পল্লীকবি জসীমউদ্দিনের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
জসীমউদ্দিন
কবি জসীমউদ্দিন (১৯০৩-১৯৭৬) আমাদের গ্রাম বাংলার কবি। গ্রাম বাংলার মানুষ, প্রকৃতি, লোকজীবন, লোকবিশ্বাস-সংস্কার প্রভৃতি নিয়ে তিনি কবিতা রচনা করেছেন। বৈষ্ণব পদকর্তা চণ্ডীদাসের মতো তিনি সহজ ভাবে সহজ সুরে কবিতা রচনা করেছিলেন, সেজন্য তাঁর কবিতা পাঠকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। বিশেষকরে তাঁর ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ কবিতাটি খুবই জনপ্রিয় একটি প্রেমের কবিতা।
জসীমউদ্দিনের কাব্যগ্রন্থগুলি হলো— ‘রাখালী’ (১৯২৭), ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ (১৯২৯), ‘ধানক্ষেত’ (১৯৩১), ‘বালুচর’ (১৯৩৪), ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ (১৯৩৪), ‘রূপবতী’ (১৯৪৬), ‘এক পয়সার বাঁশী’ (৯৯৪৮), ‘মাটির কান্না’ (১৯৫১), ‘সাকিনা’ (১৯৫৯), ‘সুচয়নী’ (১৯৬১), ‘মা যে জননী কান্দে’ (১৯৬৩), ‘হলুদ বরণী’ (১৯৬৬), ‘জলের লেখন’ (১৯৬৯), ‘ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে’ (১৯৭১), ‘মা গো জালিয়ে রাখিস আলো’ (১৯৭৬) প্রভৃতি।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ‘কল্লোলযুগ’ গ্রন্থে জসীমউদ্দিনের কবিসত্তা সম্পর্কে বলেছেন একেবারে সাদামাটা আত্মভোলা ছেলে এই জসীমউদ্দীন! চুলে চিরুনি নেই, জামায় বোতাম নেই, বেশবাসে বিন্যাস নেই। হয়তো বা অভাবের চেয়েও ঔদাসীন্যই বেশি। সরল শ্যামলের প্রতিমূর্তি। যে গ্রাম তারই পরিবেশ তার ব্যক্তিত্বে, তার উপস্থিতিতে। কোনো কারুকলায় কৃতিমতা নেই, নেই কোনো প্রসাধনের পারিপাট্য। একেবারে সোজাসুজি মর্মস্পর্শ করবার আকুলতা। কোনো ইজমে’র ছাঁচে ঢালাই করা নয় বলে তার কবিতা হয়তো জনতোষিণী নয়, কিন্তু মনোতোষিণী।” এই উক্তি যথার্থ এই কারণে যে, কবি জসীমউদ্দীন পলী প্রকৃতির স্নিগ্ধ কমনীয় মাধুর্য এবং ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোকজীবনের উপাদান দিয়ে তাঁর কাব্যজগৎ গড়ে তুলেছিলেন। জসীমউদ্দিন জীবনে যেমন ছিলেন আত্মভোলা, অগোছালো, তেমনি তাঁর শিল্পকলাও অযত্নসম্ভূত এবং সহজ সরল। অনায়াস সারল্য ও সহমর্মিতা তাঁর কবিদৃষ্টির দুই প্রধান সম্পদ। তিনি সম্পূর্ণভাবে মাটির কাছাকাছি কবি। তাই তাঁর কাব্যে লেগে আছে মাটির গন্ধ।
কবি জসীমউদ্দিনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাখালী’। এই কাব্যের অন্যতম কবিতা হল ‘পল্লীজননী’, ‘কবর’ প্রভৃতি। আলোচ্য কবিতাটি ‘কল্লোল’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতায় এক বৃদ্ধ, তার স্ত্রীর কথা স্মরণ করেছেন এভাবে—
এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
‘রাখালী’ কাব্যগ্রন্থে কবি মেঠো সুরে গ্রামীণ জীবনের রাখালিয়া বাঁশির সুর শুনিয়েছেন আমাদের। যেমন মাটি ও মানুষের সম্পর্ককে তাঁর কথাসাহিত্যে প্রকাশ করেছেন তেমনি জসীমউদ্দিন তাঁর ‘রাখালি’ কাব্যগ্রন্থে মাটি ও মানুষ এবং গ্রামীণ জীবনের চালচিত্র অংকন করেছেন।
তাঁর ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ একটি প্রেমমূলক কাহিনিকাব্য। রূপাই ও সাজুর বিরহ-মিলনের কাহিনি এই কাব্যের বিষয়বস্তু। কাব্যটি মাঠ ও মেঠো মানুষের কাব্য। এই মাঠের বিবরণ দিতে গিয়ে কবি বলেছেন—
সোনার সীতারে হরেছে রাবণ, পল্লীর পথ ’পরে।
মুঠি মুঠি ধানে গহনা তাহার পড়িয়াছে বুঝি ঝরে।
