//
//

পত্রসাহিত্যের সংজ্ঞা দাও। একটি সার্থক পত্রসাহিত্য আলোচনা কর।

পত্র বা লিপিসাহিত্য

পত্র এবং পত্রসাহিত্যের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। পত্র একেবারেই বৈষয়িক এবং প্রয়োজনভিত্তিক হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে পত্রের প্রাপকও একজন এবং পাঠকও একজন। বিশেষ প্রয়োজন সম্বন্ধে অবহিত করাই বৈষয়িক পত্রের উদ্দেশ্য। কিন্তু পত্র যেখানে সাহিত্য হয়ে ওঠে সেখানে প্রয়োজন তুচ্ছ হয়ে যায়—মনের অত্যন্ত কাছাকাছি যে আছে তার কাছে এখানে। লেখক তার হৃদয় উন্মোচন করেন। ব্যক্তিগত তা এখনও থাকে, তবে প্রয়োজনভিত্তিক থাকে। না হয় লঘু আলাপচারিতা, অথবা গভীর অনুভূতির প্রকাশে তা সাহিত্যের স্তরে উন্নীত হয়। সেক্ষেত্রে পত্রটি যার কাছে প্রেরিত হয়েছে শুধু তার কাছেই নয়, সাহিত্যমনস্ক অন্য যে কোনো মানুষের কাছেই পত্রটি উপভোগ্য। এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন–যারা ভাল চিঠি লেখে তারা মনের জানালার ধারে বসে আলাপ করে যায় তার কোন ভাব নেই, বেগও নেই, স্রোত আছে। ভাবহীন সহজের রসই হচ্ছে চিঠির রস।

একজন প্রখ্যাত ইংরেজ সমালোচক পত্রের গৌরব আরো বৃদ্ধি করতে চেয়ে বলেছেন— ‘‘Great letter-writers are suppressed novelist, frustrated essayists born before their time.’’

এই ধরনের সার্থক পত্রসাহিত্যের আলোচনা করবার আগে এ বিষয়ে আরো দুটি প্রসঙ্গ আমাদের উল্লেখ করতে হবে। প্রথমত, কালের বিচারে যেদিন থেকে লিপির আবির্ভাব সেদিন থেকে পত্রেরও উদ্ভাবন। একদিকে গ্রীকপুরাণে আমরা যেমন পাই পত্রের ব্যবহারের কথা, অন্যদিকে রামায়ণ-মহাভারতেও পত্র রচনার কথা আছে। মহাভারতের নল-দময়ন্তী উপাখ্যানে দময়ন্তী হংসের পায়ে বেঁধে পত্র প্রেরণ করেছিল রাজা নলকে।

