিত্বের যে বীজ ছিল, তাই পল্লবিত হয়েছিল পরবর্তীকালে। অথচ সেই অর্থে ন্যাশনাল থিয়েটারকে পেশাদারি বা ব্যবসায়িক থিয়েটার বলা যাবে না।
শৌখিন থিয়েটার এবং পেশাদারি ও ব্যয়িক থিয়েটার—এই দুই প্রান্তের মাঝখানে থেকে ন্যাশনাল থিয়েটার বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে একটি সন্ধিক্ষণের গুরুদায়িত্ব পালন করেছে।
এবারে প্রশ্ন উঠবে, ন্যাশনাল থিয়েটার কতটা জাতীয় নাট্যশালার মর্যাদা পেতে পারে।
প্রথমেই মনে রাখতে হবে, পরাধীন দেশের নাগরিকদের জাতীয় নাট্যশালা হতে পারে না। সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্রেই একমাত্র জাতীয় নাট্যশালা সম্ভব। সেই হিসেবে ব্রিটিশ পরাধীন বাংলায় জাতীয় নাট্যশালা গড়ে উঠতে পারে না। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই সেই দেশের জাতীয় নাট্যশালা নির্মিত হয়।
তবু, এই নাট্যশালা নামের সঙ্গে ‘ন্যাশনাল’ শব্দটি যুক্ত হওয়ার ফলে এর মর্যাদা অনেকগুণ বেড়ে গেছে।
ধনী বাঙালির প্রাসাদ-মঞ্চ থেকে মুক্ত করে বাংলা থিয়েটারকে সর্বজনের সামনে নিয়ে আসার কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে এই ন্যাশনাল থিয়েটারের। শখের ব্যক্তিগত থিয়েটারকে সর্বজনের সাধারণ রঙ্গালয়ে পরিণত করার প্রাথমিক কাজ এই ন্যাশনাল থিয়েটারের উদ্যমের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেয়েছিল। আর সেই সময়ে মধ্যবিত্তের নবজাগ্রত চেতনার মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটে চলেছে। হিন্দুমেলার প্রতিষ্ঠা দিবস ১৩ এপ্রিল, ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে। তারপরে হিন্দুমেলার অধিবেশন হয়ে চলেছে। বাগবাজারের যুবকবৃন্দ এই জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত ছিল। তাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে মনোমোহন বসু, শিশির ঘোষ এবং নবগোপাল মিত্র যুক্ত ছিলেন। নবগোপাল মিত্রের নামই হয়ে গিয়েছিল ‘ন্যাশনাল’ নবগোপাল। ন্যাশনালের চিন্তায় তিনি মশগুল ছিলেন। শিশির ঘোষ এবং মনোমোহনও জাতীয় ভাবোদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত ছিলেন। এদের সবাইকার সমবেত চেষ্টায় নাট্যশালাকে একটা জাতীয়তার পরিমণ্ডল দিয়ে তৈরি করার ইচ্ছে নিশ্চয়ই ছিল। সেই প্রেরণা থেকেই এর নাম ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ রাখা হয়েছিল। জানা যায়, প্রথম দিকে এর সঙ্গে ‘ক্যালকাটা’ কথাটি যুক্ত ছিল, পরে তা বাদ দেওয়া হয়। ন্যাশনাল-এর সঙ্গে সেই দেশের কোনো একটি বিশেষ স্থানকে জুড়ে দিলে, তা আর যাই হোক, স্থানিকবদ্ধ হয়ে পড়ার ফলে ‘জাতীয়’ আর থাকে না। তবে এও জানা যায়, নাটক অভিনয়ের আগে সংবাদপত্রের দেওয়া বিজ্ঞাপনে কিন্তু নাম ছিল ‘দি ক্যালকাটা ন্যাশনাল থিয়েট্রিকাল সোসাইটি’। ন্যাশনাল থিয়েটার তারই সংক্ষিপ্ত রূপ। পুরো নামটির মধ্যে জাতীয়তাবোধের আবেগ ছিল, জাতীয় নাট্যশালা স্থাপনের কোনো সচেতন প্রয়াস ছিল না।
বড়লোকের গণ্ডী থেকে নাটককে মুক্ত করে সর্বসাধারণের কাছে নিয়ে আসা, মধ্যবিত্ত যুবকবৃন্দের নাটকাভিনয়ের আগ্রহ ও নেশা এবং সর্বোপরি তদানীন্তন জাতীয়তার আগুনের উত্তাপ পাোহানোর একটা অভিপ্রায়—এইসব মিলিয়েই ন্যাশনাল থিয়েটার গড়ে উঠেছিল।
যে অর্থে ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ জাতীয় থিয়েটারের মর্যাদা পেতে পারে, এই নাট্যশালার সেই মর্যাদা প্রাপ্য নয়। যদিও এরা দীনবন্ধুর ‘নীলদর্পণ’ নাটক অভিনয়ের জন্য বাছাই করে ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবোধের পরিচয় রেখেছিলেন, তবুও এদের প্রয়াস ‘সঙ্কীর্ণ ন্যাশনালিজম’-এর পর্যায়েই ছিল। জাতীয় নাট্যশালা এটি নয়। এর নামের সঙ্গে ‘ন্যাশনাল’ নামটি যুক্ত থেকেছে বলেই, একে জাতীয় নাট্যশালার মর্যাদা দেওয়া যায়।