এই কাব্যটি একটি শোকগাথা। কেননা রূপাই-সাজুর করুণ বিয়োগাত্মক প্রেমকাহিনি এই কাব্যে অপরূপ রূপ লাভ করেছে।
তাঁর কাব্য ‘বালুচর’ রবীন্দ্রনাথের দ্বারাও প্রশংসিত হয়েছিল। কাব্যটিতে রয়েছে গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত প্রকৃতি ও পল্লী বাংলার ছবি। যেমন—
কাল সে আসিবে, মুখখানি তার নতুন চরের মত
চখা আর চখি নরম ডানায় মুছায়ে দিয়েছে কত।
তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ ‘ধানক্ষেত’। এই কাব্যে রয়েছে ছাব্বিশটি কবিতা। এই কবিতাগুলির মধ্যে গ্রাম বাংলার সুখ-দুঃখ ও প্রাকৃতিক রূপ চিত্রিত হয়েছে। যেমন—
শিশির তাহারে মতির মালায় সাজায়ে সারাটি রাতি,
জোনাকীরা তার পাতায় পাতায় দোলায় তারার বাতি।
জসীমউদ্দিনের আর একটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ হল ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’। কবি নিজেই এই কাব্যটির পরিচয় প্রসঙ্গে. জানিয়েছেন—“দুটো নর-নারীর দাগহীন প্রেম ভালোবাসা কীভাবে দুটি ভিন্ন সমাজের নানা প্রতিকূল অবস্থায় বিষের পাহাড় গড়ে তুলতে পারে—এরই বেদনাবিধুর চিত্র এঁকেছি ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে”। সোজন ও দুলীর প্রেমকাহিনি এই কাব্যের মূল কাহিনি। প্রেম সম্পর্কের সহজ স্বাভাবিক রূপের প্রকাশে এই কাব্য পাঠকের কাছে আকর্ষণীয়। বর্ণনার মধ্যে রয়েছে স্বতঃস্ফূর্ততা—
সোজনের সাথে তার ভারি ভাব, দুলীর ইচ্ছে করে,
সোজনেরে সে যে লুকাইয়া রাখে সিঁদুর কৌটা ভরে।
আঁচল খানিরে টানিয়া টানিয়া বড় যদি করা যেত,
সোজনেরে সে যে লুকায়ে রাখিত কেহ নাহি খুঁজে পেত।
শিশুদের জন্য এবং শিশু মনস্তত্ত্বকে রূপ দেবার জন্য কবি কয়েকটি কাব্য রচনা করেছিলনে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘হাসু’, ‘এক পয়সার বাঁশী’। শাস্তিনিকেতনের আশ্রমকন্যা হাসুকে কেন্দ্র করে ‘হাসু’ কাব্যটি রচিত। এই কাব্যে শিশুমনের আনন্দ-উল্লাস, অভিযোগ-অভিমান, কৌতুকময়তা প্রভৃতি স্বভাববৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়েছে। যেমন—
তাহলে কি লক্ষ্মীরা সব, মাঝে মাঝে খবর নিও
কেমন থাকে বিড়াল ছানা লিখে আমায় পত্র দিও।
কুকুর ছানা ঘুমায় রাতে? দুষ্টু ইঁদুর পালায় কোথা
ক’বার কাঁদেন ব্যাঙের পিসী? লিখো আমায় সকল কথা।
শিশুমনের কথা ভেবে শিশুদের আনন্দ দেবার জন্য ‘এক পয়সার বাঁশি’ কাব্যটি রচিত হলেও সমকালীন সমাজের অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে কবি সোচ্চার ছিলেন। তাই লিখেছেন—
লক্ষ যুগের অত্যাচারের
শোধ লইতে সকল মারের
তোমার মুখে বাজবে বাঁশী
অগ্নি শিখায় জ্বলে।
তাঁর অন্যান্য কাব্যগুলি ততটা উল্লেখযোগ্য নয়। তবে ‘হলুদবরণী’-র রোমান্টিক সৌন্দর্য ‘জলের লেখন’ কাব্যের প্রেম ও সৌন্দর্যলোক, ‘মা গো জ্বালিয়ে রাখিস আলো’ কাব্য গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির পরিচয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আসলে জসীমউদ্দিন আধুনিক কাব্যের ধারায় উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে তিনি কল্লোল গোষ্ঠী ও রবীন্দ্রনাথ এই উভয় প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে সহজ সরল মেঠো সুরে পল্লী বাংলার প্রকৃতি ও সমাজজীবনকে উপলব্ধি করেছেন। আর সেই উপলব্ধির প্রকাশও ঘটেছে আঞ্চলিক কথ্য ভাষায়। এ জন্য তাঁর কবিতা আমাদের আকর্ষণ করে।
Leave a Reply