ছিন্নপত্রের অন্তর্গত ১৪১ সংখ্যক পত্রে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—‘পৃথিবীতে অনেক মহামূল্য উপহার আছে তার মধ্যে সামান্য চিঠিখানি কম জিনিস নয়।’ ১৯৮ সংখ্যক পত্রে তিনি আরও বলেছেন—‘কথা যে-জিনিসটা এড়িয়ে যায় এবং প্রবন্ধে যে-জিনিসটা কৃত্রিম হয়ে ওঠে, চিঠিতে সেইটে অতি সহজে আপনাকে ধরা দেয়।’ অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের কাছে ততক্ষণ চিঠি বা পত্র মানেই সাহিত্য যতক্ষণ না তা সাহিত্যের কিছু মৌলিক গুণ তাতে প্রকাশিত হচ্ছে। চিঠিতে সাধারণত থাকে দুজন ব্যক্তি-লেখক এবং প্রাপক। এই দুজনের সম্পর্কের আন্তরিকতা প্রত্যাশিত কারণ লেখক এবং প্রাপকের যুগল উপস্থিতিতেই চিঠির প্রধান রস সৃষ্টি হতে পারে।  চিঠি বা পত্রে লেখককে যেমন ধরা যায় তেমনি চিঠির মধ্যে দিয়ে তাঁর জীবন সম্পর্কে নানা ভাবনা-চিন্তা, শিল্পকলা, দার্শনিকতা, মনোগত আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন ও ইচ্ছা প্রভৃতি নানা তুচ্ছ কথারও প্রকাশ ঘটে। অন্যক্ষেত্রে প্রকাশে যা বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে চিঠিতে তা অবাধে, অকপটে প্রকাশিত হতে পারে। রথীন্দ্রনাথ রায় তাঁর ‘রবীন্দ্রমনন’ গ্রন্থের ‘পত্রসাহিত্য’ প্রবন্ধে এই শ্রেণির সাহিত্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন-‘‘পত্রলেখকের রচনারীতি, সূক্ষ্মরসবোধ ও অন্তরঙ্গ উপস্থিতি অতি তুচ্ছ ও সাধারণ বিষয়কেও অসামান্য করে তোলে। শ্রেষ্ঠ পত্রসাহিত্যের মধ্যে যত্নকৃত শিল্পপ্রয়াস, কষ্টকল্পিত হাস্যরস, অযথা তথ্যভারাক্রান্ত দুর্বহ চিন্তা প্রভৃতি বর্জিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়।’’ সবমিলিয়ে বলা যায় যে সাহিত্য ধারায় পত্র এবং সাহিত্য দুইয়েরই গঙ্গা-যমুনা সঙ্গম পরিলক্ষিত হয় তাকে পত্রসাহিত্য বলে। অর্থাৎ পত্র যেখানে সাহিত্যমূল্য এবং সাহিত্য রসের বাহক হয় সেখানেই যথার্থ পত্র সাহিত্যের রসময় রচনা।

পত্রসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য

  • পত্রসাহিত্য সাধারণভাবে ব্যক্তিগত ভাবনার বাহক। কিন্তু সেই ভাবনার সর্বজনীনত্ব প্রাপ্তি ঘটে। অর্থাৎ পত্রের ভাব ব্যক্তিকতার আধারে সীমাবদ্ধ না থেকে বিশ্বজনীনত্বে উত্তীর্ণ হয়।
  • পত্রসাহিত্যে পত্র লেখকের অন্তর মানস ও রসলোকের উন্মোচন ঘটে। এক্ষেত্রে পত্রের রস ব্যক্তিক সীমাকে ছাড়িয়ে রসের জগতে বিচরণ করে।
  • সাহিত্য যেমন সময় সমাজ চরিত্রের অন্তলোর্ক-বহিলোর্কের দর্পণ, পত্র যদি সেই স্তরে উত্তীর্ণ হয় তবে তাকে পত্রসাহিত্যের মর্যাদা দেওয়া হয়।

একটি সার্থক পত্রসাহিত্য

রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’ পত্রসাহিত্যের দাবিদার হওয়ার যোগ্যতা রাখে। কারণ—

প্রথমত, পত্রগুলি রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতা হলে, নির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে রচিত হলেও শেষ পর্যন্ত তা কবির ব্যক্তিক ভাবনার স্তর ছাড়িয়ে বিশ্বগত হতে পেরেছে। ফলে একান্ত ব্যক্তি জীবনের পত্র হয়ে উঠেছে কোনো সাহিত্যিকের সাহিত্যকীর্তি। রবীন্দ্রনাথের একাধিক পত্রে ব্যক্তিক অভিজ্ঞতার বিশ্বগত সাহিত্যিক অভিব্যক্তিতে পরিণত হওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন ১০৮ সংখ্যক পত্রে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন— ‘‘অন্ধকারের আবরণের মধ্য দিয়ে এই লোকালয়ের একটি যেন সজীব হৃদস্পন্দন আমার বক্ষের উপর এসে আঘাত করতে লাগল।…বৃহৎ জনতার সমস্ত ভালোমন্দ সমস্ত সুখ দুঃখ এক হয়ে তরুলতা বেষ্টিত ক্ষুদ্র বর্ষানদীর দুই তীর থেকে একটি সুকরুণ সুন্দর সুগম্ভীর রাগিনীর মতো আমার হৃদয়ে এসে আঘাত করতে লাগল। আমার ‘শৈশব সন্ধ্যা’ কবিতায় বোধ হয় কতটুকু এইভাব প্রকাশ করতে চেয়েছিলুম।’’ এই বর্ণনা এবং কবিতার মধ্যে কোনো ফারাক খুজে পাওয়া কঠিন। এই বিবরণই আরও পূর্ণতর রূপ পেয়ে ‘সোনার তরী’ কাব্যের ‘শৈশব সন্ধ্যা’ কবিতায় রূপলাভ করেছে।