ব্রিটিশ শাসনের যুগে সরকারী সাহায্যে জাতীয় নাট্যশালার প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ছিল না। ১৮৭২-এ প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল থিয়েটার বিলাতি থিয়েটার থেকে নিজের পার্থক্য বোঝাতেই উক্ত নাম গ্রহণ করেছিল। ন্যাশনাল, হিন্দু ন্যাশনাল, গ্রেট ন্যাশনাল, বেঙ্গল থিয়েটার প্রভৃতি নামকরণের মধ্যেই এই মনোভাব কাজ করেছিল। পেশাদার থিয়েটারের যুগে মানসিকতার সঙ্গে সঙ্গে নামও পরিবর্তিত হলো। পালটে হল স্টার, মিনার্ভা, এমারেল্ড, ক্লাসিক, কোহিনূর।
রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে ন্যাশনাল থিয়েটারের অবদান
ন্যাশনাল থিয়েটারের বৈশিষ্ট্য ও কৃতিত্ব সূত্রাকারে উল্লেখ করা যেতে পারে—
- সখের নাট্যশালায় সাধারণের প্রবেশ অবাধ ছিল না। ন্যাশনাল থিয়েটারে যে কোনো ব্যক্তি টিকিট কিনে নাটক দেখার সুযোগ পেলেন।
- টিকিটের মূল্য ইংরেজদের থিয়েটারের থেকে অনেক কম ছিল। তাই সাধারণ মানুষ টিকিট কিনে ঢুকতে পারতো।
- সাধারণ মানুষের সঙ্গে এই যোগ এবং প্রবেশাধিকার স্বীকৃত ও সহজ ছিল বলেই প্রধানত একে সাধারণ রঙ্গালয় বলা হয়ে থাকে। ন্যাশনাল থিয়েটার থেকেই এদেশে সাধারণ রঙ্গালয়ের সূত্রপাত হলো।
- সাহেবদের বিলিতি থিয়েটারের উচ্চমূল্য, বিদেশী নাটক ও পাত্রপাত্রী কোনোকিছুর সঙ্গেই বাঙালির প্রাণের যোগ ছিল না। ন্যাশনাল থিয়েটার বাঙালির সকলের নিজস্ব থিয়েটার।
- ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ধনী ব্যক্তির উঠোন ভাড়া নিয়ে। ফলে সেই ধনী ব্যক্তির মালিকানা বা কর্তৃত্ব কিংবা খেয়ালখুশি একে নিয়ন্ত্রিত করতে পারেনি।
- এটা ঠিক, ভাড়া করা স্থানে তৈরি মঞ্চ স্থায়ী ছিল না। ভাড়া করা স্থানে, ভাড়া করা সরঞ্জাম দিয়ে অস্থায়ীভাবে তৈরি নাট্যশালায় অভিনয় হতো কিন্তু নিয়মিত। সপ্তাহে প্রতি শনিবার এবং পরের দিকে বুধবার ও শনিবার নিয়মিত অভিনয়ের ব্যবস্থা হয়। সখের নাট্যশালায় এইরকম নিয়মিত অভিনয়ের ব্যবস্থা ছিল না।
- অভিনেতারা প্রয়োজনে কিছু অর্থ পেতেন। পেশাদারি চুক্তিগতভাবে না হলেও, অভিনেতাদের অর্থ গ্রহণের মধ্যে পেশাদারি থিয়েটারের বীজ তৈরি হয়েছিল।
- একটি সংঘবদ্ধ নাট্যদল এই থিয়েটার পরিচালনা করেছিল। সখের নাট্যশালায় একজন ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছা খেয়ালখুশির ওপরে সেখানে সব কিছু নির্ভর করত। এখানে একটি নাট্যগোষ্ঠি সমবেতভাবে থিয়েটার পরিচালনা করার ফলে ব্যক্তিক আওতা থেকে থিয়েটার মুক্তি পেল।
- জাতীয় ভাবোদ্দীপনায় তৈরি হলেও, এই থিয়েটারকে যথা অর্থে জাতীয় নাট্যশালা বলা যায় না। সীমাবদ্ধ অর্থে জাতীয়তার চেতনা ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ নামকরণে কার্যকরী হয়েছিল।
- “The National Theatre is first public indertaking of its Character…… The doors of the National Theatre are open to the public. Whoever shall pay for admission to it, will be permitted to go in it,’’—National Paper (11.12.1872)
- ন্যাশনাল থিয়েটারের এইসব অভিনেতা ও উদ্যোক্তারা পরবর্তী ২৫ বছর ধরে বাংলা থিয়েটারগুলির সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত থেকে নাট্যাভিনয়ের প্রধানতম দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলি পালন করেছে।
Leave a Reply