ব্যক্তিক পত্রের সাহিত্য হয়ে ওঠার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন দেখতে পাই ছিন্নপত্রের ১০ সংখ্যক পত্রে। এখানে ধূ ধূ বালুচরের যে বর্ণনা আছে তা অনায়াসেই উৎকৃষ্ট সাহিত্যের মর্যাদা পেয়ে যায়। যেমন— ‘‘প্রকাণ্ড চর ধু ধূ করছে কোথাও শেষ দেখা যায় না। কেবল মাঝে মাঝে এক এক জায়গায় নদীর রেখা দেখা যায়। আবার অনেক সময় নদীকে বালি বলে ভ্রমও হয়— প্রাণ নেই, লোক নেই, তরু নেই, তৃণ নেই, বৈচিত্র্যের মধ্যে জায়গায় জায়গায় ফাটল ধরা ভিজে কালো মাটি, জায়গায় জায়গায় শুকনো সাদাবালি।’’ ব্যক্তিক এই অভিজ্ঞতা যে সাহিত্যিক মর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়েছে তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায় ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে। সেখানে দামিনীর জীবনের এক সন্ধিক্ষণে বালুচরের যে বর্ণনা আছে তার সঙ্গে এই পত্রের সাযুজ্য অনেকখানি।

দ্বিতীয়ত, ছিন্নপত্র যে একাধারে পত্র এবং সাহিত্যের মর্যাদায় আসীন তার উৎস মূলে রয়েছে পত্র লেখক হিসাবে রবীন্দ্রনাথের অন্তর মানস এবং সেই মানসের রসলোকের অসীমতায় উত্তরিত হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়াটি। পত্র লেখকরা যেভাবে আত্মুন্মোচন করে সে তুলনায় রবীন্দ্রনাথ একটু প্রচ্ছন্ন হলেও তাঁর আত্মপ্রকাশ যে একেবারেই ঘটেনি তা নয়। কি ছিন্নপত্র, কি ছিন্নপত্রাবলী উভয় সংকলনেই রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিমুগ্ধ রোমান্টিক কবিমানস উদঘাটিত।  যেমন ৬৪ সংখ্যক পত্রে পদ্মাতীরের যে সৌন্দর্য বর্ণনা রবীন্দ্রনাথ করেছেন তা আসলে সাহিত্যের রোমান্টিকতা তথা রোমান্টিক সৌন্দর্য চেতনার মূর্তরূপ-‘‘আমার এই যে মনের ভাব এযেন প্রতিনিয়ত অঙ্কুরিত মুকুলিত পুলকিত সূর্যসনাথা আদিম পৃথিবীর ভাব। যেন আমার এই চেতনার প্রবাহ পৃথিবীর প্রত্যেক ঘাসে এবং গাছের শিকড়ে শিকড়ে শিরায় শিরায় ধীরে ধীরে প্রবাহিত হচ্ছে—সমস্ত শস্যক্ষেত্র রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে এবং নারকেল গাছের প্রত্যেক পাতা জীবনের আবেগে থরথর করে কাঁপছে।’’

কাছের মানুষের কাছে চিঠি লিখলেও শুধু যে ব্যক্তিগত কথা বলার স্পৃহা থাকে, তা নয় কবি রবীন্দ্রনাথ জমিদার রবীন্দ্রনাথকে আত্মগত করেই মানবপ্রীতির কথা ভেবেছেন, এক্ষেত্রে পত্রসাহিত্যের বৈচিত্র্যও ফুটে উঠেছে। যেমন ৮১ সংখ্যক পত্রে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-‘‘আমার এই দরিদ্রচাষী প্রজাগুলোকে দেখলে আমার ভারি মায়া করে, এরা যেন বিধাতার শিশু সন্তানের মতো নিরুপার। তিনি এদের মুখে নিজের হাতে কিছু না তুলে দিলে এদের আর গতি নেই। পৃথিবীর স্তন যখন শুকিয়ে যায় তখন এরা কেবল কাঁদতে জানে—কোনো মতে একটুখানি ক্ষুধা ভাঙলেই আবার তখনই সমস্ত ভুলে যায়।’’

তৃ্তীয়ত, সাহিত্য যেমন সময়-সমাজ ও চরিত্রের দর্শনকে বুকে ধারণ করে, ছিন্নপত্রের পত্রাবলিও তেমনি ব্যক্তিকতার পত্রে পরিবেশিত হওয়ার পর পরবর্তীকালে সময়, সমাজ ও চরিত্রের রূপচিত্র উন্মোচনে মুখর হয়েছে। পদ্মায় ভ্রমণ করার সময় নিতান্ত সহজ-সরল যাদের জীবনের চোখ ধাঁধানো ছড়াছড়ি নেই সেইসব আটপৌরে জীবন একদা রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিল। তাদের জীবনের প্রতি গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রবীন্দ্রনাথ নিজের দার্শনিক এবং প্রীতিধর্মের ভিত্তিটাকে দৃঢ় করে তুলেছিল। মানবজীবন ঘনিষ্ঠতার এমন দৃশ্য ধরা পড়েছে ৩০ সংখ্যক পত্রে— ‘‘আমাদের ঘাটে একটি নৌকা লেগে আছে, এবং এখানকার অনেকগুলি জনপদ বধূ তাঁর সম্মুখে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। বোধ হয় একজন কে কোথায় যাচ্ছে এবং তাকে বিদায় দিতে সবাই এসেছে।..ওদের মধ্যে একটি মেয়ে আছে। তার প্রতিই আমার মনোযোগটা সর্বাপেক্ষা আকৃষ্ট হচ্ছে। বোধ হয় বয়সে তেরো বারো হবে, কিন্তু একটু হৃষ্টপুষ্ট হওয়াতে চোদ্দো পনেরো দেখাচ্ছে। মুখখানি বড়ো, বেশ কালো অথচ বেশ দেখতে।’’ নিতান্ত সাধারণ মানবজীবন এবং তাদের বিচ্ছেদ-বেদনাকে কেন্দ্র করে লেখক চিরকালের বিচ্ছেদের কথা উপলব্ধি করে গভীর দার্শনিকতায় পৌঁছেছেন।

সবমিলিয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি পত্রসাহিত্যের বিষয়বৈচিত্র্য, পত্র লেখকের মনোজীবন, নানাজনের সঙ্গে সম্পর্ক, এই মেঘ রৌদ্র, আকাশ, নদী, জনপদ, কোলাহল, নিস্তব্ধতা সব কিছুই রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রে বিদ্যমান। তাই পত্রসাহিত্য হিসাবে ছিন্নপত্রের সার্থকতার বিষয়ে কোনো সংশয় থাকে না

তথ্যসূত্র:

কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্তDownload
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাসDownload
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরীDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাসDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যালDownload
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাসDownload
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
সাহিত্যের রূপরীতি ও অন্যান্য – কুন্তল চট্টোপাধ্যায়Download
সাহিত্য ও সমালোচনার রূপরীতি – উজ্জ্বলকুমার মজুমদারDownload
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তDownload
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দীDownload
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যালDownload
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেনDownload
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায়Download
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষDownload

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!